ভ্রমণ

‘কুলডিহার কাঁকন-বাঁকে’ 

নামে এ’ মাসের (June 2015) ‘গৃহশোভা’তে আমার একটি লেখা বেরিয়েছে। কাঁকনের ব্যাপারটাই হচ্ছে বালার ওপরমহল্লায় কাঁটা শিরোনামটি কাব্যিক শুনতে লাগলেও আসলে সতর্কিকরণ। ‘কাঁকন’ দেখতে খানিকটা বালার মত হলেও বালা নয়। তার Circular Area জুড়ে কাঁটার মত Design থাকলে তবেই সে’টি কাঁকন। একদম অন্যরকম সুন্দর, বন্যসুন্দর। যে সামলাতে পারে তাকে এ’টি অনন্যতা দেয় আর যে পারেনা তার হাত কেটে-ছড়ে একাক্কার। এমন কি এ’টি সামলাতে পারা বাহুকে বাহার দিলেও তার আশেপাশে ঘোরাফেরা মানুষ এর আঘাত থেকে যে অব্যহতি পাবেই এমন কথা নেই কুলডিহা’ জায়গাটি হচ্ছে এমনই। তায় যদি তা’তে ঘন-ঘন বাঁক থাকে তবে তো কথাই নেই। লিখতে বসে তাই ‘কুলডিহার কাঁকন-বাঁকে’  শব্দটা  আপনি এসেছিল।  ‘গৃহশোভা’ কে ধন্যবাদ এ’ লেখা ছাপার জন্য।


‘কুলডিহা’র কাঁকন-বাঁকে'              

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

যাব-যাব ভাবতে-ভাবতে একদিন সব ফেলে ছুট- পৌঁছে গেলাম কুলডিহা নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ধানী জমি, গ্রাম, অরণ্য নিয়ে একদিকে সিমলিপাল অন্যদিকে কুলডিহা। সিমলিপাল যদি আলগা চটক হয়, তবে কুলডিহা এক হরিণ চোখের ফড়িং মেয়ের সরলতা ও সাজ নিয়ে সমগ্রটা। এ কন্যের কাঁকনের বাঁক এতই তীক্ষ্ণ ও প্রাকৃত যে তাতে ঘষটা লেগে ঘোল খেয়েছি জোর

দলে আট থেকে আঠাশ-আটচল্লিশ ছুঁয়ে ছিল ষাট পেরোন দুজন অসম বয়সী হলেও প্রকৃতির সুরে বাঁধা পড়েছিলাম বলেই ছিলাম একান্নতায়। নাহলে সম্ভব? ওবামার সাথে কখনো মেলে ওসামা? কিন্তু এখানে মিলেছিল, ওবামার পিঠে ওসামা যে কতবার হাত বুলিয়ে দিয়েছে- আসলে কিছুটা বোঝাবুঝি ছিল নিজেদের আর অনেকটা ভালবাসা দিয়েছে প্রকৃতি তাই বোধহয়...



 সিমলিপাল থেকে কুলডিহাকে আলাদা করেছে সুখুয়াপোতা আর গাগুয়া নামের দুই পাহাড় যে ভাগটায় ছোট বড় মিলিয়ে মেলা কাঠবিড়ালী- সেটিই ‘কুলডিহা’। ক’জন মিলে ক’দিন ধরে কষে মেখেছি কুলডিহার সাতশো রঙা সবুজ ও সবুজপাতার আনাচ-কানাচের ভয় পৌঁছনো এখানে সহজ ছিল না, বাধা ছিল প্রায় নীলগিরি পাহাড়ের মাপে। শেষে যার সূত্রে যেতে পেলাম- এই ভ্রমণের সেই মানুষটিই মূখ্য মুখ এমনিতেই কুলডিহার কাঁকনে ঘন ঘন বাঁক- বিপুল বনানী পেরনো জঙ্গলে রোদ ঢোকেনা তায় এই বিবরণ বাদ দিলে আঁধার পেরিয়ে প্রবেশ আরো শক্ত হবে বৈকি আসলে আপাত সহযোগী মানুষটির কোনো রাখঢাক নেই, দু-হাট খোলা মনোভাব। অনেক চেষ্টায় ফোনে তো পেলাম কিন্তু কিছু শোনার আগেই তাঁর প্রস্থুত রাখা প্রশ্নমালার সামনে পড়তে হল প্রায় ‘হ্যালো’ শব্দটির  গায়ে-গায়ে জুড়ে এক নিঃশ্বাসে তার প্রশ্ন- কোথায় যেতে চাই- চাঁদিপুর, ভিতরকণিকা, কপিলাস, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, সিমলিপাল...
বাপরে- উত্তর দেব কি, মাথার মধ্যে তখন ভীমরুলের ভোঁ ভোঁ। যেন বাসে উঠেছি, কন্ডাক্টর হাঁকছে- বেলেঘাটা, কাদাপাড়া, চিংড়িঘাটা, মেট্রোপলিটন... কোনমতে ঐ ছেদহীন নামমালার মাঝখানে নিজের চাওয়াটুকু সিঁধিয়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম- ‘কুলডিহা, কুলডিহা‘ ফোনের ওপারের মানুষটি নিলাজ ধাতুতে গড়া- দিব্যি নির্ভার। দয়ার দান দিচ্ছেন ভঙ্গিমায় একটি নৈর্ব্যক্তিক আওয়াজ শুধু ছুঁড়ে দিলেন কি যে মানে আওয়াজটির... বুঝতে পারিনি বলেই খেজুরালাপে গেলাম, কেননা পেতে আমাকে হবেই ‘কত নাম শুনেছি আপনার,’ ‘কুলডিহার কোলে-কাঁখালে কত না কীর্তি,’ ‘লজের গায়ে শুনেছি বিদেশী সৌরভ...’ সবটা বেকার, আসলে কথার ফাঁকে বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা উনিও অনড়। বলতে থাকলেন যে কুলডিহার যেহেতু চাহিদা প্রচুর সেহেতু হবে না-টা ধরেই নেওয়া যায়। আশ্চর্য্য, উনি কিন্তু এখনো ডেট জানেননি। তা’তেও ‘না’ বলছেন মানেই আগাম ভেবে রাখা। আশা নিয়ে বহুক্ষণ বাজে বকেছি- চূড়ান্ত হিউমিলিয়েটিং দশায় দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ আমার তীক্ষ্ণ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডেট দু’টো জানালাম- ডিসেম্বরের 25 আর 26 তিনি কম নন, অনায়াসে ও’সব ডেট বুকড্ বলে জানিয়ে দিলেন। সিগার চিবোতে-চিবোতে কথা বললে যেমন কটকট শব্দ ওঠে, মানুষটি কথা বলছিলেন সেই ঢঙে আমি বুঝে যাচ্ছিলাম, ওটা আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গীমায় অন্যপ্রান্তের মানুষটিকে রেয়াত না করার স্টাইল যা বহু ব্যবহারে ক্লিন্ন। বেশ, সে থাক তার জায়গায়- আমি আমার।

মোষে-মোষে যুদ্ধ হলে যেমন শিঙে শিঙ বাধিয়ে দু’টোই দাঁড়িয়ে থাকে ও ফের ঝটকা মেরে খুলে নিয়ে ঢুঁসোয়- আমাদের অবস্থা খানিক তেমন। হারাতে চলেছি আন্দাজ পেতেই জেদ চড়ল অসম্ভবকে সম্ভাবনায় বদলানো আমার স্পেশাল এবিলিটি, হেরে যাচ্ছি খালি কুলডিহায় কতবার যে...


 বুকিং এখনো চালুই হলনা অথচ বুকড... পষ্টাপষ্টি ভদ্রলোকের কাছে অবিশ্বাসী মনোভাব পৌঁছে দিলাম। তিনি এ ধরণের বার্তালাপ শোনেন না বরং হাত কচলানী পেতেই অভ্যস্থ এত সহজে অচেনার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া... ইগো তেঁনার টাল খাচ্ছে বুঝলাম ঠান্ডা পাথুরে গলায় জানিয়ে দিলেন- সরকারী অফিস থেকে যেহেতু বুকিং হয়, সেহেতু আমি যেন ওখানেই যোগাযোগ করি।
হাঃ বাণ ছুঁড়ল ওপক্ষ, একদম শব্দভেদী বাণ। চ্যালেঞ্জ-ঋদ্ধ এ্যাটিচ্যুডে বিঁধে এবার আমার মুখে কুলুপ। কুলডিহা-কুলডিহা করে কতবার টাল খেয়েছে আস্থা- তবু যে কেন... আমার গোঁয়ার্তুমির ফাঁক গলে এটাও বুঝি যায় একসময় বালেশ্বরের অফিসে ফোন করে শুনেছি যে ফোনে বুকিং হবেনা সরাসরি করতে হবে। তার মানে ভাবলাম হয় মানি অর্ডার নয় থ্রু অনলাইন পেমেন্ট। কিন্তু নাহ, অফিস জানালো হবে না। অগত্যা? বুঝে পাচ্ছিনা কি করি কলকাতা থেকে বালেশ্বরে গিয়ে বুকিং? সম্ভব, না এমন হয় কখনো? ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত কেন প্রশ্ন করে জানতে পেলাম এটাই নাকি নিয়ম।

‘নিয়ম?????? কোনো বনেই এমন শুনিনি যারা হিল্লী-দিল্লী-হায়দ্রাবাদ থেকে আসবে?’ উত্তর তো দূর, ফোন কেটে গেল তত্ক্ষণাত্। ভুল আমারই- কথার ভিতরের কথাটা বুঝতে চাইনি বলে ওদিকে এজেন্টের চ্যালেঞ্জটি ভেতরে ধোঁয়াচ্ছে তাঁর ঠান্ডা-ঠান্ডা কুল-কুল চালে আমার ঘাড়ে ওদিকে ঘামদরিয়া কুলকুল। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাস দেখি বাঁকা পথের খুঁটিতে মজবুতিতে গাড়া- এবার নুইতে হল আমাকে স্পষ্ট জানালেন যে আগে কন্ট্যাক্ট করা পাবলিকের প্রেফারেন্স আগে ও তারপরেও আছে উপরীর একটা হিসেব ওসব ঠিকঠাক পেয়ে গেলে তবেই বুকিং মেলা না মেলার প্রশ্ন আমি যে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিকে টাকায় না মেপে ইচ্ছেগুলোকেই প্রায়োরিটি দিই- এই খবর কি মানুষটির কানে পৌঁছে গিয়েছিল?

সাধারণতঃ বেড়াতে বেড়িয়ে কোন আকস্মিক সিচ্যুয়েশনে পড়া ও তাকে কাটিয়ে ওঠাও একধরণের এনজয়মেন্ট। এ্যাডভেঞ্চার না থাকলে আর পরিপাটী চৌহদ্দী ছেড়ে পথে বেড়োনো কেন? এখানের প্রকৃতিতে যত আয়োজন- সমস্যাও তত। প্রত্যেক জায়গার মত কুলডিহারও একটা বিশেষত্ব আছে- তা হল প্রতি পদে ঘুষঘাষ, অন্যায্য ডিলিং যা প্রকৃতির প্রণোদনাকেও ছাপিয়ে গেছে

আমি জানতাম যে কুলডিহা ছাড়িয়ে দশ কিলোমিটার ভিতরে আরেকটি জায়গা আছে নাম- যোধাচুয়া। কপাল ঠুকে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। আমার জানার বহরে এবার এজেন্ট মানুষটি চমকালেন। জানালেন যে, যে দলে আট থেকে আটষট্টি বছরের মানুষজন আছে তাদের জন্য যোধাচুয়া সুবিধেজনক নয় ফেসেলিটিস প্রায় নেই বললেই হয় তোলা জলে স্নান-পান তায় থাকার জন্য দু’টি মোটে ঘর এ’ছাড়া নির্জনতা ছাড়া এ্যাস সাচ কিছু নেই দোষ দিইনা তাঁকে- এমনটা তিনি ভাবতেই পারেন বেড়ানোর ধাঁচধরণ আজকাল এত শৌখিনতায় জড়িয়েছে যে অসমবয়সীরা একসঙ্গে থাকার আনন্দেই যে আনন্দ পেতে পারে তা তাঁর বোধে ঢুকছে না বন্যতার চেনা কন্সেপ্ট আজকাল মাতলামীর মধ্যে বসত করে, স্বাভাবিকতাই বিস্ময়। মনঃশ্চক্ষে দেখলাম- এপাশ থেকে ওপাশে নিয়ে চিবোতে থাকা হিরোর সিগার ফের মুখ থেকে নেমে এলো দু আঙুলের ফাঁকে।

অনেকগুলো জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতায় জানি, অরণ্য গভীর থেকে গভীরতম হলে প্রাপ্তির কোটা ভরবেই তায় যদি উপরী হিসেবে জোটে নির্জনতা তবে তো সোনায় সোহাগা বিনা বাক্যব্যয়ে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম ভদ্রলোক এবার খাতির নেওয়ার বদলে কিছুটা খাির দিলেন জানালেন প্রথমদিন আমাদের ‘যোধাচুয়া’-য় থাকতে হলেও পরদিন উনি ‘কুলডিহা’-য় ব্যবস্থা করে দেবেন হঠাত্ই দেখি দয়ার সাগর... আসলে কোথাও দিয়ে আমায় বোধহয় আসলি ভ্রামণিক বলে মনে হচ্ছে ওঁনার তাই ছেলে-ছোকরার যে দল পরপর দুদিন বুকিং নিয়ে রেখেছে, তাদের উনি একদিন ‘কুলডিহা’য় ও পরদিন ‘যোধাচুয়া’-য় পাঠিযে দেবেন বলে জানালেন আমি অবাক হলাম, বুকিং দিয়ে রাখা মানুষকে কিভাবে... জিজ্ঞাসা করাতে গলায় সেই পুরনো আস্থার আওয়াজ উঠে এলো ফের। ওঁনার ওপরেই ছাড়তে বললেন ব্যাপারটা।

কি বলব, আমি তো আপ্লুত। এবার খুব দূর থেকে হলেও তীর দেখা যাচ্ছে- তরী এই ভিড়ল বলে। উল্লসিত আমি ফের প্রশংসার খাতা খুললাম- ‘সো কাইন্ড অফ ইউ।‘ ভদ্রলোক ব্যারিটোন ভয়েসে দয়াটয়া ডিসকার্ড করে জানালেন যে এখনো সবটাই চলছে হাওয়ায়। এরপরের অগ্রগতি নির্ভর করছে ঠিকঠাক সময়ে ঠিকঠাক প্রাপ্তির ওপর সঙ্গে এটাও বলে দিলেন- ইমিডিয়েটলি শুধু বুকিং-এর টাকা পাঠালেই হবে, বাকী পেমেন্ট বালেশ্বরের অফিসে পৌঁছে দিতে হবে তারপর এন্ট্রি ফি, ক্যামেরা, ড্রাইভার, জ্বালানী, বাংলো সব মুখে-মুখে হিসেব করে জানালেন কোন এ্যামাউন্টটি সরকারী, কোনটি উনি নেবেন ও ফরেস্ট অফিসারের জন্য কত টাকা। একই সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে গেলে আগামী দশ দিনের মধ্যে আসল কাগজ পেয়ে যাব বেঁকা পয়সার এই কনফিডেন্স দেখে আমি থ। মিনমিন করে ক্ষীণ স্বরে তবু জানতে চেয়েছিলাম যে বিট অফিসার সরকারী চেয়ারে বসে এমনটা করে কি করে? ভদ্রলোক থামিয়ে দিয়ে বলে ছিলেন ওঁর থেকেও অনেক রহিস পার্টি আছে, তবু ওপরঅলারা ওঁনাকেই গুরুত্ব দেন

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাবার একটা প্লাস পয়েন্ট আছে আমার আগ্রহী মনোভাব যেমন পৌঁছে যায় মানুষটির কাছে তেমনি বিশ্বাসটাও তাই কথা প্রসঙ্গে আমার বলতে অসুবিধে হলনা যে টাকা শুধু উনি দেন না, ‘রহিস পাবলিকে’ও দেয় তবে ওপরওয়ালা কেন ওঁনাকেই প্রেফার করেন? আসলে ওঁনার স্পেশালিটি ঠিক কোথায় একটু বুঝতে চাই, এই আর কি। ভদ্রলোক জানালেন- ওখানে পৌঁছে চোখের ওপর ঘটনা পরম্পরা দেখলে নিজেই সবটা বুঝতে পারবো তাছাড়া কুলডিহার জাংগল-ক্যাম্পটি নাকি উনিই চালান এ ব্যাপারে গভর্মেন্টের আদৌ উত্সাহ নেই অথচ পর্যটকের উত্সাহ অনন্ত এটা দেখে উনি ব্যাপারটাকে দু’ভাবে ভেবেছেন এক- পর্যটকের কাছে নিজেকে পরিচিত করে তোলা, দুই-অবস্থার সুযোগ নিয়ে উপার্জনের পন্থা খুঁজে বার করা এসব ক্ষেত্রে চোখের চামড়া পাতলা হলেই প্রাপ্তি সুতরাং...  যেমন জঙ্গলে আগে জলের অসুবিধে ছিল, উনি ইনিসিয়েটিভ নিয়ে দু’টো টিউবওয়েল বসিয়েছেন তাছাড়া গ্যাস, সোলার লাইট, পানীয় জল নিয়ে কুলডিহা এখন রাণী। স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠে এল- তাহলে যোধাচুয়ায়? নাঃ, পরিষ্কার জানালেন সেখানে কিছু করেননি কেননা বেশীর ভাগ মানুষ কুলডিহায় এলে যোধাচুয়ায় যাবেই- যেহেতু ভরপুর সবুজ, গভীর অরণ্য কিন্তু ফেসিলিটিস্ তেমন নেই বলে থাকার কথা খুব একটা কেউ ভাবেন না

আমার যা বোঝার ছিল বুঝেছি, অনর্থক কথা না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে গেলাম জানালাম দু-একদিনের মধ্যেই ওঁনার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি, বুকিং আমার চাই-ই এবার যে এ্যামাউন্ট উনি বলেছেন, তার সঙ্গে যেন একস্ট্রা পঁচিশ টাকা জুড়ে পাঠাই তা উনি মনে করালেন ওটা নাকি ক্যাশ ট্রান্সফারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কেটে নেবে ভদ্রলোকের একদিকে অনায্যতার ডিলিং, অন্যদিকে পেশাদারীত্ব। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা মিটিয়ে অপেক্ষায় রইলাম- নাঃ, কোনো হেরফের নেই, কথা তো কথাই। দশ দিনের মধ্যে পাকা কাগজ হাতে এল

সব গুছিয়ে নিয়েছি এবার বেড়বো ভোরের ট্রেন, মোবাইলের এ্যালার্মে কেউ পাখীর ডাক, শিশুর কান্না রেখে নিশ্চিন্তির কাঁথামুড়িতে গেলাম। উঠবো, সাজানো জামা-জুতোয় ট্যাক্সি ধরবো ও ধাঁ। কিন্তু ভাবার সঙ্গে ঘটে ওঠার বড্ড বিরোধ। মাঝে যে কোন রসিকজন সূক্ষ্ম রসের ভিয়েনঘরে জিরেন কাঠে পাক দিচ্ছেন... বেড়োবার ঠিক মুখেই চাবী হারালো। সময় তখন সেকেন্ডে দু মিনিটের হারে এগোচ্ছে। কত আর, মিনিট পাঁচেক এলোথেলো- তারপর এক তরুণীর হাতব্যাগ হাতড়াতেই... ব্যস, এবার আমরা ছিলে ছেঁড়া ধনুক- ছুটছি। খুশীকন্যার মুখের রোদ লেগেছে ভোরবেলাকার গায়। প্ল্যাটফর্মের চালায়, গাছের পাতায়, রেলইয়ার্ডের ফাঁকে আলতো আদরের মত কুয়াশার আস্তরণ।
জঙ্গলে যাচ্ছি, সঙ্গে চাল-ডাল-জল... হাতি থেকে আলপিন বাদ নেই কিছুই। সবাই মিলে বোঁচকা টেনে কোনমতে কোচে পৌঁছলাম গাড়ি স্পিড নিতেই এবার ভাবনপথে হাজির পরের সিন। নেমে কাকে ফোন করব, নীলগিরিতে বিসলেরী ওয়াটার পাব কিনা, কাঠের জ্বালে খাবারে ধোঁয়া গন্ধ ছাড়বে কিনা... ভাবতে-ভাবতে পৌঁছে গেলাম ‘বালেশ্বর‘ কতটুকু আর- সাড়ে তিনঘন্টার জার্নী।
প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরতেই শুনতে পেলাম ডাক- স্বপ্নমগন? হ্যাঁ, হ্যাঁ স্বপ্নমগন, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা ধরলাম। ঝাঁ চকচকে বোলেরোর গায়ে ঠেসানে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিই প্রশ্নকর্তা। আগাম ব্যবস্থা করে রাখা এই গাড়িটির ড্রাইভার উনি, নাম দীপ্তিময়

আমাদের দলের নাম স্বপ্নমগন মাঝেমাঝেই তার মগ্ন স্বপ্নে হলুদ-সবুজ রং ভরতে লাগে। যেমন এখন। পৌঁছে গেছি সদরে... অপেক্ষা শুধু প্রবেশের- অন্দরে।  ড্রাইভার দীপ্তিময়ের ব্যবহারে ছিল এমন এক দীপ্তি যা না থাকলেই মুস্কিল যতই হোক্ কদিন এর সঙ্গেই কাটবে। এন্ট্রি পারমিটের জন্য আমাদের বিট-অফিসে নিয়ে গেল দীপ্তিময়। অফিসার ওড়িয়া মহিলা তিনি হ্যালাফ্যালার একটা কাগজে হিসেব লিখে হাতে ধরিয়ে বললেন- কিছু বলার আছে? আমার বিস্ময় চরমে বলার থাকলেই বা কে শুনবে, নিয়ম তো নিয়মই! হঠাত্ এজেন্ট ভদ্রলোকের কথাটা মনে পড়ল- এখানে এলে নিজেই দুচোখে দেখবেন ম্যাম...‘  না, অফিসারের ঈঙ্গিতটা নজর এড়ায়নি বরং নিজেই উনি হেল্প করলেন। জানালেন, সঙ্গে ক্যামেরা থাকলেও উনি পেপারে লিখবেন না, ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে পাঁচবছরের কম দেখানোয় আপত্তি নেই। বদলে যে টাকাটা উনি নেবেন, রসিদে তার উল্লেখ থাকবে না। আমি ভাবলাম, অসুবিধে কি- যেমনি ঠাকুর, তেমনি তার নৈবেদ্য জেনেবুঝেই এসেছি যখন। আধঘন্টায় কাজ মিটিয়ে নীলগিরি' থেকে মাছ-বাজার-বিসলেরী কিনে ছুট আমরা পৌঁছলে রান্না হবে, তারপর খাওয়া, তারপর... কি জানি কি তারপর, আগে তো পৌঁছই।

কুয়াশা অভেদ্য রোদের চাপা তাপ গায়ে মেখে- তাল, সুপারী, জংলী লতাপাতার সখ্যতা দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেলাম শেষ জনপদ নীলগিরি। বনের সরু পথ, পথের দুধারে সারিবদ্ধ গাছ, ফাঁক দিয়ে তার রোদ্দুর পড়ে আলো-ছায়ার আল্পনা আর অদূরে নদীর পটচিত্র। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি ভাবতে-ভাবতেই ঝুপ্পুস আওয়াজ ও দুপাশে ফোয়ারার মত স্রোত। দেখি গাড়িটি কেন্দুনদীতে নেমে পড়েছে আর এ্যাক্সিলেটর দাবিয়ে জেদী নদী পেরিয়ে যাচ্ছে দীপ্তি- চাকার চারপাশে সেই আক্ষেপেরই জোয়ার হঠাত্ই গাড়ির নীচে বোল্ডার পড়ে ভেতরে বিপুল উথাল-পাতাল। আনাজ-পাতি, বিশ-লিটারি বিসলেরী, মানুষ-জন সব একধারসে ড্যাং-গড়াগ্গড় সামলাবো কি- হেসেই কুটিপাটি। কোথাও সীম-বেগুনের রাজ্যে আমি তো কেউ কাঁচা ডিমে ফ্যাচাস্। তবে ঐ একবারই। ঝোরা দেখলেই এরপর একে অন্যকে আঁকড়ে-পাকড়ে ধরেছি এতই বদল ছবি এই জঙ্গল দেখিয়েছে যে আগের রূপ মুছতে না মুছতেই চোখে অন্য অপরূপ এসে দাঁড়াচ্ছিল কুলডিহার প্রতিটি বাঁক যেন আছোঁয়া কিশোরীর উল্লাস-সহ জীবন্ত, বন্য, আদিম

বেলা দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম যোধাচুয়ায়। বাজার-দোকান কেয়ার-টেকারের জিম্মায় দিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে পড়লাম। যদিও ঠান্ডা তবু আস্তানা জুটতেই শরীরে ক্লান্তি নেমেছে ঝাঁপিয়ে ছেলেরা বিছানা জুটতেই কেউ কম্বল-বালিশের সঙ্গে মিতালীতে, কেউ প্রকৃতিতে আটের বাচ্চাটি আলাপালায় ঘুরঘুর করে কাটাল আমাদের মেয়েদের চেতনাতেই যত দেখি ধূলোবালির ঝঞ্ঝাট... আগে স্নান অবশ্য কাঠের জ্বালে ফোটানো গরম জল হাজির হল তক্ষুনি
মূলোশাকের আবার ক্যাশমেমো-র মতই দেখি বুনো বাথরুমে আবার টালির বাহার ওদিকে দরজার দক্ষিণ কোণে মৌমাছি বাসা বেঁধেছে, সিলিং-এ উইয়ের আঁকিবুকি তবু মনের মধ্যে কি যে ছন্দোময় গান। আসলে বুনো জায়গার বন্যতাটাই আসল- যেন এটাই চাইছিলাম, ঠিক এমনই অগোছালো উদভ্রান্তি। নিজের ঘরে অথচ একটা মথ উড়ে গেলেও অশান্তি। অভ্যাস-মুক্তির এই আনন্দকে ছুঁয়ে যে আরাম উড়ছে আকাশে তা শিকড়ের টান বলে চিনতে পারলাম

ইতিমধ্যে কাঠের জ্বালে রাঁন্নাবাড়ি সারা, খিচুড়ি-ডিম-পাঁপড়-ভাজায় লাঞ্চ সেরে বেরোলাম। ঘন্টাখানেক জঙ্গল চষে যখন সন্ধ্যা নামছে, তখন দীপ্তি বলল ও পুকুরিয়ার দিকে গাড়ি  ঘোরাচ্ছে কিছুটা আন্দাজ করলেও বুঝে পেলাম না এমন কি আছে সেটা দেখবার ধন্ধ কাটাতে দীপ্তি জানাল ওটা একটা বড় পুকুর যেখানে জন্তু-জানোয়ার জল খেতে আসে। বাব্বা- চিন্তা হয়ে গেল। বলেই ফেললাম- একে অন্ধকার তায় কৃষ্ণপক্ষ

দীপ্তি ভারি দৃপ্ত বলল- আমি তো আছি ভয়ের ভার আমাদেরও কম না- প্রায় সাথেসাথেই বলে ফেললাম- ওরা তোমায় চেনে বুঝি? শ্লেষের শব্দকে ঠাট্টায় নেবার মতন শিক্ষা আছে দীপ্তির। তাই মৃদু হেসে গাড়ীতে উঠলো, পিছুপিছু আমরাও- পৌঁছে গেলাম পুকুরিয়া। বেশ বড়সড় পুকুর যার মাঝ-দরিয়ায় আর্টিস্টিক কেতায় দাঁড়িয়ে আছে এক ইকড়ি-বিকড়ি গাছ। ওপাড়ে দৃষ্টি-অগম্য আঁধারে কুচি-কুচি জোনাকী আর চুড়ান্ত নিস্তব্ধতার থম বাড়িয়ে চতুর্দিকে ঝিঁঝিঁর ঝুমঝুম এমনই সময় খুব কাছ থেকে জল পড়ার শব্দ শুনে দুদ্দাড়িয়ে এক পাবলিক দৌড়ে গিয়ে উঠল গাড়িতে। আকস্মিক এই ঘটনায় একেই ঘাবড়েছি, তায় মারাত্মক চমকে দিয়ে কোথা থেকে যেন তীব্র আলো পড়ল ঝোপে। দেখি দীপ্তি স্পটলাইট ফোকাস করেছে... এবং যেদিকে- সেদিকে আলোয় ভাসতে-ভাসতে এক লজ্জাখাকি পুরুষ কড়ে আঙুল তুলে জানান দিচ্ছে জল বিয়োগের কথা। তিনি যে কখন টুকটুক করে ঝোপের আড়ালে তা যেমন জানা ছিলনা, তেমনি জানা ছিলনা দীপ্তির সঙ্গে স্পটলাইট আছে জোড়া আকস্মিকতার ধাক্কায় তখন ‘স্বপ্নমগন’-এর স্বপ্ন ভেঙে খানখান, বুকে উত্তেজনার হামানকুট। খুব হয়েছে, গাড়িতে ফিরলাম- কাচ তুলে দিয়ে চুপচাপ বসলাম দীপ্তি আশাবাদী- বলল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে হাতী একসময় পাবই মশা কামড়াচ্ছে তবু চড়-চাপ্টা মুলতুবী রেখেছি- পাছে হাতি পালায়। এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটেছে কি কাটেনি- হঠাত্ই স্তব্ধ চরাচরে ফোঁসর-ফোঁসর শব্দ দীপ্তি সঙ্গেসঙ্গে স্পটলাইট তাক করল কিন্তু কোথায় কি- আওয়াজ তো গাড়ীর ব্যাকসীট থেকে আসছে। যিনি চেম্বার খালি করেছেন তিনি এখন নিশ্চিন্তির নিদ্রায় তাঁরই নাসিকা নিসৃত...

