নেপাল-এর জলে-জঙ্গলে
আজ(12.11.11)আনন্দবাজার পত্রিকার ‘ওয়ান স্টপ ট্র্যাভেল’-এ প্রকাশিত আমার লেখা
চানঘরে গান@চিতওয়ানআজ(12.11.11)আনন্দবাজার পত্রিকার ‘ওয়ান স্টপ ট্র্যাভেল’-এ প্রকাশিত আমার লেখা
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
কোন
সাড়া-শব্দ নেই, ঘঁতর-ঘঁতর করে আগুয়ান হাতী গায়ে প্রায় পড়ে আর কি! সামনে হাঁটছি,
তিনি আসছেন পিছন থেকে। ভাগ্যিস্, ‘ভাগো’ বলে চেঁচালো কেউ। লাফিয়ে বাঁয়ে সরতেই ডানদিক
দিয়ে শুঁড় দুলিয়ে পেরিয়ে গেল জোরকদমে। কি হতো যদি ডাঁয়ে সরতাম? ভেবেই বুক থমকে
যেই দাঁড়িয়েছি শুনি মহিলা চেঁচাচ্ছেন-
- ধারাধৌতি হোগা বহেনজী, জলদী যাও, জলদী।
-
মতলব?
-
আগে নদী হ্যায়- নারায়নী। ওহি পড়...
- লেকিন কিসকা... ক্যায়সে?
আর উত্তর... রাস্তার ধারে কাঠপাতার বোঝা নামিয়ে যে জিরেনটা
নিচ্ছিলেন, তা ফের মাথায় তুলে ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছেন তিনি, ছুঁড়ে দেওয়া অনন্য
একপীস হাসি উপহার দিয়ে।
এবার হাঁকপাঁক এগোই। অদুরে নজরে পড়ে নদী, তটরেখা আর তট
ঘিরে সাদা চামড়ার বিদেশী মুখের মিছিল। বুঝে পাই না কি হল। রথ না দোল না
ট্যানিং-এর টানে সানবাথিং-এর ভিড়! পা চালিয়ে এগোতেই জলে ধুপ্পুস্ আওয়াজ ও বেপরোয়া সেই হাতীই দেখি নদীতে
উল্টেপাল্টে লুটোপুটি। ভাবলাম ভিনদেশীরা এ’জন্যই জুটেছেন-
এটাই বুঝি ধারাধৌতি। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, পিচিক-পিচিক ছবি তুলছি, মাহুত হাতীকে শুনি
বলছেন- বৈঠ, বৈঠ, বৈঠ... ওমা! শুয়ে গড়াগড়ি দেওয়া হাতি
দিব্যি হিন্দী বুঝে মাথা ঝাঁকিয়ে বসল আর তুরতুর করে দুই বিদেশী উঠে এলো ওর পিঠে। শক্ত করে জড়িয়ে ধরল গলায় বাঁধা দড়ি আর সওয়ারীসুদ্ধু মাহুত এগোল ভিতরজলের
দিকে।
কি ট্রেনিং!!! তার চেয়েও বড় দেখলাম- জীবনের আনাচ-কানাচে পড়ে থাকা রোদ্দুর, ঘুমিয়ে
থাকা ইচ্ছেগুলোকে কত ঊজ্জ্বল করে অনুভবে বসত দিতে মুখিয়ে আছে বিদেশীরা। আমাদেরই
দেশের হাতিতে চেপে স্নান, অথচ কোন দেশোয়ালী মানুষই নেই। দেখতে-দেখতে কি উত্তেজনা
ভিতরে... মনে হচ্ছিল যাই... নেমে পড়ি- এ’ অনুভবের নুন-মরিচে
নাহয় একদিনের জন্য প্রাণিত হোক্ আমার মধ্যমাপের ঘস্টানো দিন। কিন্তু... এই ‘কিন্তু’টাই যত গোলোযোগের।
গিয়েছিলাম নেপালের জঙ্গল- চিতওয়ান। সকালে ক্যানোইতে করে নদী
পথের সাফারী সেরে পায়ে-পায়ে আশেপাশে ঘুরছি, এ’ ঘটনা তখনকারই।
মাহুতের
একটা কায়দা আছে দেখলাম। মুখে বলার সঙ্গে, হাতীর পিঠের ওপর পায়ের প্রেসারে ঠিক
কাজটার অক্ষর লিখে দিচ্ছে, যা শুধু ওরা দুজনেই জানে... দাতা ও গ্রহীতা। সওয়ারী
পিঠে তুলে মুখে বলছে- ‘পিছু, পিছু,
পিছু...’ হাতী সামনের পায়ে ঠেলে উঠে পিছনের পা ফোল্ড করে
বসছে। মাহুত বলছে- ‘উঠ্, উঠ্, উঠ্...’