আঃ, আমরা আবার ঠকলাম, আবার হাসলাম গা কাঁপিয়ে অথচ টুঁ-শব্দটুকু না করে- পাছে হাতি পালায়। হায় বেচারী দীপ্তি ও তার স্পটলাইটএকগাছি হরিণ পেলেও হত। পুরো এ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স অগত্যা গাড়ি ছুটল বাংলোর দিকে। আমাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে দীপ্তির স্পটলাইট এমন অজায়গা-বেজায়গায় জ্বলে উঠল যে ও নিজেই চমকে-টমকে একশা।
জলে-জঙ্গলে অন্ধকার নামলে খুব বেশী কিছু করার থাকেনা। তাই ফিরেই সবাই ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ছাদে উঠলাম। একতলা বাংলোর দোতলায় ছাদ, ঘন আঁধারে হাত-পাও ঠাওর হচ্ছে না। মোবাইলের আলোয় ধাপি খুঁজে নিয়ে বসলাম আড্ডার কোনো নির্দিষ্ট টপিক থাকল না কেননা দলের কেউ ফিল্মমেকার, কেউ ডান্সার, একজন কম্পোজার, মিউজিক ডিরেক্টর, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, হোমমেকার ও সঙ্গে ছুটকো এক কচি। সে লিসনার, সে অবজার্ভার। একমাত্র কম্প্যুটার সম্পর্কিত আলোচনা উঠলেই তার জ্ঞানগম্যির জ্বালায় অস্থির আমরা যে যার ফিল্ডের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-দিগদারী নিয়ে মেতে থাকলাম কিছুক্ষণ ও হিম পড়া শুরু হতেই নামলাম। ভোরে ঘুম ভাঙল ছুটকো ছেলের ডাকে। সে নাকি শিশিরের শব্দ শুনেছে অবাক হলাম- শিশির? সে তো মিহি, গুঁড়ো- তার আবার শব্দ কিন্তু সে শুনেছে ও সেটা শুনিয়েই ছাড়বে সবাইকে হাত ধরে টেনে বাইরে আনলো চিন্তায় পড়লাম- সারা রাত্তির ছেলে ঘুমোয়নি নাকি? আসলে রাত্তিরে যেটা হিম বোলে ও শুনেছিল সেটাই সকালে শিশির কিনা দেখতে চেয়ে ভোর-ভোর উঠেছিল তারপর ভেতর থেকে নাকি শুনেছে টুপটাপ শব্দ যা এখন আমিও শুনছি বললাম- ধুর, শিশির না বৃষ্টি  চল দেখি...
বাইরে বেরিয়ে দেখি গাছের পাতা-মাটি-উঠোন সব ভিজে, টুপটাপ শব্দও হচ্ছে অথচ আমাদের গা ভিজছে না। তবে? ছুটকো ছেলে দেখালো- বড় বড় গাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায় শিশির জমা জল পড়ে চলেছে অবিরাম আর তারই শব্দ টুপটাপ। আমরা তো আর গাছের তলায় নয়, দাঁড়িয়েছি এসে আকাশের নীচে। তাই স্পর্শে সে নেই আছে শুধুই শব্দে। ভাগ্যিস সে কৌতুহলী ছিল, নতুন এক  অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে গেলাম

আর নয়, এবার ব্রেকফাস্ট সেরেই দুদ্দাড়িয়ে উঠলাম গাড়িতে- গন্তব্য কুলডিহা। পথে পড়ল ঋষিয়া ড্যাম। বিশাল বড় নদী, নদীতে ফুরফুরে নৌকো, গ্রাম্য দিশপাশ, ন্যাংটা ছেলেপিলে, ধান আছড়ানো পাছাড়ে মগ্ন কৃষক, খড়-ছাউনীর চালের মাথায় সারে-বাহারে টুনটুনিদের কিচিমিচি। এমনই উন্মনা হলাম যে শেষে দীপ্তিকেই ডাকতে হল জানালো বেলা হয়েছে ঢের কুলডিহা পৌঁছে রান্না হলে তবে খাওয়া-দাওয়া তারপরে জঙ্গলে ঘোরা ব্যস, আর বলতে হল না- ইঙ্গিতেই কাম ফতে দৌড়ে সেঁধিয়ে গেলাম গাড়িতে। আবার বনতলের ছায়া মেখে জার্নী। গাড়ির ঠিক আগেই পাইলট কারের মত একটি হলুদ বুলবুলি চলেছে তার উড়াল সঙ্গে চলতে-চলতে পৌঁছে গেলাম কুলডিহা। এখানে টেন্টে উঠলাম- নতুনের স্বাদ নিতে চাই। ‘স্বপ্নমগন’-এর মনজমিতে তাঁবু-র ছায়া পড়তেই সব বাক্যিহারা। ঘুলঘুলি জানালা, দড়ির ফাঁসকল-আঁটা দরজা, কাঠি-পর্দা ভেদ করে ভেতরে রোদের আঁকিবুকি। ত্রিপলের তাঁবুটি যেন আপ্যায়ন নিয়ে সেজেগুজেই বসে… এবার নজর গেল দূরে। গাছের গায়ে ঠেসানে রাখা ইয়াব্বড় হাতির মাথার খুলি। কুল, বাঁদরলাঠি, গোলঞ্চর গাছ দিয়ে ঘেরা বাগানে পাখি আর অঢেল প্রজাপতি বাংলোটি পরিখা দিয়ে ঘেরাকিজানি কেন, হয়তো জন্তুর ভয়। সামনে সরু পথ, মাটি-মাটি উইঢিবি, অদূরে সল্টলিক... একটা তীব্র আবেশে জাপ্টে গেল মন। কাটতেও সময় লাগল না- কেননা এজেন্ট মানুষটি দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে জনা কুড়ির দল নিয়ে। দলটি একেবারে বেয়ারা টাইপের- বনের প্রাপ্য মর্যাদাই দেয় না। হট্টগোল, চিল্লামেল্লি, ব্যাটমিন্টন... যেন পার্কের মাঠে চড়ুইভাতিতে এসেছে এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জায়গা- বারণের কেউ নেই, করলেও বোঝার মন নেই। এলো, খেলো, খেললো, জন্তু কেন দেখলো না-র অনুযোগে ধুন্ধুমার চেঁচালো ও পাতা মাড়িয়ে খচরমচর শব্দ তুলে চলেও গেল। এজেন্টটির পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে হোটেল আছে- ওখানকার ট্যুরিস্টদেরই এই ট্রিপে আনে। প্রায় রোজই নাকি সারাদিনের জন্য ঢোকে আর সন্ধ্যার মুখে বেড়িয়ে যায়। কি পায় এভাবে মানুষজঙ্গল কি কারুর ঘুঙুর বাঁধা পা যে নাচতে বললেই নাচবে? আসলে এক পাবলিকের পয়সার প্রয়োজন আর অন্যজনের কম সময়ে প্রাপ্তির। ব্যস, মিলে গেল হিসেব তবু যে টাকার সঙ্গে আছে সে গেনার প্রাপ্তির হিসেব কষা যে ট্যুরিস্ট সময় কঞ্জুষি করে প্রকৃতিকে পেতে চায়, তার আশা ভাঙবেই।   


ওরা চলে গেল, ঠান্ডা হল কুলডিহা... এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ ঘন্টাখানেক সময়ের শুশ্রুষা পেতেই অস্তিত্ব মাড়ানো গানহারা কুলডিহা ফের ছন্দে হেসে উঠল, তার গালের পড়া টোলে মুখ দেখতে দেখলাম ভিজে আকাশকে। হঠাত্ই এক ধাড়ি স্ক্যুইরাল তার ফাঁপানো পুচ্ছ নাচিয়ে দৌড়ে গেল এক গাছ থেকে অন্যয়। খাওয়া-দাওয়া-রান্না ভুলে ‘স্বপ্নমগন’ মেদুর হয়ে গেল। তবে চাবী খোয়ানো সেই ভুলো কন্যা কিন্তু অনন্যা- কল্পনায় ঢুকলেও বাস্তব খোয়ায়নি। এরই মধ্যে তার রান্নাবান্না সারা, টেবিল সাজিয়ে ডাকতে এসেছে। কুলডিহায় গ্যাস আছে- চাইলে কেয়ারটেকারও রেঁধে দেয়। খেয়েদেয়ে কাছের ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম, নজর সল্টলিকে- যদি পথভুলে... কিন্তু ঝাড়া দু-ঘন্টা কাটিয়েও কোথায়? মশায় অতিষ্ট হয়ে ঘরে ফিরলাম ও খেলায় মাতলাম- ডামসরাড্। মিনিট পনেরো বাদেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি- দেখি কেয়ারটেকার ও ড্রাইভার দীপ্তি স্পটলাইট নিয়ে রেডী। একটা হাতী নাকি পরিখার আশপাশে ঘুরছে। নিজের মত যাবার উপায় নেই, একটা পার্টিক্যুলার পয়েন্ট অবধি ওদের সঙ্গে গেলাম। কৃষ্ণপক্ষের রাত জানান দিচ্ছে আঁধারের নিশ্ছিদ্রতা। কিছুটা পরেই ফস্ করে আলো জ্বলল... সেই স্পটলাইটকাঠকুটো মড়মড়িয়ে ভাঙার আওয়াজ পেলাম, গাছপালার দোলাচল দেখলাম, কিন্তু তিনি কোথায়? হয়তো অন্ধকার গায়ে মেখে ধূসর তিনি কাছেই...

পরদিন ভোরে ভাগ্যিস কটা নাচুনে হরিণকে নুন চাটতে দেখেছিলাম। বনের সার্থকতা বনের আপন মধ্যেই স্থিত। প্রাণীকুল তার সম্পদ ঠিকই কিন্তু তাদের জন্য যাওয়া মুখ্য হলেই মুশকিল। এক এক জঙ্গল এক একভাবে তার সৌন্দর্যকে তুলে ধরে। তীব্র লিপ্সা নিয়ে, বাধাহীন বহুদূর দৃষ্টি চালিয়ে ছুঁতে চেয়েছিলাম যে কুলডিহাকে, সে জঙ্গল অন্যরকম দু-হাট খোলা দু-দুয়ারী বিস্তার দেবেনা এ। জংলী ঘেরাটোপ এত ঘন- এত মজবুত্ যে আমি চাইলেও চোখ দিয়ে সবুজের নিশ্ছিদ্রতা ডিঙোনো যাবেনা

শেষমেষ সেই সবুজ ছোপানো মনে- নীলচে আকাশের রঙ, কুয়াশার শব্দ, তাঁবুর শিরশিরানী মাখামাখি হয়ে সবটা ভীষণ নম্র, মখমলি ও আর্দ্র হয়ে রইল। এবার সময় ফেরার। স্বপ্নমগন’ কি কখনো ডানা মুড়ে বসে থাকতে পারে... স্বপ্নহীন? পারেনা। তাই আগামীর সুর সাধতে-সাধতে সওয়ার হলাম ট্রেনে- নজর ঘরপানে। ফিরছি। ছেড়ে আসা পরিজন, ফেলে আসা কাজপত্র একে একে লাফিয়ে নামছে মনে। হাওয়ায় শুনছি নগরের গান, রোদ্দুরে কার্মিক কারুকাজ।

...............................................................................................................................................................................................................................................

কিভাবে যাবেন- হাওড়া থেকে ভোরের ‘রূপসী বাংলা’ ধরে বালেশ্বর স্টেশন। এখান থেকে ভাড়া গাড়িতে কুলডিহা।
কখন যাবেন- বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে যেকোন সময়ই যাওযা যায়। শীতকালটা আরামপ্রদ হলেও পশুপাখি দেখার জন্য গ্রীষ্মকালই ভাল।
যোগাযোগ- দীপ্তি রাউত- ফোন নং- 0986944354
Agent: মনোরঞ্জন দাস- ফোন নং- 09937332552
কোথায় থাকবেন- কুলডিহা ও যোধাচুয়া ফরেস্ট রেস্ট হাউস। উপরের ফোন নং-এ যোগাযোগ করলে ওরাই ব্যবস্থা করে রাখবে।
........................................................................................................................................................................................................................................................................................

.....................................................................................................................................................
'শুভম সাময়িকী'তে প্রকাশিত আমার একটি লেখা

May 2015
'আপনাতে আপনি বিভোর একলা একাকুলা'
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

একাকুলার কাছিমপিঠ পথ

এই কুলাতে ‘সে’ আছে, আমি, রান্নাঘরে রাঁধুনী আর এক হেল্পার কাম চৌকিদার- ব্যস্। জায়গার নাম একাকুলা। গিয়েছি নদীপথে ভিতরকণিকা ও পরের দিন নিজেকে নিয়ে মশগুল থাকা একলা একাকুলা‘য়। তখন সবে বিকেল পেরচ্ছে- বাংলো সংলগ্ন কনকচাঁপা গাছের তলায় যে রান্নাঘর, তার লাগোয়া উঠোনজুড়ে দেখি হরিণকুলের মেলা- মানুষ দেখেও তিড়িং লাফে পালায় না। রাঁধুনী বলল এমন নাকি এসেই থাকে- রান্না ঘরের বাতিল আনাজ, আলু-মূলোর খোসা, চালধোয়া জল আর ফ্যানের টানে। বাহ্! বাজারহীন, বিদ্যুতবিহীন, বন্যতার বাঁশপাতা আড়াল নেওয়া সমুদ্রযাপনের মাঝে এই হঠাত্ প্রাপ্তি কি আমাদের সত্যি পাওনা ছিল? ছিলনা। তাই আশাতীত উপরীটুকু পেয়ে আমি দিশাহারা। ওদিকে হরিণকুলের কোনো তাপ-উত্তাপ নেই যেন পাড়া বেড়াতে এসেছে- এসেছে নতুন অতিথির খবর নিতে। ‘একাকুলা’র শুরুটাই শুরু হল জগঝম্প বাজিয়ে। সরকারী যে আবাসটিতে উঠেছি, সেও নাম কা ওয়াস্তে ‘গেস্ট হাউস’- আদতে গ্রামের একটি গৃহস্থের বাড়ি যেমন খানিকটা আটপৌরে হয়, খানিকটা দেখনদারির- অনেকটা তেমন। সামনে ছড়ানো উঠোন, কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে গিয়ে উঁচুতে দালান, দু’ধারে দু‘টো ঘর, চওড়া দেওয়াল, দেওয়ালে ঘুলঘুলি, পুরনো দিনের খিলান দেওয়া দরজা- জায়গার সঙ্গে সবটাই বেশ সামঞ্জস্য দিয়ে বাঁধা। শুধু এলাকাটি যে সমুদ্র-পাড়ার তা জানান দিচ্ছে উঠোন জুড়ে বালির পরত, ঝিনুক, মরা হর্স-শু-ক্র্যাবের খোলস। 
হর্স শ্যু ক্র্যাব

এরই সঙ্গে আবার দু-পাঁচ পা দূরে দেখি বালি-বালি মাটিতে একটা পলাশ গাছ হাওয়ায় দুলছে, গাছ জুড়ে দর্পিত ফাগুনের লাল উল্লাস। বিস্ময় আমার বাগ মানছে না, বুঝছি না অনুভূতিকে কি নাম দেব- মুগ্ধতা না বিহ্বলতা। মাটিতেও ছড়িয়ে আছে অনেক। ফুল আর বালি নিয়ে বেশ কিছুটা সময় এখানে গেল- স্বপ্ন-স্বপ্ন সাজানো এমন সুখগুলোকে ছুঁতেই না এ্যাদ্দুর আসা। সন্ধ্যা হতে ভেতরে ঢুকলাম, চৌকিদার লন্ঠন দিয়ে গেল কিন্তু মন ঘরে বসে না। কি তুক্ যে করল একাকুলা... প্রেমিসেস থেকে মোটে বিশ-পঁচিশ পা দূরে রান্নাঘর তবু যাবার যো নেই- আদিগন্ত আঁধার। শেষে টর্চ ভরসায় এগোলাম ও রাম-রাম জপতে-জপতে স্যুট করে সেঁধিয়ে গেলাম ভেতরে। ঢুকতেই রাঁধুনী ইশারায় চুপ থাকতে বলল, নিয়ে গেল খিড়কি দোরের দিকে। ঘরে হ্যাজাক ছিলই, এবার জোরালো টর্চের আলো ফেললাম মাঠে। 15/20 জোড়া চোখের জলানেভা চকমকি বুঝিয়ে দিল তেঁনারা অপেক্ষায়... রাঁধুনীর ফ্যান গালবার সময় হয়েছে। নাঃ, খাবার সময় বিরক্ত করা ঠিক না, আলো নিভিয়ে দিলাম।
একলা একাকুলা

কলকাতা থেকে উড়িষ্যার ভদ্রক স্টেশনে নেমে ভাড়া গাড়ি নিয়ে এসেছি চাঁদবালি। এটাই রুট। এখন ফেব্রুয়ারীর শেষ- ট্যুরিস্ট সিজনও প্রায় শেষ বলা যায়। বুঝতেই পারছি, প্রাইভেট বোটওয়ালারা বেশ মুশকিলে পড়েছে, পাল্লা দিয়ে রেট কমাচ্ছে। একই সঙ্গে নানান আত্মপ্রচার ও  লোভনীয় ছাড়। এর মধ্যেই বেছেবুছে একটির সঙ্গে কথাবার্তা এগোল- ছাড়টি তার লুক্রেটিভ। সবাই যেখানে দু’দিনের হিসেব বোঝাচ্ছে সেখানে সে দিচ্ছে তিনদিনের ট্রিপ। আমরা তিনদিনের প্ল্যান করেই বাড়ি থেকে বেরিয়েছি- দু’দিন হলে বাকী দিন নিয়ে কি করতাম! তাকে বলতে সে এক কথায় রাজী। আসলে ট্যুরিষ্ট প্রায় নেই, এমন কি সরকারী লঞ্চও লোকাল যাত্রী নিয়ে কাছাকাছির দ্বীপগুলোয় ট্রিপ করছে।
ভিতরকণিকার জেটি

আমরা ভুটভুটি ঠিক করেই লোকাল মার্কেট থেকে জল ও খাবার নিতে ছুটলাম আর বোটওয়ালা গেল ডিজেল কিনতে। তিনদিনের বেশীর ভাগটাই এবার জলে-জলে কাটবে। সময় হু-হু এগোচ্ছে, আধঘন্টার মধ্যে আমরা দু’পক্ষই রেডী।  টুবুটুবু ডিজেল ভর্তি জ্যারিকেন উঠল বোটে, অন্যদিকে উঠল মুড়ি-কাঁচালঙ্কা-শশা-চানাচুর। পুরো মার্কেট ঘুরে- ফিরে, ওগুলোই সেরা লাঞ্চ বলে মনে হল। চাঁদবালী থেকে এবার পারমিশন করিয়ে নিয়ে বোটে উঠলাম। মাঝিমাল্লাও কত আপনজনের মত ব্যবহার করছে। পাটাতনের ওপর চাদর বিছিয়ে বিছানা করে দিল, মুখে রোদ না লাগে তার ব্যবস্থায় টাঙিয়ে দিল কাপড়। ঝিপঝিপ করে বোট চালু হল- আমরা যাচ্ছি ভিতরকণিকার দিকে, কখনো শুয়ে কখনো বসে।
জঙ্গলপথ

চাঁদবালিতে যে নদীর নাম ‘ব্রাম্ভণী,’ ভিতরকণিকায় সেই তিনিই ‘বৈতরণী’ যা একাকুলায় নাম নিয়েছে ‘পাঠশালা।‘ ‘ব্রাম্ভণী’ থেকে ‘বৈতরণী’তে পড়ার মুখে তেমন কিছু বদল না ঘটলেও দু’ধারের বালি-বালি মেঠো পাড়ে কখনো সখনো কুমীর দেখতে পাচ্ছি- নিশ্চুপে শুয়ে। আশেপাশে বক উড়ছে, কাদাখোঁচা... তবে একাকুলা যাবার পথে ‘পাঠশালা’ নদী কিন্তু অন্য পড়া পড়িয়েছে- যা অনন্য ও সর্বার্থেই আলাদা। দ্বীপের যত কাছে যাচ্ছি, ততই ইঞ্জিনশক্তিকে হার মানানো জলের উতরোল পৌঁছে যাচ্ছে বুকের গভীরে। দুলুনী বাড়ছে, বোটের জিনিসপত্র এদিক-ওদিক গড়াচ্ছে- বুঝতে পারছি  সমুদ্র কাছেই- কানে ঠেউ ভাঙার ঊচ্ছ্বাস। একসময় হঠাত্ই চোখের ওপর লাফিয়ে নামল সমুদ্র। আর কি আশ্চর্য্য, নদী-সমুদ্রের ডিমার্কেশন লাইন যে নিজেদের অস্তিত্বকে অক্ষুণ্ণ রেখেও এ’ভাবে মিলতে পারে তার নমুনা সেট করে চলেছে সারাক্ষণ-  খুশদিল বইছে- আমি মাতোয়ারা।
অস্তরাগে একা

প্রথমদিন ভিতরকণিকায় থেকে আমরা দ্বিতীয়দিন গেলাম একাকুলায়, নদী-সমুদ্রের মোহনায়। আছোঁয়া সারল্যের অনুরাগ মেখে একাকুলা-র সমুদ্রতট সারাক্ষণ উছলাচ্ছে অথচ একই সময় উল্টোদিকে নদীর বুকে তার অন্য খেলা- জোয়ার-ভাঁটার। অর্থাত নদীতে জোয়ার এলে ও সেই জোয়ারে পানসী ভাসলে তবেই ফেরার কথা ভাবা যাবে- নয়তো চাতকের মত থাকো বসে ফটিকজল চেয়ে। অবশ্য দিনে জোয়ার একবার আসবেই। আমি আসলে একাকুলার ইচ্ছাধীনাই হতে চেয়েছিলাম। সব জায়গায় জোর চলেনা, কোথাও তো সমর্পণের শান্তিটুকু থাক্। প্রকৃতিলীন হবার কিছু শর্ত আছে- তাকে মানতে হয়। আর মেনেছি বলেই জেনেছিএকাকুলা জীবন্ত এক প্রাণ... অন্তরে তার অপর্যাপ্ত কথা!
একাকুলা

বাংলোর উঠোন জুড়ে যে মরা হর্স-শু-ক্র্যাবের মেলা তা এত জীবন্ত ও ঝকঝকে যে কুড়িয়ে এনে ধুয়ে-মুছে রোদে দিয়েছি। প্রকৃতির আপনপুরের উপহার নিয়ে যাব কলকাতায়। কিন্তু ‘সে’ বিব্রত ও অসহযোগের বাধাদানে-
- কি হবে এসব?
- চিন্তা কোরনা,  ঠিক গুছিয়ে নেব...
- নেবে কিসে? বিশ্রী গন্ধ,
- কই, আতর দিয়েছি যে...
- এজন্যই। পচা মাংস, সঙ্গে আতর... বমি আসছে।
- এখানে না থাকলেই হয়...
- কোথায় যাব?
- ক-ত... তাকিয়ে দেখ ঠিক পাবে।
- ও, তুমি পাচ্ছ বুঝি!!!
- খুউব...
- বেশ।
গাল ফুলিয়ে দুমদুমিয়ে সে ঘরে ঢুকল আর আমি বাঁধন-ছুট হতেই ছুটলাম মোহনার দিকে। আহা, একেক সময়ের ঝগড়া স্পেস-কে যে কি মহার্ঘ্যতা দেয়। অন্ততঃ ঘন্টা দুয়েক এখন বাকবন্দী খেলা। একফালি অভিমানের ফাঁকে আমার সময় ছিল অপেক্ষায়- হাত ধরে তার চললাম। গোটা দ্বীপটায় সাকুল্যে আছি নজন। আমরা দুই, এক চৌকিদার, এক রাঁধুনী, দুই অরণ্যকর্মী আর খাঁড়িতে তিনটি মাঝিমাল্লা নিয়ে আমাদের ভুটভুটিটি- ব্যস, মনুষ্য-গপ্প শেষ।
'নিত্য তোমার যে ফুল ফোটে ফুলবনে'
  
হাঁটতে শুরু করলেও আমার গতি মন্থর, ভিজে বালি ঠেলে এগোনো দুষ্কর। তবু পৌঁছলাম কাছিমের পিঠের মতন উপুড় পড়ে থাকা উঁচু একটা জায়গায়, যার দুপাশে ছলাত্ছল জল- একদিকে যার সমুদ্র অন্যদিকে নদী। উঁচু পথের দুধারে ঝাউগাছ, বিছিয়ে আছে শুকনো আমলকী, পায়ে জড়াচ্ছে বুনোলতা। তীব্র বাতাসে গাছপালা এলোপাথারী দুলছে। কেননা হাওয়া সামলাবার এককুচি আড়াল নেই, সারাক্ষণ কাটাকুটি খেলা। নদী-সমুদ্রের এই বিভাজন রেখায় দাঁড়িয়ে দেখছি দুধারের জলের রঙের স্পষ্ট ফারাক। তারতম্যও কত মধুর হতে পারে, তার ছবি আছে একাকুলার কাছে। আমার পড়া এমন প্রকৃতিপাঠ এই প্রথম। যেন জীবনানন্দের কবিতা- আধুনিক, আগ্রাসী, জারুল-হিজল-লহনার শব্দ দিয়ে আঁকা।
একাকুলার জেটি। দূরে টুলটুল দুলছে আমাদের নৌকা

বেশ কিছুটা এগোনোর পর সমুদ্র-দিকের ঢালে নামলাম। অদূরেই দ্বীপগহিরমাতা। অলিভ-রিডলে কচ্ছপ যেমন ডিম পাড়তে গহিরমাতায় আসে, তেমনি আসে একাকুলায়- বীচময় ছড়িয়ে তার একশো নমুনা। মরা কচ্ছপের রোদ-পোড়া-গন্ধ, সমুদ্রের গর্জন আর নিঃসঙ্গ চরাচরে হাঁটতে থাকা একটাই মনুষ্যপ্রাণ আমি, ওদিকে মাথার ওপর শ্রিল চীত্কারে চিলের চংক্রমণ। ভয় পেয়ে গেলাম, ছুটতে-ছুটতে নিজেরই পদচিহ্ণে পা ফেলে- ফেলে ফিরে এলাম কাছিম-পিঠ পথে।এবার এক্সপ্লোরেশন ঢালের অন্যদিকে- ম্যানগ্রোভের জঙ্গল। কিন্তু বাধা এখানেও। সমুদ্রের দিকটায় বালি ছিল আর এদিকে এঁটেল মাটি। কাদাজলে পা ডুবছে, ডেঁয়ো-পিঁপড়ের মত কুড়কুড় করে ছুটছে লক্ষ লাল কাঁকড়া। জলাসংলগ্ন গাছের নীচু ডালে হঠাত্ই দেখি ছোট্ট এক কচ্ছপ ঘাড় উঁচিয়ে বসে- আমার নজর যেতেই শরীরটা ছেড়ে দিল আর টুপ করে গড়িয়ে গেল জলে। মাটি ফুঁড়ে উঠেছে সুন্দরী গাছের শিকড়- নাড়ির অদৃশ্য বাঁধনের মত পায়ে জড়িয়ে ধরছে আর সরতে চাইলেই ডাকছে ‘আয়-আয়
অলিভ রিডলে টার্টলের ছানা

মোহগ্রস্থ চলেছি আমি স্বপ্নসম্ভবের পথে। কঁ-কঁ করে হঠাতই একটা বনমোরগ সামনে দিয়ে দৌড়ে চলে গেল। কখন কি হবে কিচ্ছু জানা নেই- এই এলাকা এমনই আচমকা। চারিদিকে ছড়ানো স্টার ফিস, ঝিনুক ছাড়াও কত অজানা জীবিত-মৃত প্রাণ। হাত ভরে তার কিছু কুড়িয়েছি- এবার ফিরতে হবে। কিন্তু মুস্কিল- বেরনো যাচ্ছেনা। পায়ের গোছ অবধি বসে যাচ্ছে কাদায়, গাছপালার ঘনত্ব বেড়ে আকাশ আড়ালে, মনুষ্য স্পর্শবিহীন প্রকৃতি যেতে নাহি দিব’ বলে ক্রমশঃ আঁকড়ে নিচ্ছে পা। এমনই বিপদকালে মন-অগোচরে সে। কুড়োনো সম্পদ তখনই ভার লাগল। সব ছুঁড়ে ফেলে হাতদুটো ফ্রী করে নিলাম, তারপর গাছের ডাল পুঁতে-পুঁতে মাটির ভার গ্রহণের ক্ষমতা বুঝে এগোতে থাকলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর নজরে এল ডানদিকে বাঁশের সাঁকো- চিনতে পারলাম, এপথেই একাকুলায় এসেছি। সাঁকোর শেষমুড়োয় দেখি ভুটভুটিটি টুলটুল দুলছে, মাঝিমাল্লারা ব্যস্ত কিছুর গবেষণায়। মনে প্রশান্তি সবে বসব-বসব করছে ঠিক তখনই ওদের ইশারায় জলে তাকিয়ে থমকে গেলাম- যে পথ ধরে এসেছি, ঠিক সেদিকেই নদীর ধার ঘেঁষে একটা কুমীর ভেসে আছে। শুনলাম একটা বক ধরতে ঝাঁপিয়েছিল, কিন্তু ইঞ্চি তিনেকের মিস্ ক্যালকুলেশনে ব্যর্থ হয়েছে বেচারী। আপাত নিস্পৃহতা নিয়ে তিনি এখন ধ্যানীর মগ্নতায়। 
একাকুলার অন্যতম বাসিন্দা

এবার স্পষ্ট হল সবটা। এতক্ষণ যে লতাপাতা আমায় আঁকড়ে ধরছিল, কাদামাটিতে গেঁথে নিচ্ছিল পা- তার উত্তর পেলাম মূহুর্তে। সুমঙ্গলা প্রকৃতি আসলে আগলাচ্ছিল আমায়, নাড়িতে তাঁর টান পড়ছিল শিকড় উপড়ে যাওয়ার। বেশ বুঝেছি, ডালবাকলের আঁকশী ছিল তাঁর বাড়ানো হাত- আর কাদার আঁচলে রাখা ছিল আশীর্বাদ। আমি বোকা- মাকেই কিনা সন্দেহের...

পিছু ফিরে জঙ্গলে চাইলাম, কৃতজ্ঞতার জলে ভরে উঠল চোখ। এবার আমি বাংলোর দিকে। কিজানি, এখনো ‘সে’ ঘরে না আমার খোঁজে বেরিয়ে পড়েছে! এপথে নয়তো? সতর্ক করা দরকার- তাড়াতাড়ি পা চালালাম।
ভান এমন... যেন মৃত

.........................................................................................................................................................................................................................
*কিভাবে যাবেন- উড়িষ্যার ভদ্রক স্টেশনে নেমে বাস বা রিজার্ভ গাড়িতে চাঁদবালী সেখান থেকে জলপথে ভুটভুটি করে প্রথমে ডাংমল 2 ঘন্টায় তারপর ডাংমল থেকে একাকুলা 4 ঘন্টা। এছাড়া ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট থেকে যে 3 ধরণের বোট পাওয়া যায় তার ক্যাপাসিটি 30 জন/15 জন/5 জন ও খরচ যথাক্রমে মাথাপিছুRs.1500/-,1000/-,700/- ফুয়েল ছাড়া। ইদানীং একাকুলায় অরণ্য-নিবাস ছাড়াও সরকার থেকে কিছু টেন্টের ব্যবস্থা হয়েছে ও এলাকা সবার জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। বুকিং-এর জন্য যোগাযোগ- Divisional Forest Officer,  Mangrove Forest Division Rajnagar, Dist: Kendrapada, PIN:754225, Ph (06729) 272460, Fax: 91-6729-272464 Or Asst. conservator of Forests, Chandbali, PIN 756133 Ph. (06786) 220372 ডাংমল, গুপ্তি, হাবালিকাঠি বা ভিতরকণিকা স্যাঙ্কচুয়ারির বুকিংও এখান থেকেই দেওয়া হয়। 
............................................................................................................
'মনমোহিনী সৌলা, মনভূমে তুই রইলা'
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

2015 ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় 'দু-কূল'-এ প্রকাশিত লেখা। 28.02.15



আকাশে মেঘছেঁড়া ফুটি ফুটি আলো, সৌলা আড়মোড়া ভেঙে দূর সমুদ্রের ধোঁয়া-ধোঁয়া ছায়া দ্যাখে কুয়াশার। সূর্য্য উঠতেই ঘোমটা ফেলে চোখ তুলে সে তাকিয়েছে যেই আমি চমকে গেছি। সারি দিয়ে চলা লাল কাঁকড়ার সারি, লাখে-হাজারে ঝিনুক, চলন্ত তারামাছ আর ভরন্ত ঠেউ-এর দোলায় দুলছে চুমকী জ্বলা আগুন ফেনার রাশি।

কিন্তু এসবে আসব পরে, যেখান দিয়ে ছাড়া সৌলা যাওযা যাবেনা আগে সেটায় আসি। বাঙালীর চির পরিচিত দী-পু-দা মানে দীঘা, পুরী, দার্জিলিং-এর মধ্যে কবে যেন স্যুট করে সেঁধিয়ে গেল... না, বলা যাবেনানাম শুনে যদি অনিচ্ছে রোগে ধরে! সাদা-রঙের বাইরের পৃথিবীকে দেখতে চাই বলেই ভিতর-রঙের ডেট এক্সপায়ার হতে দিইনি- তাই খুঁজে পেয়েছি সৌলা। তবু প্রাথমিকভাবে ইচ্ছে ছিলনা যাবার। এত চেনা জায়গা মাড়িয়ে যেতে হবে... সত্যি যদি পাড়ার দীপুদা ডেকে ওঠে- মঞ্জু--- তখন? যে নাগরিক পরিচয় খুলে রাখতে চাই বলে পালাই সেখানেও দীপুদা? অথচ নাম ধ্বনিতে জায়গাটি এত মোহময়ী যে এড়ানো মুশকিল। অতঃপর ইচ্ছে অনিচ্ছেকে নিয়ে টস্ করলাম। মোহময়ীর আদ্যাক্ষরকে দী-পু-দা-র ফ্রেমে ফেলে খুঁজতে থাকলাম পরিচিত নাম। কি আছে, মিলে গেলে যাবোনা।  প্লেসড হল- দী-পু--দা, পু--দী-দা বা -দী-পু-দা হয়ে। নাঃ চেনা নাম নেই, এমন কি কোন নামও তৈরী হলনা। মন বললো এটাই নির্দেশ, কোনো পরিচয় কাঁটায় বিঁধবে না তোর উধাও হবার ইচ্ছে। সুতরাং...