দেখি পা সোজা করে ধুমাবতী উঠে দাঁড়াচ্ছে। মাহুত বলছে- ‘উপর,
উপর, উপর...’ হাতী ফুরররর করে সিধে নিজের নাক বরাবর ছিটিয়ে
দিচ্ছে জল- উপরদিকে। একবার তো জলের ধাক্কায় মাহুতের হাতের অঙ্কুশই গেল হারিয়ে।
জলের তলায় শুঁড় বুলিয়ে-বুলিয়ে বোকা হাতী খুঁজেও দিল তা। তারপর কতবার যে মাথায়
পড়ল সেটা...
শুঁড়-ফোয়ারার
যা ইন্টেন্সিটি, তা’তে
স্নানকামীদের নাকানীচোবানী দশা। ফোর্সে টালমাটাল পরীরা ধরাশায়ী হয় আর কি। ধারাপাত
সাইডে চাইলে মাহুত হাঁকছে- ‘পিছাড়ি, পিছাড়ি, পিছাড়ি...’ ফুরররর এবার শুঁড় দুলিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে। এমনি পিছাড়ি, উপর, বাঁয়ারীর কম্বিনেশনে
সওয়ারী যখন নাকাল, তখন হাতীকে বসিয়ে মাহুত শুধু একবার হাঁকে- ‘তীরে লাগে...’
ব্যস,
এই কথাটার বড্ড কাঙাল হাতী। কানে যেতেই ঢুপ্পুস্ করে ভরাভর্তি পোয়াতীর মত ডানকাতে
শুয়ে পড়ছে আর সওয়ারী জলের মধ্যে পড়ে বিস্তর হাবুডুবু। এখানে একটা অপশন আছে। এই
সময় যে পিঠ থেকে পড়বে না, সে বিনা খরচে মৌজ নেবে আবার। যদিও দেড়ঘন্টার
হস্তিকান্ডে মোটে দু’জন ব্যালান্স
রেখেছিল। কিন্তু মুস্কিল ঐ... একবারের জল এপিসোডেই এমন উস্তমখুস্তম, যে পরেরবারে
কেউ জলকাব্যে যাচ্ছেন না। অন্যদের নাস্তানাবুদ দেখাকেই উপাদেয় বোধে পাড়ে বসে হেসে-হেসে
গড়িয়ে পড়ছেন- আমারই মতন।
নাচন-কোঁদন শেষ। মাহুতের এক চেলার হাত উপচে গেল টাকায়। হাতী
ফের ঘঁতর-ঘঁতর চালে দিশপাশ নস্যাত করা পুছ-দুলিয়ে শুঁড়-ঝুলিয়ে মূহুর্তেই হাওয়া।
নামেই গজগামিনী- ইচ্ছা হলে ভীমভৈরবী্। বাচ্চাদের মত পিছু নিতে চেয়েও ঠকে গেলাম।
অবশ্য অসুবিধে নেই, খোঁজবার মন জেগে থাকলে মিলবেই- যেমন আমার মিলেছিল। ছড়িয়ে আছে
অঢেল রূপময়তা চিতওয়ানের মাঠে-ঘাটে-গ্রামে।
তখন বেশ বেলা, রোদে চলাফেরাই দায়। টুপি মাথায় এগোতে থাকলাম।
জনপদ হাল্কা হয়ে ক্রমশঃ ধানজমি, কর্ষিত মাঠ, আলভূমির কাছে চলে এসেছি। কানে এল
সানায়ের মত সুরেলা আওয়াজ ও দ্রিদিম-দ্রিম ঢোলের সঙ্গত। এতটাই তা মায়াময় ও জায়গার
অনুষঙ্গে এতটাই সাযুজ্যের, যে নিজেকে হ্যামলিনের বাঁশীর টানে ভূতগ্রস্থ, আচ্ছন্ন
এক ইঁদুর লাগছিল। শব্দ অনুসরণে
এগিয়ে যাওয়াটা, নিয়তির মত নিয়ে গিয়ে ফেলল একটা এমন এলাকায়, যেখানে থারু-উপজাতির
মানুষজন রিহার্সাল দিচ্ছে নাচের, গানের, বাজনার...
জানলাম, হোটেল-সংলগ্ন যে সাংস্কৃতিক মঞ্চ আছে, প্রতি
সন্ধ্যায় সেখানে পারফর্মেন্স হয়। সন্ধ্যা হতেই পৌঁছে গেলাম। সকালে যে নাচ বিনা
সাজে দেখেছিলাম, তা এখন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ময়ূরীনৃত্য- বনে দেখে আসা পাখীটারই
মতন- একদম। কি অবজার্ভশন, কি অসামান্য তার এক্সিক্যুশন। শেষে ছিল রিদিমিক
পরিবেশনা, লোকসংস্কৃতি অনুসারী। ওরা উত্সাহী দর্শকদের ডাকলেন। মধ্যবিত্ত চেতনায়
হেরে গেলাম এখানেও। উল্লসিত বিদেশীকুল এলোপাথাড়ি পা ছুঁড়ে, ঘুরে-ঘুরে নাচল আর
আমি ডান্সার হয়েও, ফোক-এর সঙ্গে যদি না মিলতে পারি এই দ্বিধায় ফুরিয়ে ফেললাম বেলা।
শো শেষ। চেতনায় পরের জন্মে মধ্য-মানসিকতা মুক্তির আকাঙ্খা
নিয়ে উঠলাম। আজ কোজাগরী লক্ষীপূজো। জ্যোত্স্নার প্লাবনের মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে মনে
হল হাস্যমুখে, স্মিতস্বরে প্রকৃতি বর দিচ্ছেন আমায়- ‘ইচ্ছামণি ভব।‘
**************************************************
22 comments:
ভ্রমণ-আনন্দের নামকরণটি খাসা হয়েছে । সুপাঠ্য এবং সুললিতও বটে ।
Tomra gaile ki ashiben, mor mahut bandhu re
Hastire naran, hastire choran,
Kakoua basher aara
Ore ki shape dongshilek bandhubak
Bandhua hoilo mor lorare
খুব ভাল লাগলো ।
ইন্দিরা, অনেকদিন বাদে তুমি এসেছ আমার ঘরে। ইচ্ছে হচ্ছে তোমায় নক্সাকাটা আসন পেতে বসিয়ে, খুব যত্ন করি- আর তালপাতার বাতাস দিতে-দিতে তোমার চোপতা-গঙ্গেত্রী- বেড়ানোর গপ্প শুনি। পড়েছি তো বটেই, তবু হেসে-খেলে গড়িয়ে-পড়ে আদান-প্রদান একটা অন্য ব্যাপার- তাই না? তোমার লেখাটিও ভারি সুন্দর ইন্দিরা, ছবি অসাধারণ। এখুনি লেখাটা প্রিন্ট মিডিয়ায় পাঠাও আর মাঝেমাঝে এ' ঘরে এসো...
তোমাদের মত গুণীজনের জন্য আমি অপেক্ষায় থাকি।
তৃষিতা, আমার লেখা পোস্ট করেই সবার মতই আমিও যে তৃষিত থাকি তা কি জান? কোথাও গিয়েছিলে বুঝি... বললে এ্যাদ্দিন বাদে! যাই হোক্, পড়েছ ও বলেছ- এই ঢের। অধিকাংশই দেখি আসছে-পড়ছে, বলছে না... যাচ্ছে। এই সাইটের এ্যাডমিন হওয়ার সুবাদে কতজন লেখাটা পড়ল, তা জানতে পারছি বলেই কিনা...
দু' কথা বলতে মানুষের এত অনীহা? কিজানি!!!! আমার তো উল্টো। কোথা দিয়ে কথা জোগায় জানিনা, বলতে বসলে থামতে পারিনা।
হাতি নিয়ে তোমার লেখাটা আমি বাংলা হরফে এখানে লিখে দিচ্ছি। কেননা বাঁকা-বাংলার মজাটা নিতে গেলে বাংলা হরফ না হলে মজা নেই। ভুল থাকলে ঠিক করে দিও।
তৃষিতার ইংলীশ হরফে লেখাটার বাংলা...