 এই তো বোঝা গেছে আমি মন্দারমণি মাড়িয়ে সৌলা যাচ্ছি। এখনো অধরা এ রূপোময়ী যে সারল্যে আছে- তাকে এড়ানো কঠিন। তাবলে যে গেছে সেই জানে এ’ব্যাপার তা নয়। বরং যে গেছে তার দুর্গার মত তৃতীয় নয়ন ছিল, রূপের খনি খোঁজার ইচ্ছে ছিল আর ছিল ইতিবাচক মেদুর ভিজে মন- তবেই। অভিমানী কিনা... সেজেগুজে তার বসে থাকতে বয়েই গেছে। সবাই আসবে, চোখের কোণে চাইবে আর খেলা শেষে বালিতে বানানো ঘর ভেঙে অন্য ঠিকানায় উঠবে... না, এ হতে দেবেনা সে। তার ভূষণহীন আরণ্যক অবস্থিতি সম্মান দাবী করে। তবে এই মন্দারমণি আর বেশীদিন অধরা নয়। নাগরিক পাঠশালায় পড়তে পাঠিয়ে তাকে শীলিত করার ব্যবস্থা চলেছে।

ছুটি পেয়েছি দুদিনের তাই যাচ্ছি। এ্যালার্ম ক্লকে ভোর চারটের চীত্কার রেখে শুতে গেলামপরদিন হাঁপাতে-হাঁপাতে ধর্মতলা- দীঘার বাস সাড়ে পাঁচটায়। তখন হাল্কা শীতের আমেজ, মার্চের প্রথম সপ্তার প্রথম শনিবার। বেলা বাড়তেই রোদে চোখ কুঁচকানো ভুরু ব্যাথা করা তাপ। অথচ দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরোতেই থৈ-থৈ কুয়াশায় গাড়ীর দৃষ্টি গেল আটকে। সামনের উইন্ডশিল্ড আবছায়ায়- গতি কম নিয়েও ছুটছে। ফগ লাইট জ্বেলে, ইলেক্ট্রনিক হর্ন চেপে ধরে ড্রাইভারের আত্মবিশ্বাসী ড্রাইভিং ঠিক ঘন্টা চারেকে পৌঁছে দিল চাউলখোলা- দীঘার তিরিশ কিলোমিটার আগে। ব্যস, নেমে পড়লাম ব্যাগপত্র ও মনের উড়নতুবড়ি চুলবুলী নিয়ে। কিন্তু জায়গাটা দেখি নেহাত্ই বেরসিক এক বাণিজ্যপুর। এইদিকে তেলেভাজা ওইদিকে কয়লার গুদাম অন্যদিকে স্টেশনারী শপ, লিকার বার... মোটকথা হাবিজাবি দিশপাশে খাবি খাওয়া দশা। প্রায় সাথে-সাথেই সমুন্দুর-সমুন্দুর-সীবীচ-সীবীচ চিল্লিয়ে হাজির হল যত হাড় জিরজিরে মোটরভ্যান, কেঁদো কোয়ালিস, গেরস্থপোষ্য এ্যামবাসাডার থেকে স্লিম মারুতির চালক দল। তাদের অভিজ্ঞ চোখ আমাদের পাঁচন গেলা মুখোচ্ছবির ভাষা পড়ল আর মূহুর্তে অভয় দিল- এইখান দেইখ্যা দিদি ওইহানের কদাডা ভাইব্যান না। একবার তো পৌঁসান, দ্যাখবাননে মজাডা... মেলা-মেলা।  


মজা মেলা ছিল কিনা জানিনা- তবে ঝাউপাতা, বালিপথ, গ্রাম্য দিশপাশ এখনো সরলতা ছিঁড়ে নাগরিক তামারং মাখেনি মুখে। আলগা চটক তার শরীর জুড়ে ঠেউএর মতন অবিরাম। তার বালিয়ারী, তার বাইশ কিলোমিটার বিস্তৃত বীচ, এলাকার মানুষজনের আপনপুরকে অবুঝ চোখে দেখা, দাম বুঝতে না পারা জায়গায় হেলাফেলার মুক্ত ক্রিয়াকাজ, শক্তপোক্ত বীচ-এর ওপর দিয়ে হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলা গাড়িমন্দারমণির সবটাই অন্য। সবটাই নম্র একদিকে অন্যদিকে কঠিন। সবটাই যেন কোলে তোলার ও দূরে ঠেলার মিশেল দিয়ে তৈরী এক অপাপবিদ্ধ ঢঙ্। এ ঢঙের সঙ্গে সোফাতে নয়, পাটী পেতে বসে মুড়ি কাঁচালঙ্কা ভাঁড়ের চায়ে অফুরান আড্ডার ধারাপাতে কেটে যাবে রোদালো বেলা। ইচ্ছে করে উধাও হতে একা, ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে দূরে যেখানে মোহনায় নদী, নদীতে মাঝির খেয়া বাওয়া, মোটরভ্যানের ঝিমঝিম শব্দে চালক বৌ-এর খড়কুটোর দরজা ঠেলে লাজুক চোখের চাওয়া।


হোটেলগুলো কিন্তু সাজসজ্জা বৈভবে একে অন্যে টেক্কা দিচ্ছে। তকতকে, ঝাঁ-চকচকে বিলাসী- পরিপাটী। সমুদ্রস্নানের পর গা-কিড়কিড় বালী মুছে তনদুরস্ত হতে কোথাও বাথটাব, হাজারো ফিটিংস, বাহুল্যযুক্ত সাওয়ার, কোথাও আধুনিক জাকু্Zী টাবের গোপন আলাপন। কী নামে ডাকবো তোকে, দেখবো কী চোখে, কোন পরিচয়ে সাজতে ভালবাসলি তুই- মন্দারমণি? শ্যাওড়া গাছের পেত্নীরাণী বেনারসী পরেছিস না রূপসী ললনা তুই ছেঁড়া শাড়ীতেও উন্মুখ? জানিনা কোন উপমাটা ঠিকঠাক। তবে কামনার আগুন যেভাবে সাজিয়ে বসে আছিস তাতে পতঙ্গ হয়ে পুড়েছি আমি- পুড়বে আরো ঢের। তোকে ঘিরে সূর্যোদয়, সুর্য্যাস্ত, শনশন হাওয়া, ঝিনুক আর ঝাউবন বন্দনা গানে মাতাল। এ টান এড়ানো যায়না। যে গান গাইছিস্, সে সুর হ্যামলীনের বাঁশীওয়ালার কাছে শিখেছিস তাই মোহময়। দূরে ভেসে চলা ট্রলারের টিমটিমে আলোয় ঝাঁপানের ডাক, আরতির ঘন্টা বাজছে সন্ধ্যা নামলো যেই।

এত সৌখিনতা স্বত্ত্বেও ওখানে কারেন্ট নেই বলেই সন্ধ্যা নামতেই হোটেলে-হোটেলে জেনারেটরের গুঞ্জন। ঐ যে বললাম- এখানের সবটাই নম্র একদিকে তো অন্যদিকে কঠিন অপরিচয়। এই অপরিচয়কে, এই অচেনা কাঠিন্যকে মন্দারমণি ধীরে সরানোর চেষ্টায়। জানিনা তখনো এত মাধুরী থাকবে কিনা, তবে নিট্-ক্লিন-মেদহীনতা আরেক রকম রূপকথা শোনায়। আমার মত আবেগ চাপ বইতে-বইতে অম্বুলে পর্যটকই শুধু নয়- আছে চাঁদির নিক্তিতে সবকিছু মেপে সোহাগ করারও পাবলিক। তাদের জন্য কিছু রেখে-ঢেকে, একটুও না সেজে তুই দাঁড়াস যদি মন্দারমণি, তবে এটা জানি- আমি, সে ও সখা সব্বাইকে তুই খুশী দিবি। এই বসন্তেই বিদ্যুত দফতর সবুজ সিগন্যাল দিয়েছে, বীচের ওপর ইলেকট্রিকের খুঁটি পোঁতা সারা। বছর ঘোরার আগেই বাজবে আলোর দামামা। অন্ধকারে যে বীচ ছিল ভয়ে হাঁটার, তাতে বন্ধ হবে গাড়ীর চলাচল। মন্দারমণির সমস্ত মেঠো রাস্তা এবার কংক্রিটের চাদরে ঢাকা পড়ল বলে।


বীচের ওপর যেখানে হোটেল বা রিসোর্টের কেতা শেষ, সেখান থেকে শুরু হয়েছে স্থানীয় মানুষের ছেঁচাবেড়ার ঘর। সেখানে ওরা লোকশিল্পের নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে। এই চেষ্টার আন্তরিকতা খুব- সামর্থ্য কম। কোথাও কড়ির হার-দুল-বাজু, কোথাও মুক্তোর পসরা, দড়ির চটি, আয়না ঘিরে ঝিনুক গেঁথে ওয়াল হ্যাঙ্গিং, পর্দা, এ্যাসট্রে, শঙ্খ, এমন কী কাঁকড়ার খোলা দিয়েও ঘর-সাজানোর জিনিস। এখানকার এই সবকিছু দী-পু-দা তেও মেলে কিন্তু চিলতে হাসির ফাঁকে তা লুকনো ব্যাথার মত্। মনোযোগ তো কাড়েই না উপরন্তু বীচ জুড়ে রোলের দোকান, ফুচকা, ঝালমুড়ির বাড়বাড়ন্ত বিরক্তি তৈরী করে। যেন বেলাভূমি নয়, চড়েছি লোকাল ট্রেনে- ফেরি হচ্ছে সস্তার টিপ-চিরুণী-নরুণ- লেলে ছেআনা, ছেআনা, ছেআনা... ঐ দৈনতার পাশে মন্দারমণির বীচকে রেখে বুঝলাম ছেঁচাবেড়ার এই দোকানগুলো আছে বলেই মন্দারমণি ঊজ্জ্বল। একে প্রাকৃতিক ও গ্রামীন সৌকর্য্যের মিলিত উদ্ভাস বলা যায় অথবা কাব্য।


মন্দারমণি পৌঁছেই আমরা জলে নামলাম। তখন জোয়ার, ঠেউ-এর পিঠে ঠেউ। বড় ঠেউ এলে বসে যাচ্ছি আর ছোট ঠেউ নিয়ে চলেছে খুনসুটী। এসবে বেলা গেল, দুপুরের খাওয়া সেরে এবার হোটেলেরই আনাচ-কানাচে ঘুরে, ঝুপড়ীর ঝিনুক-মুক্তো কিনে বিকেলে গেলাম মোহনার দিকে। সেই ডিজেলচালিত মোটরভ্যান, সেই বীচের ওপর দিয়ে বাঁয়ে সমুদ্র ডানদিকে হোটেল-দোকান ফেলে এগোনো। বাইশ কি.মি বীচের ঠিক মাঝেখানের হোটেলে ছিলাম বলে আমাদের জার্নি ছিল এগারো কি.মি-এর আধখানায়। যেতে-যেতে দৃষ্টিসীমার দূরে সরে গেল হোটেল-দোকান-রঙমহল- এবার নিবিড় প্রকৃতি, উল্টে থাকা ডিঙি নৌকা, নীলচে জাল ও ঝাউবনের সঙ্গ। এও শেষ হল, এসে পৌঁছলাম নীল সমুদ্র আর অস্ত সূর্য্যে রাঙা নদীর মোহনায়্। ফুরফুরে হাওয়ায় জলে হাল্কা কাঁপন, অতি স্নিগ্ধ ঠেউ। প্রকৃতির এই অসামান্যতা এত প্রভাবী যে ব্যাখাতীত বেদনার মত বেজেছে, বর্ণনা তাই সম্ভব হল না- মন ঈশ্বরে গেল। এ অনুভবে যেতে গেলে আসতেই হবে এখানে।

নদীতে বহমানতা থাকলেও কোথাও কাদাজল কোথায় শুকনো-শুন্য ঢিবি। ছেঁড়া-ছেঁড়া সেই কিছু জল আর ভাঙা-ডাঙা দূরের দ্বীপ দেখিয়ে ভ্যানওয়ালা বলল-
- হোইডা তাজপুর গ দিদি। যাতি হলে কাল সকাল-সকাল আইসো, লৌকা পারাইয়া দেইখ্যা আসবা।
 হাঁকপাঁক করে বলি-
- তা কাল কেন? আজই দেখ না, ঐ তো নৌকা যায়।
- নাই গ... বোঝো না কেনে। নৌগাডা হুইপাড়ে বান্ধা- জলের কাঁপনে দুলতিসে। তাশাড়া অহন ভাঁটা...
- কিন্তু তুমি যে বললে কাল সৌলা নিয়ে যাবে?
- হেইডা বাসনা অইলে যাইয়ো। আসলে উদিকে কাদা আর কাঁকড়া ছাড়া জেইল্যা ছাওলের ঝাউ-ছাউনীর ঘর। হুটেল-উটেল নাই দেইখ্যা মানষে যাতি চায় না। আর হুইপারে যে তাজপুর, হোথায় সব্বস্ব আচে গ দিদি। একখান কী সোন্দর হুটেল হইছে। উআরা খেলার মাঠ বানায়ে দিছে, সিলিপ. খাবার দু’কান... মানষে জলে নাইম্যাও কিসব নিয়া খেলে গ।


আমি বললাম- ভাল তো, তবু সৌলাই যাব।
পরদিন ভোর হতেই ভ্যানওয়ালা হাজির। আমরা চললাম বাকী এগারো কিলোমিটার দূরের অন্যদিকের মোহনায়। এ পথে গাড়ির যাওয়া-আসা নেই, মোটরভ্যানও নয়- তাই পথ চলার শুরু থেকেই সবটা অনাঘ্রাত সৌরভের মত। দী-পু-দার রোল-চাউমিনময় পরিবেশ দেখেও যাদের প্রীতি কমেনি বরং বেড়েছে, তাদের ওপথ ভাললাগার নয়। এমনিতেও কেউ আসেনা। পূর্বদিকে সূর্য্য ওঠার তোড়জোড় চলেছে আর আমরা আলো-আঁধারী ডিঙিয়ে ভিজে বালী মাড়িয়ে, মোটরভ্যানের বসে যেতে চাওয়া চাকাকে ইঞ্জিন শক্তিতে এড়িয়ে- পৌঁছে গেলাম সৌলা। এখানকার বর্ণনা কীভাবে দেব জানিনা- এই অপরূপকে বাক্যে বাঁধা আমার সাধ্যের অতীত। যতদূর চোখ যায় শুধু ঝিনুক আর কাঁকড়া। নদী, নৌকা, কুয়াশা, সূর্য্য সব মিলিয়ে আমরা স্পষ্টতঃই স্তব্ধবাক। ঝিনুকের পরিমাণ এত বিপুল যে বালীতে দুহাতের বেড় ছোট করে আনতে থাকলে কম করেও দেড়শো ঝিনুক আঁটছে। বেশীরভাগই জ্যান্ত ও আনকমন। এই বাহুল্য অস্বস্তিদায়ক ও বাহারকে বিপদে বদলাচ্ছে। কেননা হাঁটা-চলা দায়, কখন যে পা কাটে। ললনার কালো চুলে একটি-দুটি তারাফুলে যে রূপ ফোটে সেই বাহার কি চুল ঢেকে দেওয়া লক্ষ ফুলে ফোটে? লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য বড় হয়ে উঠে ম্যাসাকার কান্ড। তবে স্বস্তির কথা এই যে একটু বেলা বাড়তেই দু-পাঁচজন জেলে-জেলেনী এল ও নদীতে জাল ফেলার পাশাপাশি ঝিনুক কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে থাকল। জিজ্ঞেস করলাম-   
সব দিয়ে কি হবে গো?
- ব্যাচবো।
- কোথায়?
হাটে।
কবে হাটবার?
- বুধবার।
ইস্, এটাও একটা মিস্, আমরা তার আগেই ফিরব।

ওদিকে কাছে-দুরে লক্ষ-কোটি কাঁকড়া দৌড়ে চলেছে, কেউ গর্তে নয়- সব পাড়ি দিচ্ছে সমুদ্রে। এ এক অভুতপূর্ব দৃশ্য। সোনালী বালী, কাঁকড়া আর তাদের গতির মিলমিশে বালিয়ারীর রং গোলাপী। অথচ আলস্য মেখে কাঁকড়াকুল যেখানে রোদে বসে সেখানটা কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ছড়ানো লাগছে- বেলাভুমির আদি-অন্ত একবারে লালে লাল। এক ঝিনুককুড়ুনীকে বললাম-
- কাঁকড়াগুলো ধরছো না যে... 
নাই গ।
কেন?
কংকডাগুলান সমুনদ্দুরের শভা।
তা শোভা তো আরো অনেক কিছুই, সেগুলো যে ধরো।
তি পারবো না দিদি। সেই ছুট থিকা শুইন্যা আলাম, বাপ-দাদারা কলো... তাই তোমারেও কলাম।
কি সুন্দর বিশ্বাসের সমর্পণ। তারা যা শিখিয়েছে সেই মত প্রজন্ম চলছে বলেই না ভারসাম্য প্রকৃতিতে। কাঁকড়ারা কেন নির্ভয় তার আন্দাজ পেলাম। জেলেরা এলে-গেলেও তাদের সঙ্গে বিরোধের আভাসমাত্র নেই- যে যার কাজে ব্যস্ত। শেখবার মত সহাবস্থানে প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণী। কাঁকড়ার লালাভ মিছিল শুধু চোখ চেয়ে দেখবার, ব্যাখ্যা করে সে সৌন্দর্যের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা বাতুলতা। গায়ে-গায়ে জড়ামড়ি ঝিনুক, কড়ি, অগোছালো ঝাউবন, নদীতে বয়ে চলা খেয়া-নৌক- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি‍! তখন জোয়ার আসছে- ধীরে হাওয়া বইতে শুরু করল, তিরতিরে ঠেউ জানান দিচ্ছে জল বাড়ছে, জেলেনীরা গেল। সৌলাভূমির রূপে মজে আমরা শৈশবে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কাদা-বালী মেখে, ভিডিওতে ছবি তুলে সময়ের হিসেবে দেখি বেলা বেশ। মোটরভ্যানের সওয়ার হলাম ও চেনা চৌহদ্দির হোটেলপুরে ফিরে এলাম। 


এখানে স্থানীয় মানুষজনের গরিব অবস্থাকে ব্যবসায়ীরা অনুকম্পার মুল্যে কিনেছে। শুধু তাই নয়, জায়গার সম্ভাব্য পরিণতি চিনিয়েছে টাকার রঙে। তাদের চাষের জমি ছিল বীচের ওপর- এখন হোটেল। অবশ্য স্মৃতি ছুঁয়ে থাকা বিঘেখানেক জায়গাও কিছু নজরে এল যেখানে সব্জি চারা, লাউমাচা বা কাকতাড়ুয়ায় মিলে বিপ্লবী সবুজ ক্ষেত। তবে নগরায়নের যে ব্যস্ততা দেখলামগরবিনীর সবুজ চোখে সুর্মা পড়ল বলে। যেমন জোয়ার এলে জলে যখন বীচ টইটুম্বুর, সারি-সারি হোটেলের কোল দিয়ে তখন না চলতে পারে ভ্যান, না গাড়ী, না মোটরবাইক। ইতিমধ্যে পর্যটক এসে পড়ল তো সর্বনাশের মাথায় পা। থাকো বসে দু/তিন ঘন্টা... ভাঁটার টানে জল নামুক, তবে যাত্রার কথা ভাবা। ওদিকে মাথার ওপর তখন হয়তো চাঁদিফাটা রোদ্দুর কিংবা ক্ষুধায় কাতর প্রাণ। একদিকে হোটেলমালিক রেঁধেবেড়ে হাত বাড়িয়ে বসে, অন্যদিকে পর্যটকের সঙ্গে সমুদ্র খেলাধূলার ডাক পাঠাচ্ছে। কী জ্বালা, তারই কাছে এসে কিনা জব্দ তারই হাতে! এ’ ভারী সৃষ্টিশীল গল্প, একেবারে মন্দারমণির নিজস্ব। এই জলখেলা থেকে অসহায় (?কে বাঁচাতে এখন ব্যবসায়ীকুল উঠেপড়ে লেগেছে, অন্যপথে পৌঁছনোর ব্যবস্থা সারা। বছরখানেকের মধ্যেই বীচের ওপর দিয়ে গাড়ীকুলের যাত্রা থামবে। স্বার্থবুদ্ধির থেকে একটা ভাল কাজ যেমন হল, তেমনি খোয়া যেতে বসেছে এর নিজস্বতা। যাক্ গে, হয়তো ভালই হল। যদিও জোয়ার-ভাঁটার এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা আমার কাছে হীরের মত দামী হয়ে আছে।


কাঁকড়াখনি সৌলা, মনভূমে তুই রইলা। স্বপ্নে হলুদবালী, ধুধু দিগন্তে সূর্য়ের ঘুম ভাঙা, খাড়া সাদা চোখে লাল কাঁকড়ার রোদরঙে লুটোপুটি আর অপর্যাপ্ত ঝিনুক- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! এই দুদিনের প্রাপ্তি আমায় দশ বছরের অনেক কান্না মোছাল- অনেক অপ্রাপ্তি ভুলিয়ে। এই আবেশ তাই অশেষ, এই ভাল লাগা অনিঃশেষ।      
............................................................................................................................

কীভাবে যাবেন- ধর্মতলা থেকে দীঘাগামী যেকোনো বাসে নামতে হবে চাউলখোলা, সেখান থেকে ভ্যানরিক্সা বা গাড়িতে মন্দারমণি। কোথায় থাকবেন-পান্থতীর্থ 91635-18060, 0322-0234418 ছাড়া সমুদ্রপাড়ে অজস্র হোটেল আছে। গাড়ির জন্য যোগাযোগ- বিশু- 9933941436, 9564236399  কীভাবে বেড়াবেন- ভ্যানরিক্সায় করে বীচের ওপর দিয়ে একদিকে তাজপুর মোহনা ও অন্যদিকের মোহনা সৌলা যাওয়া যায়, যেখানে কাঁকড়ার প্রাচুর্য্যে বালিয়ারীর রঙ কখনও গোলাপী কখনও লাল।
‘দুকূল’ এ্যামেরিকা থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য পত্রিকা। আজ 28.02.15-য় একটি কমপ্লিমেন্টারি কপি (ফেব্রুয়ারী সংখ্যা) পেলাম। আক্ষরিক অর্থেই এটি দু-কূল মানে প্ররাচ্যে ও প্রতীচ্যের লেখকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়।
............................................................................................................

আজ 26-শে জানুয়ারী 2013-এর আনন্দবাজারের ওয়ানস্টপ ক্ল্যাসিফায়েডে 'বেড়ানো' বিভাগে প্রকাশিত আমার লেখা
'নাচিছে তা থৈ-থৈ ঐ মহাকাল'
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

                                                                মাছ ধরছেন মেছো


গিয়েছিলাম জয়ন্তীর জলজঙ্গল ও মহাকালের পাহাড়চূড়ায়- গেল বছর হেমন্তে। ডুয়ার্সের এই এলাকা পুরোপুরি আলাদা। প্রথমদিন গাড়ি নিয়ে বনবাদাড় চষে ফেলে স্থির করলাম পরদিন যাবো মহাকাল। কিন্তু এবারেই গন্ডগোল। সবাই বলল- এক্সপিরিয়েন্স না থাকলে যাওয়া ঠিক হবেনা। কিন্তু এক্সপিরিয়েন্সটা কিসের তা বুঝতে গেলে তো যেতে হয়। পাহাড়-চূড়ায় মহাকালের অধিষ্ঠান অথচ সে রূপ স্থানীয়রা বোঝাতে পারেনা। শুধু মহাকাল শুনে নাকের পাটা ফোলানো ওদের বিস্ফারিত দৃষ্টিটুকু ছুঁতে পারি আর প্লাবনের মত তাগিদ অনুভব করি ভিতরে। সুতরাং...
                       মহাকষ্টে মহাকালে

সুতরাং পরদিন বেরতেই হল। সকাল নটায় গাড়ি নামিয়ে দিল রুখাশুখা জয়ন্তী নদীর মাঝখানে, আমরা ছজন হাঁটতে থাকলাম। সাদা বালী-কাঁকড়ের খাত ধরে চলেছি- বাঁদিকে ছফুট উঁচুতে চর, তাতে বুকসমান সোনালী ঘাস, ডানে স্লেটরঙা পাহাড়ের কোল বেয়ে সরু বনপথ এঁকেবেঁকে গেছে ভুটানের দিকে। একদম পিকচার-পারফেক্ট ধুন-এ বাজছেন মিস্ পাহাড়ী। জুলজুল চোখে ওপথে তাকিয়ে আমরা সিধে রাস্তা নিলাম, মহাকালীন divaয় আমরা গ্রস্থ হচ্ছি ক্রমশঃ। নদীর প্রবাহ পাহাড়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে সাপের মত জড়িয়ে আছে- নদী, ঝর্ণা, প্রপাত হয়ে। যত এগোচ্ছি, বদলে যাচ্ছে ছবি- নানা মাপের বোল্ডারের ফাঁক-ফোকড়ে নদী বয়ে চলেছে তিরতির। সমতলের মানুষ আমরা- বোল্ডার সামলে চলা সোজা? কোনমতে কেঁদে-ককিয়ে পেরতে-পেরতে এসে পৌঁছলাম তীব্র খরস্রোতার সামনে। দুটো পাহাড়ের ফাটল দিয়ে নদী বেরিয়ে আসছে- বাধা-বন্ধনহীন। তার গর্জন- সাদা ফেনা, তার আছাড়ি-পিছাড়ি উদ্দামতা স্তব্ধ করে দিল আমাদের। সম্বিত ফিরতে এগোলাম, পিছু চেয়ে দেখি সমতলে পড়েই নদী বদলে ফেলেছে চরিত্র। কলস্বরা তখন মিষ্টি চেহারার এক নম্রগমনা বধূ। অবাক লাগল- সামনে দেখছি ভীমাবতীকে আর পিছনেই তিনি লক্ষীস্বরুপিনী! এক অপলক অভিজ্ঞতা।
                       বোল্ডারময় পথে

আমাদের যেতে হবে স্রোতের বিপরীত পথ ধরে ওপরে- কিন্তু ভেবে পাইনা কিভাবে। কিছুটা এগিয়ে দেখি পাহাড়ের গায় চৌদ্দ/পনেরো ফুট ওপর অবধি হেলানে রাখা এক খুঁটি, যাতে ফুটখানেক অন্তর কাটারীর চোপা। ওইটি বেয়ে উঠতে হবে। মানে? হাঁকপাঁক করে ওপরে চাই, গর্তের ফাঁক দিয়ে নজরে পড়ে চিলতে নীলাভ আকাশ আর আগেভাগে পৌঁছে থাকা গাইড বাপীর বাড়িয়ে রাখা হাত। ফাঁকা ঐ এরিয়াটুকুতে ওঠা দিয়েই নাকি যাত্রার সূচনা। শুরুতেই থমকে যাচ্ছি, বিস্ময়ের হাঁ বন্ধ হয়না। তবু এগোলাম- খাঁজ কাটা খুঁটিতে গোড়ালী জমিয়ে উঠতে গিয়েই বুঝলাম ওটি আলগোছেতে রাখা।
                      যে পথে যাত্রা শুরু 

শরীরকে দুহাতের ওপর প্রায় ঝুলিয়ে-ঝুলিয়ে ওপরে পৌঁছে যেই হাঁপ ছেড়েছি, দেখি অন্যদিকের পাহাড় থেকে প্রপাতের মত জয়ন্তী তীব্র ধারাপাতে- পেরোতে হবে এবার এটা। বিস্ময়ও বিভ্রান্তিতে পড়ছে। সম্ভব? পর্বতারোহণে এসেছি নাকি? তাহলে দিদি থাকুন, বাকীদের নিয়ে আমি এগোই- নাক থেকে মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীমায় বলে বাপী এগোল। এতই সহজ বুঝি! উপায়ান্তর আমি ঢোঁক গিলে এগোতে থাকি। এখানের গল্প একটু অন্য। শালকাঠ নদীর এপার থেকে ওপারে ফেলে রাখা, সাপোর্ট হিসেবে কোমর-মাপে পাশে একগাছি বাঁশ। এবার কিন্তু ফেরার উপায় নেই- পিছনের জন এসে পড়েছে, আমি দাঁড়ালে সেও টলোমলো। নিজের কাছে নিজেরই যখন চ্যালেঞ্জ নেওয়া সারা তখন আত্মপ্রত্যয়ই ভরসা, এগোতে থাকলাম। ব্যস, শালকাঠে পা পড়তেই সড়াত্- বহুকাল জলে থেকে-থেকে সে শ্যাওলার্ত। ভাগ্যিস পাশে কেতরে পড়া রেলিংটুকু ছিল।
                  ভাগ্যিস পাশে বাঁশের ঠেকনা ছিল   

পুরো পথজুড়ে এমনি সাতটি সেতু পেরতে হল। ঝুরোমাটির পাহাড়ে গ্রিপ না থাকায় কম করে পাঁচবার পড়লাম আর নড়বড়ে খুঁটি পাকড়ে অন্ততঃ চারবার ওঠানামা করলাম। এইভাবে নদী পেরতে-পেরতে এসে পড়লাম চড়াই-এর সামনে। এগোব কি, শরীর সামনে ঝুঁকে থাকছে, পায়ের পাঞ্জা সিধে বসেনা কখনই। মাঝেসাঝে উত্ড়াই পড়ছে, যা আরও ভয়াবহ- ঝর্ণার জল পড়ে-পড়ে পথ পিচ্ছিল। কেউ কাঁদছে তাও এগোচ্ছে। সবটাই একসে বঢ়কর এক খতরনাক জার্নি- জীবন নিয়ে ভিডিও গেম খেলা। এভাবেই কখন যেন ধুনির সামনে উপবিষ্ট মুনির কুঠুরীর মধ্যে নিজেকে আবিষ্কার করলাম- ছানাবড়া চক্ষুতে। বুঝলাম, ঢুকে পড়েছি গুহায়।
                     আলো জ্বলজ্বলে লেপ্চা ছেলে

গুহার মধ্যে বায়ুচাপের বদলের জন্য কিনা জানিনা, মুখের মাসলে তিরতিরে কাঁপন- অনুভব এক্কেবারে নতুন ও এক্ষুনির। ভিতর ঘোরতম অন্ধকার, টিমটিমে এক প্রদীপ জ্বলছে, পাথুরে দেওয়াল বেয়ে খনিজজল চুঁইয়ে নামছে আর তারইমধ্যে চোখে ধাঁধা লাগানো টকটকে লালের আড়ম্বর। ধুনির আগুন লাল, পুরোহিত পট্টবস্ত্রে লাল, চারিদিকে সিঁদুরের ল্যাপালেপি, লাল জবার মালা, গুহায় গড়ানো জলও সিঁদুর ধুতে-ধুতে লালচে-স্রোতা। অনাস্বাদিতপূর্ব ব্দটা স্কুলে পড়েছিলাম, তার বাস্তব পরিচয় মিলল মহাকালে। ঘুরঘুট্টি কালোকে জড়িয়ে নেওয়া লালের এই আধিপত্য সম্রাজ্ঞীর মত রাজাসনে বসে আছে। টিমটিমে প্রদীপটি এমনই জায়গা বুঝে রাখা, যেখান থেকে আলো-ছায়ার মায়া মনে স্বর্গসুষমার প্রাপ্তি জোগাচ্ছে। অনবরত খনিজজল পড়ে ও জমে-জমে গুহার গায় নানান ভাস্কর্য্যের কারুকাজ (স্ট্যালাগটাইট, স্টালাগমাইট মহিমায়), পুরোহিত-বচনে তারই কোনোটা মহাকাল কোনোটা পার্বতী।
                   রুখাশুখা জয়ন্তীর বালী-কাঁকড়পথ