'তোমরা গাইলে কি আসিবেন মোর মাহুত বন্ধু রে-
হস্তিরে নারান, হস্তিরে ছোরান
কাউয়া বাঁশের আড়া
ওরে কি শাপে দংশিলেক বন্ধুবক
বন্ধুয়া হইল মোর লোরারে।'
এটা বোধহয় প্রচলিত একটা অহমিয়া গান, তাই না?
kothao amar hariye jaoar nei mana, MONE MONE....ei moner pothta na dekhalei bhalo chhilo..amra mone mone atto besi pari j moner sathe bastaber khub akta mil thake na.ontoto amar khetre....lekhata khub bhalo laglo. porte porte mone porchilo amra jokhon kaziranga berate gechilam tokhon ak dongol buno hatir majhkhane porechilam....ebar nischoi bolbe seta niye kichu likhte..ha amio lekhar kotha onek din dhorei bhabchi..MONE MONE.
সুচেতনা, খোঁজ পেয়েছি তোমার মনের... লিখতে জানলে পালাতে চাওয়াকেও জাস্টিফাই করা যায়, তার নমুনা এই সুন্দর কমেন্ট। এ'জন্যই আমি ছাড়বো না- লিখতে হবেই, এটা দাবী। তারপর যদি লিখে কখনো নাম হয়ে যায় তখন কিন্তু সেই সাফল্যের অংশীদারিত্ব চাইব। কেন বলতো? কেননা আমার এই ধাক্কাধাক্কির একটা দাম তো তখন নেওয়াই যায়, তাই না?
খুব খারাপ! এত কি হাসা যায়? পেট ব্যাথা হয়ে গেল।
যেতে ইচ্ছে করে রে.................. । লোভে পড়েছি দিদি।
*চৈতী- ভুল করেছ চৈতী, আমার ঘরে হিমাদ্রীকে বলে গেলে। আমার লেখা পড়বে না?
*আল ইমরান- বেশ, একদিন ইচ্ছে ঠিকই পূরণ হবে। তবে লেখা পড়ে কেমন লাগল তা বলবে কে?
কিসে তোমার মনে হলো আমি ভুল করেছি, ভুলতো করিনি আবারও পড়লাম তোমার লেখাইতো। এত মজা করে লিখেছো সত্যি খুব খুবই ভালো লেগেছে।
এবার যাই হিমাদ্রী কি লিখেছেন পড়ে আসি, এরপর উনারটা না পড়লে নিজেকেই লজ্জা পেতে হবে।
যাকগে বাবা, বুঝতে ভুল করেছি হয়তো... কিন্তু এই ফাঁকে তো আরেকজনের সঙ্গে পরিচয় করানো গেল। ব্যস, আপাততঃ এ'টুকুই লাভ।
আচ্ছা চৈতী, এত ভাল লেখ তুমি, তোমার কক্সবাজার, চিটাগঁঙ-এর বেড়ানো লিখবে না? বড্ড জানার ইচ্ছে অথচ তেমন কিছু লেখা এখনো অবধি পড়ে উঠিনি। সময় পেলে একটু লিখো।
মঞ্জুদি
জানি না এতো দিন পরে আবার তোমার লেখায় তুমি কমেন্টস গণার জন্যে আসবে কি না, এ লেখার মন্তব্য আমি আগে দিয়েছি।
ওয়ান স্টপের ই-মেইল এ্যাড্রেসটা যদি দাও।
সত্যি হিমাদ্রীভাই, তুমি আজকাল বড্ড অন্যমনস্ক থাকছ। যেখানে যা লেখার সেখানে লিখছ না, লিখলেও ফিরে দেখতে আসছ না, এমন কি মেলঘরও খুলে দেখছ না? তুমি এখানের কমেন্ট 'মতামত' বিভাগে দেওয়া মাত্রই আমি উত্তর করেছি ও সেদিনই ওয়ানস্টপের এ্যাড্রেসও দিয়েছি।
মনে হচ্ছে কাজের খুব চাপে আছ... তাই ভুল, তাই বেখেয়াল। এনি ওয়ে 'মতামত'-এ যাও ও নিজের মেলবক্স ঝেড়েঝুড়ে দেখ।
jodi konodin sotti sotti lekha suru kori, sedin naam hok ba na hok full credit tomakei debo, tumi chaibar agei...akta kotha ager comment e bola hoi ni, seta holo tomar chhobi gulo o fatafati hoyeche. specially oi chhobita jetate hatir pith theke 2 jon pore jache. khub moja peyechi oi chhobita dekhe.