গর্ভগৃহের কাছাকাছি পৌঁছেও যখন আমাদের ক্ষমতায় কুলোচ্ছিল না- তখন দেখেছিলাম মোবাইলে সব বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টায়- মা, হয়তো আর ফিরব না, ভাল থেকো।ভাগ্যিস টাওয়ার ছিলনা- নাহলে কি হত বাড়ির মানুষগুলোর? ঠিক তখনই এক্সপিডিশনে আসা এক দঙ্গল ফরিস্তার সঙ্গে দেখা। তাদেরই উত্সাহে, তাদেরই শেখানো মতে নিঃশ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের জোগান বাড়িয়ে শেষে পৌঁচেছিলাম চূড়ায়।
                      ডানদিকে ভুটানের শুঁড়িপথ

কষ্টের মূল্যে পাবার তৃপ্তি প্রাপ্তিঘরে চিরকালের বাসা বাঁধে। তাই ঝাঁকি দিতেই মহাকালচেনা উত্তেজনায় এনে ফেলল তিনসেকেন্ডে। শেষের দিকে পথ ক্রমশঃ সঙ্গীন হয়েছে, তবুবাঁচতেও পারি, মরতেও পারি-র অনিশ্চয়তা দিয়েছে এক ইউনিক এক্সপেরিয়েন্স।
                     পাহাড়ি ঝোরায় ধূলোখেলা





'লেপাচা খা'- থেকে দেখা সূর্যাস্ত

লেখাটি 'সকালবেলা' পত্রিকার 'ঘুরে আসি' বিভাগে পাবলিশ হয়েছে 26-শে জুলাই তখন অমরনাথ গিয়েছিলাম বলে পাইনি। অবশেষে কিছু দিগদারী সামলে আজ হাতে পেলাম। শিরোনাম ছিল- 'সেখানে রূপের সেখানে ভয়ের বাসা।' দপ্তর সেটি বদলে রেখেছে-

জীবন নিয়ে লোফালুফি
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

কী খেয়ালে গিয়েছিলাম ইস্ট ডুয়ার্স? জয়ন্তীর জল-জঙ্গল, চা-বাগানে বেড়াবার খেয়াল এক আর মহাকাল-এর পাকদন্ডী পথে বিপদের সঙ্গে যোঝা আরেক। সুস্থ দেহে এসেছি যে, এই ঢের। আমাদের দলের নাম ইচ্ছেডানার উড়াল- তাবলে যেখানে-সেখানে উড়তে চাইলেই হল? আসলে সবার মনমর্জি মোটামুটি একইরকম বলেই বোধহয়...
ইন্দ্র থাপার গেস্টহাউস

এই ...উড়াল’ সদস্যরা মাঝেসাঝেই গেয়ে ওঠে- চল না, কোথাও যাই।’ ‘যাই-যাই ডাক অহরহ শুনি ভিতরে, তাতে যেই ওদের ইচ্ছের রং লাগে, বুক জুড়ে কাঁইনানা-কাঁইনানা... তখন ঢাকি-কাঁসী নিয়ে শুধু বেরোবার অপেক্ষা।

জানুয়ারীর লাল দাগানো দিনগুলোকে হিসেবে তুলতে মিটিং ডাকলাম। মিটিং প্র্যাকটিক্যালি ইটিং-এই শেষ হয়ে চলল গত হয়ে যাওয়া ভ্রমণগুলোর স্মৃতিযাপন। কোথায় যাবে, কিভাবে- ওসব দায় আমার, ওদের মন নেই। ওরা খোলা ডানায় সবুজ রঙ মাখতে পেলেই হল। আমি আসলে সেই সাপুড়ে যার বাঁশীর সুরে সাপগুলো অমনি ধরা দেয়। শুধু কদ্দিনের জন্য’- হিসেবটুকু সবার। অফিস-কলেজের সেই অঙ্ক কষেটষে বাইশ তারিখ দুপুরে বেরনো গেল, পরদিন ভোরে পৌঁছলাম নিউ-আলিপুরদুয়ার। পরিপাটী সুন্দর স্টেশনে- কুয়াশা জড়ানো ওড়না-আড়ালের ছায়া-ছায়া মায়ার খেলা। বোলেরো গাড়ী নিয়ে হাজির হলেন ড্রাইভার রতন শর্মা। চোখে আমাদের জমাট কৌতুহল- শিশুর মত দশা। যা দেখছি তাতেই উদ্বেল। আধা মফস্বলী জায়গাটিও ভাল লাগার ভোরবেলা দিয়ে ধোয়া, ঊষ্ণ, উদাস।
 রুখাশুখা জয়ন্তীর নুড়িপাথুরে পথ... ডানদিকে ভুটান

এবার চলা শুরু। দুধারে বন, সুপারীবাগান, সেনা-ছাউনী, দূরে-দূরে পাহাড়ের আবছায়া আবেশে মেতে তিরিশ কিলোমিটার দূরের বক্সাদুয়ারে পৌঁছলাম যখন তখনও রোদ আলতো, নরম। ভাগ্যিস্ গাড়ীর ইঞ্জিন শক্তিশালী ছিল, সেই জোরেতে ঘাটরাস্তা পেরিয়ে দিব্যি টং-এ উঠে এলাম। নামলাম যেখানে, সেখান থেকে পাঁচ কিলোমিটার হাঁটাপথে পৌঁছতে হবে হোটেল। এতক্ষণ বেশ প্রকৃতিলীন ছিলাম, এবার কাঁধের বোঝা তার উপস্থিতির জানান দিতে লাগল। দু পা এগোতেই হোটেলের পাঠানো পোর্টারের সঙ্গে দেখা। বোঝা চালান করলাম ও ঝাড়া হাত পায়ে পৌঁছে গেলাম ঘন্টাখানেকেই। পাহাড়ের গায়ে ঠেসান দেওয়া প্রায় ঝুলন্ত ঘরে কজন বসলাম জাঁকিয়ে। বসলাম মানে ঐ আর কী... চাযে ঠোঁট ভিজিয়েই বেড়িয়ে পড়লাম। যা দেখছি, যেদিকে তাকাচ্ছি, সবটাই মনে জগঝপ্ম বাজানো অভূতপূর্ব- অধরাকে ধরতে চাইছি চোখের ফ্রেমে- তক্ষুণি।
প্রত্যেকের হাতেই এখন ডিজিটাল ক্যামেরা, ঝপাঝপ ছবি উঠছে, সঙ্গে অনুযোগও। যা দেখছি, তার এক কণাও ধরা যাচ্ছেনা। কেউ বলল- ক্যামেরা কোম্পানীগুলো বেকার। এত পিক্সেল তত এক্স-র গপ্প শোনায় অথচ ফ্রেমে কিচ্ছু আঁটছে না। সব বেচার ধান্দা, বুঝলে! ওদের আর কী বলি, আমারও তো সেই দশা। দৃষ্টি পরিধির সমগ্রকে বাক্সবন্দী করতে চাইছি আর ঠকছি সারাক্ষণ।
মহাকালের  পথে

পৌঁছলাম যেদিন, সেদিন 23-শে জানুয়ারী- স্পোর্টস চলছে। সমতল অংশটি বক্সাফোর্টের কোলে, যেন চরণ ছুঁয়ে হিসেবহীনের মাঠ। তিনদিকটায় জঙ্গুলে পাহাড় ধাপে-ধাপে উঠে গেছে আর অন্যদিকটায় ফোর্ট। বেলা পর্যন্ত খেলাধূলো দেখে, ফোর্টের ভগ্নতা ও দৈনতার আলোচনা করতে-করতে ফিরলাম যখন, তখন দেড়টা বাজে। দেখি নেপালী মালিক ইন্দ্র থাপা খেতে দিতে গিয়ে হিমসিম খাচ্ছে, সব বোর্ডারের পেটে একসঙ্গে আগুন লেগেছে- অথচ এ্যামেচার স্টাইলে গড়ে ওঠা নেটওয়ার্ক ওদের পল্কা। বৌ রাঁধছে, মেয়ে কুটছে, ছেলে জ্বালানীর যোগান দিচ্ছে। সহকারী দুই/তিনজন লেপ্চা সঙ্গে আছে, কিন্তু রাবণের চিতার কাছে নস্যির মত সব উড়ে যাচ্ছে। তাড়া আমাদেরও। বক্সাদুয়ারে থাকব মোটে একদিন, তাই শুষে নিতে চাই মায়াপুরীর সবটুকু বৈভব। শুনেছি লেপ্চা খা বলে পাঁচ কিলোমিটার ওপরে যে পাহাড়, তা অসাধারণ। যেতে হবেই। সঙ্গে যদিও গাইড থাকবে- তবু ফেরার পথে অন্ধকার নামলে উপায়? অতঃপর রান্নাঘরে হানা দিলাম। নিজেরাই বেড়ে নিলাম আতপচালের ভাত, জলজ ডাল, বাঁধাকপির তরকারী, এগকারী। তারপর কাঠকুটোর ধোঁয়ায় কাশতে-কাশতে আর কাঁদতে-কাঁদতে খাওয়া শেষ। আমাদের সেল্ফহেল্প সাহায্যটুকুতেও বর্তে গেল ইন্দ্রবাহাদুর। তারপর ওর ব্যবস্থা করে দেওয়া গাইড নিয়ে- পাহাড় থেকে পাহাড় পেরিয়ে, ঝর্ণার জল ছুঁয়ে হাঁপাতে-হাঁপাতে পৌঁছে গেলাম লেপ্চা খা। অত উঁচুতে অনেকটা সমতল ভূমি- এ্যাঙ্গেলে উঠতে-উঠতে পাহাড় হঠাত্ই মাথাভাঙা। যেন নৈবেদ্যর চূড়াটুকু কোনো দুষ্টু ছেলের হাতে পড়ে থ্যেবড়ে গেছে। হু-হু হাওয়া জানান দিচ্ছে- তোমরা এখন বিলকুল একা... উঠেছ টঙে। পাহাড়ের খাঁজে-ভাঁজে আটকে আছে তূলো-তূলো মেঘ। কি অপরূপ, পাহাড় আর মেঘ যেন সখ্যতার আলিঙ্গনে বাঁধা। ওপর থেকে নীচে দেখছি ক্ষীণস্রোতা জয়ন্তীর আল্পনাপথ, সাদা নুড়িময় বালা নদী আর আকাশে তাকিয়ে দেখতে পাচ্ছি অস্তগামী লাল সূর্য্যের সন্ধাযাপনের তোড়জোড়। বাক্যহারা আমরা নিজের সঙ্গে বসে থাকলাম কিছুক্ষণ। সজাগ হলাম গাইডের ডাকে- ফিরতে হবে দিদিরা...
পুকুরিয়ার পথে

অবতরণ চির কালই সহজ উত্তরণের চেয়ে। ফিরব মনে করে নামতে শুরু করলাম ও ঘন্টা দেড়েকেই পৌঁছে গেলাম হোটেল। তারপর আড্ডা দিয়ে, মুর্গীর ঝোল-ভাত খেয়ে দেখতে গেলাম ইন্দ্রর শিল্পকলা। আমরা মুভড্। বাচিক ও আঙ্গিক অভিনয়ের মাধ্যমে নিজেরই লেখা কিছু গল্প বলছে। পাহাড়, নদী, ঝর্ণাকে চরিত্র করে প্রকৃতির বেঁচে থাকার আর্তি ও মানুষের মঙ্গল-বাসনাই গল্পের উপজীব্য। ইন্দ্র ডেমনেস্ট্রেশন দিতে গিয়ে কখনো কাছিম হচ্ছে, কখনো হাওয়া, বাঘ, কাঠুরে বা গুলি খাওয়া পড়ন্ত পাখীর নকলনবিশী নিয়ে টোটাল থিয়েট্রিক্যাল প্রেজেন্টেশন। এই ইনোভেটিভ কাজের যে রেঞ্জ তার যোগ্য না ছিল দর্শক না পরিবেশ। বারান্দার চারফুটি পরিসর, টিমটিমে হ্যাজাগের আলো, অভিনয় চলাকালীন উঠে যাওয়া বেরসিক পাবলিক... কিছুই ওর মনোযোগ টলাতে পারেনি- যতক্ষণ না ও নিজে তা চেয়েছে। বেচারী কারুবাসনা চরিতার্থতার যথার্থ মানুষ পায়না, তাই শহুরে বোর্ডারই ভরসা। প্রায় ভিক্ষা চাওয়ার মত করে শোনায় অন্তরগান- বিনা পয়সায়। সঙ্গে একটা ট্রাইসাকোড আছে, তা বাজিয়ে আবহ তৈরী করে আর গল্পের ভাবানুসারে দেখায় কাঠের কচ্ছপ, তীর বেঁধা পাখী, শুকনো জলাশয়ে মৃত প্রাণী ইত্যাদি। অফ সিজনে ও সারাদিন ধরে আঠা-বাটালী-তুরপুন সহযোগে এসব বানায়। এ যেন এক অন্য ভ্রমণ- মানুষটার অচেনা চেতনপথের।
 জয়ন্তী নদীর ওপর বাঁশের সেতুতে

পরদিন সকাল-সকাল ইন্দ্রকে পয়সা মিটিয়ে চললাম জয়ন্তীর বনলতায়। নদীর কাছেই সাজানো বাংলোয় সবাই এক ঘরে উঠলাম। সকাল হতেই ইচ্ছেডানার উড়াল বেড়লাম জঙ্গল চষতে। একজনের ভিডিওয় দেখেছিলাম- পুকুরিয়া-য় গোটা চৌদ্দ হাতির জলকেলী। দেখে থেকে অস্থির- তক্ষুনি যেতে চাই। যেন পুকুরিযা হাতীকুলের দাঁত মাজার, ঘরকন্নার, রোজকার স্নানের স্থান- গিয়ে দাঁড়ালেই শুঁড় দুলিয়ে লেজ মুড়িয়ে পোজ দেবে। তর সইছেনা, দুপুরেই ছুটলাম। বেশ খানিকটা চড়াই ভেঙে ওঠার পর ওপরে পান্নাসবুজ পুকুর, পাথুরে পাহাড় আর থমধরা জঙ্গলে পৌঁছলাম। শুধু একঘেয়ে ঝিঁঝিঁর ডাক জানান দিচ্ছে পৃথিবীতে শব্দ বলে এখনো কিছু আছে। কিন্তু তারা কোথায়কাচকামিনী জলে শুধু গাছেদেরই মুখোচ্ছবি। গাইডকে বললাম-
- হাতি কই? এই যে শুনলাম একটা দল নাকি এপথেই...
- হ্যাঁ এপথেই...
- তো কই তারা?
- আসবে হয়তো... বিকেলে।
- বিকেলে কেন?
- ভোরে আর সন্ধ্যাবেলায় জল খেতে আসে কিনা....
- তা আমরা আগে কেন?                 
সে তো আপনারাই চাইলেন।
উঃ, কী রাগ ধরল। সেই কাটা ঘায়ে আবার নুনের ছিটে পড়ল যখন শুনলাম ছানাপোনা নিয়ে হাতির পাল নাকি দাপিয়ে গেছে পুকুরিয়া- বিকেলবেলায়। ওসময় আমরা বনের অন্যপথে আশায় ছুটে মরছি। কি আর করার, মনকে প্রবোধ দিলাম- আরণ্যক ধাঁধাটাই আসল মজা, গেছে যা যাক্। পুকুরিয়ার জলে যে বোম্বাই সাইজের মাগুরমাছ আর লিলিপুট ক্চ্ছপ দেখেছি, তা কি ফেলনার? হঠাত্ই ঝুপঝুপ সন্ধ্যা নামলো, আমরা ফেরার পথ ধরলাম। বরাদ্দ যে তিনদিনের হিসেব ছিল, তারমধ্যে ফুড়ুত্ দুটো দিন, পরদিন যাব মহাকাল। রাত বাড়তে থাকল, তবু কজন কথোপকথনে জেগে আছি... আড্ডার আড়ে কিছু মলিন দিন যদি মোছা যায়। ফিরে তো সেই একই বৃত্ত যাপন, অথৈ চাপের কাছে নিত্য নতজানু।

গাছের সাথে নিজেকে মিলিয়ে কন্যা 

মনে মহাকালের ডাক ছিল তাই ভোরেই ঘুম ভাঙল। সবাই বারণ করেছিল, বলেছিল রাস্তা খাড়াই- অর্দ্ধেক মানুষই মাঝপথ থেকে ফেরত্ আসে- অন্য কোথাও যাও। কিন্তু চক্ষুকর্ণের বিবাদ ভঞ্জন না করে পিছব না। নটা বাজতেই তাই গাইড টোটনকে নিয়ে বেড়লাম। গাড়ি মোটে দুতিন কিলোমিটার গিয়েই নামিয়ে দিল- এবার হাঁটতে হবে। যেখানে নেমেছি, সেই শুকনো নদীটাই পথ্। ধুধু কাঁকড়ময় বালী আর সাদা নুড়ির প্রান্তর। এই দুদিন যে পাহাড় দেখেছি আর আজকের যে ছবি তার মধ্যে আসমান-জমিন ফারাক। বড়-বড় বোল্ডার পেরতে হচ্ছে কখনো নদীকে ডানে কখনো বাঁয়ে নিয়ে। হঠাত্ই জল পড়ার শব্দ শুনে দেখি পাহাড়ের ফাঁক গলে প্রপাতের মত বেগে নামছে জয়ন্তী নদী। এই অবধি জায়গাটির নাম ছোট-মহাকাল, আমরা যাব মহা-মহাকাল। কিছু ফিরতি পথের মানুষকে জি়জ্ঞেস করলাম- কেমন দেখলেন? প্রতিক্রিয়া- ওফ, অসম্ভব... । অসম্ভব? কৌতুহল বেড়ে গেল- অল্প এগিয়েই মালুম পেলাম। দেখি একতলা সমান উঁচুতে একটা কাঠ পাহাড়ের গায়ে এ্যাঙ্গল করে রাখা, তা খাঁজে-খাঁজে কাটা, ওটা বেয়ে উঠতে হবে ওপরে। এই প্রথম আমার আত্মবিশ্বাস টাল খেল। উঠব এভাবে তো নামবো কীভাবে? নির্লিপ্ত টোটোন বলল- কেন এভাবেই। ভাবতে-ভাবতেই দেখি দলের কজন ল্যাকপ্যাক্ করে উঠে গেল- অবশেষে কী জানি কী করে- আমিও। ভাবলাম শক্তপথ পেরিয়ে এসেছি- এবার বোধহয়... হঠাত্ই পথজুড়ে দেখি বিশাল বোল্ডার স্ল্যান্টিঙ, ওপরে কাঠের পাটাতন সেই কৌণিকতার হিসেব মেনেই পাতা। হৃদপিন্ড প্রায় হাতে নিয়ে এগোলাম, মনোযোগের একটু এদিক-ওদিক হলেই নীচে ফুঁসতে থাকা জয়ন্তীর আশ্রয়-নিকেতনে সোজা। এই পর্ব ছিল পুরো চার হাতেপায়ে হামাগুড়ির মামলা। তাও পেরিয়ে এলাম ও এসেই পড়লাম সরু একরত্তি ফাটলের ফাঁকে বাঁশের আরেক খেলবাজীতে। এটা এবার উঁচু থেকে নীচেয় নামার। প্রতিবারই আমরা নতুন অভিজ্ঞতার সামনে পড়ছি আর বলছি না, না আর না... কিন্তু কী অদ্ভুত, কেউ কেউ যেই এরিয়াটা পেরিয়ে যাচ্ছে, সেই অন্যেরা কাঁদাকাঁটি করলেও পেরোচ্ছে... পেরতে হচ্ছেই। বাকী ছিল পিচ্ছিল কেঠোসেতু ধরে নদী পেরনো- হয়ে গেল সেটাও। এ যেন কম্প্যুটারে গেম খেলছি। একটা এ্যচিভমেন্টের পরেই খুলে যাচ্ছে আরেকটা লেবেল আরো শক্ত খেলা সাজিয়ে। তফাত্ শুধু ওখানে খেলা তো খেলাই আর এখানে জীবনকে নিজেরই মুঠোয় নিয়ে লোফালুফি খেলতে-খেলতে চলা। এবার রাস্তা আবার বোল্ডারময়। ভাবছি অনেক হল, এবার বোধহয় পৌঁচেছি। কিন্তু টোটন বলল- এটা বেস ক্যাম্প, আসল পথ এইবার... চলুন।

                   বক্সাফোর্টে স্থানীয় নৃত্যনিপুনাদের সাথে... 

তারপরের দুর্গমতা বোঝানো আমার সাধ্যের অতীত। এই চড়াইপথে এমন একরত্তি জায়গা ছিল না যেখানে একটু দাঁড়াই- হাঁপ ছাড়ি। উঠেই গেলাম, উঠেই গেলাম... প্রকৃতির দিকে তাকাবার মত অবস্থা নেই। দেহ থেকে প্রাণ মুক্তি চাইছে, ইচ্ছেডানার... ইচ্ছেপত্র উধাও- সব্বার। পৌঁছবো কিনা আর পৌঁছলেও ফিরতে পারবো কিনা জিজ্ঞাসায় মন ব্যস্ত। টেপ আটকে যাওয়ার মত নিউরোনে তখন একই কথার ঘুরপাক। শেষে ঝর্ণা-পিছল পথ ও ধ্বসতে থাকা ছাইমাটি সামলে চূড়ায় উঠতে পেরেছিলাম ও ফিরেছিলাম সকলেই।
লেপচা খা-য় গোধূলী

যে গুহার মধ্যে মন্দির, তার সর্বত্র দিয়ে ফোঁটা-ফোঁটা জল পড়ছে... সেই খনিজ জল থেকেই তৈরী হচ্ছে নানা আকৃতি। ঐ অপরিসর জায়গাতে আগুন জ্বেলে এক সন্নাসী বসে আছেন। তিনিই দেখালেন গুহার প্রাকৃতিক ভাস্কর্য্য্। কোনজন পার্বতী, কোনটা দক্ষযজ্ঞের সভাস্থল আর কোন রাজকীয় জন মহাকাল তা দেখলাম খুঁটিয়ে। তারপর পিছল পথ ধরে কীভাবে নেমেছি জানিনা। শুধু জানি এই অভিযান অন্তরে রাজ্য জয়ের তৃপ্তি জোগাল। ঘরে ফিরে যখন এই নাগরিক স্পন্দন আর প্রযুক্তি-প্রাণের পাশে ঐ দিনগুলোকে রাখি, তখন স্বপ্ন বলে মনে হয়, যে স্বপ্নের কাছে ফিরতে ইচ্ছে করে বারবার।

জেনে রাখুন ট্রেন- তিস্তা-তোর্সা, কাঞ্চনকন্যা, গরীবরথ। যোগাযোগঃ বক্সাদুয়ারের জন্যইন্দ্রবাহাদুর থাপা, 09475249138. জয়ন্তীর জন্য- বাপী ব্যানার্জী09434607393,  গাড়ীর জন্য- রতন শর্মা, 09434607730 
............................................................................................................

1.1.2012-র 'তথ্যকেন্দ্র'-এ প্রকাশিত ইছামতী নদীর ধারে 'টাকি' বেড়ানোর ওপর আমার লেখা

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী



ব্বাবা, এ কি নাম-‘টাকি কিনা টাক্কি!!!’ উপায কি, লিখতে বসে প্রথমেই যে নাম মাথায় এলো আরে আমি হলাম গে সুবিধেবাদী পুরোন পাপী কেন বলি। আসলে বৃষ্টিবিহীন গরমে বিদ্যুত্হীন টাকিতে পৌঁছে একে মাথায় টরে-টক্কা, তায় আবার ফার্স্ট থট’-কে প্রায়োরিটি দেবার ইচ্ছা মানে শিরোনামের ক্ষেত্রে আর কি। একজন নাট্যকার বলেছিলেন না, অলওয়েজ ওয়েলকাম ফার্স্ট থট। সেকেন্ড থটকে পাত্তা দিলেই বেটা সেজেগুজে আসে আর আসলী কথা ধামাচাপা তো সেই কথাটা মনে পড়ল, ব্যস- আটপৌড়ে সাজ পরে নেমে গেল- ইচ্ছামতীর ধারে- টাক্কি টরে-টক্কা।
টাকীতে দুদিনের টুপ্পুস ডুব খুশী যেমন দিয়েছে- তেমনি জ্বালিয়েছেও টুকটাক জানা ছিলই এটা মে মাস- হাওয়ায় গরম, খাওয়ায় গরম, ব্যবহারে গরম থাকবেই তাই ভোর থাকতেই ট্রেন ধরলাম আর রোদকে ফাঁকি দিয়ে টাকি ঢুকে পড়লাম সকাল-সকাল আমি উতলা-হ্যাংলা হলে কী হয় ওখানের লোকজন তো তা নয়রিক্সাওয়ালারা সবে ভ্যানের চাকায় জল ঢালছে, হাতলের গায়ে আগের দিনের লেপ্টে থাকা ক্লান্তি মুচছে, আর আমরা কিনা তখনই... তবু সওয়ারী তো, তাই লক্ষীর আগমনী গান শুনেই ওরা স্যাটাস্স্যাট হাত ধুয়ে রেডী ঝকঝকে ভ্যানের গায়ে আদরের আলতো চাপড় মেরে, লুঙ্গি কষে এঁটে, ঘুরিয়ে নিল ভ্যানের মুখ- ডেস্টিনেশনের দিকে একে এটা পর্যটনের অফ সিজন তায় রেগুলার লোকাল লোক বয়ে-বয়ে মানুষগুলো মনমরুনীতাই কলক্কাত্তাইয়া জিন্স-হাইহিল-সানগ্লাসের উল্লাস দেখে ওদেরও জোস জবরদোস্ত পকড় নিলউমর-ঘুমর প্যাডেল চালিয়ে দশ মিনিটেই পৌঁছে দিল বাংলোয় ওমা, পৌঁছে শুনলাম পঁচিশজনের একটা দল এসেছে হঠাত আর আচমকার সেই বেমক্কা ধাক্কায় উল্টে আমরা চীত্পাত বেলা বারোটা বাজবে, তারা ঘর ছাড়বে- তারপর...
মোট কথা এখুনি দেওয়া যাবে না অথচ গতরাতে ফোন করেই কিনা
- কী করবো দিদি, আপনারা মোটে সাতজন আর ওরা পঁচিশ অফ সিজনের এই বাজারে কী ট্যুরিস্ট ছাড়া যায়?
- তাতো যায় না, কিন্তু আমাদেরও যে ট্রেন জার্নি করে হালত্ খারাপ
- ইচ্ছামতী পাশেই, একটু নদীর বাতাস গায়ে মাখুন, সময় কোথা দিয়ে কেটে যাবে বুঝতেই পারবেন না
- জানি, জানি- ওসব জানি, কিন্তু ব্যাগপত্র নিয়ে...
- ও নিয়ে ভাববেন না, আমরা তো আছি
বলেই হাঁকডাক করে মালপত্তর নামাল আর জিম্মাদারী বদল হতেই ঝাড়া হাত-পা আমরা গেলাম দু পা দূরের ইচ্ছামতীর পাড়েনদীর ধার- খোলামেলা বিপুল বিস্তার... অথচ কোথায় হাওয়া? গরমে ঘোরাঘুরি দূর, ভোরের রেশমী আলোর কাব্যময়তাও উধাও হতে সময় লাগল মোটে তিন সেকেন্ড উপায়? সবার মন এইবার উল্টোপথে হাঁটছে- হাজার-একটা প্রয়োজনের কথা ভিড় করে আসছে। কেউ বলে বাথরুমে যেতেই হবে, কেউ জার্নিদিনের ঘেমো পোশাকের কাঁদুনীতে, কারুর ক্ষিদের চোটে চক্ষে ধাঁধাঁ ওফফ্... ফের ফিরলাম বাংলোয়
- না দাদা এভাবে চলছে না, ব্যবস্থা আমাদের চাই-ই চাই
- বারোটার সময় চেকইন, আপনি তার আগে তো ডিমান্ড করতে পারেন না-
ও, তাই বুঝি? এইবার ধরতে পারলাম ওদের ধাঁচাসুবিধে পেতেই ডিমান্ড এ্যান্ড সাপ্লাইয়ের গপ্প? আমিই বা কম কিসে, গরমের তাতাপোড়ায় এমনিতেই ক্ষিপ্ত।   
- তা আপনি কেন ইনফর্ম করলেন না? না জানিয়ে এসেছি তাতো নয়-
- কিন্তু আমরা বিজনেস করতে বসেছি-
- মশাই আমিও তো অনুগ্রহ চাইনি, জানিয়ে-শুনিয়েই এসেছিপার্টী পাকড়াতে তখন তো কত...
- কিন্তু চেক-আউট, চেক-ইন বলে একটা কথা আছে
- নিশ্চই আছে, ফোনে তালে কেন বললেন- এইসব গাঁয়েগঞ্জে আবার চেক-আউট, চেক-ইন বরং মিষ্টি হেসে কী বলেননি- এই গরমে আসছেন, আমরা তাতেই ধন্য...
এই তাল বুঝে খামচে ধরার উত্তরে সে কী বলবে ভেবে পেল না ম্যানেজার খানিক ভ্যাবলা মুখে চেয়ে থাকল, তারপর ধাঁ করে উঠে চলে গেলমিনিট দশেক বাদে এসে বলল-
- আমার রুমটা আপনাদের জন্য ছেড়ে দিচ্ছি, ওখানেই একটু মানিয়ে-গুনিয়ে বসুন, তারপর দেখি কত তাড়াতাড়ি...
গ্রাম্য আবহ, গ্রাম্যতায় মোড়া দিশপাশে গ্রামের ছেলেই ম্যানেজার, তো তার আবার রুমঐ যেমন হলে নিজেকে বেশ মশাই-মশাই লাগে- তেমন আর কীএকপীস মচমচে খাট, খোলা আলমারীতে গাদাগুচ্ছের কম্বল-বিছানা-বালিশ, মাটিতে ছড়ানো বঁটি, কাঁচি, ডেকচী এমনি আলাপালায় ঘর ঠাসা দমঐ গরমে কম্বলগুলো যত চোখে পড়ল, তত বাড়ল আমাদের হাঁপানী তায় আবার আগের দিনের ঝড়বৃষ্টিতে এন্টায়ার টাকির তার ছিঁড়ে বিদ্যুত বেসামাল জেনারেটর খানিক চালিয়ে খানিক বন্ধ দিয়ে কোনোমতে ছন্দে ফেরার চেষ্টা চালাচ্ছে হোটেলগুলো এবার সাতজনের চারজনে সামলেসুমলে ম্যানেজারের মুচমুচে খাটে চড়লাম আর বাকী কজন ঘুরে-ফিরে, ইয়ার্কীর চেষ্টা করে কাটিয়ে দিলাম সময় ইতিমধ্যে লুচি-তরকারীর ব্রেকফাস্ট সারা ভাগ্যিস্ রাঁধুনীরানী দুর্দান্ত রাঁধিয়ে- ভাগ্যিস্ নদীর ওপরের ডাইনিং রুমখানি সুবাতাসে প্রায় উড়ছিল- ভাগ্যিস্ ইছামতীতে তখন জোয়ার জলে ঠেউ আর আমরা উন্মন... তাই কোথা দিয়ে যেন বয়ে গেল বেলা ভাগ্যিস্-গুলোই সহনীয় করল দু/তিন ঘন্টার অপেক্ষা বারোটা বাজল- ওরা লেপা-পোঁছা সারল, আর আমরা যে যার ঘরে ঢুকলাম। গায়ে মাথায় জল ঢেলে, তাতাপোড়া মন ভিজিয়ে বসলাম জমিয়ে
 
এরপর কী হল? কী আবার- বুভুক্ষুদের যা হয় তাই হল স্নান-খাওয়া-গুলতানি আর অনেকখানি না পাওয়ার পর প্রাপ্তিসুখের আয়েশ নিতেই ফুরিয়ে গেল বেলা বিকেল পাঁচটা বাজতেই হাজির সকালবেলার ভ্যানওয়ালারাএখন আমরা খুশদিল- খেয়ালী মজায় যেতে একে-একে ভ্যানে চডে বসলামসেনাধ্যক্ষ শঙ্কর রায়চৌধুরীর বাড়ি, তার আধুনিকতা, খিলান-দরদালান-নাটমন্ডপে সাজানো পুরনো বাড়ির বৈভব- জোড়া শিবমন্দির- কৃষ্ণকিশোরের দোলমঞ্চ- রামকৃষ্ণ মিশনের আরতি দেখে, ইছামতীর তীরে এসে বসলাম একটু একটু করে পেরিয়ে যাচ্ছে যে সন্ধ্যাকাল, তার আঁধার তখন ঘন কষ্টিকালো পাথর কলকাতায় কত কৃষ্ণপক্ষ রাত কাটিয়েছি, কিন্তু দুষণমুক্ত গ্রাম্য পরিবেশ দৃষ্টিকে প্রসারিত হবার যে সুযোগ দেয়, তা শহরে কোথায়? দেখেও কতকিছু নজরে আসেনা নগরে না সেই মন, না অবকাশ, না আকাশের দিকে চোখ তুলে চাওয়াঅভিমানী আকাশ সাজলেও টেকেন টু বি গ্রান্টেড হয়ে পড়ে থাকে আনমনে অথচ এখানে! এসেছি মুক্ত মনে প্রকৃতির সমগ্র সুধা শুষে নিতেদৃষ্টি তাই একোণ-ওকোণ, ফাটল-ফোকর... যাচ্ছে সর্বত্রগভীর কালো আকাশে চাইলাম... দেখি আঁজলা করে ছড়িয়ে দেওয়া লক্ষ-কোটী তারার রাশি, ঘন হয়ে চিপকে আছে একে অন্যের গায়ে যেন চকমকী পাথর- যেন আদিম লোভের চোখ- অনবরত জ্বলছে-নিভছে আকাশ আলাদা, এ আকাশ টাকির একার সেই চাঁদোয়ার তলায় বসে, নদীর স্রোতের দিকে তাকিয়ে-তাকিয়ে ও সঙ্গী দুই গায়কের গানের সুরে ভাসতে-ভাসতে সন্ধ্যা গড়িয়ে রাতের হাতে ব্যাটন রেখে গেল আর আমরা? প্রায় ধ্যানস্থ অবস্থা থেকে খেলা শেষের বাঁশী শুনতে পেয়ে উঠলাম ও ঘরে ফেরার উদ্যোগ নিলাম ঘর মানে তাত্ক্ষণিকের ঐ আবাসস্থল- আপাততঃ ওটাই বিলাসপুর, ওটাই বাসা
পরদিনের ভোরে ফের ভ্যানে করে টাকির অন্যদিকে ঢুঁ তখনো সূর্য্যের তেজ ঝলসানো নয়, হাওয়ায় সোঁদা গন্ধসারাটা পথ জুড়ে কত যে ফলের গাছ... থরে থরে তাতে ফলে আছে আম-জাম-কাঁঠাল-খেজুর-করমচাহাতের কাছে নবোঢ়ার নোলকের মত আমগুলো দুলদুল করে দুলছে পরিমাণে এতই বেশী, যে নিজেরটা নিয়ে অস্থির কেউ আর অন্যেরটায় ফিরে তাকাতে পারে নামাটীতে অজস্র সবজে-সাদা জামরুল পড়ে বিছিয়ে আছে পরতের মত পাড়ার ছেলেপুলেরা খেয়ে-খেয়ে ক্লান্ত, এখন ছাগলের দল তার সত্কার করছে ছোট্ট খেজুর গাছ থেকে হাত বাড়িয়েই দিব্যি পারা যাচ্ছে খেজুরের থোকা আমরা যাচ্ছিলাম গোলপাতার বন দেখতে নদীর ধার ধরে, আলপথ মাড়িয়েহঠাত্ই দেখি নদী থেকে এক জেলে উঠে এলো পাড়ে আর হাটুরের কাছে বেচে দিল তার জলশষ্য আমরা ভ্যান থেকে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে নেমে পৌঁছে গেলাম ব্যাপারীর কাছে।
- কী মাছ, কী মাছ?
- কাঁকড়া গ দিদি।
- চিংড়ী নেই?
- আসে আসে, হেইটুকুন্ পাইসি…..
জেলেভাই দেখালো কিছু লাফাতে থাকা বাগদা। কথা না বাড়িয়ে ওটুকু কিনে ফেললাম। সাইজে তর্জনীর চেয়ে কিছু বড়, মধ্যমার চেয়ে অল্প ছোট নিয়েই কত সোরগোল আমাদের। তারপর গোলপাতার জঙ্গলে পৌঁছলাম, দেখলাম অদূরেই বাংলাদেশের পাতার ছাউনী দেওয়া বাড়ি, মা কাপড় শুকতে দিচ্ছে, নিকোনো উঠোনে খেলা করছে ন্যাংটা খোকা, দিদি খোলামকুচির এক্কাদোক্কায়। ইচ্ছে করল যাই- গিয়ে বসি দু দন্ড, কিন্তু... 
ঘুরেঘুরে ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল কী করি? মনে-মনে তাই ওপারের দাওয়ায় গিয়ে বসলাম আর ওদের সাথে মেলবার ইচ্ছা দিয়ে মেখে মুড়ি-চিঁড়ে-পান্তাভাতের স্বাদ নিলাম ভরপুর- মন ও চোখ খোলা রেখেই। তারপর ফিরলাম, গেস্ট-হাউসের রাঁধুনীকে চিংড়ীর দায়িত্ব সঁপে, স্নান-খাওয়া সারলাম ও ফের নদীর ধারে। তরতর করে ভেসে চলেছে ডিঙিনৌকা আর মাস্তুলে উড়ছে ভারতের পতাকা। হয়তো ওপারের নৌকাও পতাকায় সেজে এমনি করেই সতর্কতা রাখে। আমরা বাংলাদেশের একটা নৌকাও দেখিনি... যদিও তীক্ষ্ণ নজরে আপ্রাণ খুঁজেছিলাম তাদের।
ফলুয়ের মত জাল দিয়ে দেখলাম ছোট ছোট ছেলেপুলেরা বাগদা আর গলদার মীন ধরছে। অদ্ভুত সেসব কারুকৃতি। দেখতে-দেখতে বেলা গেল আর হঠাত্ সোঁ-সোঁ শব্দে নদীকে উথাল-পাথাল করে ধেয়ে এল রাশি-রাশি মেঘ। ছুটতে-ছুটতে ঘরে ফিরলাম, কিন্তু মন পড়ে রইল নদীতে। কীজানি ওসব ভয় দেখানো তান্ডব না সত্যি ভাঙনের শুরু!!!!! প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার অভাবে নাগরিক মন ধ্বংসের শব্দেও নূপুর বাজার আমেজ পায়। তাই ঝড়ের তীব্রতা কমতেই ঝুপড়ি চায়ের দোকানে- ছ্যাঁচাবেড়ার আড়াল নিয়ে নদীর দিকে মুখ করে বসে গেলাম- ফের। ঠেউএর সশব্দ উতরোল, পাড়ের কাছে নদীর দাপাদাপি আর কব্জির জোরে নৌকাকে সঠিক দিশায় নিতে চাওয়া মাঝিমাল্লার কসরত্ দেখতে-দেখতে সন্ধ্যা পেরোল। আমরা আবার ঘরপানে- ভিড় এড়াতে দিনের লাস্ট ট্রেন ধরব, তারই প্রস্তুতি এবার।
রাতের খাওয়া সারলাম। এখন বাজে নটা, গ্রামের হিসেবে বেশ রাত। সেই পরিচিত ভ্যান, সেই অন্ধকার, সেই নির্দিষ্ট লয়ে প্যাডেল টানার ছুপছুপছুপ শব্দ শুনতে-শুনতে পৌঁছে গেলাম স্টেশন। ধুধু করছে প্ল্যাটফর্ম- কলকাতার দিকে যাবার জন্য ঐ রাতে কোথায় মানুষজন? উপরন্তু বৃষ্টি হয়ে গিয়ে চারিদিক ধোয়া-ধোয়া পূণ্য আবহের ঠান্ডা ঝড়ো হাওয়া। মনে হচ্ছে যেন পূজায় বসবে প্রকৃতি তাই গা-ধুয়েছে, চন্দনগন্ধে প্রস্তুত হচ্ছে সে। সংলগ্ন জঙ্গলে জোনাকীর দিপদিপ, টিমটিম করে জ্বলতে থাকা লালচে-নিভু আলো আর নিস্তব্ধ লম্বা পড়ে থাকা প্ল্যাটফর্ম যেন একা যেতে-যেতে হঠাত্ হারিয়েছে পথ- অন্ধকারে। এমনই সময় মুগ্ধতার বোধ খানখান ছিঁড়ে দিশপাশ কাঁপিয়ে ট্রেন এসে দাঁড়াল স্টেশনে, আর আমরা যে যার ব্যাগ খুলে দুদিনের এই অতুল সুখকে চেপেচুপে ঠুসে ঢুকিয়ে নিলাম আর বার করে পড়ে ফেললাম নাগরিক সভ্য মুখোস। কাজে ফিরতে হবে না...

চানঘরে গান@চিতওয়ান

নেপাল-এর জলে-জঙ্গলে
আজ(12.11.11)আনন্দবাজারের ওয়ান স্টপ ট্র্যাভেল-এ প্রকাশিত আমার লেখা
চানঘরে গান@চিতওয়ান
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

কোন সাড়া-শব্দ নেই, ঘঁতর-ঘঁতর করে আগুয়ান হাতী গায়ে প্রায় পড়ে আর কি! সামনে হাঁটছি, তিনি আসছেন পিছন থেকে। ভাগ্যিস্, ভাগো বলে চেঁচালো কেউ। লাফিয়ে বাঁয়ে সরতেই ডানদিক দিয়ে শুঁড় দুলিয়ে পেরিয়ে গেল জোরকদমে। কি হতো যদি ডাঁয়ে সরতাম? ভেবেই বুক থমকে যেই দাঁড়িয়েছি শুনি মহিলা চেঁচাচ্ছেন-
- ধারাধৌতি হোগা বহেনজী, জলদী যাও, জলদী।                    
- মতলব?
- আগে নদী হ্যায়- নারায়নী। ওহি পড়...
- লেকিন কিসকা... ক্যায়সে?
আর উত্তর... রাস্তার ধারে কাঠপাতার বোঝা নামিয়ে যে জিরেনটা নিচ্ছিলেন, তা ফের মাথায় তুলে ততক্ষণে হাঁটা দিয়েছেন তিনি, ছুঁড়ে দেওয়া অনন্য একপীস হাসি উপহার দিয়ে। 
এবার হাঁকপাঁক এগোই। অদুরে নজরে পড়ে নদী, তটরেখা আর তট ঘিরে সাদা চামড়ার বিদেশী মুখের মিছিল। বুঝে পাই না কি হল। রথ না দোল না ট্যানিং-এর টানে সানবাথিং-এর ভিড়! পা চালিয়ে এগোতেই জলে ধুপ্পুস্ আওয়াজ ও বেপরোয়া সেই হাতীই দেখি নদীতে উল্টেপাল্টে লুটোপুটি। ভাবলাম ভিনদেশীরা এজন্যই জুটেছেন- এটাই বুঝি ধারাধৌতি। সঙ্গে ক্যামেরা ছিল, পিচিক-পিচিক ছবি তুলছি, মাহুত হাতীকে শুনি বলছেন- বৈঠ, বৈঠ, বৈঠ... ওমা! শুয়ে গড়াগড়ি দেওয়া হাতি দিব্যি হিন্দী বুঝে মাথা ঝাঁকিয়ে বসল আর তুরতুর করে দুই বিদেশী উঠে এলো ওর পিঠে। ক্ত করে জড়িয়ে ধরল গলায় বাঁধা দড়ি আর সওয়ারীসুদ্ধু মাহুত এগোল ভিতরজলের দিকে।
কি ট্রেনিং!!! তার চেয়েও বড় দেখলাম- জীবনের আনাচ-কানাচে পড়ে থাকা রোদ্দুর, ঘুমিয়ে থাকা ইচ্ছেগুলোকে কত ঊজ্জ্বল করে অনুভবে বসত দিতে মুখিয়ে আছে বিদেশীরা। আমাদেরই দেশের হাতিতে চেপে স্নান, অথচ কোন দেশোয়ালী মানুষই নেই। দেখতে-দেখতে কি উত্তেজনা ভিতরে... মনে হচ্ছিল যাই... নেমে পড়ি- এ অনুভবের নুন-মরিচে নাহয় একদিনের জন্য প্রাণিত হোক্ আমার মধ্যমাপের ঘস্টানো দিন। কিন্তু... এই কিন্তুটাই যত গোলোযোগের।

গিয়েছিলাম নেপালের জঙ্গল- চিতওয়ান। সকালে ক্যানোইতে করে নদী পথের সাফারী সেরে পায়ে-পায়ে আশেপাশে ঘুরছি, এ ঘটনা তখনকারই।
মাহুতের একটা কায়দা আছে দেখলাম। মুখে বলার সঙ্গে, হাতীর পিঠের ওপর পায়ের প্রেসারে ঠিক কাজটার অক্ষর লিখে দিচ্ছে, যা শুধু ওরা দুজনেই জানে... দাতা ও গ্রহীতা। সওয়ারী পিঠে তুলে মুখে বলছে- পিছু, পিছু, পিছু... হাতী সামনের পায়ে ঠেলে উঠে পিছনের পা ফোল্ড করে বসছে। মাহুত বলছে- উঠ্, উঠ্, উঠ্... দেখি পা সোজা করে ধুমাবতী উঠে দাঁড়াচ্ছে। মাহুত বলছে- উপর, উপর, উপর... হাতী ফুরররর করে সিধে নিজের নাক বরাবর ছিটিয়ে দিচ্ছে জল- উপরদিকে। একবার তো জলের ধাক্কায় মাহুতের হাতের অঙ্কুশই গেল হারিয়ে। জলের তলায় শুঁড় বুলিয়ে-বুলিয়ে বোকা হাতী খুঁজেও দিল তা। তারপর কতবার যে মাথায় পড়ল সেটা...
শুঁড়-ফোয়ারার যা ইন্টেন্সিটি, তাতে স্নানকামীদের নাকানীচোবানী দশা। ফোর্সে টালমাটাল পরীরা ধরাশায়ী হয় আর কি। ধারাপাত সাইডে চাইলে মাহুত হাঁকছে- পিছাড়ি, পিছাড়ি, পিছাড়ি... ফুরররর এবার শুঁড় দুলিয়ে ডাইনে-বাঁয়ে। এমনি পিছাড়ি, উপর, বাঁয়ারীর কম্বিনেশনে সওয়ারী যখন নাকাল, তখন হাতীকে বসিয়ে মাহুত শুধু একবার হাঁকে- তীরে লাগে...
ব্যস, এই কথাটার বড্ড কাঙাল হাতী। কানে যেতেই ঢুপ্পুস্ করে ভরাভর্তি পোয়াতীর মত ডানকাতে শুয়ে পড়ছে আর সওয়ারী জলের মধ্যে পড়ে বিস্তর হাবুডুবু। এখানে একটা অপশন আছে। এই সময় যে পিঠ থেকে পড়বে না, সে বিনা খরচে মৌজ নেবে আবার। যদিও দেড়ঘন্টার হস্তিকান্ডে মোটে দুজন ব্যালান্স রেখেছিল। কিন্তু মুস্কিল ঐ... একবারের জল এপিসোডেই এমন উস্তমখুস্তম, যে পরেরবারে কেউ জলকাব্যে যাচ্ছেন না। অন্যদের নাস্তানাবুদ দেখাকেই উপাদেয় বোধে পাড়ে বসে হেসে-হেসে গড়িয়ে পড়ছেন- আমারই মতন।
নাচন-কোঁদন শেষ। মাহুতের এক চেলার হাত উপচে গেল টাকায়। হাতী ফের ঘঁতর-ঘঁতর চালে দিশপাশ নস্যাত করা পুছ-দুলিয়ে শুঁড়-ঝুলিয়ে মূহুর্তেই হাওয়া। নামেই গজগামিনী- ইচ্ছা হলে ভীমভৈরবী্। বাচ্চাদের মত পিছু নিতে চেয়েও ঠকে গেলাম। অবশ্য অসুবিধে নেই, খোঁজবার মন জেগে থাকলে মিলবেই- যেমন আমার মিলেছিল। ছড়িয়ে আছে অঢেল রূপময়তা চিতওয়ানের মাঠে-ঘাটে-গ্রামে। 
তখন বেশ বেলা, রোদে চলাফেরাই দায়। টুপি মাথায় এগোতে থাকলাম। জনপদ হাল্কা হয়ে ক্রমশঃ ধানজমি, কর্ষিত মাঠ, আলভূমির কাছে চলে এসেছি। কানে এল সানায়ের মত সুরেলা আওয়াজ ও দ্রিদিম-দ্রিম ঢোলের সঙ্গত। এতটাই তা মায়াময় ও জায়গার অনুষঙ্গে এতটাই সাযুজ্যের, যে নিজেকে হ্যামলিনের বাঁশীর টানে ভূতগ্রস্থ, আচ্ছন্ন এক ইঁদুর লাগছিল। ব্দ অনুসরণে এগিয়ে যাওয়াটা, নিয়তির মত নিয়ে গিয়ে ফেলল একটা এমন এলাকায়, যেখানে থারু-উপজাতির মানুষজন রিহার্সাল দিচ্ছে নাচের, গানের, বাজনার... 
জানলাম, হোটেল-সংলগ্ন যে সাংস্কৃতিক মঞ্চ আছে, প্রতি সন্ধ্যায় সেখানে পারফর্মেন্স হয়। সন্ধ্যা হতেই পৌঁছে গেলাম। সকালে যে নাচ বিনা সাজে দেখেছিলাম, তা এখন দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। ময়ূরীনৃত্য- বনে দেখে আসা পাখীটারই মতন- একদম। কি অবজার্ভশন, কি অসামান্য তার এক্সিক্যুশন। শেষে ছিল রিদিমিক পরিবেশনা, লোকসংস্কৃতি অনুসারী। ওরা উত্সাহী দর্শকদের ডাকলেন। মধ্যবিত্ত চেতনায় হেরে গেলাম এখানেও। উল্লসিত বিদেশীকুল এলোপাথাড়ি পা ছুঁড়ে, ঘুরে-ঘুরে নাচল আর আমি ডান্সার হয়েও, ফোক-এর সঙ্গে যদি না মিলতে পারি এই দ্বিধায় ফুরিয়ে ফেললাম বেলা। 
শো শেষ। চেতনায় পরের জন্মে মধ্য-মানসিকতা মুক্তির আকাঙ্খা নিয়ে উঠলাম। আজ কোজাগরী লক্ষীপূজো। জ্যোত্স্নার প্লাবনের মধ্যে দিয়ে যেতে-যেতে মনে হল হাস্যমুখে, স্মিতস্বরে প্রকৃতি বর দিচ্ছেন আমায়- ইচ্ছামণি ভব।

********************************************



সিমলিপাল- অজানা গান





তব কমলপরিমলে রাখো হৃদি ভরিযে  

 


'তথ্যকেন্দ্র' পত্রিকায় প্রকাশিত 1.09.2010
সিমলিপাল অজানা গান  
মঞ্জুশ্রী রাযচৌধুরী

: যাবি?
-----

ক্লাশে একদিন হঠাত্ই বললাম।
: কোথায়, কোথায়, কোথায়?
সম্মিলিত আগ্রহস্বরে রিনরিনিয়ে উঠল ওদের মনের নূপুর।
কোথায় আর, যাই চল্ বনে।
আমি একাই হুজুগে নই। দেখি আমারই মতন খ্যাপা ওরাও প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে বললো
চলো, চলো, চলো।
ব্যস। চলো তো চলো। সঙ্গে সঙ্গে সব বসে পড়লো ক্যালেন্ডার খুলে ছুটি-দিনের রাঙা আলোর খোঁজে। পাওয়া গেল শুক্রবারের ২৩ শে জানুয়ারী থেকে সোমবারের ২৬ পর্যন্ত ৪ দিনের লাল দাগানো দিন।
তখুনি কথা, তখুনি ফাইনাল ও তখুনি শুরু বুলবুলের (আমার ডাকনাম) ওড়াউড়ি। ঠিক হল যাব সিমলিপাল।

ব্যবস্থা কার?
-------

সব ব্যবস্থাদি আমার। এ ভার কেউ দেয়না আমায়, আমি নিজেই তুলি কাঁধে। ঐ যে যাচ্ছি-যাচ্ছি-র গান শুনি অনবরত, তা কী কম? বাবাঃ। যে আমার কী ভাল লাগার ঘটনা, তা বলার নয়। যাবার আগের এই যে প্রস্তুতি, এই যে মনের পাকে জড়িয়ে যাওয়া প্রকৃতি, সঙ্গী, কল্পনার উড়াল তাই তো আসল খুশী। দিন চারেকের ঐ হট্টগোল তো আসবে আর ফুরিয়ে যাবে অকস্মাত্। তার আগের এই উদ্ভাস তো অপরিমেয়। বেড়ানোর ওম্ আমি শুরুর সলতে পাকানো থেকে প্রদীপ শিখার কাঁপন অবধি ধীরে-ধীরে নিতে-নিতে যাই। তাই একা-একা করছি, কেন করছি বা বাকীরা সাহায্য করলো না কেন-র কোনো অনুযোগই তৈরী হয়না মনে। বেড়াতে গিযে সবার চোখে যখন খুশী ছলকে ওঠে, আমার তখন ঐ প্রাপ্তিটা অন্যদের চেযে বেশী অর্জন বলে মনে হয়। তা সে যাই হোক্, এবার তো বনবাংলোর বুকিং, ট্রেনের টিকিট, জীপের ব্যবস্থা, বনে কদিন কি খাবো তার লিস্ট ইত্যাদি-প্রভৃতি কত্ত কাজের হিসেব। বসে গেলাম সবকিছুকে নিয়ে সাজাতে- একা একাই।

ছন্দ ছিল কি?
--------

ছিল ছিল, কিছু তো ছিলই। কিছু আবার ছিলও না। য়েমন ট্রেনের টিকিটেই ছন্দহারা আমরা কি জব্দ যে হলাম। আমি দেখেছি, যেকোন কাজ সুচারু হয় যদি তার ছন্দটা ঠিক থাকে। যে জায়গায় আমরা ছন্দহীন, সেখানটা কিন্তু ছেড়ে কথা বলে না। আসলে সবকজনেই তো আর চাকুরে নয় যে যাব ভাবল আর ঝড়াক করে টাকাও বেড়িযে এল। এবার আজ দিচ্ছি ম্যাম, কাল দিলে হবেনা, অন্যেরা দিক আগে-র বাহানা সামলে যখন অল্পস্বল্প ফান্ড তৈরী হল, তখন হাতে আর একমাস বাকী সময়। আমি অথচ খরচ শুরু করে দিযেছি। বনবাংলোর বুকিং সারা, ব্যবস্থা করেছি বোলেরো 9-সীটার গাড়ীর, দুদিন অরণ্যভ্রমণ সেরে দেবকুন্ড হযে থাকবো য়ে খাসাডিহা-র ইকো-ক্যাম্পে, তারও বুকিং শেষ। এতো হোটেল নয, জঙ্গল বলে কথা। প্রত্যেকের নামে আগাম বুকিং না সারলে থাকার অনুমতিই মিলবে না। সুতরাং...
ট্যাঁকের টাকা খরচ করছিলাম ঠিকই কিন্তু বুঝছিলাম না যে কে বা কজন যাবে। এই টালবাহানায় যেই দেরী করেছি, ব্যস্- বালেশ্বরের টিকিট কাটতে গিয়ে পড়লাম একদম 127নং ওয়েটিং লিস্টের ফাঁপড়ে। এবার খানিকটা নিজেকে ও বাকিটা ওদেরকে বোঝাতে বললাম-ওরে, তোরা সব ডান্সার। যখন প্রোগ্রামে নাচিস্, তখন আড়াই/তিন ঘন্টা তো কোথা দিয়ে উবে যায় বল। পারবি না আর ঘন্টাখানেক দাঁড়িয়ে যেতে? মোটে তো সাড়ে তিনঘন্টার জার্নি। মুখ কাঁচুমাঁচু ওরা আমার কথা শোনে আর আগত দিনটায় ভিড়ভাট্টার মধ্যে কষ্ট সামলানোর কৌশল খোঁজে। নিজে নাচা আর নাচতে থাকা কামরায় শরীরকে সিধে রাখতে চাওযা কসরত সেম হল? জানি, জানি- আমিও জানি তা। তাই ওদের আত্মবিশ্বাস উসকে দিতে বলি- উপায় কি, বুকিং সব সারা। এখন তীরের কাছে এসে পড়েছি, তরী আমাদের ভেড়াতেই হবে। ওরা মনে-মনে প্রস্তুতি দেখলাম সেরেই রেখেছে। কচিমন বলে কথা- অল্পে রঙীন, অল্পে মুখর, অল্পেই তুষ্টি। তবু আঁধার মুখগুলোয়, স্বর্ণকুচির উদ্ভাস দেখতে চাওয়ার লোভে আমার মন কিন্তু অন্য উপায়ও খুঁজতে থাকে। এসপ্ল্যানেড্ থেকে বারিপদার বাস ছাড়ে, একদিন সেখানেও দৌড়লাম। বিকেল পৌনে ৪-টেয় লাস্ট বাস ছেড়ে তা পৌঁছবে রাত ১০টায় বারিপদা। আমাদের সাকুল্যে 4-টি দিনের একটি যদি বাসেই......নাঃ। এ ভাবনা ত্যাগ করলাম তত্ক্ষনাত্। কী আর বলি- আমাদের একার চোখেই তো ঐ 4 দিনের রাঙাআলো ধরা পড়েনি, যারা অর্গানাইজড্ তারা স্বপ্নসত্যির হিসেব কষেছে আরো অনেক আগে। আমি হাঁকুপাঁকু করলেই কি দনাদ্দন যা চাই তা মিলবে? যারা অনেস্টলি ও ইগারলি চেয়েছে, ভবিতব্য তাদেরই হেল্প করবে এতো জানা হিসেব। জ্ঞানপাপীর মত সব বুঝেও মনে স্বস্তি নেই মোটে। প্রায় প্রতিদিনই একবার করে এনকোয়ারীতে ফোন করি আর এগিয়ে আসতে থাকা দিনের দিকে চেযে শ্বাস ফেলি লম্বা। পজিশান কোনোমতেই এগোয় না। এই করতে-করতে বেড়োবার ঠিক আগের দিন সন্ধ্যায় জানলাম- টিকিট কনফার্মড। ব্যস্।

নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিয়েছিলে বুঝি?
-----------------------

হ্যাঁ, হ্যাঁ, তা বলা যায় বেশ। মনে রাজ্যজয়ের খুশী এসে এমন বসত গড়লো, যে তার রেশ টানতে ট্রেন ফেল হবার জোগাড়। যেন ওটাই মোদ্দা হিসেব ছিল, এবার দেরী করে গেলেও রেলঅলারা গাড়ী না ছেড়ে হেঁকে হেঁকে বলবে-দিদি  আসুন-আসুন, বসুন-বসুন, খাবেন নাকি কিছু?যা পাবার ছিল না, তা পেয়ে খুশীর স্বস্তি এমন নিশ্চিন্তির কাঁধে ভর দিল যে শেষ মূহুর্তে ছুটে-ছুটে-ছুটে দমহারা আমাদের ভুল গাড়ীতে তুলে রেল শোধ নিচ্ছিল আরেকটু হলেই। একে দেরী করে বেড়িয়েছি, তায় বোঁচকার ভার বিপুল। এবার টাঙিয়ে দেওযা নামের লিস্টি ও বগি নং খুঁজতে গেল একজন। আর আমার অবস্থা- এই রে পালায় বুঝি, পারলে ট্রেনের যেখানে খুশী উঠি। কারণ প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি দেখাচ্ছে আর 5 মিনিট বাকী। তীরে এসে তরী না ডোবানোর যে এক্স্যাম্পল দিযেছিলাম, সেটাই যেন মুখের সামনে এখন ভেংচী-নৃত্য করছে। ছিঃ, ছিঃ, ছিঃ। চোখের সামনে দিয়ে ভোরের গাড়ী এভাবে পালাবে? কোনো একটায় উঠে তো পড়ি, পরে স্থিতু হয়ে নাহয় খোঁজা যাবে। যেই ভাবা সেই কাজ। যে বগির দরজা সামনে পেলাম উঠে পড়লাম হাঁকপাঁক করে। এদিকে আরেক পাবলিক তো ওঠেইনি। তিনি একদম ঠিক-কামরার ঠিক-আসনে ঠিক-ভাবে বসেই ছাড়বে ভেবে দেখতে গেছেন লিস্টি। ভাগ্যিস্। শুধু এটুকুই কিন্তু বাঁচিয়ে দিল আমাদের। দৌড়তেদৌড়তে সেইজন এসে পৌঁছল যেই, সেই একশো কথা শুনিয়ে তাকে বগিতে উঠিযে নিতে আমরা মরিয়া ঝাঁপালাম। চেঁচামেঁচী শুনে কামরার এক যাত্রী বলল -আরে করসেন কি, এই গাড়ী রূপসী বাংলা’ ‘ধৌলী তো নয়। মানে? আকাশ ভেঙে পড়া মাথায় বোঁচকা চাপিয়ে ফের দৌড়-দৌড়-দৌড়। এবার যাকে কথা শুনিয়েছিলাম, এখন তারই পদাঙ্গ অনুসরণে ছুটছি। ঐ বিশাল লম্বা ট্রেনটার প্রায ইঞ্জিনের কাছে আমাদের কামরা, যেতে হবে অদ্দুর। প্ল্যাটফর্মের ঘড়ি এদিকে ৬টা বাজিয়ে দিযেছে। ভুল বগিতে ভুল করে উঠেছিলাম বলে কিছু আর বলার মুখ নেই, তাই ছুটছি শুধু। হাঁপাতে-হাঁপাতে বদ্ধদমে আকাঙ্খিত কামরায় এবার পা ফেলা মাত্র গাড়ীর নাকছমাচ্ছম ছুট্। আমাদের সকলের যৌথ চাওয়ার তীব্রতাই হবে বোধহয়, ট্রেন নাহলে পাঁচ মিনিট লেট-এ! ছটার ট্রেন ছাড়ল ছটা বেজে পাঁচ। আমরা ছজন অবশেষে চললাম সিমলিপাল।

ভাগ্যিস্!……… আরও কতবার?
---------------------

আর মোটে একবার। ভোরের ট্রেন জুড়ে সেদিন থিকথিকে ভিড়। প্রায় এওর কোলে-কাঁখালে, কিংবা বগলের ফাঁকে আটকে গিয়ে যমযন্ত্রণার টিপ্পুনী নিতে নিতে নামলাম এসে বালেশ্বর। রিজার্ভ বগির ধরণই যদি এই, না জানি জেনারেল কি ছিল? এরপর পাখীর ডানায় ভর করে যে উড়াল নিল দিন, তার সুখ বুকে বইতে-বইতে একসময় কবিতা হয়ে গেল। ওতে যাব পরে। গদ্যে বরং ছন্দপতনের শব্দ শোনাই। ইকো ক্যাম্পের বোর্ড হাতে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যিনি, তাঁর সাথে গিয়ে বেশ তকতকে এক নতুন বোলেরোতে চড়া গেল। দুর্লভক্ষণের খোঁজে, ফুরফুরে হাল্কা মনে এই আনন্দিত-জনেদের নিয়ে শীত সকালের কুয়াশা ছিঁড়ে গাড়ী ৩ মিনিটেই স্পীড তুললো ১০০কি.মি পার আওযার। ড্রাইভার ওড়িয়া, নাম কাকু ও বাংলাতে বেশ পটু। সে জানালো বালেশ্বর থেকে গাড়ীতে ঘন্টাদেড়েক লাগবে বারিপদা। তারপর পিথাবটা চেকগ্যেটে নিজেদের পরিচয়ের প্রমাণ দাখিল করে বনমধ্যে আরো চার-সাড়ে চার ঘন্টার যাত্রাশেষে পৌঁছনো যাবেজামুয়ানী। আমাদের বুকিং ওখানেই, 2750 স্কো.কি.মি বনের সেই একদম শেষমুড়োয়। অথচ বারিপদা না হয়ে যোশীপুর দিয়ে বনে ঢুকলে নাকি পৌনে এক ঘন্টাতেই পৌঁছে যাব বাংলোয়। বালেশ্বর থেকে যোশীপুরের রাস্তা পিচঢালা হাইওয়ে যেহেতু, গাড়ী বললো উড়েই যাবে নাকি। কাকু বেশ জোরই করতে লাগলো আমাদের। শুরু হল এবার আমার দোনামন। কি করি, কি করি? সমস্ত দাযিত্ব আমার যেহেতু তাই সিদ্ধান্তের ভারও আমার। ভুল হলেই ফের গুলিয়ে যাবে সব। তাছাড়া ছজনের থেকে মত চাইলে যে ছশো মতের আমদানী-সম্ভাবনা, তা থেকে বাছাই করে........বাপরে.......। মনে ভাবলাম, থাক, ডিসিশন নিজেই নিই। বনে এসেছি এই জঙ্গুলে এ্যামবিয়েন্সটাকেই তো চেটেপুটে নিতে। সুতরাং কেন দ্বিধা, কেন ফের অন্যপথের ভাবনা? যে পথ জানি সে পথেই যাই, হোক্ দেরী। আত্মস্থিত থেকে ও বেশ বিশ্বাসের সুরে বললাম- লাগুক সময়....বনের মধ্যে দিয়েই যাব। এখানেও সেই ভাগ্যিস্-এরই কারুকৃতি ফের। বারিপদার পিথাবটা চেক গ্যেট দিয়ে ঢুকতে গিয়ে জানলাম, পারমিশন যেহেতু বারিপদার থেকে, তাই যোশীপুর দিয়ে গেলে বনে এন্ট্রিই পেতাম না। আমার আত্মপ্রত্যয়ের ক্যানভাসে এবার বাকীদের সপ্রশংস তুষ্টির ছায়া পড়লো। ভাগ্যিস্ এ রাস্তা বেছেছিলাম।