এই মন্তব্য স্প্যাম-এ গিয়েছিল- এইমাত্র মুক্তি দিলাম উত্তর দেব বলে।
তোমার লেখার ক্রেডিট আমায় যাবে জেনে বড়ই ছটফটানী ভিতরে... কবে, কবে, কবে... লেখা আসবে কবে? আমি ব্লাউজে কলার বসাতে দিলাম, তুলতে হবে না...
তোমার সঙ্গে আমি আবার বেড়াতে যাব মঞ্জুদি। কতটা তোমার দেখা আর কতটা কল্পনা... সত্যিই কি নাচতে ওঠনি? তবে খাসাডিহায়, টেনসায় কি ছিল? বুঝতে চাই দিদি, বুঝতে চাই।
বোঝাবুঝির কিচ্ছু নেই রে ভাই। টেনসা খাসাডিহার মামলা ছিল আলাদা। পথে দলবেঁধে তারা নাচছে... আমি ভিড়ে গিয়েছিলাম। আর এটা টিকিট কেটে সব দেখতে গিয়েছি, নাচ চলছে মঞ্চে। মঞ্চকে আমি যত ভলবাসি, ভয়ও পাই ততটা। তাই দ্বিধা, তাই দোলাচল...
এ লেখার একটি কণাও কল্পনা নয়, সব সত্যি। আর বেড়াতে যাবে? চলনা... কবে থেকেই তো...
টালবাহানা, ব্যস্ততা তো তোমাদেরই ভাই, আমি অকাজের কাজী, একপায়ে খাড়া আছি।
আমাদের এখানে আনন্দবাজার আসেনা, তাই আনন্দবাজারের আনন্দ নেওয়ার উপায় নেই, শুধু বাজারেই যেটুকু আনন্দ - আর বাজার বলতেতো ঐ "মল" যেখানে গেলে লুজ-মোসেনর মতো মল(টাকা)ত্যাগ শুরু হয়ে যায়, আর গিন্নী সঙ্গে থাকলে তা আবার জোলাপের কাজ করে...তাই আনন্দর চেয়ে টেনশন হয় বেশি...
এবার তোমার লেখার কথাই আসি...তোমার লেখা যেমন আশা করি তেমনই, তাই ভালো না লাগার কোন অবকাশই নেই...
তুমি লিখেছো - "জীবনের আনাচ-কানাচে পড়ে থাকা রোদ্দুর, ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছেগুলোকে কত ঊজ্জ্বল করে অনুভবে বসত দিতে মুখিয়ে আছে বিদেশীরা"।
আসলে আমরা স্বপ্ন দেখতে ভালবাসি, তাতে এতোই বিভোর থাকি যে, সেগুলো যখন বাস্তব হয়ে ধরা দেয় আমরা কিন্তু তা ধরতে পারিনা, খেপা খুঁজে খুঁজে ফিরে পরশ-পাথরের মতো অধরাই রয়ে যায়...এছাড়া আর একটা কারণও আছে -"পাছে লোকে কিছু বলে বা খারাপ বলে" এটাকে কিছুতেই মন থেকে হটাতে পারিনা...যে কারণে তুমি ডান্সার হয়েও, ফোক-এর সঙ্গে যদি না মেলাতে পারো এই দ্বিধায় ফুরিয়ে ফেললে বেলা - করলে ইচ্ছেরই অবহেলা...আমরা চিরদিনই সব কিছু দেখতে এবং তার সমালোচনা করতেই ভালবাসি, নিজে করে দেখতে বা দেখাতে ভয় পাই - লজ্জা, দ্বিধাবোধ এগুলোও এক ধরণের ভয়ই...এগুলোকে কাটিয়ে উঠতে না পারলে ইচ্ছে কোনদিনই অনুভবে রুপান্তরিত হবেনা।
এ'জন্যই দাদা আপনাকে পড়তে বলি, বলতে বলি... কারণ বলাটা আপনার হাস্যরসে জারিত এত নিজস্ব, এত আন্তরিক, যা বেশ কিছুটা দুর্লভ। আর শেষের কথাটা আংশিক সত্য। মানে 'লজ্জা, দ্বিধাবোধ এগুলোও এক ধরণের ভয়ই...' কথাটা। ব্যক্তিগতভাবে এইক্ষেত্রে নাচতে না ওঠাটা একটু অন্য। বহুদিন স্টেজে উঠে-উঠে স্টেজে ওঠাটাকে আমি দারুণ এনজয় করি, ও'সব লজ্জা, দ্বিধা কবেই গেছে। আসল কথা হল দাদা 'জানা থাকা'র যন্ত্রণা। ফোকটা আমার সাবজেক্ট