পাগল হলে চলে?
--------------

না তো- চলে না, কিছুতেই নয়। তাই দেরী নয, ছুটতে হবে জোর। মনমুকুরে এখন বনের ছাযাছবির ডাক। যে হুহু শব্দে গাড়ী নিয়ে দৌড়চ্ছিল কাকু, জঙ্গলে ঢুকতেই সে কেরামতি খতম। ঘাটরাস্তায় অজস্র ওঠা-পড়া, ঘনঘন বাঁক। বিশাল বিশাল শাল-সেগুনের গাছ, কোথাও কোথাও দঙ্গল বেঁধে যেন হাত ধরাধরি করে আগলেছে পথ। তারই ফাঁক গলে পথে লক্ষ কাটাকুটি, আলোর ছায়ামাখা আল্পনা। এই মুগ্ধতার রেশ থাকতে-থাকতেই দেখি পথের বাঁকে চোখের ওপর য়েন লাফিযে পড়ল লুলুং নদী। ভুলে গেলাম বেলা অনেক হল, ভুলে গেলাম গিযে রাঁধলে তবে খাওয়া হবে। সব কজনের হুটোপুটি, বনের বাঁক, নুড়ির ফাঁক গলে কোথা দিয়ে পেরিয়ে গেল সময। শেষে কাকুর ডাকে সম্বিত ফেরে। আমাদের মত ওর তো আর পাগল হলে চলে না। প্রোফেশনের প্রয়োজনে প্রকৃতির এই মোহাবেশ থেকে মুক্তি নেবার কৌশল ওকে শিখতে হয়েছে। এই আবহে তৈরী হওযা ভাপকে তাই উড়িয়ে দিতে সময় লাগলো না ওর। আমরাও আচ্ছন্নতা কাটিয়ে উঠে বসলাম জীপে।

বিভ্রান্তি। কার?
------------

সন্ধ্যে যখন রাতের কাছে ডিউটি বদল করছে, প্রায় এরমই সময় এসে পৌঁছলাম জামুয়ানী। কৃষ্ণপক্ষের রাত। আকাশে তাকিয়ে মনে হল যেন ধরা দেবে হাত বাড়ালেই। এতও তারা হয় আর তা কিনা দেখা যায় এমনি খালি চোখে? মুগ্ধ সবাই ফের উন্মন, ফের চেনা আকাশের অচেনা ছন্দে দিশাহারা। এছাড়া অন্য উপায়ও নেই। গাড়ীর হেডলাইট নেভা মাত্র ঐ ঝাঁপিয়ে পড়া অন্ধকারে নিজের হাত-পা-ই নজরে আসছে না তো বাংলো। দূ-রে একটা আলোর আভাস দেখে ওদিকে যাওয়া গেল। দেখি ওটা চৌকিদারের ঘর ও তারা আমাদের দেখে যেন বিভ্রান্ত-টালমাটাল। কি যে করবে ভেবে পাচ্ছেনা। না, এটা হবার ছিল না। আসলে মকরসংক্রান্তির পরপরই ওদিন ছিল প্রথম হাটবার। হাঁড়িয়ায় আকন্ঠ মস্ত হয়ে ব্যোম ভোলানাথ দশা সব্বার। এদিকে বাস্তব অবস্থার সামনে পড়ে সারাদিনের ক্লান্তি হুমড়ি খেয়ে নেমেছে আমাদের শরীরে। এবলে ঘর দেখাও, ও বলে বাথরুম যাব, কেউ হাঁকে আলো দাও, নাকীসুরে ক্ষিদের বায়না তোলে কেউ তো কেউ ঐ মাঠেই শুতে চায়। মাদকতায় গ্রস্থ মানুষগুলোর কিনা একেই মাথায় ভীমরুলের গুনগুন, তায় বাইরে থেকে এই অনভিপ্রেত চ্যাঁ-ভ্যাঁ। গ্রামের লোকাল গরীব চাষীভুষি মানুষ এরা। এখন কি যে করবে, কোথায় দাঁড়াতে দেবে বা এই সম্মিলিত চাহিদার কোনটা আগে মেটাবে তা নিয়ে ছোটাছুটি শুরু করলো। করলো তো, কিন্তু আলোর পরিধির বাইরে গিয়ে যেই ওরা নজরহারা, শুরু হচ্ছে ফের আমাদের জল, আলো, ঘরের জন্য হাহাকার। ওরা আসলে সেই ব্যবস্থাই করছে ও তা অন্ধকারকে সঙ্গী করেই। এরিযাটা যে মুখস্থ। দূর থেকে টিউবওয়েলের ঘ্যুচুং-ঘ্যুচুং শব্দ শুনতে পাচ্ছি, ভুষোমাখা লন্ঠন একটা ধরিয়ে গেল কেউ, কাঠ ফেড়ে আগুন জ্বালার চেষ্টাও শুরু হল। চৌকিদারের বৌমা এবার টলোমলো পায়ে একটা হেঁচকী তুলতে থাকা লন্ঠন নিয়ে চললো আমাদের ঘর দেখাতে। ওটুকু আলোয় নজরে এলো পাশাপাশি দুটো ঘরে দুটো-দুটো করে বিছানা, সঙ্গে এ্যাটাচবাথ্ ও বাথরুমে একটি বালতী, মগ ও বেসিন। লন্ঠন যেহেতু একপীস্, তাই বাথরুমে কেউ গেলে বাকীরা অন্ধকারে ঘুপচীমুপচী ঐ এক খাটেতেই জড়োসড়ো। শুনলাম হ্যারিকেন আছে, কেরোসিন নেই। আমরা পরদিন যখন বনমহলে বেড়োবো, তখন ঐ গাড়ীতেই গিয়ে ওরা অন্য কোনো বাংলো থেকে তেল আনবে। বিভ্রান্তির চরম একদম। তা যাই হোক্, একসময় বাথরুমে যাবার পালা এলো আমার। পায়ের কাছে লন্ঠন রেখে মুখ ধুতে জল ফেলেছি বেসিনে, ব্যস, ঐ শীতের রাতে পা গেল সপসপিযে ভিজে আর হেঁচকী ওঠা লন্ঠনে জল লেগে দপদপ করে তিনি দেহ রাখেন আরকী। কি হল? দেখি ওমা- বেসিন আছে, পাইপ নেই। যেহেতু তোলা জলে কাজ সারতে হবে তাই বাহুল্যবোধে পাইপ-ই লাগানো হয়নি।

অপ্রাপ্তি না প্রাপ্তি?
-----------

ইতিমধ্যে রাতের খাবার রেডী। সারাদিনের না খাওযার পরে যেন অমৃতভোগের গন্ধ নিযে খিচুড়ী-ডিমভাজা এল। পেটে দানাপানী আর চোখ-সয়ে নেওযা অন্ধকারকে মনে-মনে যেই গ্রহণ করলাম, ব্যস্, আর আমাদের পায কে? মনে এমন তৃপ্তি বসল যে স-ব অপ্রাপ্তিগুলো মধুর ও এ্যাডভেঞ্চারাস লাগতে লাগলো। হাঁড়িয়া না খেয়েও শুরু হল মনে একশো ফানুসের ওড়াউড়ি। শুধু বুঝে নেবার ছিল অবস্থা ও পরিস্থিতিটা। খুশী-মন এবার আঁকড়ে ধরলো সমগ্র পরিবেশ ও তার বাই-প্রোডাক্ট। গল্পগাছায় সময় কোথা দিয়ে উড়ে গেল কেজানে। আকাশে তারা দেখে আর জোনাকীর আলো গোনা শেষে বেশ রাত করে সব শুতে গেলাম ঘরে। পরদিন ভোরে যখন রোদের আলো, আলপথ, ধানের ক্ষেত, বয়ে যাওয়া নাম না জানা নদী, ছড়িয়ে থাকা পলাশ বিছানো পথ- এই সবটা নিয়ে ধরা দিল জামুয়ানী, তখন আমরা আনন্দে আত্মহারা। বেড়াতে গিযে এই যে অচেনা কিছু হিসেব, অজানা ঘটতে থাকা নানান আলুথালু ঘটনা, একে যদি এ্যাডভেঞ্চার বলে, তবে তার পূর্ণ আস্বাদন দিল সিমলিপাল। এই মাপের প্রাপ্তিবোধের জন্য অবশ্য সবার মন প্রস্তুত নয়। কিন্তু সৌভাগ্যবশতঃ আমাদের কজনার মনের তার ছিল একই সুরে বাঁধা।

কি চাও, নিজস্ব রঙ না সাজানো ঢঙ?
-------------------------

যেখানে কিছুটা ফাঁকা মালভূমি মত এরিয়া আছে, কাছাকাছি নদীজলের উত্স আছে, সেখানে মাত্রই 4/6 ঘরের যে গ্রাম, তারই কাছাকাছি বাংলোগুলোর অবস্থান। বনদপ্তরের মনোভাব ব্যাপারে খুবই যুক্তিগ্রাহ্য। বন্য পরিবেশ তার নিজস্ব রূপে থাকবে, আর বাইরের জন তুমি তার মন রাখবে অর্থাত ওদের সাজানো স্বর্গে গিযে, ওদের খুশীর মধ্যে নিজেকে স্থাপন করে নিবিড় ভাবে জড়িয়ে নাও তোমার আনন্দআবেশ। পশু-পাখী-বন-আদিবাসীজন সবাই চলবে-ফিরবে-ঘুমোবে তাদের নিজস্ব ঢঙে, নড়বে আপন বিভঙ্গে। চাও যদি তবে ঐ সুখ তুমি আলতো করে শুধু মেখে নিতে পারো মনে। এ বৃত্তান্ত আমার একদম সঠিক বলে মনে হল। কোত্থাও কোনো সাজানো রঙের বেয়াড়া হিসেব ছিল না। সিমলিপাল সোচ্চারে জানান দিযেছে তার উপস্থিতি প্রতিদিন ভিন্নভিন্ন ছাঁদে।                                               
ঝর্না-পাহাড়-পাখীর কথা কখন?
---------------------                                                               
বলব-বলব, ধীরে এবং ধীরে। এরপরের তিনদিন শুধু বন, হরিণ, ঝর্ণা, পাহাড়, ওটাচ-টাওয়ার, নদী আর শুঁড়িপথে মুক্তো কুড়োনোর গল্প। এগল্প চেনা, এ গল্প প্রাপ্তির, গল্প শুধুই খুশীর ক্ষণগুলোকে রোয়ার, মনের গোপনে বন্দী করার ও কল্পনার তুলিতে সাজিয়ে আপন-সঙ্গে খেলার। এই সিমলিপাল-অজানা গান-এর ক্যাপসানে ওর বসত নয়। তাই ওই খুশীকে অন্যনামে মুক্তি দেব পরে। তারচেয়ে যে সুখটা বুকে থাকতে-থাকতে কবিতা হয়ে গেল শেষে সেটাই শোনাই।

সিমলিপাল, সিমলিপাল
বনবাদাড়ে মন মাতাল।                                       
হিমেল হাওযার পাগলামী সুখটানে,
ছয় ছাগলে খরাক্লিষ্ট প্রাণে,
অরণ্যঘ্রাণ অঢেল ঢেলে নিলুম।

ছাগলগুলোর নাম দেবাশীষ,
সংগীতা, জয়মালা
ছাড়া
খোকন ছিল সাথে।
আর মঞ্জুর যেজন,
বাঁধন-মরণ-ক্ষরণ,
সঙ্গী সে তো ছিলই।

বুকের খাঁচায় সবুজ-সবুজ রং মেখেছি,
মন ধুয়েছি লুলুং নদীর জলে।
সমমনা আমরা কজন মিলে,
টিমটিমে লন্ঠনে,
ভয় পেযেছি খুউব।
 
সুখ শুধু নয় ঘরে।
দুঃখরই বা এতই কোথা জোর?
যে মিলন-আকুল ইচ্ছে ছিল বুকে,
প্রকৃতির সেই রূপ-রূপালী থেকে
নিলাম আলো-ধুলো তুলে,
নিলাম দু-দশ মাসের রসদ।
এখন আমার ভিতর ভিসুভিয়াস
আমার ইচ্ছে লিম্যুজিন।
আগুনবুকে দৌড় শুধু দৌড়।
এখন আমি যীশু দয়ার সাগর।
খন আমি বট-এর মত ছায়া।
এখন আমায় দুঃখ দেবে যে,
তাকেও দেব স্বর্ণকণার মালা।
************************************

যাচ্ছি দূরে 
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
ওরে ওরে ওরে আমার মন মেতেছে।  কেন? কেন আবার, বৃষ্টিতে সাধ গিয়েছে ভিজতে, তাই যাচ্ছি দূরে। কদম্বের গন্ধ-মাতাল বনে, হলুদ রেণুর সুরে, বন্ধু-আঙুল আঁকড়ে যাব লেবু রঙা নদীর জলে মন ভাসাতে সাতটি সহ-সুমন। জায়গার নাম হাজারীবাগ, নদীর নাম বরাকর, প্রেমের নাম প্রকৃতি আর আমার নাম পাগল। থাকবো বনের আপন ঘরে, আর কচুপাতার মুক্তোকণা নিয়ে প্রাণ ভরে খেলবো সাতজনে।

আর স্বজন? কি যে বলি, কেমন যেন স্বজন!!!!! মন মরুক, দেহ বাঁচুক ভাবনা ফাঁদে পড়ে, তারা একশো পিছুটানে। যেওনা, যেওনা... জলে বানের ডাক, যেওনা, যেওনা... হাওয়ায় বিপদ-আভাস। কোথায়? আমি তো দেখি জলে পানকৌড়ির ডুব, আমি তো হাওয়ায় শুনি মেঠো বাঁশীর সুর। এজন্যই স্বজন তুমি আর আমি মিললাম না কোন কালেই। কি আর উপায়? তুমি থাক নাহয় তোমার সুখী উদ্বেগকে সঙ্গী করে আর আমি ঝর্ণা তলার বিপদে। ফিরে আসি, দেখা হবে রোদের পথে ফের। তখন স্বজন- কেঁদনা।

ভুটান ঘুরে এলাম ( The land of Peaceful Dragon)
কিছুদিন আগে ভুটান ঘুরে এলাম। আমরা টিমে প্রায় ১৫ জন ছিলাম। ভুটানে একটি সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের রুট ছিল "বুড়িমারি - জয়গা - ফুন্টসিলং - থিম্পু - পুনাখা - পারো - জয়গা - বুড়িমারি - ঢাকা"। ওদের সংস্কৃতি দেখে এলাম, আমাদের সংস্কৃতি দেখিয়ে এলাম। ওরা অনেক বেশী বন্ধুবৎসল। যদিও আমাদের ট্যুর ব্যাক্তিগত ছিল, তারপরও ভুটান মিনিস্ট্রি যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আপ্যায়নে ও কমতি ছিল না। আমাদের হোটেল থেকে শুরু করে সকল দিকেই ছিল তাদের সুনজর। মিনিস্ট্রি থেকে টুরিস্ট বাস দিয়েও সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশ থেকে আমাদের টিমের ভিসা পেতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। দু-একজনকে ভারতীয় এম্বাসি একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল তবে ডবল ট্রানজিট ভিসা হয়ে গেছিল সবার। আমি, ববি ( আমার স্ত্রী ), আফসারা (আমার মেয়ে), সুমি আপা, সুমন ভাই (সুমি আপার হাসবেন্ড ), সঞ্চরা ( সুমি আপার মেয়ে ), লিমন ভাই, জুয়েল ভাই, লাকি, জয়া, বাবু ভাই ( গানের শিল্পী ), অভিনেতা সানবিম, লুৎফর স্যার ( আমাদের এই ট্যুর এর আহবায়ক এবং নিয়ন্ত্রক ) এবং ওনার পুরো পরিবার মিলে আমরা গিয়েছিলাম বাই রোডে।

রাত ১০ টার মধ্যে শ্যামলীর বি.আর.টি.সি কাউন্টার গিয়ে উপস্থিত হলাম। ১০ই সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১২টায় যখন গাড়ি ছাড়ল, তখন অন্যরকম একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিলো। সেদিন ছিল চাঁদ রাত, মোবাইল এর এফ.এম. এ বেজে উঠছিল "রমজানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ।"

বুড়িমারি বি.ডি.আর. ক্যাম্পে আমি ও আমার পরিবার
বুড়িমারিতে পৌঁছলাম পরদিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে, সেদিন ছিল ঈদুল ফিতর এর দিন। সেইদিন ই প্রথম ঈদ এর নামাজ পরতে পারলাম না। বাংলাদেশ বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করার সময় একটা আশ্চর্য অনুভূতি কাজ করছিলো, একই রকম মাটি, ঘাস, বাতাস, কিন্তু পার্থক্য ছিল একটি সীমানা। নো-ম্যান্স ল্যান্ড এ গিয়ে অবাক হচ্ছিলাম, এখন আমি কারো না। না ভারতের না বাংলাদেশ এর। এটাই দেশের বাইরে প্রথম যাওয়া তাই হয়তো একটু বেশিই অবাক হচ্ছিলাম।
সীমান্ত থেকে জলপাই গুড়ি হয়ে চলে এলাম জয়গা চেক পোস্ট এ। এখান থেকে ক্লিয়ারএন্স নিয়ে সোজা চলে এলাম ভারত ভুটান সীমান্তে। আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো, তাই ফুন্তসলিং এ হোটেল পেলজরলিং এ খাওয়া দাওয়া করে রওনা হলাম থিম্পুর দিকে। একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ভুটানে ঢুঁকে বাংলা বা ভারতীয় খাবার আশা করা বোকামি। তাই ওখানে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে খাবার সেরে নিতে হয়েছে। এগুলো এক কথায় অখাদ্য। ভারতীয় যে খাবার গুলো ওরা রান্না করে তা ভালো কিন্তু ...........................

Bolero গাড়ি
যাই হোক, একটা বোলেরও গাড়ি ভাড়া করে রাতেই রওনা দিলাম। আমাদের ড্রাইভার এর নাম ছিল আমিন। চমৎকার একটি ছেলে। ওর কাছে পথে যেতে যেতে ভুটান এর কিছু বর্ণনা শুনলাম। পথে বেশ কয়েক স্থানে চেক পোস্ট ছিল, আমরা সেইখানে গাড়ি থামিয়ে পাসপোর্ট চেক করিয়ে নিলাম। রাতে পাহাড় বেয়ে গাড়ি উঠছিল, সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সারাদিনের জার্নিতে সবাই ক্লান্ত কিন্তু ঘুম আসছিল না কারো, তার বদলে সবাই ঝিমুচ্ছিলাম।

গেদু, পাহাড়ের কোলে বার
এমন সময় ড্রাইভার আমিন কে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে ভালো কোন চা খাওয়ার মতো জায়গা আছে কি না? জিজ্ঞেস করে আবার নিজেই চিন্তা করলাম এই পাহাড়ে চায়ের দোকান আসবে কোত্থকে, কিন্তু আমিন বলল, চিন্তা করবেন না একটু সামনেই গেদু নামক একটা জায়গা আছে যেখানে চা পাওয়া যায়। গেদু পৌঁছালাম প্রায় রাত ১২টায়। এখানে পেলাম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা এলাকা। ভুটানে প্রায় প্রতিটি দোকানই বার, যেখানে বিয়ার থেকে শুরু করে কিছু লোকাল এবং কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া যায়। আসলে পাহাড়ের উপরে বলে ওখানে ঠাণ্ডা বেশী পরে তাই ওরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ার এবং অন্যান্য আল্কহলিক পানীয় গ্রহন করে। হয়ত এ জন্যই আমাদের গাড়ির সামনে লেখা ছিলো "Life is risky after whiskey"। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে ভুটানে অ্যালকোহল খুবই সহজলভ্য কিন্তু কোথাও সিগারেট পাওয়া যায় না। 

যাই হোক চা পাওয়া গেল, কিন্তু মুখের কাছে এনে দেখি শুঁটকির গন্ধ। আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। দেখলাম অন্য সবাই খেয়ে ভালই বলছে। আমিও তখন একটু চেখে দেখলাম, আমার কিছুটা পেট ব্যাথা করছিলো, চায়ে চুমুক দেয়ার ১০ সেকেন্ড এর মধ্যে ভালো হয়ে গেল। পরে জেনেছিলাম ওটা ছিল হারবাল সবুজ চা।
থিম্পুতে হোটেল টেনডিন

থিম্পু পৌঁছালাম রাত ২টায়। হোটেল টেনডিন এ বুকিং দেয়া ছিল আগেই, তবে হোটেলে গিয়ে কোন খাবার পেলাম না। কি আর করা না খেয়েই রুম এ ঢুকলাম। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলাম। এমনিতেই দুই দিনের জার্নিতে ক্লান্ত, ঘুম আসতে সময় লাগলো না। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোছল করে জামাকাপড় পরে চলে এলাম হোটেল এর ডাইনিং এ।
হোটেল রুমে আমি ও আমার স্ত্রী ববি
হোটেল টেনডিন এর ডাইনিং
আমি ও ববি

ফ্ল্যাশব্যাক



মাসের 11.06.11-তে ‘NEWS বাংলা পত্রিকার খোলাআকাশ পাতায় কভার পেজে প্রকাশিত লেখা।

চন্দন রায়চৌধুরী

আলো ঝলমলে কয়েকটা দিন

সকালবেলা একদল রোদ্দুর এসে গায়ে-মুখে ঝাঁপাঝাঁপি করে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। চোখ খুলতেই মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগেকার দৃশ্যগুলো। ঠিক এমনি করেই খোলা জানলা দিয়ে সাঁই-সাঁই করে এসে কানে-কানে কত কিছু বলে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। এই পর্যন্ত লিখে cut লিখতে বাধ্য হলাম। এই flashback এর শুরু থেকে না লিখলে পাঠক হয়তো ভাববেন বড় পুরনো ধরনের লেখা। এখনকার কিছু চলতি শব্দ ব্যবহার না করলে বা সিনেমার কিছু term ব্যবহার না করলে লেখা জমবে না। মানে আজকালকার চলতি শব্দে ব্যাপক হবে না। এবার শুরু করি তা'হলে flashback-এর প্রথম দৃশ্য দিয়ে।

দৃশ্য 1

সেদিন দুপুরবেলা অফিসে এসেছিলাম আমারই মুক্তিপ্রতীক্ষিত একটি ফিল্মের মিটিং-এ। সবে বসেছি, হঠাত্ ফোন এল ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারের অভিজিত চ্যাটার্জীর কাছ থেকে। বলল- আপনি কি এখনই একবার আসতে পারবেন আমাদের সল্টলেকের অফিসে? রাঁচীতে আমাদের একটা ফেস্টিভ্যাল আছে ফোক-ডান্সের ওপর। সেটার কিছু মিউজিক কম্পোজ করতে হবে। ডিরেক্টর শ্রী অনুপ মতিলাল আজই সব ফাইনাল করবেন। একটা কাজে এসে আরেকটা কাজের খবর নিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনাগুলো সব ফুটবল খেলতে শুরু করে আর কি। আসলে চিরকালই মিউজিকের নানা ক্ষেত্রে নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছি তা সে ক্লাসিক্যাল, মর্ডান কিংবা ফিল্ম, ডান্সড্রামা, থিয়েটার, এ্যাডফিল্ম... যাই হোক্ না কেন। এবার মনে মনে নিজেকে খোঁজার নেশায় ফোক্ মিউজিক যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে নেশা ধরালো। যাই হোক্, মিটিং সামলে ছুটলাম EZCC-র অফিসে। জানতে পারলাম 28-শে ফেব্রুয়ারী থেকে 9-ই মার্চ অবধি থাকতে হবে রাঁচীতে, আর অক্টেভ 2011 নামে যে অনুষ্ঠান হবে তার মিউজিক কম্পোজিশনের দায়িত্ব আমার। নর্থ-ইস্ট জোনের আটটি জায়গার বিভিন্ন ফোক-ডান্স নিয়ে হবে এই ফেস্টিভ্যাল। সঙ্গে নানান রকমের প্রদর্শনী ও আঞ্চলিক পোশাকে থাকবে ফ্যাশান প্যারেড। যেটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং মনে হল, তা হচ্ছে এই সমস্ত জায়গার মিউজিশিয়ানরা আসবে তাদের নিজস্ব মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে। এবার তাদের নিয়ে মিউজিক কম্পোজ করে পারফর্ম করতে হবে। এর আগে বহু জায়গার যেমন মুম্বাই, দিল্লী, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদির মিউজিশিয়ানদের নিয়ে প্রোগ্রাম বা রেকর্ডিং করেছি। কিন্তু এবার যেটা আমাকে প্রলুব্ধ করল তা হল ওখানকার ফোক্ মিউজিককে খুব কাছ থেকে দেখা, জানা এবং সেই সঙ্গে ভ্রমণের একটা বাড়তি পাওনা। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে প্ল্যান করলাম যেহেতু ডান্সের প্রোগ্রাম, সেহেতু স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাব। কিন্তু বাড়ি ফিরে শুনলাম ঐসময় ওর নিজেরই প্রোগ্রাম, তাই একাই যেতে হবে। অতঃপর জয় মা বলে রওনা দিলাম রাঁচীর উদ্দেশ্যে।

দৃশ্য 2   

1st March সকাল 10 টায় রাঁচীতে পৌঁছতেই একটি গাড়ি (যা আমার জন্য রাখা ছিল) নিয়ে গেল ন্যাশানাল ক্যাম্পের ভিলেজে। যেখানে গেস্টহাউস, সেখানে আমার জন্য একটি সুইট বরাদ্দ ছিল। ঘরগুলোতে ঢুকে আমার প্রথমেই মনে হল যে ওখানে ফুটবল বা ক্রিকেট যে কোনটাই খেলা যায় অথচ আমি থাকব একা। যাহোক্, কোন রকমে ব্যাগটা রেখেই গাড়িতে চলে এলাম ঠিক উল্টোদিকে, যেখানে হোস্টেলে আছে সমস্ত ডান্সারর্স এবং মিউজিসিয়াশস্। পৌঁছন মাত্র প্রোগ্রামের অন্যতম ভারপ্রাপ্ত গৌতম মুখার্জীর ফোন- ঠিকঠাক পৌঁছেছেন তো? আমি এখুনি আসছি।গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম সামনের বিরাট খোলা জায়গাটায় যেখানে বড-বড় গাছগুলো শনশন হাওয়ার সঙ্গে ফিসফাস কথা বলছে, সেখানে চলছে নাচের মহড়া। কোরিওগ্রাফার তরুণ প্রধান আমাকে বসতে বলে ডান্সারদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগল বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন পাত্রপাত্রী, বিরাট খোলা আকাশের নীচে রোদ্দুর আর বসন্তের আগমনের খবর বয়ে আনা বাতাসে মাটির গন্ধ, ঘাসের ছোঁয়া নিতে-নিতে আমি হারিয়ে যেতে থাকলাম নতুন নাটকের মাঝে। দুপুরে লাঞ্চ সারলাম সকলের সঙ্গে তারপর গেস্ট হাউসে ফিরে ফের ভাবতে বসলাম কম্পোজিশান নিয়ে। বিকেলে স্টেজ রিহার্সাল। সকালে এসে ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছি বিভিন্ন জায়গা থেকে কি কি ইন্সট্রুমেন্ট এবং মিউজিসিয়ানস্ এসেছেন। প্রথমেই চোখে পড়ল অসম থেকে আসা চারজন ঢোলক প্লেয়ার এবং ফ্লুটিস্টের দিকে। এছাড়া শিঙা, করতাল, দোতারা, সারেঙ্গী এবং বিভিন্ন পারকাশনিস্টও এসেছেন মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর ইত্যাদি থেকে। প্রত্যেকের নিজেদের বাজনার স্টাইলটা একান্তই তাদের নিজস্ব। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলের দোরগোড়ায় তখন ফের গাড়ি করে স্টেজ রিহার্সালের গ্রাউন্ডে। গেস্ট হাউস থেকে এই মোরাবাদী গ্রাউন্ড বেশ দূরে। পথে যেতে-যেতে ছোট মত টিলা দেখতে পেলাম, যার চূড়ায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। সাড়ে চারটেয় পৌঁছে গেলাম মাঠে। মনে হল এই অনুষ্ঠানে শুধু মিউজিক নয়, সাউন্ড ব্যালান্সটাও আমাকে করতে হবে। নাহলে এই বিশাল এরিয়া জুড়ে মিউজিক প্রোডাকসন ঠিকঠাক ভাবে শ্রোতার কাছে নাও পৌঁছতে পারে। স্টেজটি 100 বাই 80 ফিট, ব্যাকড্রপে সুন্দর ক্রাফটের ডিজাইনে লাল সূর্য্য, বাইসনের শিং, বর্শা ইত্যাদি দিয়ে লোকসংস্কৃতির ছাপ রেখে সাজানো। দেখেই ভাল লাগায় মন আচ্ছন্ন হল। সেদিন শুধুই ডান্স রিহার্সাল দেখলাম ও বুঝে নিলাম কি করতে হবে। পরদিন সকালে হোটেলের পিছনে খোলা আকাশের নীচে বড়-বড় গাছের ছায়ায় ঘেরা একটা জায়গায় শুরু হল আমার কম্পোজিশন ও রিহার্সাল। বলতে দ্বিধা নেই, এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। এমনভাবে নেচারের মধ্যে মিউজিককে শুনতে-শুনতে আক্ষরিক অর্থেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। মিউজিক যখন শেষ হল, তখন অনেকের হাততালীর শব্দে সম্বিত ফিরল। দেখলাম অভিজিত্, তরুণ, লাইট ডিজাইনার কনিষ্কদা একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত তালিতে। মনে একটা প্রত্যয় এলো, মনে হল স্কুলের ফার্ট টার্মটা ভালই দিলাম।     

দৃশ্য 3

এরপর চলল কয়েকদিন ধরে রিহার্সাল। কখনও স্টেজে নাচের সঙ্গে, কখনও বা গেস্ট হাউসের ঘরে। কারোর মধ্যে কোনও ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই। সুরসাগরে ডুব দিয়ে সবাই খুশী। এমনি করে সব ডান্সার, মিউজিশিয়ান, ই.জেড.সি.সি-র সমস্ত অফিসিয়াল, ডান্স কোরিওগ্রাফার, এই কর্মযজ্ঞের হাজার কাজের অন্যান্য সব কর্মীরা কখন যে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছি তা নিজেরাও টের পাইনি। এমনি ভাবেই একসময় অনুষ্ঠানের মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল। টেনশনে যেদিন শুতেই পারছিলাম না। এ তো স্টুডিও রেকর্ডিং নয়, যে ভুল হলে যত ইচ্ছে শুধরে নেওয়া যাবে। যাই হোক্, অনুষ্ঠানের দিন সাড়ে চারটেয় পৌঁছে গেলাম। সমস্ত সাউন্ড চেক করে সকলকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সব ইন্সট্রুমেন্টের সুর মিলিয়েও টেনশন আর কাটে না। আমার ছাত্র তন্ময় গিয়েছিল আমার এ্যাসিস্টান্ট হয়ে। ওকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম কি করতে হবে, কিভাবে সামলাতে হবে, তবু শান্তি নেই। সব মিউজিসিয়ানরা কিন্তু খুব সহজ ভাবেই সিচ্যুয়েশনকে উপভোগ করছিল। আকাশে মেঘ করেছিল, হিমেল হাওয়ায় ধুলো উড়ছিল। ভবছিলাম যদি বৃষ্টি নামে তো কি হবে... সব পন্ড? কিন্তু ধূসর মেঘ মুচকি হেসে দু-চার ফোঁটা ঝরিয়ে দিয়ে কোথায় যেন উধাও হল আর ঝুপ করে নামল অন্ধকার। একটি গং (এর ধরণের বড় ঘন্টা) এর আওয়াজে শুরু হল অনুষ্ঠান। এই আওয়াজের রেশ রেখে, তার মধ্যে থেকে ভেসে এল একসঙ্গে অনেকগুলো শিঙার আওয়াজ এবং তারই সঙ্গে পাহাড়ি বাঁশীর সুরে সূর্যোদয়ের খবর যেন ছড়িয়ে পড়ল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের গা বেয়ে দূরে। পাহাড়ি যে বিগ ড্রাম, এবার তাদের পালা। গুরুগম্ভীর তার আওয়াজে ধীরে যেন দৈনন্দিন জীবনের ঘুম ভাঙতে শুরু করল। শোনা গেল পুরুষ ও মহিলা কন্ঠে লোকগীতির সুর যা খোলা আকাশের নীচে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি করল। এরপর তালে-তালে সমস্ত নর্থ-ইস্ট কখন যে মিলেমিশে একই স্রোতে বইতে-বইতে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের গান হয়ে দাঁড়াল আমি বুঝতেই পারিনি। সম্বিত ফিরে পেলাম অনুষ্ঠান শেষে যখন তরুণ এসে জোর করে আমাকে স্টেজে নিয়ে গেল সকলের সঙ্গে পরিচিত হতে। যা নিয়ে এত বিব্রত ছিলাম, তা অনুষ্ঠানের সাফল্যের পরেও মনের কোণে দিব্যি ঘাপটি মেরে বসেছিল। তারপর হঠাত্ই করতালির শব্দে আর অভিনন্দনের বন্যায় ভাসতে-ভাসতে অলক্ষ্যে একটা ব্যাথার সুরও চিনচিন করে অনুভব করলাম। বিদায়ের বাঁশী বাজতে শুরু করেছে। ই.জেড.সি.সি-র ডিরেক্টর শ্রী অনুপ মতিলাল, অফিসার এ্যাডমিনিস্ট্রেটর শ্রী প্রদীপ ঘোষ, ডিরেক্টর ফিনান্স শ্রী টি.কে বাসু এসে যখন মিউজিকের প্রশংসা করে গেলেন, তখন অনুভব করলাম সমস্ত স্তরের মানুষকে ছুঁতে পেরেছে আমার মিউজিক। আসলে ব্যাকরণগত যে সঙ্গীত তার সঙ্গে হৃদয়ের রঙ মেশাতে না পারলে তা কখনই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। অনুষ্ঠানের এ্যাঙ্কার শ্রীমতি গৌরী বসু আমাকে দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর স্টেজ ছেড়ে যেতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।

দৃশ্য-4

ওদিনও রাতে আর ঘুম আসে না। মনে-মনে চলেছে এই কদিনের নানান কথা, টেনশন, উচ্ছ্বাস। একসময় কান্ত শরীর ঘুমের কোলে আশ্রয নিল ও ভোর হতে যখন ঠান্ডা বাতাস গান শোনাতে এল, শেষ শীতের মিঠে রোদ্দুর এসে ঘুমের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চাইল. তখন উঠতেই হল বিছানা ছেড়ে। অনেক কিছু পেলাম আবার ফেলেও চললাম সময়টাকে। অন্যান্য দিনের মত ডায়রী নিয়ে বসলাম, তারপর শেষবারের মত ঐ কদিনের পরিচিত ব্যালকনীতে দাঁড়ালাম, ফেলে যাচ্ছি এখানের যে আকাশ, তার দিকে তাকালাম। তাকালাম সেই বিশাল স্টেডিয়ামের দিকে, সবুজ ঘাসে মোড়া ধুধু মাঠের দিকে, সামনে শুয়ে থাকা পরিষ্কার পিচ বাঁধানো রাস্তার দিকে আর দূরে সেই হোস্টেল যেখানে রয়ে গেল অজস্র ভাল লাগায় মুখর, গত দশদিনের সুন্দর মূহুর্তগুলো।

Friday, 15 April 2011


ভ্রমণ- কাছেই আছে মহারাজ

2010-এর 3-রা অক্টোবর উত্তরবঙ্গ সংবাদের টইটই পাতায় প্রকাশিত লেখা


কাছেই আছে মহারাজ

চন্দন রায়চৌধুরী

তখন আকাশ সবে ফর্সা হতে শুরু করেছে, সওয়াই মাধোপুর থেকে আমরা রণথম্বরের পথে। দূরত্ব মাত্র চৌদ্দ কিলোমিটার। জঙ্গল সাফারিতে যাচ্ছি ক্যান্টারে চড়ে, এই গ্রুপের সঙ্গে তিনজন স্থানীয়ও আছেন। এঁদের অনর্গল কথা বলাটা থামানোর জন্য গাইডকে অনুরোধ করলাম। সাধারণতঃ যারা জঙ্গলে ঘুরে অভ্যস্থ, তারা এমন হয়না, কিন্তু.... যাই হোক্, গাইডের হঁশিয়ারিতে কাজ হল, কিন্তু টিপ্পনী কাটতে ছাড়ল না- এত সহজে বাঘ দেখা যায় না, এই জঙ্গলে বনকর্মীরা বাঘ সেজে ঘোরে, আসল দেখতে ভাগ্য থাকতে হয়, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আমরা চলেছি 4নং জোনের পথে। পথে দেখা অন্য একটি দলের সঙ্গে, যারা সফরের শেষের দিকে। ওরা বলল বাঘ মিলতে পারে, কেননা ওরা পাশের 5নং জোনে জঙ্গলরাজের দেখা পেয়েছে। উত্তেজনায় আমাদের রোম খাড়া। হঠাত্ই সম্বরের একটানা ডাক শুনে গাইড জানাল, এটা এ্যালার্ম কল। সম্বর বাঘের গায়ের গন্ধ পেয়েছে নিশ্চই, তাই বাকীদের সতর্ক করার জন্য ডাকলে এই রকম শব্দ করে। কাছে পিঠেই কোথাও আছেন মহারাজ। গাইড আমাদের কথা না বলে চুপ করে থাকার নির্দেশ দিলেন ও দেখলাম অল্প দূরেই জঙ্গলের মধ্যে গাছ-গাছালী নড়ে উঠল। হ্যাঁ ঠিক, ঐ তো... সবুজের মধ্যে হলদে ডোরা কাটা ঝিলিক। ধীর পায়ে মহারাজ বেরিয়ে এলো জঙ্গল থেকে, নাক ঘষল একটা গাছের গুঁড়িতে। আমরা গাড়িতে অল্প দূরেই, কিন্তু ভ্রুক্ষেপ না করে মন্থর গতির রাজকীয় ভঙ্গীতে রাস্তা পেরিয়ে সে সেঁধিয়ে গেল ওপাশের গভীরে। ক্যান্টারের সব যাত্রীরা এবার হতচেতন.... বাকরুদ্ধ। জঙ্গল তো কম ঘুরিনি, কিন্তু প্রায় বিনা প্রস্তুতিতেই, এত কাছ থেকে এভাবে বনের বাঘকে দেখা- এক অবিস্মরণীয় অভিজ্ঞতা।

রাজস্থানের রণথম্বর দু-হাত ভরে দিল আমাদের। এই বনে সম্বর ছাড়াও দেখলাম প্রচুর নীল গাই আর খালে-বিলে-নদীতে অসংখ্য পরিযায়ীর মেলা। রাজবাগ, মিলাক আর পদম জলাশয়কে ওরাই সাজিয়ে রেখেছে। রণথম্বর জাতীয় উদ্যানে জঙ্গল, পাহাড়, জলাশয় ছাড়াও রয়েছে এক অসাধারণ প্রাচীন কেল্লা। প্রায় 825 স্কোয়ার কিলোমিটার জায়গা জুড়ে বিস্তৃত এই জঙ্গলে রয়েছে প্যান্থার, চিঙ্কারা হরিণ, বুনো শুয়োর, হায়না, শেয়াল, বনবিড়াল আর লেপার্ড। এই রাজস্থানে ভ্রমণের আরও এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা হল ভিলেজ ট্যুরিজমের অংশীদার হওয়া। এই অভিজ্ঞতার সঞ্চয় হল ধুধু বালিয়ারীর মধ্যে খুরি নামের জায়গাটিতে এসে। স্থানীয় অতি সাধারণ এক রাজস্থানী গৃহস্থের বাড়িতে থাকার সুযোগ পেয়েছিলাম। এক অতি সাধারণ গ্রাম্য বাড়িতে এক অসামান্য আতিথেয়তার উষ্ণতা পাওয়ার অভিজ্ঞতা ভোলবার নয়। সংবাদপত্রের ছোট পরিসরের মধ্যে দিয়ে একে ধরা যাবে না, এই গল্প আলাদা ভাবে বলবার। শুধু এটুকু জানাই- ছাগলের দুধ, বাজরার রুটি, সাধারণ সব্জি দিয়ে খাটিয়ায় বসে খাওয়া,.... লাখ টাকার বিনিময়েও এই স্বাদ, এই ভালবাসা পাওয়া যাবে না। অদুরে কুয়ো থেকে জল তুলছে একগলা ঘোমটা দেওয়া নারী, উঠোনে পাঁচ-ছখানা উট ঊর্ধলোচনে জাবর কাটছে... মনে হচ্ছিল যেন স্বপ্নের দোরগোড়ায় আস্তানা গেড়েছি। সন্ধ্যে হতেই আবার স্থানীয়দের লোকগানের আসর, যা আমার কাছে খুবই আকর্ষণীয় ছিল। কাছেই মরুভূমির সুবিশাল প্রান্তর। উটের পিঠে যেতে যেতে কত ভাবনা, কত দৃশ্য, কত ধরণের সুর মনের জানালায় নানারকম দৃশ্য রচনা করে চলল। সেইসব দৃশ্যের রঙিন উপস্থিতি এত সহজে বলে ফেলব, এই ক্ষমতা আমার নেই। যেহেতু আমি সুরের জগতের মানুষ, তাই ওই মজলিশ পরিপূর্ণ এক ভাল লাগায় বুঁদ করে রেখেছিল সারা সফর জুড়ে।


 

Tuesday, 12 April 2011


ভ্রমণ

তপ্তপানী-গোপালপুর

             লেখক- মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী


- কংকডা, কংকডা.. অছি কংকডা....
হাঁক শুনে লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে, একে টপকে তাকে ডিঙিয়ে একবারে দৌড়ে এলাম ট্রেনের দরজায়। মনে-মনে যা ভাবছি- তাই কি? ঠিক। দেখি বেশ কটা সামুদ্রিক কাঁকড়া জালিকাটা ঝুলিতে নিয়ে হেঁকে যাচ্ছে একজন মেছো গন্ধের মানুষ। ওদিকে ইকড়ি-বিকড়ি কাঁকড়াগুলো হাঁচড়-পাঁচড় একে অন্যের গা বেয়ে উঠছে-নামছ-বাইছে...... ব্যস, আপাততঃ আমার এটুকুই ঢের। ইতিপূর্বে না দেখা দৃশ্য, অচেনা কংকডা হাঁক আর পিচকালো মানুষটা আমায় এক পলকে উড়িষ্যার কোলে তুলে নিল। রাতে ঘুমতে-ঘুমতে কখন যে পা রেখেছি এদেশে তার জানান দিল এই ভোরবেলা। গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে বালুগাঁও স্টেশনে। আমি কিছু ভেবে ওঠবার আগেই দেখি নুনেপোড়া চেহারাটা আমার মন ধুয়ে দিয়ে সরে যাচ্ছে দূরে।

কোথাও একটা যাব স্থির করার পর থেকেই আমার ঘুম নেই দুচোখে, ওদিকে ভয়ও ভরপুর। মনের মধ্যে বাজি-বারুদের চুলবুলী মানেই আমার কাছে তা প্রশ্ন চিহ্নের মত!!!!! কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে অন্যদিকে, এমন বিশ্বাস বসে গেছে ভিতরে। জীবনভর এতই ঠকঠকঠক ঠকানি..... তবু অগ্রাহ্য করলাম  সেই কু-ডাক। রোদরঙা বালুমাখা ঠেউ খুব যে আমায় টানছিল তা নয়, আসলে যাবই এমন চাওয়া ছিল আর দুদিনের ছুটি। ব্যস্, চালাও পানসী বেলঘরিয়া। অনেকে মিলে যাচ্ছি-যাব-র বিস্তর ঘোটালা সামলে, টিকিট কাটতে গিয়ে দেখলাম আপনি আর কোপনিতেই যাত্রি সংখ্যা শেষ। অগত্যা.... যাব যখন ভেবেছি তখন দুজনে-দুজনে একলাই নাহয়....

একলা মানে একলাই। স্বামী-স্ত্রী আবার একান্ত কবে হল? এজন উত্তরে গেল তো ও দক্ষিণে, ও-জন পূবে তো এ পশ্চিমে। আত্মপ্রতিষ্ঠার লড়াই, জেদের, ভিন্ন মতের লড়াই লড়তে-লড়তে যে ক্ষণটুকু একান্তের, তাকে হয় সার্চ লাইটের আলোয় ফেলে অণ্বেষণ, নয় এমনিতর প্রকৃতির মধ্যে নিয়ে ফেলে েলফেলফপপপপআঁতিপাঁতি খোঁজা। আশায় বাঁচে চাষা প্রবাদে আস্থা রেখে দুজনেই স্থির করেছি যাওয়ার। সোজা চলে গেলাম উল্টোডাঙা স্টেশন, তারপর কাল বাদে পরশু বেরহামপুরের টিকিট কেটে গদাম করে চড়ে বসলাম চেন্নাই মেল। হুট বলতে যচ্ছি মানেই ভুলের একশো সম্ভাবনা। ফেরার টিকিটও পেতে হবে। মনে আশঙ্কা- যদি না পাই? কাউন্টারের জানলায় নাক লাগিয়ে গলার শিরা ফুলিয়ে তাই চেঁচালাম-
- ফার্স্ট মার্চের ফেরার টিকিট যদি থাকে, তবেই দাদা ছাব্বিশেরটা........
- আরে চেঁচাচ্ছেন কেন, আস্তে বলুন.... আছে। এমনিতেই মেছো বাজার তায়.....
- ঠিক আছে, ঠিক আছে....
বাব্বা, অবশেষে যাচ্ছি.... ভাবটা মনে ঢোকা মাত্র সব ক্ষমা হয়ে গেল। টিপনী কাটা মানুষটার বকুনী কানে পৌঁছলই না। আমি তখন মাদার টেরিসা- ক্ষমার অন্য নাম। ভেবেই রেখেছিলাম, 27 আর 28-শে ফেব্রুয়ারীর প্রথম দিন থাকবো তপ্তপানী, দ্বিতীয় দিন গোপালপুর, ও তৃতীয় দিনের সন্ধ্যায় চেন্নাই মেল ধরে মিঞা-বিবি ফিরব চেনা ছন্দের ঘর পানে।

টিকিট কেটে থেকে আহা কি ফুর্তি মনে। একদিন বাদ দিয়ে ট্রেন অথচ তর আর সয় না। যেন কখনো কোত্থাও যাইনি.... এই প্রথম ট্রেনে উঠব, এই প্রথম সাগর দেখব, এই প্রথম রেঁধে নিয়ে যাওয়া খাবার খেতে-খেতে দৃষ্টি অগম্য জানলার কাচে গাল পেতে তারা খুঁজব..... এক্কেবারে গ্যাদগ্যাদে অবস্থা যাকে বলে। বেড়ানোর কথায় এই চেহারার সঙ্গে সাক্ষাত্ আমার প্রায় প্রতিবার ঘটে। বদলাতে পারিনি নিজেকে, চাইওনা। এ্যাড্রোনালিন গ্রন্থির এই ক্ষরণে আমি তাজা হতে থাকি বরং দিন-প্রতিদিন। এবার তোড়জোড়। বেশী বেশী গোছগাছ করতে চাইলেই বা হবেটা কি, মোটে দুজন যাচ্ছি- দুদিনের জন্য। দু-এক সেট জামা-পত্তর নিতে না নিতেই গোছানো শেষ। এবার পড়লাম খাবার নিয়ে। ঘরে খাই রুটি-চচ্চড়ি অথচ ট্রেনে চাই মেথি পরাঠা, চিকেন কষা, মিষ্টি.... আমি সত্যিই আদেখলে। আসলে মনের মধ্যে গুটিসুটি বসে থাকা ছুটিটাকেই আমি যে চাটুপুটু দিই, তা জানি। জানি, জানি, এর সবটা আমি জানি- তবু করি। যাকে বলে একদম ছেলেমানুষীর ছত্রিশভাজা। এজন্যই বেড়াবার ভাবনা মাথায় এলে আমি এত উত্তেজিত হই। এই কেজো কলকাতায় কি করে সম্ভব ঐ ছত্রিশভাজা হওয়া? 

ট্রেন সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, আমরা বেরিয়ে পড়লাম সময় হাতে নিয়ে। কতজন আসছে-যাচ্ছে এটা দেখতেও বেশ লাগে। পর্যটকের মুখ, সঙ্গী, ভঙ্গী, লাগেজ, অপেক্ষার ধরণ.... এই সবটার মধ্যে দিয়ে আমি মানুষগুলোকে খুঁজি।

বেরিয়ে প্রথমেই বাগবাজারের ফেরীঘাটে, তারপর লঞ্চ পেরিয়ে সাড়ে ছটায় স্টেশন। দুজনের কাঁধেই ছোটখাট সাইড-ব্যাগ, তার মধ্যেই বিশ্ব। ভারহীন নির্ঝঞ্ঝাট পৌঁছে গেলাম নতুন প্ল্যাটফর্ম। যতক্ষণ অবধি নির্দিষ্ট কামরার নির্দিষ্ট সীটে বসে নির্দিষ্ট টিকিটটাকে নিরীক্ষণ না করছে, ততক্ষণ অবধি আমার সঙ্গীজনের শান্তি নেই। তার আগে অবধি ব্যাজার, সবেতেই কোষ্ঠকাঠিন্যে ভোগা তেএঁটে ভাব। এই এনকোয়্যারিতে খোঁজ, পর মূহুর্তেই ট্রেন কোন প্ল্যাটফর্মে আসছে গবেষণা, লিস্ট টাঙানোর গাফিলতি অনুমানে রেলঅলাদের বাপান্ত....  এ চেহারা আমার চিরচেনা। তাই ওতে মন না দিয়ে মেতে গেলাম নিজের সঙ্গে নিজে। দেখতে থাকলাম ব্যস্তসমস্ত আসা-যাওয়া, অভিব্যক্তি, মানুষজনের আলাপ। কেউ বেড়াতে যাচ্ছে, তার মুখ-চোখের চেহারার সঙ্গে কতই অমিল যে ইন্টারভ্যু দিতে যাচ্ছে তার। কেউ যাচ্ছে ছেলেপুলের কাছে হয়তো অনেকদিনের যাচ্ছি-যাব’-র বাহানা সামলে। কেউ বহুদিন কাটিয়েছে এই প্রবাসে, তারপর চেষ্টা-চরিত্রের গুছানো ছুটিতে নিচ্ছে বাড়ির পথে উড়াল। প্রত্যেকটা মুখের আয়নায় তাদের আকাঙ্খার ছায়া দুলছে টুলটুল। এই দেখাটা, এই চেনাটাও আমার কাছে বেড়ানো.... অন্যভাবের বেড়ানো। কি যে ভাল লাগে আমার ছায়া তিরতির মুখগুলোর ওপর ঐ ঝুঁকে পড়া রামধনুকে ছুঁতে। পড়তে ইচ্ছে করে তাদের ভিতরের ভাষা, যা আপাত অন্যমনস্কতার হাত ধরে আপাততঃ বসে আছে প্রতীক্ষায়। হঠাতই আচম্বিতের চল-চল...ট্রেন দিয়েছে...শুনে ঘোর কাটল ও শেষ হল পরিভ্রমণ। তেঁনার সমস্ত রকম এনকোয়ারি শেষ, মুখের ভাবে এখন ভোম্বলনাথ ত্রিকোনোমিতির আঁক। এবার সীট-পত্রর খুঁজে বসা গেল কোনমতে। হ্যাঁ, কোনমতেই, কেননা ট্রেন যতক্ষণ না রওনা দেয়, ততক্ষণ মানুষজনের উত্তেজনার শেষ থাকেনা। স্থিতু হবে কি- দেশি-বিদেশী ব্যাগ, ছেলের ক্যারাম, টেনিস রাকেট, কোলেরটির সফ্টটয় সব ঠিকঠাক সান্টিং করতে হবে না। গলদঘর্ম হয়ে, চশমার ডাঁটি খুলে, একে গুঁতিয়ে, তাকে খেঁকিয়ে সেসবের গতি করার সময়কালটা সত্যি ভয়াবহ। সঙ্গে গোটা সংসার, খেলাধূলো, রোজের অভ্যাসকে এভাবে বয়ে বেড়ানো... উফ, কোথায় মজা? বলে লাভ নেই, খাবারের স্বাদ নেবার মতই বেড়ানোর স্বাদও অন্য অন্য স্বাদ-মুকুলে অন্য অন্য মজায় থাকে এটা বুঝেছি বেশ। ট্রেন নড়ে উঠতেই শরীরও নড়েচড়ে যেই ডিসব্যালান্স, সেই গোছানিপত্র বন্ধ। দম ধরে বাকীদের অপেক্ষা শুধু সেই সময়টুকুর। তারপর তো-
- পুরী?
- না, তপ্তপানী।
- ধুর, একটা চৌবাচ্চায় খানিকটা গরমজল.... কি দেখবেন?
- কত কিছু... জঙ্গল, নির্জনতা, গাছের ফাঁক দিয়ে পথে পড়ে থাকা আলোর আঁকিবুকি?
- সে তো অফ সিজনে বোটানিক্যাল গার্ডেনে গেলেও...
ঐ যে বললাম, ভিন্ন অনুভবের ভিন্নজন কথা ভিন্নতর স্বাদমুকুলের। হাতে গরম তার প্রমাণ দাখিল হতেই আমি জানলা দিয়ে বাইরে তাকাই আর তারা ব্যাগের থেকে শশা, পেয়ারা, চকলেট.....

এবার মন গেল এক মুসলমান দম্পতির দিকে। ট্রেনের সাইড বাঙ্কের উপর-নীচে তাদের বার্থ.... নামবে বেরহামপুর। কলকাতার পার্ক সার্কাসে বাড়ি, যাচ্ছে ছেলের কাছে। এর আগেও গেছে কবার কিন্তু এবার ছেলে-বৌমা নিয়ে চিল্কা যাবার প্ল্যান। যদিও বেরহামপুর আমাদের সকাল সাড়ে সাতটায় পৌঁছনোর কথা, তবু ওঁদের গন্তব্য জেনে নামতে হবে-নামতে হবে-র টেনশান কিছুটা কাটিয়ে ওঠা গেল। আস্বস্ত মনে সীটের ওপর কাগজ বিছিয়ে নিয়ে- কপোত-কপোতী মোরা মুখোমুখি বসিলাম ও আহারাদি সাঙ্গ করতঃ যাইলাম নিশ্চিন্তির শয়ন আয়োজনে।

আমি শুয়েছিলাম লোয়ার বাঙ্কে আর আমার তিনি মাঝে। সবে ঘড়ির কাঁটা টেনে টুনে দশের ঘরে, উল্টোদিকের বার্থ থেকে তখনই নাক ডাকার বিপুল নির্ঘোষ। কিছুক্ষণ শুয়েছিলাম অথচ ঘুম তো দূর শান্তি নেই একটুকুও। এদিকে ফিরলে কুটুস ওদিকে ফিরলে কাটুস.... কি জানি কিসের কামড়ে একদম ছটফটিয়ে মলাম। তায় সহযাত্রীর নাসিকা বাদ্যে মনে ঈর্ষা মেঘেরও ঘনঘটা। কি যে কামড়াচ্ছে বুঝেই পাচ্ছি না। চলন্ত ট্রেনে মশা? একটু যে হাত-পা মেলে টান টান হবো, তারও কি উপায় আছে? আমার ওপরেই মাঝের বার্থের লোয়ার পার্টটা দেখি বিলকুল ছাল-চামড়া ছাড়ানো। হাত তুললেই কাঁটা-স্প্রিং-ছোবড়ার তীব্র জেহাদি আক্রমণ। প্যাঁট-প্যাঁট করে শরীরের কোথাও না কোথাও ফুটে চলেছে, সারা শরীর চুলকুনী সহ জ্বলুনির জ্বালায় জেরবার। নির্ঘুম ঐ মধ্যরাতে শুরু হল আজব চিন্তার আনাগোনা। ঐ ছোবড়া থেকে ঝুরঝুর করে পড়ছে না কি ছারপোকা? নিশ্চই তারা আমাকে পেয়ে রক্তের উত্সবে মেতেছে, অপরিচিত স্বাদ পেতে-পেতে খুনী নেশায় পেয়েছে.... যদি ম্যালেরিয়া হয়, ফাইলেরিয়াও তো হতে পারে, ডেঙ্গু! কোথায় শুনেছিলাম যেন ওসব মশাবাহিত রোগ। কি জানি... ছারপোকাদের ওপর খুব একটা গবেষণা কর্ম কি দেখেছি? নাঃ, শুয়ে থাকা গেল না। মনের মধ্যে হাজারটা খুশী-খুশী ভাবনা আনলাম, খাসাডিহায় ক্যাম্প ফায়ারের চুলবুলী স্মৃতিতে গেলাম, তবু বাস্তব ঝক্কি কি এড়ানো যায়? গেলনা। বসবই বা কোথায়? সব সিটিং বার্থ এখন স্লিপিং চেহারায় কনভার্টেড। বসলাম ঘাড় গুঁজে নিজের বার্থেই, বাইরের অন্ধকারে চেয়ে... ঢুলেঢুলে....  অস্বস্তি শুধু গায়ে নয়, শুরু হয়েছে পেটেও। লোভীদের যা হয় আর কি। শরীরের খাদ্যযন্ত্র শক্ত-পোক্ত খাবার পেয়েছে, সঙ্গে অনিদ্রার অত্যাচার। এইবার সে বেচারীর হজম করাবার প্রচেষ্টার কাছে আমার চুপচাপ থাকা তো দায় হয়ে দাঁডাবেই। পেটের মধ্যে নানান গোলযোগ, বাদ্যি-কাঁসির নানান ধানাই-পানাই নিয়ে ভোরবেলার অপেক্ষায় উদগ্রীব রইলাম। যুদ্ধ করতে-করতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, তা ভাঙল শেষে কংকডা হাঁকে। এবার মানুষটা দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যেতেই বাঃ, বাইরে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একটা শান্ত স্টেশনের ওপর ভোরবেলাকার রোদ, আলাভোলা দিশপাশ, মনে হেঁকে যাওয়া শাব্দিক উচাটন, মানুষজনের মুখে নির্লিপ্তির ওড়না.... ঝিম ধরে যাচ্ছিল আমার। দেখতে-দেখতে গাড়ি ছেড়ে দিল, এসে বসলাম নিজের জায়গায়। প্রায় সবারই ঘুম ভেঙেছে ও বার্থগুলো সিটিং পজিশনে কনভার্টেড.... ফের। আমার উঠে যাওয়ার ফাঁকে এক ওড়িয়া দম্পতি দেখি দিব্যি দখল নিয়েছে আমার সীটের। ওদের দেশে এসে ওদেরই সঙ্গে তর্কে.... না বাবা না, বসুক, এসেই যখন গেছি। ইচ্ছে করলে উঠিয়ে দেওয়াই যায়, কিন্তু কি হবে সারাক্ষণ ঔচিত্যের লড়াই লড়ে? ফাঁক গলে যে মণিমুক্তো কত গড়িয়ে যায়- সেদিকে দেখিনা।

এই দম্পতি মনে হল সদ্য বিবাহিত। ওদের পাশে আমি একটু পশ্চাত্ ঠেকাতে পেরেই ধন্য। মানুষ পড়ার জার্নীটাও আমার খুব পছন্দের এক জার্নী কিনা, সুতরাং.... তারা পচর-পচর করে আপনমনের কচকচিতে, আমি বুঝছি কচুপোড়া। অল্পস্বল্প কোথাও যেখানে বাংলার সঙ্গে মিল, সেই ফাঁকটুকুর মধ্যে দিয়েই চুরি করে শুনছিলাম। মনে হল মেয়েটি বাপের বাড়ি যাচ্ছে আর ছেলেটি যাচ্ছে তাকে রাখতে। বৌকে ছেড়ে আসতে হবে অথচ ইচ্ছে নেই হলে যেমন দুঃখী-দুঃখী লাগে, তেমনই তার ভাষা, হাব-ভাব। আর মেয়েটি? ভরপুর এনজয় করছে বরের কাতরতা। ওড়িয়ারা খুব পান খায়, মেয়েটিও খাচ্ছিল। লাল টুকটুক ঠোঁটে, লাল শাড়ি লাল সিঁদুরে মাখামাখি মেয়েকে বেশ লাগছিল দেখতে। আমাদের পৌঁছনোর জন্য পড়েছিল আরো দুঘন্টার পথ। এই সময়টুকু ওদের আহ্লাদী বিরহ-বিলাস দেখতে-দেখতেই কেটে গেল। দুম করে কখন যেন এসে গেল বেরহামপুর, আমি তখনো তাদের নয়া সুরের গানে.... অন্যমনে। 