নয়, আমার সাবজেক্ট কত্থক, ভরতনাট্যম। দু'ধরণ স্টাইলের দূরত্ব কতখানি তার আন্দাজ অল্পস্বল্প আছে বলেই দ্বিধা, আছে বলেই ভয়। যে জানেনা, তার কাছে অঙ্গবিক্ষেপ মানেই নাচ, তালে-তালে দেহ-সঞ্চালনা মানেই নাচ। আটকে গিয়েছিলাম আমি ওখানেই। অথচ সিমলিপালে আদিবাসীদের সঙ্গে নাচতে বা টেনসার গাঁয়ে নেচে ফেরা সাঁওতালীদের সঙ্গে পা মেলাতে মূহর্তের দ্বিধা আমার পা জড়িয়ে ধরেনি। ও'সব জায়গায় আসলে স্টেজ ছিলনা, ভূমি ছিল। মানুষ ছিলনা, প্রকৃতি ছিল। আমিও তাই 'আমি' ছিলাম না, ছান্দিক স্বাভাবিক-জন ছিলাম। আমার আচরণের এটাই মনে হয় ব্যাখ্যা।
তুমি আমার এই কথাটাকে আংশিক সত্য বলে পরে তুমিই তার পূর্ণতা দিলে...তুমি লিখেছো "আন্দাজ অল্পস্বল্প আছে বলেই দ্বিধা, আছে বলেই ভয়"...আমিতো তাই বলতে চেয়েছি এটাও এক ধরণের ভয়, তার কারণ যাই হোক না কেনো...ক্লাসের ফার্স্ট বয়ের ভয় ফার্স্ট হওয়ার, আর লাস্ট বয়ের ভয় পাশ করার...দুজনেই ভায়ের স্বীকার...আর মজার ব্যাপর ফার্স্ট বয়ের ভয়টা বেশি ভয়ানক, কারণ একটা নম্বরের গন্ডি পর করলেই পাশ করা যায় তাই সেটা সম্পূর্ণ তার নিজের উপর...কিন্তু ফার্স্ট হওয়াটা অন্যের পারফর্মেন্সের উপর বেশি নির্ভরশীল...আমাদের অর্থাৎ বাঙালিদের একটা স্বভাব আছে আমরা "করলে ভালো করবো,নইলে করবো না" অর্থাৎ আমার নিজের যোগ্যতা থেকে পদস্থলিত হতে ভয় পাই...আবার সেই ভয়...কাজ করলে পাছে ভুল হয় সেই ভয়ে কাজ করতে চাই না তাই আজ আমরা এত কর্মবিমুখ...ব্যবসা করেলে পাছে লোকসান হয় এই ভয়ে আমরা ব্যবসা করতে ভয় পাই, তার চেয়ে অন্যের গুলামী অর্থাৎ চাকরিই শ্রেয়..."করলে ভালো করবো, নইলে করবো না" এই মানসিকতা আমাদেরকে অনেক কিছুই করতে দেয়না যার জন্য আমাদের অনেক যোগ্যতা থাকা সত্বেও আমরা পিছিয়ে পড়ছি...সেন্চুরি করবো বলে করা যায়না, মন দিয়ে খেলতে খেলতে হয়ে যায়...বেশিরভাগ সময় আমদের অতিরিক্ত জ্ঞান বা জানাটাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়...না জানলে বরং নির্ভয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়, আগে যা হবে দেখা যাবে এই ভেবে...যেটা আমরা কোনদিনও করতে পারবো না সেটাই যা সমস্যা....
এখনও বলি দাদা, আমার তখনকার মনোগত বাসনার সঙ্গে 'ভয়' শব্দটার কার্যাবলী আংশিক ছিল। অধিক ছিল যা আপনি শেষে বলেছেন- 'জ্ঞান বা জানাটাই আমাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে অন্তরায়...না জানলে বরং নির্ভয়ে এগিয়ে যাওয়া যায়।' এ'কারণেই আমরা যেকোন বিটের সঙ্গে যা খুশী করেই বলি ওয়েস্টার্ন ডান্স করলাম আর ওয়েস্টার্নরা যেনতেন কোমর দুলিয়েই মনে ভাবে দারুণ ওরিয়েন্টাল ডান্স করছি। তবে মানতেই হবে-'করলে ভালো করবো, নইলে করবো না'-র ফাটকে প্রধানতঃ আমরাই আটক।
Post a Comment