নামো, নামো... এক্ষুনি ট্রেন ছেড়ে যাবে। বাস্তবের পথ-বিলাসী সঙ্গীজনের হাঁকপাকানীতে হঠাত্ করেই নিজেকে আবিষ্কার করলাম প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছি.... ট্রেন মিলিলে যাচ্ছে দুরে। ওভারব্রীজ ক্রশ করে বাইরে এলাম। ফেব্রুয়ারীতেই রোদে বেশ তেজ, স্টান্ডে এসে দাঁড়াতে সব ছেঁকে ধরল। অটোঅলারা কেউ বলে তপ্তপানী যাবেন? দুশো টাকা। গোপালপুর যিব্ব? একশো কুড়ি টঙ্কা। এরই মধ্যে আবার গোটা কয়েক সাইকেল রিক্সাও প্যাঁকোর-পোঁকর ভেঁপু বাজিয়ে হাজির। কেউ বলে- বসিস্টান্ড যিব্ব?কেউ বলে- টিক্কে দূর অছি, কেউ বলে- পঁচিশ টঙ্কা লাগিব। আমাকে আর কেউ বলতে দেয়না, ভাবতেও দেয়না। বুঝেই পাচ্ছিনা বাসে যাব না অটোয়। ঠিক এই রকম জায়গাগুলোয় এসেই আমার সঙ্গীজনের খেল খতম। তার অপার আনন্দ বরং এ্যাংজাইটি আর টেনশনে। কি করব ভাবতে যেই একটু সময় নিয়েছি, সেই দেখি এক করিতকর্মা চালক হাত থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে গুছিয়ে ফেলেছে রিক্সায় আর ঠেলেঠুলে আমাদের উঠিয়ে নিল তাতে। দ্বিধাগ্রস্থতা থেকে মুক্তি পেয়ে আমিও বাঁচলাম। পর্যটকের দোনামনার ওপর নিজের সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াই যে বুদ্ধিমানের কাজ, এতকাল সওয়ারী টেনে-টেনে রিক্সাওলার এই বোঝাটা ভালই হয়েছে দেখলাম। বেশ চডবড়ে রোদ উঠেছে। রিক্সা চালাতে গিয়ে কষ্ট হবে জেনেও রিক্সাওয়ালা মাথার ওপরের হুডটা তুলে দিল। যেই সে আমার কথা ভাবল অমনি অজান্তে আমার মধ্যেও সে জায়গা করে নিল দিব্যি। ভাড়া মেটাতে গিয়ে খুশী-খুশী বাড়তি দিলাম যখন, তখন নিজের মধ্যের আর্দ্র মানুষটাকে খুঁজে দেবার জন্য প্রণত হলাম তার প্রতি। বেরহামপুর জায়গাটা কেমন, তার একটা হাল্কা আন্দাজ পেলাম স্ট্যান্ডে আসার পথে। রিক্সায় উঠতেই মন গিয়েছিল আশে পাশে। জায়গাটা একেবারেই একটা মফস্বলী শহর। একটু এগিয়ে চওড়া রাস্তা ছেড়ে রিক্সা সরু গলি পথে গেল। কখনো আবার বাস রাস্তাতেও ফিরছিল তবে বেশীটাই সরু গলির সমাহার। জানিনা ওটা শর্টকাটের হিসেব ছিল কিনা, তবে কিছুক্ষণের যাত্রায় মনে হল চওড়া-সরু মিলিয়ে বেরহামপুরের এটাই মূল চেহারা। মিনিট পনেরোর যাত্রাশেষে এসে পৌঁছলাম বাস আড্ডায়। রিক্সাওয়ালা আমাদের টিকিট কাউন্টারের সামনে নামিয়ে দিয়ে ঘাম মুছতে-মুছতে গেল। দেখি বিচ্ছিন্নভাবে কাছে দূরে দাঁড়নো কিছু বাস, মিনিবাস। মাথা ফাটা রোদের কেরামতিতে প্রাণ যায় যায়। একটা সেড খুঁজে নিয়ে আগে দাঁড়ান গেল, তারপর মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে, দু ঢোঁক গলায় ঢেলে গুটিগুটি গেলাম কাউন্টারে। ভিতরের লোকটি নীচু মুখে টাকা গুনতে-গুনতে, ঝুলে থাকা চশমার ওপর দিয়ে তাকিয়ে বলল-
- কোথায়?
- তপ্তপানী।
- জন?
- দুজন।
- একশো কুড়ি।
ব্যাগ থেকে টাকা বার করতে-করতে জিজ্ঞেস করলাম-
- কটায় ছাড়বে?
- দুটোয়।
এ্যাঁ? এখন সবে সাড়ে নটা.... গরমে দুটো অবধি এই হতশ্রী জায়গায় কি করব? হাঁকপাঁক করে বললাম-
- দাঁড়ান দাদা দাঁড়ান, আমরা এখুনি যেতে চাই।
- ঠিক নটায় একটা ছেড়ে গেল, আপনারা কোথায় ছিলেন?
- ইস্, জানিনা যে... কলকাতা থেকে আসছি। আর কি কোনোভাবেই....
- এটা পুরোন বাসস্ট্যান্ড। এখান থেকে দিনে মোট দুবারই তপ্তপানীর গাড়ি ছাড়ে।
- এখন উপায়?
- এক কাজ করুন, আরেকটা রিক্সা নিয়ে চলে যান নতুন বাস স্ট্যান্ড। ওখান থেকে বেসরকারী বাস ছাড়ে, গাড়ি পেয়ে যেতেও পারেন।
পেয়ে যেতেও পারেন মানে এখানেও সেই ভবিতব্য ভরসা। এতো ভ্যালা অনিশ্চয়ের রাজ্যে এলাম....
বিপাকের মাশুল দিয়ে রিক্সা ধরে ফের নতুন বাস আড্ডায় এলাম। এবার রিক্সাতে শুধু চাপলাম আর নামলাম। হাঁটা রাস্তার মধ্যেই ছিল জায়গাটা। তা যা হোক্, এখানে দেখি বাস, মিনিবাস, ট্রেকারের ছড়াছড়ি।

কলকাতা থেকে আসার সময় একটা ব্যাপার ক্লিয়ার করে এসেছিলাম, যে হাজার অসুবিধেতেও ট্যাক্সি কিংবা ট্রেকার নেব না। বাসে না ঘুরলে সেই জায়গার চরিত্রকে ঠিকঠাক ছোঁয়া যায় না। ট্রেন থেকে নেমেই ব্যক্তিগত বাহন বুক করে নিয়ে আলগোছের বেড়ানোয় আমার তীব্র অনীহা। উপায় না থাকলে আলাদা, কিন্তু একশো অপশন যখন আছে। সুতরাং নিরুপায় তিনিও আপাততঃ আমার পিছুপিছু.....

এবার নতুন বাস স্ট্যান্ডের কাউন্টারে শুনলাম- এখন কোন গাড়ি নেই, তবে একটা বাস ছাড়ছে যেটা দিগপন্ডী অবধি যাবে। দিগপন্ডী থেকে ঘনঘন তপ্তপানীর বাস.....

ওফ্, এই হয়তো, নাকি-র চক্কর মুক্তি যে কখন মিলবে কেজানে। তেড়েফুড়ে রোদ উঠেছে বলেই যা বিরক্তি। নাহলে বেড়াতে বেড়িয়েছি নতুন-নতুন কিছুর মধ্যে দিয়ে যেতে চাই বলেই তো। তপ্তপানী মনে হল খুব জরুরী জায়গা নয়। পুরনো বাসস্ট্যান্ডে দুটোয় একটা বাস তবু ছিল, আর এখানে আড়াইটের আগে কিছু নেই। পাগল নাকি, এই চড়বড়ে রোদে কত ভাজা হব? বাস আড্ডার যা হাল... মানুষজনের চরিত্র পড়ার বাতিক আমার মাথায় উঠল। কেউ ঝগড়া করছে, কেউ খৈনি ডলছে, কেউ গাড়ির পিছনে ছুটছে.... আর আমি ওদিকে নেই। মন এখন নিজের সঙ্গে জুড়ে গেছে চেপ্পে। পৌঁছতে হবেই এবং তা খুব তাড়াতাড়ি। নাহলে দুটো দিনের প্রথম দিনটা ঝরাপাতার মতন খসে পড়লে কি চলে? উঠে পড়লাম দিগপন্ডীর বাসে। কন্ডাক্টর ভালই, আমাদের দেখে ট্যুরিস্ট-ট্যুরিস্ট লাগছিল বোধহয়, নাহলে ভিড়ের মধ্যে ব্যাবস্থাপত্র করে সামনের সীটে বসতে দিল কেন? এমনও হতে পারে যে একঘেয়ে সওয়ারী দেখতে-দেখতে ক্লান্ত চোখ বেড়ুয়া পাবলিক পেয়ে উত্তেজিত। তা যাই হোক্, আমরা সুবিধে পেলাম। যাদের তুলে আমাদের বসাল তাদের কোন দ্বিরুক্তি নেই। নির্বিবাদে পিছনের দিকে চলে গেল। আমার খারাপই লাগল- আহা, গরীব বলে কি বসবার হকদারীটাও নেই? পরে ভেবে দেখলাম নেই, সত্যিই নেই। হকের গদি আঁকড়ে থাকার বুঝদারীটা নেই যেহেতু, অশিক্ষার ফাঁক গলে হকদারীটাও হাওয়া। হেনস্থাকেও চিনে নিতে জানতে হয় শিক্ষা দিয়ে। তা নেই যেই, অসম্মানকে চিনল না আর আমরা দিব্যি বসে-বসে প্রকৃতি বিভোরতা নিয়ে চললাম। মানবিকতা বা চেতনার রোদকে আপাততঃ আড়াল করা ছাড়া রাস্তা নেই.... বেড়ানোটাই নাহলে মাটি হবে যে। অশিক্ষার চোরাবালী মনে যত প্রশ্ন তুলবে, ফুরফুরে মন তত দূরে সরবে। না বাবা, রিং-রিং করে ভিতর সারাক্ষণ গাইছে- হাতে মোটে দুটো দিন। জোর করে ভাবনা এড়িয়ে জানলা দিয়ে বাইরে তাকালাম। মিনিট পনেরো যেতে না যেতেই তৃষিত চোখ ভরপুর সবুজে গেল। বাস গিয়ে পড়ল শষ্য-শ্যামল ধরণীর কোল ঘেঁষা রাস্তায়। কাছে দূরে পাহাড়ের ছবি- শাড়ির পাড়ের মতন ঘিরে আছে নদী, ধানক্ষেত, খড়ের ঘরকে জাপ্টে মাঝে নিয়ে। কিছু পরে পরেই সেসব হারিয়েও যাচ্ছে ও আবার হাজির হচ্ছে দুচোখের আঙিনায়। হাওয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ধাঁ ধাঁ ছুটছে বাস, ভিতরে ওলটপালট, হল্লা... সুবিধা আমাদেরই, যত তাড়াতাড়ি পৌঁছনো যায়। এক-একটা গাঁ-গঞ্জ আসছে, গাড়ি থামছে, কোলে-কাঁখালে ছেলেপুলে, বোঁচকা, কোদাল, আরো কত কি জিনিস-পত্র নিয়ে মানুষ উঠছে নামছে- গাড়ি আবার ছুটছে। ছুটতে-ছুটতে একসময় গাড়ি হাঁপ ছাড়ল এসে দিগপন্ডী-তে। ব্যাগপত্র তেমন কিছু নেই, তাই হুট বলতেই নেমে পড়লাম ও কাছে-পিঠে কোথাও কোনো বাসের টিকিও নেই। এও এক মফস্বলী গাঁ। পানের দোকান, মিষ্টির দোকান, গাড়ির ব্যাটারী, জুতো, চা, ফল মায় সর্ষে খোলের দোকান সুদ্ধু নিয়ে এলাকা নিতান্তই সাদামাটার দৈনন্দিন চেহারা। পুরো যাত্রাপথে মনে মনে ভাবছিলাম কোনো বাস-স্ট্যান্ডে যাচ্ছি। কিন্তু কোথায় কি? নামার পরই আশাহত আমি লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে গিয়ে ধরলাম কন্ডাক্টরকে।
- এটা বাসস্ট্যান্ড তো নয় ভাই।
- নয় তো কি, একটু দাঁড়ান।
- কিন্তু বেরহামপুরে যে আমায় বলল-
- কি বলল? মনে করে দেখুন, বলল দিগপন্ডী থেকে বাস পাবেন। আপনি নিজেই যদি... 
- বলেছিল অনেক বাস পাবেন।
- মহা ব্যস্ত-বাগীশ তো আপনি.. এইমাত্র নামলেন, একটু অপেক্ষা করুন।
- আরে আপনি তো বাস নিয়ে চলে যাচ্ছেন, তারপর এই দিগশূ্ন্যপুরে দাঁড়াব কতক্ষণ....
- রসুলপুর থেকে যে বাস আসছে তা দিগপন্ডী হয়ে তপ্তপানী দিয়ে যাবে... বাসে যাবেন, আবার ধৈর্য্যও ধরবেন না.... ছটফট করলে হবে?

যে কন্ডাক্টর বাসে অমন ভালবেসে বসিয়ে ছিল, ওমা, নামানোর পরই কেমন যেন পর-পর....
ধুস্। ধমক খেয়ে একদম ফুস হযে গেলুম আমি। কোথায় স্ট্যান্ড থেকে আগেভাগে উঠে জানলার ধারে বসব স্বপ্নে ছিলাম, সেই কিনা এখন সর্ষে খোলের গন্ধগেলা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছি....
কেজানে কতক্ষণ? রোদের দহন অসহ্য হচ্ছে, ব্যাজার মুখে এলাম একটা মিষ্টির দোকানে। দোকানী বলল এইমাত্র নাকি তপ্তপানীর বাস বেড়িয়ে গেছে, পরেরটা আধঘন্টা বাদে। এ তো বেশ ভাল খেলা দেখছি, যেখানেই যাচ্ছি শুনি এইমাত্র বেড়িয়ে গেছে.... এই কথাতে চিড়বিড়ানিটা আরো বাড়ে জানে বলেই কি মানুষ এমন খেলা খেলে, না উল্টোদিকের অসহায় মুখচ্ছবিটা দেখে ভিতরে খুব আরাম বোধ হয়? জানিনা। কি আর উপায়, চলে যেখন গেছে তখন অপেক্ষাই সই। টুকটুক করে ভিতরে ঢুকলাম ও বিখ্যাত ছানাপোড়া অর্ডার করে টুকিয়ে-টুকিয়ে তাই নিয়ে সময় কাটাতে থাকলাম। এভাবেই বা কতক্ষণ? পনেরো, কুড়ি, তিরিশ মিনিট? নাঃ, বাসের দেখা নেই। ইতিমধ্যে সারাঅঙ্গে ওড়িয়ায় লেখা নাম নিয়ে অন্ততঃ সাত-আটটা বাস এসেছে-গেছে আর তাঁতের মাকুর মত আমিও দৌড়াদৌড়ি সেরে ফেলেছি। শেষে মিষ্টান্ন ভান্ডার এর লাগোয়া পানওয়ালার প্রাণে দয়ার উদয় হল। ডেকে বলল- ততোপানী যিব্ব? ক্লান্ত আমি মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলায় সে আপন ভাষায় গড়াগ্গড় কি সব বলে গেল। ভাষা না বুঝলেও তার সহযোগী মনোভাবের সুর বুঝতে অসুবিধে হল না। ঠান্ডা হয়ে বসতে বলল ও বাস এলে ডেকে দেবে যে, এটাই তার কথা। আমি এবার খুশী-খুশী কৃতজ্ঞতার প্রকাশ স্বরূপ একটা পানই কিনে ফেললাম। বাঃ, বেশ সেজেছে। এখানে জলবায়ুর কারণে পানের এই স্বাদ না মশলা ব্যবহারের পদ্ধতিতে- মনে মনে এই সংক্রান্ত গবেষণা চালাতে-চালাতে একসময় মুখের পানও ফুকুত্। এবার? বাজল প্রায় সাড়ে এগারোটা। রাস্তার উল্টোদিকে মুদিখানার দোকান। এবার কি ওইখানে.... ভাবতে-ভাবতেই হৈহৈ রৈরৈ করে পানওয়ালার চীত্কার। অদূরে দাঁড়ানো বাস থেকে তখন মাথায় বোঁচকা, কোলে বাচ্চা, কাঁখালে মুরগী নিয়ে মানুষ নামছে তো নামছেই। বাপরে, ভিতরে এত ছিল? এটাই তাহলে তপ্তপানীর বাস। তা বেশ, ছুটতে-ছুটতে ওঠা গেল। সব বাসের কন্ডাক্টার তো আর এক রকম হবে না... এও নয়। ভরাভর্তি বাসে উঠে ইতি-উতি নজর চালাতে লাগলাম, সীট-ফীট যদি মেলে.... দেখি বেশীর ভাগ বাইরের দিকের সীটে লোক বসে অথচ জানলার দিকটা ফাঁকা। ওরে বাবা, মনে ফুর্তি নিয়ে হাঁকুপাঁকু আমি এগোতে থাকলাম। হায়, কাছে গিয়ে চক্ষু চড়কগাছ। সীটের পায়ের কাছে এক বোঝা কাঁঠাল পাতার মাঝখানে একটি হুমদোপানা রামছাগল গুছিয়ে বসে পাতা চিবোচ্ছে আর বাইরের দিকের সীটে বসা যে লোকটি জিম্মাদার, তার হাতে ঘন্টি বাঁধা দড়ি। মানুষটি নির্বিকার... নিস্পৃহতায় অর্ধলোচন। রীতিমত দু দুটো সীটের টিকিট কেটে সে উঠেছে ও ছাগলের জন্য দিয়েছে আরো কিছু বাড়তি। সুতরাং.....   সুতরাং এই জানা ও দেখাটা একদম অন্য হয়ে এলো আমার কাছে। বাসে করে না গেলে এ জিনিস কি কখনো পাওয়া হত? ভাল লাগা ফের ফিরছে মনে। ইতিমধ্যে বসার জায়গা পেয়ে গিয়েছি, চোখ ফেলেছি জানলা দিয়ে বাইরে। সেই একই রকম গাঁ-গঞ্জ পেরিয়ে যাচ্ছি- দূরের পাহাড় ঘন্টা খানেকের মধ্যেই নিকট হল। গাড়ি গোঁ-গোঁ শব্দে উঠছে, এই ডানে বাঁক নেয় তো পরক্ষণেই বাঁয়ে- থামাথামির বিশেষ বালাই নেই। সামনের দিকে দেখতে-দেখতে একটা অদ্ভুত ভাল লাগায় জড়িয়ে যাচ্ছি। হঠাত্ই এক জঙ্গুলে বাঁকে ঘ্যাচাং করে গাড়ি দাঁড়াল.... কানে কন্ডাক্টরের ততোপানী-ততোপানী হাঁক নিয়ে এসে পড়লাম তপ্তপানী। নেমে দেখি কোথাও কিচ্ছু নেই, সামনে কিশোরীর সিঁথির মত আঁকাবাঁকা রাস্তা চলে গেছে দূরে আর উলোঝুলো মেয়ের না আঁচড়ানো চুলের মতন কালচে সবুজ থৈথৈ জঙ্গল চারদিকে। পথ ধরে এগোতে থাকলাম, এগোতে থাকলাম, দেখি একবোঝা কাঠকুটো মাথায় নিয়ে একজন কাঠুরে জঙ্গল থেকে বেরোচ্ছে। দৌড়ে তাকে ধরলাম-
- ও.টি.ডি.সি-র পান্থনিবাস যিব্ব।   
ব্যস, এটুকুতেই আমার ওড়িয়ার দৌড় শেষ। ভাগ্যিস সে বুঝল। হাত তুলে দেখিয়ে দিল রাস্তাটা। সামনে কিছুটা এগিয়ে ডানহাতে আরো সরু একটা রাস্তা গেছে ভিতরদিকে যার শেষ প্রান্তে পান্থনিবাস। পাহাড়ি ঢালে ছোট ছোট বিছিন্ন কিছু দোতলা-তিনতলা ঘরদোর। এরই একটায় জায়গা হল আমাদের। হয় অফ-সিজন নয় আজ ভোট বলেই বোধহয়, মানুষজন প্রায় নেই। ডবল বেডের রেন্টে ম্যানেজার মশাই আমাদের দিলেন একটা ফোর বেডেড রুম। কোনমতে স্নান সেরে বিকেল ছোঁয়া দুপুরে ছুটলাম ডাইনিং হল-এ। বেচারীদের রাতের রান্নার তোড়জোড় তখন, তারই মধ্যে কোনমতে....

আমার আর তর সইছিল না, আবার বেরোলাম পথে। হরিণঘরে গেলাম- যেটা একটা পার্ক। ছুঁয়ে দিলেই ঝুঁকে পড়ছে এমন লজ্জাবতী লতা, বিশাল গাছ আর বন্য পারিপার্শ্বিকতার মাঝখানে হরিণদের ঘিরে রাখা এলাকা। সব মিলিয়ে বেশ একটা কেয়ারলেস কেয়ারফুল বিউটি। পিছনে পাহাড়, চোখের সামনে হরিণ, প্রায় নাকের ওপরে উইঢিবি নিয়ে একটা আলতো অনাদর, এক অন্যমনস্ক গোছানোপনা। সন্ধ্যা নামার আগেই এবার তপ্তপানী-র দিকে গেলাম। সত্যি বটে..... ছোট্ট একটা ডোবার মত ধোঁয়া ওঠা জায়গা, জলের রং সবুজ। স্থানীয় মানুষজন ধাঁই-ধপাধপ কাপড় কাচছে, দুই বিদেশি মেয়ে-পুরুষ হেলান দিয়ে বসে গাছের গোড়ায়। ঘাটের সিঁড়ি পিছল, জুতো খুলে শুধু পা-টুকুনিই ডোবালাম। কুন্ডে যাবার প্রবেশমুখে দুই থাবাপাতা সিংহ আছে (যা ওড়িষ্যার সব মণ্দিরেই থাকে) বরং এর আকর্ষণ বেশী। যার নামে জায়গার নাম, সে হতাশ করলে কি হয় তপ্তপানীর প্রকৃতি ভরে আছে তার আশালতায় জড়ানো জংলী বৈভবে। বিকেল পাঁচটা বাজল, শালপাতার ছাউনী ঘেরা একটা দোকানে বসে এবার মৌজ করে লিকার চায়ে বিকেল ভিজালাম। তখনো আকাশে আলো, বাতাসে দূরের গন্ধ। এড়াই কি করে!!!!! টুকটুক করে এগোতে থাকলাম... একাই। ক্রমশঃ রাস্তার দুধার থেকে বন-জঙ্গল সরে যাচ্ছে, ধীরে কাছিয়ে আসছে সবুজ মেঠো জমি, হাওয়ায় দুলছে আবাদী ফসল, কাছে-দূরে স্লেটরঙা পাহাড়। আবিষ্টতা চেতনায়। হাঁটতে-হাঁটতে এতটাই দূরে এসেছি যে অন্ধকারে অচেনা পথে ফিরব কিভাবে চিন্তা হল। তবু পিছু ফিরতে মন চায়না। নিজেকে বোঝালাম, পথ যখন আছে, সওয়ারী আছে, তখন সওয়ারও আছে ঠিক। বাস আসবেই, একটু যা সময়ের অপেক্ষা। একটা কালভার্টের ওপর বসলাম, গলা ছেড়ে গাইলাম- আমারে আজি জাগালে যদি নাথ, ফিরো না তবে ফিরো না.....শুনলো শুধু ফুটি-ফুটি তারায় ভরা আকাশ। হঠাত্ দেখি দূরের ঢাল বেয়ে কি যেন একটা নামছে.... কাছে আসতে বুঝলাম ওটা বাস ও আমাকে তুলে নিয়ে ঠিক পাঁচ মিনিটে নামিয়ে দিল পান্থনিবাস। নিরালা নির্জনতার হল এই এক মুস্কিল। আমি আনমনা যতক্ষণ ততক্ষণ বেশ, কিন্তু জ্ঞানগম্যি সহকারে আমি একা বোধ মনে একবার জাপ্টে ধরলেই গেল। যা হোক্, সে বোধে যাবার আগেই পান্থনিবাসের কেয়ারটেকারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। নির্জনতার এটাও ধরণ যে সন্ধ্যার পর থেকে বাকী সময়টা বড় লম্বা লাগে। প্রলম্বিত সে সময়কে নিয়ে যে তখন কিভাবে ব্যয় করি.... একবার ডাইনিং রুম, একবার জ্যোছনা ভাসা বাগান, একবার বারান্দা করেও সময় আর ফুরোয় না। কলকাতায় এসময় আমি কি করতাম? বাব্বা, ভাবার চেষ্টা করেই হাঁকপাঁক করে ফের ফিরে এলাম এই সাজানো অলসতার কাছে। উড়িষ্যার বিখ্যাত পোকা নিয়েও চলল খানিক গবেষণা। ঘরে-ডাইনিং রুমে-বাগানে-বাথরুমে সে যে কত ধরণের মথ-প্রজাপতি-পোকা, তা আর বলে শেষ হবে না।

পরদিন সকাল হল। চা খেয়ে বোঁচকা গুছিয়ে সোজা বাস রাস্তায়। ঠিক নটা বাজল, গোঁ-গোঁ করে বাস হাজির, লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ওঠা মাত্রই তার দুদ্দাড় দৌড়। গতকাল শুনেছিলাম নটায় আসবে, তা বলে এতটা পাংচুয়্যাল? নটা মানে নটাই? অথচ গাড়ি আসছে সেই কোন না কোন মুলুক থেকে- পেটের মধ্যে ছাগল-বাছুর-মুরগী ভরে। ভিড়ে-ভিড়াক্কার বাস ঢালু পথে নামতে-নামতে ঘন্টা দেড়েকেই পৌছে দিল বেরহামপুর। সেই ভিড় থিকথিক স্ট্যান্ড, সেই চেনা ছকের বাস, কোলে-কাঁখালে.... না। আর যাত্রাপথে ছাগল-মুরগী নয়, প্রায় সত্তর শতাংশ মানুষের কোলে-কাঁখালে এবার সমুদ্র সংক্রান্ত জিনিসপত্র। কারুর সঙ্গে মেছো জাল, কেউ সঙ্গে নিয়েছে কাঠের প্যাকিংবক্স, কারুর সঙ্গে ইয়া বড় গামলী.... বাঃ। এ আবার অন্য অভিজ্ঞতা। পূজোর আগে আচমনের মত, ভূমিকার মত, প্রেমের আগের বিশ্রাম্ভালাভ। এইজন্যই তো বাস যাত্রা এত পছন্দের। আমার সমগ্র অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দিয়ে এই শুষে নেওয়া নোনা গন্ধ কোথায় পাব? তাছাড়া লোকাল বাসে ট্যুরিষ্ট দেখে স্থানীয়দের চোখে যে বিস্ময় ফোটে, তার তুলনাও পদ্ম ফোটার চেয়ে কোনো অংশে কম নয়।

ভাবতে-ভাবতে আর চোখ দিয়ে মাঠ জোড়া শষ্যক্ষেত্র কুড়তে-কুড়তে একসময় গাড়ি নামাল যেখানে, সেখানে দেখি আশে-পাশে দোকান, এস.টি.ডি বুথ, সেলুন নিয়ে একটা নেহাত্ই কেজো জায়গা। মন খাবি খেল.... এখানে থাকতে হবে নাকি? তবে যে শুনেছিলাম হোটেল সমুদ্রপাড়ে.....

একটা অটোঅলা দেখি আমার দিকে জুলজুল করে তাকিয়ে আছে। জিজ্ঞেস করলাম-
- সমুদ্দুর যিব্ব?
- হ্যাঁ যিব্ব, যিব্ব।
ঘটাং করে ইঞ্জিন স্টার্ট হল ও ফুচুক করে এগিয়েই..... মানে পলক ফেলার আগেই পাড়ের কাছে গাড়ি। সামনে মোটে দু পা-ও না হেঁটে এই বোকামীতে যা ফল ফলবার তাই ফলল। বেকুব। পয়সা নিতে গিয়ে অটোঅলাও একই বিড়ম্বনায়.... বেচারীও বেকুব। যাই হোক্, সমুদ্রমুখী হোটেল কলিঙ্গতে ওঠা গেল। এখন বেশ বেলা, তাবলে সমুদ্রস্নান বাদ দেওয়া যায় নাকি? পাড়ের কাছে গোলগাল ছাউনীঅলা হোটেলটা দেখে পছন্দ হল বেশ। বড় গলদা চিংড়ির রোস্ট আর ডাল-ভাত-ভাজার অর্ডার দিয়ে নেমে পড়লাম জলে। ঠেউ-এর সঙ্গে একা-একাই কত গপ্প-গাছা-খুনসুটি.... উঠতে ইচ্ছে করে না। কিন্তু সঙ্গীজনের নোলার তাড়ায় উঠতেই হল। আয়েশ করে খেয়ে তিনি গেলেন ঘুমোতে আর আমি চষতে। ঘুরে-ঘুরে আশ মেটে না, বিস্ময় আমার সবখানেই। জাল বোনা থেকে, জেলেদের মাছ ধরা থেকে, বাজারে সেই মাছ বরফ ঠেসে গুদামজাত করা অবধি দেখলাম স-ব। ইতিমধ্যে বিকেল হল, রুমে ফিরলাম ও সঙ্গীজনকে খাতা-কলম নিয়ে কাব্যকলায় দেখে অবাক হলাম খুব। তখন না বুঝলেও, সময় পরে জানিয়ে দিয়েছিল তার সেই কাব্যপ্রীতির কারণ। সে অবশ্য আলাদা ভ্রমণ, আলাদা সময়ের। আপাততঃ ফিরি সেই দিনে। ঘরে ঢুকেই তাগাদা লাগালাম- চল, চল, লাইট হাউসে উঠব না? এখানে আজ একটাই দিন, ঝুপ্ করে সন্ধ্যা নামলেই শেষ।





লাইটহাউস থেকে কত দূরে যে নজর চলে যায়- যেন দৃষ্টিসুখের উত্সব। বাধাবন্ধনহীন শুধু নীল আর নীল। অন্ধকার নামতেই নীচে এলাম। এবার সমুদ্রের পাড় ধরে খানিক হন্টন, ফেরা, আবার এগোন, কিছু সময় ঝিনুকের দোকানে ঘুরুর-ঘুরুর। একশো বারের দেখা সেই ঝিনুকবোনা ঝাড়লন্ঠন, পর্দা, ধূপদানী নিয়েই কাটালাম কত সময়। সন্ধ্যা ইতিমধ্যে টুপ করে গড়িয়ে রাতের কোলে পড়ল আর ফাঁকা হতে থাকল সমুদ্রের ধার। ফের ঝাউ-ছাউনীর হোটেলে রাতের খাওয়া সেরে ফিরলাম অস্থায়ী ঠিকানায়। ঠেউ উছলানো শব্দ আর হাওয়ার নোনা গন্ধ মনে মাখতে-মাখতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। ভোর হতেই মনে হল আরে, আজই তো ফিরে যাব....  ব্যস, শুধু চা-টুকু খেয়েই বেড়িয়ে পড়লাম আবার। এখানের ব্যাক ওয়াটারের কথা শোনা ছিল। খুঁজে-খুঁজে সেখানেও গেলাম। কিন্তু কি বলব, আমার কৌতুহল কখনো-কখনো বড্ড শোধ তোলে। ব্যাক ওয়াটারে জল তো আছে কিন্তু সেসব বড়....

আসলে ওটা জেলে ভাইদের প্রাতঃকৃত্যাদির জায়গা। আশেপাশে জাল শুকোচ্ছে, উপুড় দিয়ে ঢেলে রাখা মাছ শুকোচ্ছে- একেবারে নৈরেকার দশা, পালাতে পারলে বাঁচি। শেষে অন্য রাস্তা দিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে পৌঁছলাম এক মন্দিরে। ঢোকবার মুখেই সেই চিরাচরিত থাবা পাতা সিংহ, কারুকার্য করা ভাস্কর্য মন্দিরের সারা চত্বর জুড়ে। দেবদেউল বন্ধ, জানিনা কে ছিলেন ভিতরে- জগন্নাথ না কৃষ্ণ! ঘুরে-ঘুরে বেলা গেল, ফের সমুদ্দুরে একা-একাই জল-ঝাঁপ। এবার মনে শেষের বাঁশী বেজেছে। ঝাউ-ছাউনীর দোকানে লাঞ্চ সেরে রাতের ডিনার প্যাকেট অর্ডার দিয়ে ফিরতে হল। দুপুরে বারান্দায় এসে বসলাম, ঠেউ-এর সঙ্গে কিছু সুখ-দুঃখের কথা-কথায় বিকেলে এসে দাঁড়ালাম। সঙ্গী মানুষও তার পেটভরা ঘুম সেরে উঠল। এবার ট্রেনের সময় যত কাছে এগোতে থাকল, সেই শুরু হল তার টেনশন-গেলা চেনা ছান্দিক ধারাপাত। আমি বিনদাস, আপনভোলা। দুদিনের এই সঞ্চয় আমাকে রাগ ভুলিয়েছে, কান্না ভুলিয়েছে, আর এ তো সামান্য উচাটন, বাস্তব পথিকের তৈরী করা কষ্ট-কষ্ট উদযাপন। আমার মধ্যে এখন ধুন্ধুমার। কালচে-সবুজ বনের রঙ, হলদে-সবুজ মাঠের রঙ, নীলচে-সবুজ সমুদ্র রঙ তোলপাড়। ট্রেনে উঠলাম, কাঁথা মুড়ি দিলাম ও সব কটাকে ডেকে নিলাম ভিতরে। ভোর হল আজ অন্য ভ্রমণের বার্তা সঙ্গে নিয়ে..... নিশ্চুপে।










No comments: