'আনন্দবাজার' ওয়ানস্টপে আজ 2.2.2014 বেরনো ‘ছায়ামায়ায়’- গল্পটির শেষভাগ নীচে ব্লু কালারে হাইলাইটে রাখলাম। গল্পটি তিনভাগে বেরিয়েছিল, 19.01.14, 26.01.14 ও আজ 02.02.14-য়।
ছায়ামায়ায়
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
(1ম ভাগ)
বিন্দি তখন গরুমারা জঙ্গলের মাচানে। ঘন্টা দেড়েক গায়েব ছুঁচো-বেজী কিছুরই পাত্তা নেই। সঙ্গে ঋক আছে- গাইড... তবু ছমছমে ভাব, অন্ধকার নামলেই চিত্তির। তল্পিতল্পা গুটবে ভাবছে হঠাত্ হঁসর-ভঁসর শব্দে নীচে তাকিয়েই উল্লাস। স্কুইরাল-হরিণ নয় একেবারে গণ্ডারের দেখা পেয়ে বিন্দির উত্তেজনা তুঙ্গে। বিস্ফারিত নাসার তেজীয়াল রাগ যে তেঁনার কিসের ওপর কেজানে- খাড়াই খড়্গ আছড়ে পড়ছে গাছে মূহুর্মুহু। আর তখনই তন্ময়তাকে খানখান করে বনজঙ্গল কাঁপিয়ে বেজে উঠলো মোবাইল। কী লজ্জা, কি লজ্জা- রেঞ্জার পইপই করে বলে দিয়েছিল মোবাইল যেন বন্ধ থাকে- রঙিন পোশাক, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, সিগারেটের গন্ধ... ছিঃ, ছিঃ, গাইডের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না বিন্দি। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ফোন তো থামাল কিন্তু অচেনা শব্দ বীরপুঙ্গবের দিমাগে এমন চমক পৌঁছল যে হাঁট্টাগাট্টা একছুট্টে ধাঁ। ঠাস-ঠাস করে নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছে। উপায় কি- যা ঘটবার ঘটে গেছে। তাছাড়া গাইডের তিরছি নজর বিন্দিকে অপরাধী করে রাখছে- ফিরে যাওয়াই বেটার। জঙ্গল পেরতে পাক্কা আধঘন্টা গেল। বেরিয়েই ফোন চালু করতে হল- অফিসের হয় যদি... হসপিটাল টু হনিমুন ছাড়ান নেই কিনা- শ্যামের বাঁশী বেজেই চলে। মেল আসছে, কোটেশন দিতে হচ্ছে। কি যে সব ভাবে! সমাধানপত্র কি ও পকেটে নিয়ে ঘোরে যে হাত পাতলেই পাতে পড়বে! একশো অস্থিরতা চিবতে-চিবতে বিন্দি লাস্ট কল-নং-এ ফোন লাগাল। নাঃ- টাওয়ার না পাওয়ার ঢংবাজীতে তিনি কঁকাচ্ছেন। তাহলে বাজল কি করে। ঋক বলল ‘ওটা বাইচান্সের মামলা- আমার থেকে করো।’ বিন্দির পোষাল না, মামলাটা বোঝা চাই। জঙ্গলে দু’ঘন্টা কাঠ পাকিয়ে অপেক্ষার থেকে যদি বা কিছু মিলেছিল তায় ফোন চিল্লিয়ে-মিল্লিয়ে দিল নাক কেটে। কে করেছিল, কি বলার ছিল... নানান ভাবনার সঙ্গে ফোন নিয়ে বিন্দির বিরক্তির খুটুরখাটুর চলেছে। ক’টা প্রোমোশনাল ও অফিস মেসেজের পরেই দেখল ভায়ের মেসেজ- ‘মাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি।’ মানে? কি হল? দিন তিনেক আগেও সব ঠিকঠাক, নিজের লং কোটটাও দিয়ে দিল... একরকম জোর করেই। ও’সব লং কোট-ফোট আউটডেটেড বলেও পাত্তা পাওয়া যায়নি। বাঁকা ঈঙ্গিতকে মা না বোঝার ভানে দিব্যি শুনেছে। নিজের বাঁচাকে যে স্থির করে রাখে অন্যের বেঁচে থাকার শর্তে তার ওসব গায় মাখলে চলে? উদ্দেশ্য সিদ্ধিটাই মোদ্দা। সবার জন্য বাঁচতে-বাঁচতে মা অভিমান করতেই ভুলে গেছে। অতি বুদ্ধিমতী তিনি জানেন কোথায় কি গিলতে হয়।
ইমিডিয়েটলি কলকাতা পৌঁছনো চাই- মাকে বলতেই হবে, ‘তুমি না বাঁচলে আমিও বাঁচবো না।’ কথাটা কাঁচাকাঁচা গোদা টাইপড্ হলেও এই ‘বাঁচবো না’-র এক্সপ্লয়টেশনই উপায়। মার যা নেচার, হয়তো জাপ্টে নেবে জীবন। বেচারী বিলুটা একা, কোন হসপিটালে নিল... ভেতরে শব্দপুঞ্জের স্রোত। সময় বুঝে ঋকের ফোনও নিশ্চুপ।
তুখোড় ড্রাইভার অবস্থার গুরুত্ব বুঝে প্রায় শ্যুমাখার স্টাইলে পৌঁছে দিল খুনিয়ামোড়। বিন্দির মোবাইল ধরা হাত আকাশে তাক করে থাকতে-থাকতে একসময় টাওয়ার মেলাল। কোনোমতের ঘষঘষে আওয়াজ থেকে বোঝা গেল- অবস্থা ক্রিটিকাল, কারুর রেফারেন্সে হস্পিটালে ভর্তি করা গেছে। এরপর ওরা দুদ্দাড়িয়ে হোটেল। ম্যানেজারটি চৌখস। বোর্ডার্স হ্যাপা সামলাতে-সামলাতে খ্যাঁচাপড়া চিড়চিড়াপন্ বা পাকটুস্ ব্রেনের পেটি পলিউশান গ্রাস করেনি এখনো। তাঁর চেষ্টায় ঘন্টাখানেকেই টিকিট হয়ে গেল। টাকাপয়সা মিটিয়ে শ্যুমাখারের জিপে চড়ে ওরা উড়ে চলল বাগডোগরার দিকে।
কলকাতা পৌঁছতে-পৌঁছতে রাত দশটা। বিপুল বিস্তারের সামনে যেমন সবকিছুই ক্ষুদ্র লাগে, তেমনি আকাশ চিরে যেতে-যেতে বিন্দির তুচ্ছ লাগছিল এই জীবন, কষ্টদায়ক অবস্থার ফের, নিজের একান্ত বাঁচা। অবশ্য কিছু পরেই মেঘের গায়ে চাঁদের আঁকিবুকি ওকে অন্যমনস্ক করল। পৃথিবীতে যন্ত্রণার পাশে রূপের মহোত্সব আছে বলেই না বাঁচাটা সহনীয়। ঐ সময়টুকু বিন্দির কাছে বড় আপন ছিল, একটা নির্ভার যাপন... একটা ফ্রেশনেস। ভাগ্যিস্! নাহলে মুস্কিল হত। সারাটা দিন আজ যুঝতে হয়েছে নানা অনুভূতির সঙ্গে- কষ্ট, অপরাধ বোধ, দুশ্চিন্তা...
কলকাতা পৌঁছতে-পৌঁছতে রাত দশটা। বিপুল বিস্তারের সামনে যেমন সবকিছুই ক্ষুদ্র লাগে, তেমনি আকাশ চিরে যেতে-যেতে বিন্দির তুচ্ছ লাগছিল এই জীবন, কষ্টদায়ক অবস্থার ফের, নিজের একান্ত বাঁচা। অবশ্য কিছু পরেই মেঘের গায়ে চাঁদের আঁকিবুকি ওকে অন্যমনস্ক করল। পৃথিবীতে যন্ত্রণার পাশে রূপের মহোত্সব আছে বলেই না বাঁচাটা সহনীয়। ঐ সময়টুকু বিন্দির কাছে বড় আপন ছিল, একটা নির্ভার যাপন... একটা ফ্রেশনেস। ভাগ্যিস্! নাহলে মুস্কিল হত। সারাটা দিন আজ যুঝতে হয়েছে নানা অনুভূতির সঙ্গে- কষ্ট, অপরাধ বোধ, দুশ্চিন্তা...
এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি নিল ঋক, বাড়িতে ব্যাগপত্র নামিয়েই সোজা হস্পিটাল। তিনতলার বারান্দায় একটা ট্রলি-স্ট্রেচারে বিলু বসে আছে দ-মার্কা হেরো চেহারায়। দিদিকে দেখে ধড়ফড়িয়ে নামল- বিন্দির দম ধরে থাকা ভাবটা এবার উপছে যেতে চায়- কোনমতে সামলে বলল-
- মা কেমন? জ্ঞান আছে?
- আপাততঃ স্টেবল, যেভাবে বদলাচ্ছে...
- ভেতরে যাব?
- না, না...
ঋক পরের বাড়ির ছেলে, অত আবেগী চপচপানীতে নেই- অবস্থাটা বুঝতে একটু থমকালো। বিন্দিকে বিয়ে করে থেকে দুই ভাইবোনকে দেখছে। একটুতেই হাত-পা ছেড়ে দেওয়া এদের প্রকৃতি। ঋক দু’জনকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নামল, ক্যান্টিন থেকে তিনটে চা এনে বসল গাছতলার বাঁধানো চত্বরে।
- বল এ'বার...
(2 ভাগ)
26.2.2014
যেন সবই স্বাভাবিক, খুব ইজি। ঋকের আত্মবিশ্বাসী এ্যাটিচ্যুডের স্পষ্টতায় বিলুর ঘাবড়ানো ভাব থৈ পেল। চাতালে পা গুটিয়ে বসতে-বসতে বলল- ‘চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল। সঙ্গে-সঙ্গে হাউস ফিজিশিয়ান, স্পেশালিস্ট, এ্যাম্বুলেন্সের পর্ব পেরিয়ে এখানে। তখুনি পেস-মেকার বসাতে হত কিন্তু মেডিক্যাল টেস্ট না করে হবেনা। তাই আজকের রাতটা সাপোর্টিভ ব্যবস্থায় রেখে কাল অপারেশন।’
বহুদিন থেকেই মার হৃদয় নাজেহাল বিন্দি জানে। তা’বলে এত তাড়াতাড়ি ধড়কন বিষম-ছন্দ ভালবাসবে বোঝা যায়নি। এ’সব ভাল লাগেনা বিন্দির, বড় বিরক্তিকর বাস্তবতা।
- এত জায়গা থাকতে হস্পিট্যালে কেন রে ভাই?
- কিছু করার ছিল না। আনন্দীর কাকা এখানের সার্জন, তাছাড়া তুই নেই...
আনন্দী বিলুর হোনেওয়ালী বৌ। এই মাঘেই বিয়ে- এখন কি হবে কেজানে।
- আর কারুকে জানিয়েছিস?
- হ্যাঁ, অনেককেই...
- তুই থাকবি এখানে?
- হ্যাঁ।
- কিন্তু কোথায়? সিঁড়ির কোণে-কোণে পানের পিক...
- ও’সব দেখিস না দি, রুগী রোগের জ্বালায় যখন পোড়ে ও’সব দেখে?
- কিন্তু সুস্থ মানুষগুলো তো দেখে। কেয়ার গিভারই অসুস্থ হয়ে পড়লে...
- ভাবিস্ না, সব ঠিক হয়ে যাবে।
বিলুর আস্থায় স্বস্তি পেল বিন্দি।
পরদিন সকালবেলায় এল যখন অপারেশন সারা। পরিবারে কম মানুষ থাকা যে কি ঝক্কির তা এই সময়গুলোয় টের পাওয়া যায়। বিলুর ওপর দিয়ে ঝড় একটা যাচ্ছে বটে। ইতিমধ্যে কাকামণিও এসেছেন। নার্স জানালেন- ‘পেশেন্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে, যেতে পারেন।’ অবস্থার সঙ্গে যুঝতে-যুঝতে বিলু পুরো কাহিল- বিন্দিই প্রথম গেল। ভেতরটা আলো-আঁধারী, বিন্দি দেখল মার আধো খোলা চোখে দৃষ্টিহারা নজর, গভীর কালোমুখে কষ্ট সওয়া ফ্যাকাশে সাদা ঠোঁট। দাপুটে মাকে অমন অসহায় দেখে কান্না উঠে এল বিন্দির, সামলে নিয়ে মাথায় হাত রাখল। স্পর্শের একটা ভাবময়তা যেমন আছে তেমনি স্ট্রং মেসেজও। তা শুনতে চেয়েই বোধহয় মার চোখের পাতায় তরঙ্গ। কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে বিন্দি বলল- ‘কষ্ট হচ্ছে?’ লগি ঠেলা কোন্ দুস্তর পারাবার সাঁতরে মা লাল চোখে চাইল, ঠোঁট দুটো নাড়ল আর বিন্দি শুনল- ‘মিঁয়াও।’
মারাত্মক চমকে গিয়ে কেবিনের আলোটা জ্বেলে ফেলল ও। দেখল লেজ-খাড়া এক বেড়াল বেড়িয়ে আসছে বেডের তলা থেকে। বিন্দি অসুস্থ মার চেয়েও ঘোরতর অসুস্থ বোধে কি করবে ভাবছে। ঠিক তখনই ডক্টর এলেন রাউন্ডে। বিন্দি খোনা-ফাটা গলায় কোনোমতে বলল -‘স্যার বিড়াল’। নিবির্কার তিনি অতি স্বাভাবিক স্বরে বললেন- ‘অবাক হবার কী আছে, তাড়িয়ে দিন।’ বিন্দির অবাক হবার মাত্রা এতে বেড়ে গেল চতুর্গুণ- এই নির্লিপ্তি ওকে স্থির থাকতে দিলনা। ধড়ফড়িয়ে বেরল কেবিন ছেড়ে- এক্ষুণি মাকে নিয়ে চলে যাবে ও। বিরক্তির আঁচ বিলু অবধি পৌঁছে গেল-
- মাকে কোথায় এনেছিস, আই.সি.সি.ইউ-তে বেড়াল!!!!-
- কাল আমিও দেখেছি।
- তারপরেও!!!!!
- কি করতে পারি?
- বেড়াল শুনে ডক্টর বললেন... ‘কী আছে, তাড়িয়ে দিন।’
- তবে?
- কি তবে, মিনিমাম একটা পরিষেবা থাকবে না?
- ওঁর ক্যাজুয়াল এ্যাটিচিউডের মধ্যেই তো উত্তরটা লুকোনো, বুঝলি না?
ঋকও বলল-
- কিছু পেলে তবেই কিছু না পাওয়ার অনুযোগ মানায় বিন্দি- ডাক্তারবাবু ঘুরিয়ে সেটাই বললেন!
- আমি শুনবো না, এখান থেকে নিয়ে যাব মাকে।
বিলু অবাক-
- কোথায়?
- নার্সিংহোমে।
– হ্যাঁ, এ’ গল্পটা এ্যাপারেন্টলি ভাল, কিন্তু...
- কিসের কিন্তু?
- নার্সিংহোমে রাখলেই কি রুগীর জ্বালাপোড়া কমবে না স্যাটাক্ করে ভাল হয়ে উঠবে?
- এ’টা আগেও বলেছিস্, আমি তর্কে যাব না।
- রাগলে সমাধান হবে? তারচেয়ে-
- কি তারচেয়ে? তারচেয়ে চোখ বুজে থাকব? বেড়ালের সঙ্গে মাকে এক বিছানায় থাকতে দেব?
ওদের তর্কবিতর্কের মধ্যেই কাকামণি দেখে এসেছে, বলল-
- বৌদিকে একটু সুস্থ মনে হল জানিস্। জল চাইছিল।
কিন্তু উত্তর দেবে কি, মাথা দপদপ করছে বিন্দির। কি মনে করেছে বিলু, একা সামলেছে বলে একারই খবরদারী! বন্ড দিয়ে হলেও মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে...
হঠাত্ কুশকে মনে পড়ল বিন্দির। স্কুলের সেরা ছেলে ছিল ও- পড়াশোনা, স্পোর্টস্, স্যুইমিং... ক’দিন আগে দেখা হতে বলল সাউথ ক্যালকাটার এক নার্সিংহোমে জয়েন করেছে। পরিবেশ ভাল, কাজের স্বীকৃতি, স্বাধীনতা... সবটাই বেশ লাগসই। ফোন লাগাল বিন্দি। সব শুনেটুনে কুশ বলল- ‘আরেকটা দিন ওখানে রাখ তারপর নিয়ে আয়।’ দু’দিন বাদেই ওরা ছাড়িয়ে নিল মাকে।
হস্পিট্যালের কোনো কিছু সম্পর্কেই আর আগ্রহ নেই বিন্দির, বেরিয়ে বেঁচেছে। হয়তো ভাল- তবু নিজের কাছে নিজের ভাল থাকার প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা যায়না। পয়সার মূল্যে কিনলেও স্বস্তি অনেক দামী। এখানে আনতে পেরে কি ভাল যে লাগছে... নার্সিংহোম তো নয় যেন পাঁচতারা হোটেল। সেন্ট্রালি এসি, লাউঞ্জে দামী সোফা, মৃদু সুরে সেতার বাজছে, দেওয়ালে মর্ডান পেন্টিং... এমন কি দায় বদল হতে বিলুও খুশদিল। মা ঘুমোচ্ছে... তবু তাঁকে নিয়েই চিন্তা, হাজার হোক্ ধকল তো। ভাগ্যিস্ কুশ ছিল।
(শেষভাগ)
2.2.2014
ভিজিটার্স আওয়ার্সের পর ওরা বেরলো, গাড়ি নিয়ে ঋক সোজা বাইপাশের ধাবায়। ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল-
- আর টেনশন নেই... বিনদাস থাকো। দিন পাঁচেকের মধ্যেই যখন ছেড়ে দেবে বলেছে...
- কিন্তু এখানে কেন?
- খাবে বলে...
- এখন খাওয়া যায়? মা হস্পিটালে?
- বাড়িতেও তো খেতে হত।
- কিন্তু...
- নো কিন্তু। সিচ্যুয়েশন এখন বেটার। জোর করে কষ্টে থাকার মানে আছে?
- জোর করে আছি?
- হ্যাঁ আছো, ‘কষ্টে আছি’-র ভাবনা একটা ঠকানো অভ্যাস- বাদ দাও- এনার্জি স্টোর থাকলে তবে না যুঝবে।
- হোটেলে খেয়ে?
- কিছুটা তো বটেই। মন অন্য প্লেজারে ঢুকলে কষ্টপত্র মাথায় চড়তে দেয়না। আখেরে তোমারই লাভ হবে বিন্দি। একসময় দেখবে মন খারাপ ভ্যানিস।
- না হতেও পারে...
- হতেও পারে। মাঝখান থেকে মনমরুনী থেকে কেন ক্ষতি নিজের... পরিবেশের...
ঋক এমনই। গুরুতর ঘটনাকে হাল্কাছাঁদে নিয়েও সামলায় দায়িত্বের সঙ্গে। ওর প্লাস পয়েন্টগুলো বিন্দি জানে কিন্তু নিজে পারেনা, উতলা হওয়াই ওর নিয়তি। কোনোমতে খাওয়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তি। ঋক যতই বলুক, ভেতরে-ভেতরে একটা অপরাধবোধ চলছেই। জামাকাপড় ছেড়ে ঋক বসল কম্পিউটরে আর বিন্দি বসল প্ল্যানার নিয়ে। গোছাতে হবে, সবকিছু এত এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল বিন্দির কিন্তু ঋক কোথায়? গ্যারাজে গাড়ি নেই, সেন্টার টেবিলে একটা চিরকুট, ‘ব্যস্ত হয়ো না, আমি সঙ্গে আছি- টিভি খোলো।' খাপছাড়া চিঠি পেয়ে বিন্দি অথৈ জলে। চায়ের জল চাপিয়েছিল, গ্যাস বন্ধ করে টিভি খুলে বসল। প্রত্যেক চ্যানেলেই ঘুরে-ফিরে এক খবর। প্রোগ্রামের নীচে স্ক্রল করে লেখা যাচ্ছে-
‘The city of joy faced calamitous fire that swept through the floor of South Kolkata’s… hospital… Few months back, the fire service dept. had inquired the hospital and...’
মাথায় কোনো কথা পৌঁছচ্ছে না বিন্দির- কুশকে এখুনি ফোনে পেতে হবে। কিন্তু কোথায় কি, ফোন বেজে যাচ্ছে, এমন কি ঋককে নয়, বিলুকেও পাচ্ছেনা। বারবার ওর সঙ্গেই কেন এমন হচ্ছে? গরুমারা থেকে যখন চেষ্টা চালাচ্ছিল তখন পায়নি- এখনও তাই। কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেনা বিন্দি।
‘The incident was more heartbreaking as most of the victims were patients...’
কি করতে পারে এবার ও উঠে যাওয়া ছাড়া? তাই করল, উঠে গেল বিন্দি টিভি ছেড়ে। কি জানার অপেক্ষা, কি দেখতে চায় ও... মার মুখ? ও যে পালাতে চেয়েছিল তা স্পষ্ট। পালাতে চেয়েছিল বেড়াল থেকে বৈভবে, বিভ্রম থেকে বিশ্বস্ততায়। পেল? স্বস্তির আকাঙ্খা কি শান্তির দোরে এনে দাঁড় করাল? জেদ দিয়েও নিয়তিকে পেরনো যাচ্ছে না। বিলু কতবার বলেছিল... ‘যে কষ্টে আছে তার কষ্ট সর্বত্র এক। বাইরের রূপে ভুলবি দি... ’ শোনেনি বিন্দি, ঋককে পাশে নিয়ে যা চেয়েছিল তা ঘটিয়ে ছেড়েছে। কি পেয়েছে এতে? অস্থিরতা থেকে স্থিরতায় গেছে শুধু হতাশা, বাকি প্রশ্নচিহ্ণে। কে ভুল? হসপিটাল, বেড়াল, কেতাদুরস্তের তলায় লুকনো জঞ্জাল, বিলুর দর্শনতত্ত্ব না বিন্দির... ভাবতে পারছে না আর। ওর জেদ ঠিক না বেঠিক তার উত্তরপত্র নষ্ট। বিলুর ভাবনা ভুল, ঋকের স্মার্টনেস ভুল, নিজের তীব্র আবেগ ভুল, সত্য শুধু...
কোথাও বোধহয় বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, শব্দের দামামা নিয়ে মাথার মধ্যে ক্যামেরার সাটার পড়ার স্যাক্, চোখের ওপর একশো তারার রেস। পিছনের বাগানে এসে দাঁড়ালো বিন্দি, প্রতিদিনের মত সেই ফিঙেও এসেছে, ‘টুইক’ ডাকে কান ঝালাপালা। ধূসরটি নেই- এসেছে কালোবরণী একাই। এ’সময় বিন্দি চা খেতে-খেতে বিস্কুট ছড়ায়, সেই টানে যে কত পাখী আসে। সবার নিজস্ব সময় আছে, সেই মাপে আসে বুলবুলি, ঘুঘু, শালিখের দল, তারপরেই আসে ‘কালোলীনা’ আর ‘ধূসরিনা’ দুই ফিঙে। কিন্তু আজ কি কিছু অন্যরকম? কালোলীনা হঠাত্ চুপ করে গেল কেন? বকুল গাছের গোড়ায় রোদ এসে পড়েছে- মানে সাতটা বাজল। কই, বুলবুলিও এলো না তো! সেই ছ’টা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিন্দি, কোথায় শালিখ, ঘুঘু দম্পতি? শুধু খোঁড়া কাকটা এলো অসময়ে।
ঘরে ফোন বাজছে অনেকক্ষণ- বারবার। মালসায় ঠোঁট ডুবিয়ে জল খাচ্ছে কাক, পালক ভিজছে, ভিজছে ঠোঁট-বুক-মুখ। আকাশের দিকে উঁচু করা মুখ বেয়ে জল নামছে টুকটুক করে- রূপোলী মায়া চোখে তৃপ্তির অন্তহীন সুখ। তাকিয়ে আছে বিন্দি, তাকিয়েই আছে- রোদ বেঁকে গেছে ফের। ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক গলে উঠোনে একশো আঁকিবুকি।
এখানে ছড়ানো ডুয়ার্স, এখানে ভোর-পাখী-রোদ্দুর জুড়ে দাঁড়িয়ে বিন্দি অপেক্ষায়... ‘ধূসরিনা’ আসবেই, ঘুঘু দম্পতি,শালিখ, বুলবুল, মা...
********************************************************************************
স্বপ্নসিঁড়ি
চৈতী আহমেদ
বাঁশের লাঠিটার চুড়ায় খড়ের পেচগির মাথায় গাঁথা এখনও দুইটা গোলাপী মেঘ, মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওরা হয়ে যায় স্বপ্নসিঁড়ি! সকাল বেলা রোদ চড়তেই গোলাপী রঙের ঝালর লাগানো সাদা পোষাক গায়ে চড়িয়ে তৈরি হয়ে যাই আমি সময়ের সঙ, বুলিরও যেন তর সয় না, কারণটা সূর্যের মতই পষ্ট, এই মেঘ ফেরি করে ফিরলে তবেই হবে বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া আমাদের দুই সহোদর আর সহদোরার ক্ষুন্নিবারণ, বুলি তার ভাঁজ পড়া কপালের ভাঁজগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে পেঁজা তুলোর মতো সাদা গোলাপী মিলিয়ে বিশটার মতো হাওয়াই মিঠাইয়ের ঝাড়টা কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় পিতলের ঘন্টাটি, প্রতিদিন যেমন দেয়, এটা বুলির প্রতিদিনের স্বাভাবিক ক্রিয়া হলেও আমি প্রতিদিনিই টের পাই তার ঝাঁঝ।
বাঁশের লাঠিটার চুড়ায় খড়ের পেচগির মাথায় গাঁথা এখনও দুইটা গোলাপী মেঘ, মেঘের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতেই ওরা হয়ে যায় স্বপ্নসিঁড়ি! সকাল বেলা রোদ চড়তেই গোলাপী রঙের ঝালর লাগানো সাদা পোষাক গায়ে চড়িয়ে তৈরি হয়ে যাই আমি সময়ের সঙ, বুলিরও যেন তর সয় না, কারণটা সূর্যের মতই পষ্ট, এই মেঘ ফেরি করে ফিরলে তবেই হবে বার্ধক্যে পৌঁছে যাওয়া আমাদের দুই সহোদর আর সহদোরার ক্ষুন্নিবারণ, বুলি তার ভাঁজ পড়া কপালের ভাঁজগুলোকে এক জায়গায় জড়ো করে পেঁজা তুলোর মতো সাদা গোলাপী মিলিয়ে বিশটার মতো হাওয়াই মিঠাইয়ের ঝাড়টা কাঁধের উপর ফেলে দিয়ে হাতে ধরিয়ে দেয় পিতলের ঘন্টাটি, প্রতিদিন যেমন দেয়, এটা বুলির প্রতিদিনের স্বাভাবিক ক্রিয়া হলেও আমি প্রতিদিনিই টের পাই তার ঝাঁঝ।
যেদিন আমি সাতপুরুষের ভিটা মাটি ফেলে, চক ডাস্টারের অভ্যস্ত জীবন ভুলে যমুনার ওপার থেকে এই ঢাকা শহরের পথ চিনেছিলাম, তখন বুলি ছিলো তার স্বামীর সংসারে, নিজের পেটের সন্তান ছিলো না, সতিনের তিনটি সন্তান নিয়েই ছিলো তার দুঃখ সুখের সংসার, যেদিন শুনলো তার ভাই নুরা পাগলা মাষ্টার পয়ত্রিশ বছর আগে রেসকোর্সের ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরের ৭ই মার্চের ভাষন তার বজ্র কণ্ঠ নকল করে ছাত্রছাত্রীদের শুনিয়ে দিয়ে গ্রাম ছেড়েছে বুলিও সেদিন তার শেকড় বিহীন সংসার ছেড়ে এসে জুটেছিলো আমার সঙ্গে,
উনিশশো একাত্তর সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার কয়দিন আগে আমার বৌটা কোথা থেকে অর্ধ উলঙ্গ ফিরে এসে বাড়ির পিছনে আম গাছে ফাঁসি নিলো, আমার নিজেকে মনে হলো অথর্ব, বৌটি আমার পোঁয়াতি ছিলো, আমি পাগল হয়ে গেলাম, ফ্রক পরা ছোট্ট ফুটফুটে একটা পরী আমার আঙ্গুল ধরে স্কুলে যেতে লাগলো, আমার নাম ছিলো নুরুল আমিন, মেট্রিক পাশ করে গ্রামের স্কুলে মাষ্টারী শুরু করেছিলাম, বৌ মরার পর গ্রামের মানুষ নাম দিলো নুরা পাগলা মাষ্টার।
বুলি যেদিন ঢাকায় আসলো সেদিন রাতে আমি ভাড়ার রিক্সা জমা দিয়ে সেগুন বাগিচার ফুটপাতের ঝুপড়িতে ফিরেছি।বুলি বিলাপ করতে লাগলো তুমি না মেট্রিক পাশ, তুমি রিক্সা চালাও? তুমি না শিক্ষক? আমি হাসলাম
–আমি পাগল ছাগল মানুষ রিক্সা কি আর চালাই, চালাইতো প্লেন, সেই প্লেনের পাইলট একটা ফ্রকপরা ছোট্ট পরি
-দেখ ভাইজান পাগল বলবা না, তুমি পাগল না, পাগলের কি আর স্বপ্ন থাকে? বুলি কথা বাড়ায় না
-আইচ্ছা ঠিক আছে, আমার ভাসুরে হাওয়াই মিঠাই বানাইয়া বেঁচে, আমি বানাইয়া দিতাম! তুমি আর রিক্সা চালাইবা না হাওয়াই মিঠাই বেঁচবা, আমি বানাইয়া দিমু তুমি বেঁচবা, হাত ধরে থাকা পরিটারও হাওয়াই মিঠাই পছন্দ হয়ে যায়, আমার সাথে রিক্সায় করে শিশুপার্কে আশে পাশে ঘুরতে ঘুরতে সে হাওয়াই মিঠাই চিনে গেছে, বুলি হাওয়াই মিঠাই বানায় আমার কাঁধে উঠে বসলেই সেগুলো হয়ে যায় হাওয়ার পাঙ্খা লাগানো মেঘ, সকালেতো শিশুপারকে কোনো শিশু থাকে না, তাই সাদা গোলাপী মেঘগুলোর গন্তব্য হয় শাহবাগ হয়ে টি এস সি,
যতক্ষণ মাথার উপর মেঘগুলো ভেসে থাকে ততক্ষণ কোনো ক্লান্তিই টের পাই না, গোলাপী মেঘ দুটোর দিকে তাকিয়ে টের পাই অবষন্ন হয়ে আসছে শরীর, চারুকলার সামনে এসে শুনি –এক রাজাকারের বিচারে যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে, দেখি আম গাছে আমার পোঁয়াতি বৌটা দোল খাচ্ছে, গোলাপী মেঘ দুটো গাঢ় হতে হতে দেখি রক্ত বৃষ্টি হচ্ছে ভিজে যাচ্ছি আমি, আমার ঘুম পায়, জাতীয় জাদুঘরের সামনে এসে বাঁশের লাঠিটা মাথায় দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি, ছোট্ট পরিটা এসে ঝাকুনি দেয় বাজান বাজান উঠ যুদ্ধ শুরু হয়েছে, ঐ দেখ মিছিল আমি ধড়মড় করে উঠে বসি শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত হয়ে উঠছে আমার চারদিক, -ফাঁসি ফাঁসি চাই, কাঁদের মোল্লার ফাঁসি চাই, একাত্তরের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার, আমি আম গাছের দিকে তাকাই দেখি ওখানে উড়ছে লাল সবুজ পতাকা, একটা মিছিল দেখি শাহবাগের দিকে যাচ্ছে, আমি বাঁশের লাঠিটা হাতে নিয়ে মিছিল হয়ে যাই, আজ পনেরোতম দিন আছি রণাঙ্গনে।
'সাপ্তাহিক বর্তমান' পত্রিকায় প্রকাশিত ০৬.০৩.২০১০
পূর্ণপ্রজ্ঞা
মঞ্জুশ্রী
রায়চৌধুরী (1)
গরমে বেশ
হাঁসফাঁস দশা। এই শেষ বোশেখের আবহাওয়ার এমন খামখেয়ালী ধরণে অস্বস্তি বাড়ছে। ধূলোমেঘের
লালচে আভাস নিযে থমকে আছে আকাশ। কখনো হাওয়া চলছে জোরে অথচ বৃষ্টির দেখা নেই। পূর্ণা
বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়াল। রাত এখন দুটো। সদ্য
কেনা এই ফ্ল্যাটটা ওর ভারী পছন্দের। নাম দিয়েছে ‘অবশেষে।’
খুঁজে-খুঁজে দেখাশোনা চালাতে-চালাতে হযরান ওরা যখন আশা ছেড়ে
দিযেছে, প্রায় তখনই এটা পেল। আর রেজিস্ট্রী হল যেদিন, সেইদিন সৌভিক ঘরে ঢুকেই ধপাস
করে বসে পড়ে লম্বা শ্বাস ছেড়ে বললো- ‘উঃ, অ-ব-শে-ষে...’ ব্যস্, পূর্ণার মনে
বাড়ীর নাম স্থির হয়ে গেল-‘অবশেষে।’ কত
দিন ধরে ওরা বাড়ী-বাড়ী করে যে পাগলের মত ঘুরেছে। যদিও এই ফ্ল্যাট কিনতে গিযে
পেরোতে হল টালবাহনার অনেক এঁদো গলি, তবু তো হল। আসলে সৌভিক চেয়েছিল খরচা করছি যদি,
তবে শহরের হার্টের কাছে না হলেও লান্সের কাছে থাকি এ্যাটলিস্ট। আবার পূর্ণারও
সেই একই যুক্তি। এত পয়সা যাচ্ছেই যদি তবে সারাদিনের শেষে কেন না একটু প্রকৃতির
কাছে এসে দাঁড়াই। নাগরিক সুবিধেও থাকবে আবার গাছ, পাখী, নির্জনতা... যদিও এ
জাযগাটা খুব তেমন নয়, তবুও এখানে একটা অন্যধাঁচের ভালো লাগায় পূর্ণা
মুগ্ধ হযেছিল। মনের ওপর ভাস্কর্য
উপভোগের তৃপ্তি একদম জড়িয়ে-মড়িয়ে সাপ্টে নিযেছিল ওকে। শিল্পীর আঁকা তুলিতে সেজে
একটা ফ্লাইওভার, অসম্ভব এ্যাট্রাকটিভ ওয়েতে হাল্কা
লিফ্ট নিয়ে উধাও হয়েছে বাঁদিক থেকে ডানদিকে, কমপ্লেক্সের
মাত্র শ-দুয়েক ফুট দূর দিযে। আর ওটাই
প্রতিপার্শ্বকে একটা এলিগ্যান্ট লুক দিয়ে দিযেছে এমন ষেন
ওটা কংক্রিটের নয়, নমনীয মোম বা মাটীর কোনো আর্টওয়ার্ক। কত সুন্দর এর
খাঁজ-ভাঁজ-বাঁক। আবার রাতে যখন স্ট্রীটল্যম্পগুলো জ্বলে
বা দূর থেকে আলোজ্বলা মুখে গুনগুন গানে গাড়ীগুলো ছুটে যায়, তখন ঐ গতির সঙ্গে পূর্ণাও
কিভাবে যেন জুড়ে যায়। একটা গাড়ী গেল, তারপর পরের গাড়ী, পরের
গাড়ী... এমনি একটা অপেক্ষা-অপেক্ষা খেলা চলে আনমনে। এ খেলার মজায় ওর
গড়িয়ে যায় সময়। ভাবে আসবে না, এখানে বসবে না, তবু এক অন্য মুখরতা, অন্য এই পাওয়া
থেকে সরাতেও পারেনা নিজেকে। সারাদিনের অফিসক্লান্ত দিনের শেষে এই বারান্দা, এই পুল
কত কথা নিয়ে অপেক্ষা করে থাকে ওর জন্য। বাড়ী ফিরেই
ঢোলকা হাইসকোটটা গায়ে গলিয়ে পূর্ণা সোজা এখানে এসে আগে দু-দন্ড দাঁড়ায়, তারপর
অন্যকাজ, তারপর চা-পেপার-সৌভিক...
কিন্তু আজকের
দিনটা আলাদা। সৌভিক ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরেছে। ও যে
হাল্কাফুল্কা আছে তা জানান দিচ্ছে রেকর্ডারে বাজতে থাকা গান। ওর ঘরে গান চলছে জোর।
এখনকার সিচ্যুয়েশনটার সঙ্গে একটু আগের সময়টার কত তফাত্। কোনো ব্যাখ্যা নেই এর।
সন্ধ্যেয় সৌভিক যখন ফিরলো, পূর্ণা দরজা খুলে হাত বাড়িয়েছিল ব্যাগটা নিতে। কিন্তু
পাশ কাটিয়ে সৌভিক ঢুকতে-ঢুকতে বললো- ‘না, না, ঠিক
আছে... আজ রাতে পার্টী আছে না?
একষ্ট্রা চাবীটা সঙ্গে নিয়ে বেড়োলে ভাল। আমি থাকছি
না। So…’
কি সাবলীল
ভঙ্গীমায় অবহেলার উচ্চারণ সৌভিকের। পূর্ণা তাকিযে থাকলো কিছুক্ষণ। মনে করার চেষ্টা
করলো এই ভাববাচ্যে বলাটা ও কন্টিন্যু করছে কদ্দিন। হ্যাঁ,
তা প্রায় মাস সাতেক হল বোধহয়। যে ‘অবশেষে’
পূর্ণার সুখ, স্বপ্ন, আগামী দিন, সেখানে ঢোকার মাস পাঁচেক পর থেকেই এমনি করে
সম্পর্কের অবশেষে এসে ঠেকতে হবে তা বোঝেনি ও।
পার্টীতে আজ
ইনভিটেশন পূর্ণার। নিকি-র পোস্ট হাই হয়েছে, তাই একটা
পার্টী দিচ্ছে হায়াত-এ। ভেবেছিল আজ সৌভিক
আসছে.....যাবে না। সেইমত জোরদার মিথ্যে সাজিয়ে ভিনিত-কে ফোনও করে দিযেছিল। যে
শাড়ী-সাজে পূর্ণাকে দেখতে চেয়ে সৌভিক আবদার করতো প্রায়ই, সেই ওর দেওয়া শাড়ীটাই
আজ পরেছিল পূর্ণা, অথচ...
নাঃ,
আর ভাববে না, ভাবার দরকার নেই। যা যাচ্ছে তা যাক।
এই মূহুর্তেই স্থির করে নিল- ও যাবেই। পূর্ণা ঘরে ঢুকে দরজা দিল, আলমারী থেকে
লাইক্রা মেটিরিযালের ফ্লোযিং লং স্কার্টটা বার করল। ম্যাচিং জুতোই এর সঙ্গে
একমাত্র খাপ খায় ভেবে 16 জোড়ার থেকে বাছাই করে এক সেট পরলো ও দরজা খুলে বাইরে এলো
যখন, তখন পাশের ঘরে গানের আওয়াজ আর নেই। ঘরের
হাল্কা সবুজ আলোটা জ্বলছে। সৌভিককে দেখা যাচ্ছে না, হয়তো শুয়েছে। যা খুশী হোক।
ভাববে না, আর ভাববে না ও। সৌভিকমুক্ত মন চাই পূর্ণার। না
হলে আর যোঝা যাচ্ছে না। হ্যাঙ্গার থেকে ডুপ্লিকেট চাবীটা নিয়ে পূর্ণা বাইরের দরজার
ল্যাচে হাত রাখলো।
(2)
পূর্ণা। কি
সুন্দর নাম আনুর। মাঝেমাঝে মনে হয, নামের প্রতি জাস্টিফিকেশনকে মজবুত করতেই কি ও
এমন? সৌভিক বলত-‘এত
তুমি মনে রাখো কি করে? এটা রাখছো, সেটা গোছাচ্ছো, কি নেই তা আনাচ্ছো... আনু,
আনু, একলা আমার কাছে একলা তুমি আনু। পূর্ণা থাকো তুমি অন্য সকলের কাছে।’
সৌভিকের আজও
মনে পড়ে, যখন আনুর সঙ্গে আলাপ হল কলেজে, তখন ১০ জনের মধ্যে থেকে কি অসামান্য
দক্ষতায় ও মন কেড়েছিল। সবাই কলকল করে কথা বলছে, ব্যস্ত নিজেকে
জাহির করছে, অথচ আনু সোবার, ইন্টেলীজেন্ট, হাস্যোজ্বল... একদম পরী যেন। যা
বলত, যা করত, তাই ওর চেতনা-বুদ্ধির রাস্তা পেরিয়ে নামত। উচ্ছ্বলতাকে ডিগনিটির সাথে
হ্যান্ডল করতে কতবার যে দেখেছে ওকে। তেমনি
কেয়ারীং-ও। একবার তো ছ-সাতজন বন্ধু মিলে ওরা হাঁটছিল, রূপম্-এর জামায় দিল কাকে পটী
করে। ছিল
সবাই, কিন্তু আনুই সঙ্গেসঙ্গে নিজের রুমাল ভিজিয়ে এনে ওর জামা খুলে মুছে দিয়ে তবে
শান্তি। কোনো বন্ধুর ম্যাগাজিনে ছবি বেড়িযেছে, আনু পয়সা খরচ করে কিনে এনে হৈ-চৈ
জুড়ে দিল। য়েন ওটা ওর নিজের এ্যাচিভমেন্ট, নিজের ছবি। পিকনিকে
গিযে কোমর বেঁধে রাঁধতে বসল একাই। সবাই ওর রান্নায়
মুগ্ধ, আর সৌভিকের তো কথাই নেই, কতবার যে একথা বলেছে ওকে। ‘কিন্তু
এখানে কেন আনু? বাকীরা কেমন এনজয় করছে দেখ... হাল্কা-ফুল্কা
ভাসছে...’।‘আমিও
তো ভাসছি, তুমি যে আছ...’ সৌভিকের প্রশ্নের
উত্তরে আনুর যুক্তিতে কথা থেমেছিল ওর। সারাক্ষণ একটা গোধুলীর আলোর মতন ঠোঁটজুড়ে
হাসি ওর ঝুলেই থাকতো। কি যে মন ভাল করে দেওয়া গেছে সে’সব
দিন। বাড়ী
ছেড়ে, মাযের মনোযোগ ছেড়ে, মফস্বলের শান্ত জীবন ছেড়ে এখানের পেয়িংগেস্ট-জীবনকে
বওয়া যাচ্ছিল শুধু আনু ছিল বলে। বালিশের ওয়্যার
তেলচিটে? একদিন দেখল বিছানার চাদর, ওয়্যার, মায় কুশনকভার সুদ্ধু একই ডিজাইনে
সাজুগুজু করে বসে আছে, যেন ব্যাচেলার্স রুম নয় কোন তিন তারা
হোটেলের ঘর। ভাঁড়ারে কী নেই কী আছে, ওয়ার্ড্রোবে কত কী জামা-প্যান্ট তার ম্যাচিং
টাই, তা ধীর-ধীরে ভুলে যেতে থাকলো সৌভিক। ওকে ভাল দেখতে চাওযার ইচ্ছেগুলো নিয়ে
অন্তরীক্ষ থেকে কোনো এক পরী ভরে রাখতো সবকিছু। নিশ্চুপে, মমতায়।
ঠিক... মমতায়,
ভালবাসায় নয় বোধহয়। তা যদি হত তবে এভাবে ওকে পারতো অগ্রাহ্য
করতে, কথা না শুনতে? বিশালদের পার্টীতে কি সুচারু দক্ষতায় সেদিন নাচলো আনু ভ্রমরের
সঙ্গে। আনু জানে ও এসব পছন্দ করে না। তবু...
যে আনু
অভাবগুলো বুঝতে না দিয়ে নিশ্চুপে গুছিয়ে দিত
সব, আজ সে তীব্র মুখর। প্রতিটা কাজ ও আজ জানান দিয়ে করে। সঙ্গে আবার প্রচ্ছন্নভাবে
জড়িয়ে থাকে তাচ্ছিল্য-কাঁটার বিষ। তা ভয়ানক, তা অসহ্য। ওর জোর, জেদ, বুদ্ধি সবই
সৌভিকের চেযে যেন কয়েক যোজন এগিযে নিয়ে ও জন্মেছে। আনু বোঝেইনি- যা সৌভিক মেনেছে,
মানিয়েছে, ছেড়েছে, তার সবটা ওকে ভালবেসে, প্রশ্রয়ে। সৌভিক কি-কি পারে না তাই ধীরে
মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে, কি পারে তা ছেড়ে। অথচ সৌভিকের ভালবাসায তো কোনো শর্ত
ছিলনা। বিয়ের পর থেকে খুব দ্রুততার সঙ্গে আনু বিয়েটাকেই চ্যালেঞ্জ করতে-করতে
চলেছে। অফিসের কাছাকাছি থাকলে সময় বাঁচবে, অর্থ বাঁচবে ও সবচেয়ে বড় ড্রাইভিং করার
ঝক্কি বাঁচবে ভেবে যখন লেকগার্ডেন্সের ফ্ল্যাটটা কিনতে মনস্থ করলো, তখন আনুর তা
পছন্দ হল না। ওর পছন্দের গাড়ীর রং আনুর পছন্দ নয়, লাল রং নাকি চাইল্ডিস। আনুকে
প্রেজেন্ট করা ওর শাড়ী আউটডেটেড। ওর ইনট্রোভার্ট ধরণ, ওর অগোছালো ইনোসেন্সী, ওর
পছন্দের খাদ্যতালিকা- সব নিয়ে আনু ভীষণ রকম সরব। মানুষের চেহারায় যেন প্রাণী একটা
ও। অফিস ফেরত্ দূর সাউথ ক্যালকাটা থেকে উল্টোডাঙার মোড়, বাগুইআটী, কেষ্টপুরের
মোড়ের জ্যাম পেরিয়ে গাড়ী চালিয়ে আসা যে কি
অপরিমেয যন্ত্রণার তার আন্দাজটুকুও আনুকে দিতে পারলো না কখনো। হাসিখুশী আনুর পরী-পানা
মুখ আজকাল বাদল মেঘে ছাওয়া- সারাক্ষণ।
সেই আনুকে আজ
সত্যিই পরীর মত লাগছিল। দরজা খুলে যখন হাত বাড়ালো, তখন দেখেছিল
আনু ওর দেওয়া সেই শাড়ীটা পরে আছে। ঘরোয়া, মিষ্টি, শান্ত, কেয়ারিং সেই পুরনো,
হারানো মেয়েটা- আবার। অথচ কি যে হল ওর নিজের...। পুরনো
দিনের মন উবজে উঠতেই যত রাজ্যের অভিমান ফের উজিযে এলো কোত্থেকে। ওর হাত সরিয়ে
নিজেই ঢুকল ঘরে, আহ্লাদের বদলে আঘাত দিল। অথচ এতদিনের চেনার পরেও আনু কেন বুঝল না?
আনুর কথা ভাবে বলেই না ওর মনে ছিল আজ আনুর পার্টী, আনু ভালবাসে হাসতে, মজা করতে,
নাচতে। ওকে ধাক্কা দিয়ে সৌভিক যা কিছু করে, তা চতুর্গুণ ধাক্কা হযে ওর নিজের কাছে
ফেরে।
বাইরের আচরণের নীচে চুপিসাড়ে কাঁদা ওর এই কষ্ট তো দেখতে পায়না
আনু। কেন? কারণ ভালবাসবার একটা সেটপীস্ ও সাজিয়ে রেখেছে মনে এবং সেইমত আনু চলে,
চালাতে চায়। এ আরেক অসম্ভবের গান, আরেক অন্য তিতকুটে স্বাদ- জীবনের। হার, হার।
সবক্ষেত্রে গো-হারান হারই এখন নিয়তির মত পিছু নিয়েছে ওর। অন্তরে
নিরন্তর কান্নার শব্দ আজ মুখর হতে চায়। তাও কী পারে, তাও কী পারলো সৌভিক- সেইভাবে?
(3)
বাইরে
বেড়িয়েই একটা অটো নিল পূর্ণা। চলে গেল সোজা বাস
টার্মিনাস। ওখানে য়ে বাসটা গড়িয়া হয়ে বারুইপুর
যাবে তার একটা মনমত সীটে বসলো। ফাঁকা বাস। সবে
দু’একজন
করে উঠছে, কেউ এদিক-ওদিক দেখে আবার নেমেও যাচ্ছে। অতিরিক্ত ফাঁকায় অতিরিক্ত
দিশাহারা আর কি। এই বাস না অন্য বাস না ঐ সীট এই
টানাপোড়েনের সব মানুষজন। শূন্য চোখে তাকিয়ে থাকে ও- আলগোছে ঘটনার
স্রোত বয়ে যায়। মন শুধু সাপ্টেজাপ্টে এখন ছুঁয়ে আছে
নিজেকে। মিনিট 10 বাদে গাড়ী ছাড়লো যখন, তখন এতই আনমনা ছিল, যে হুঁস ফিরলো
কন্ডাক্টরের ডাকে। গাড়ীর লাস্ট স্টপেজ অবধি একটা টিকিট কাটল পূর্ণা। ব্যস্, কেটে
গেল রেশ। অতলান্ত শূন্যতাবোধের মজায আর থাকা গেল না। বেরসিক কন্ডাকটর দিল ধ্যানীর
ধ্যান ভাঙিয়ে। বাসের ভিতরের এই য়ে নির্দিষ্ট ডেস্টিনেশনে যাবার মানুষজন, এ’সবের
দিকে মন যেতেই ওর উথলে, উপছে গেল আবেগ- কান্নায়, যন্ত্রণায়, ধিক্কারে। এতগুলো
মানুষের মধ্যে একমাত্র ওই দিশাহীন, উপায়হীন, গন্তব্যহীন নৌক? যাকে ভালবেসে পড়াশোনা
ছাড়ল, সহয়োগ দেবার তীব্র চাওয়া নিয়ে চাকরীতে ঢুকলো সে আজ এমন? সৌভিকের
উচ্চাকাঙ্খাকে উচ্চাসন দেবে বলে লোন নিযেছিল অফিস থেকে, আজও যা শুধছে পূর্ণা।
সৌভিককে খুশী করতে পূর্ণা ছেড়েছে বেঁচে থাকবার নিজস্ব ছন্দ। আনন্দমাখা
হাসিখুশী ঢঙে ও যেভাবে ছিল এতকাল, তা সৌভিকের অন্তর্মুখী স্বভাবের কাছে অতি
প্রগলভ, হাল্কা, অপছন্দের। তাই হাসি ছেড়ে দেঁতোহাসি শিখেছে, নাচ ছেড়ে ভান
শিখেছে। অথচ এই সেদিনের পার্টীর পরেও সৌভিক...।
আজকাল ও নাচেনা, হাই-হ্যালো-তেই
থেমে যায়, কিন্তু ‘বিশাল’তো
আলাদা। বিশাল সৌভিকের খুড়তুতো ভাই, তাছাড়া পার্টীটাও পারিবারিক। সে জানে পূর্ণা
ভাল নাচে। তাই পার্টীতে যখন হাত ধরে ওকে ডান্সফ্লোরে নিয়ে গেল, তখন বহুদিনের
অবদমনের পরে পূর্ণা মনপ্রাণ খুলে নেচেছিল। বিশাল, ভ্রমর, সেঁজুতি, অনন্য- সব্বার
সঙ্গে... চুটিয়ে। কিন্তু বাড়ী ফিরে সৌভিকের অফ মুড আর
অনুয়োগের সামনে পড়ে হতচকিত পূর্ণা খুঁজেছিল- এ কোনজন? এই নাচের জন্যেই ওকে যে
প্রশংসায় ভরিয়ে রাখতো- সে? এ কি সৌভিকের
কন্ফিউশন, জেলাসী না ওনসেল্ফ-এর ওপর থেকে উঠে যাওয়া বিশ্বাস? জানেনা। আজ
কিচ্ছুর উত্তর খুঁজে পায় না পূর্ণা। ও প্রিয কতকিছু ছাড়ল কারণ সৌভিক ছাড়া সারা
বিশ্ব ওর শূন্য ছিল বলে। অথচ সৌভিক? নিজের কাজ, পড়াশোনা,
চাহিদা, স্বার্থ ও তৃপ্তির বাইরে কি একবারও তাকালো চোখ তুলে? জানতে কি চাইলো কখনো-
এই ত্যাগ পূর্ণার জীবন থেকে কত কী মণিমুক্তো গড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। অবশ্য
কেন জানবে?
সে বোধের জাযগাটা তো পূর্ণাই তৈরী হতে দেয়নি কখনো। অভাববোধের আগেই সাপ্লাই নিয়ে ও
হুজুরে হাজির থেকেছে সমস্তক্ষণ। চাইবার আগেই ও
পেতে-পেতে ভুলেই গেল দিতেও কিছু হয় বলে। সৌভিক চায়নি বলে আজও পূর্ণা সন্তানহীন।
সৌভিকের সারাটা সময শুধু হিসেব কষেকষে জীবনকে যাপন। এই
বয়সে গাড়ী, ঐ বয়সে বাড়ী, তার ই.এম.আই, তারপর সিঙ্গাপুর, তারপর...
জীবনের
প্রতি বাঁকে য়ে আর্ট, বাঁধনের মধ্যেও যে বিপুল সম্ভাবনার ইঙ্গিত, তাকে ছোট্ কক্ষে
ভরতে চেয়েছে হরদম। জীবন ছাড়বে কেন? শোধ তাই এমনি করে সে তুলছে। ক্ষুদ্রতার
গন্ডীতে আচমন সেরে বিশালত্বকে বরণ করা যায়না। এত তাড়াতাড়ি তাই ক্যানভাসে উল্টে
গেল রং।
একা পূর্ণার সাধ্য কি য়ে সবটা মোছে?
: দিদি,
আপনি কি নামবেন?
ফের
কন্ডাক্টরের ডাক মনস্ক করলো ওকে।
:
হ্যাঁ ভাই, এসে গেছে?
: অনেকক্ষণ। আপনি
ঘুমিয়ে পড়েননি অথচ নামছেন না দেখে ভাবলাম কি জানি...।
: না,
আসলে শরীরটা হঠাত্ খারাপ লাগছিল।
:
আপনি বসুন না, সুস্থ হলে নামবেন।
:
না, না ঠিক আছে।
অচেনা
বারুইপুরের আধা মফস্বলী জায়গায় নেমে পড়লো পূর্ণা।
নাঃ। এ
ভাল লাগছে না। বোকার মত এদিক-ওদিক তাকানো আর উদ্দেশ্যহীন ঘুরঘুর...
একটা
কুকুরও বুঝতে পারে অসহায় এই অবস্থাটা। তাছাড়া রাস্তার
মানুষজন ওকে দেখছে তা ও বুঝতে পারল বেশ। এই রাত দুপুরে পয়েন্টেড হিল জুতো, পার্টী
ওয়্যার, সফিস্টিকেটেড লুক... না না, ঠিক হচ্ছে না। এই প্রথম ও ফিল করল চেনা
দুঃখ, চেনা বারান্দা, চেনা ঘর, মানুষ এ’সব অনেক বেটার এই
অজানা-অচেনা অনুষঙ্গের চেয়ে। ও তাড়াতাড়ি ফিরে এল বাসে। কন্ডাকটারকে উপযাচক হয়ে
বললো-
:
শরীরটা আবার খারপ লাগছে ভাই, আমি ফিরবো।
:
আমি তখনই বুঝেছিলাম, বসুন দিদি বসুন।
ইতিমধ্যে
ওর সীটে একজন বসে গেছে। কন্ডাক্টর তাকে অন্য জায়গায় বসিয়ে ওকে সেই পুরনো সীটেই
ব্যবস্থা করে দিল। অকারণ এই মিথ্যে বাহানার ব্যাপারটা পূর্ণার খারাপ লাগলো খুব। কিন্তু
উপায়ও নেই। ধরা দেওয়া যাবে না যে।
(4)
রাত
দুটো এখন। পূর্ণা ১২ টার মধ্যেই ফিরতে পেরেছিল। ওটা লাস্ট বাস ছিল
বলে লোকজন কম, তায় আবার উল্টোডাঙার পর ফাঁকা রাস্তা পেযে গাড়ী হ1ওয়ার বেগে
দৌড়েছে। সারাদিনের না খাওয়া বেশ জানান দিচ্ছিল মাথা টালমাটাল করে। বাস থেকে নেমেই
তাই ব্যাগে রাখা বিস্কুট খেতেখেতে লিফ্টে উঠে যখন ল্যাচের হাতল ঘোরালো, তখন ফের
মনে ধোঁয়ার উদয় হতে দেরী লাগলো না। এই রাত অবধি ও বাড়ীতে নেই, অথচ এতই নির্বিকার
সৌভিক? একটা ফোনও তো করেনি। মিউজিক রুম এখন শান্ত। না ক্লাসিকাল না কমার্শিয়াল সাড়া।
গুনগুন করে শুধু এসির শব্দ জানান দিচ্ছে ওর উপস্থিতি। এমন অনভিপ্রেত হয়ে ঘরে
ঢোকায়, রাজ্যের অসম্মান যেন জড়িয়ে গেল গায়। বাথটাবটা জলে ভরে প্রায ঘন্টাখানেক
শুয়ে থাকল, মন তবু অশান্ত। কিছু চায়, কারুকে চায়, কারুর জন্য বাঁচে মানুষ। সেইটা
নেই? সত্যি নেই? ও নিজে তো এমন করে শুন্যতায় য়েতে পারেনি? ফিরে এসে তাই আগেই
দেখেছিল সৌভিক খেয়েছে কিনা। আজ সৌভিক ফিরবে বলে ওর পছন্দসই রান্না করেছিল,শাড়ী
পরেছিল, পার্টী ক্যানসেল করে ভেবেছিল... ভেবেছিল অনেককিছুই যা এখন ভাবতে ভাল
লাগছে না। নিজেকে বোকা মনে হচ্ছে। বারান্দার আলোটা নেভালো পূর্ণা,
মোড়া নিয়ে এসে বসলো থামের পাশঘেঁষে, রাস্তা থেকে আসা তেরছা আলোকে আড়াল করে।
নাহলে পরের দিন আবার কৌতুহলী কোনো প্রতিবেশীর নাক গলানোর কৈফিয়ত দিতে গিয়ে হয়তো
ভদ্র থাকা যাবে না। দরকার কি? তার চেয়ে...
(5)
রাত
11-টা পেরোতেই অস্থির লাগলো সৌভিকের। ঝড়ো হাওযার দাপটে নানান কিছু পড়ছে এদিক-ওদিক... তার শব্দ আসছে মাঝেমাঝে। খুব
অবাক লাগছে এবার। এতটাই কেয়ারফ্রী, এতটাই অবহেলার এ্যাটিচ্যুড্, য়ে এখনো একটা ফোন
নেই? ও বিরক্ত ছিল, ভুল করেছে এটা ঠিক, তা’বলে আনু বুঝবে
না? বিয়ের আগের বছরগুলো আর বিযের পরের এই পাঁচটা বছর তো কম নয়! ওকে তো আজ নতুন
চিনছে না। তবে? কেন বুঝবে না?
মনে
পড়ে একবার সিনেমার টিকিট কেটে ‘89’-এ অপেক্ষা করছিল আনু। সৌভিকের
দেরী হচ্ছিল পৌঁছতে। ফোনে যোগাযোগ রাখছিল, জানাচ্ছিল রাস্তায় জ্যামের কথা...।
তবু এসে পৌঁছনোর পর, আনুর শরীরীবিভঙ্গ উচ্চরবে ক্ষোভের যে বিবরণ দিচ্ছিল, তা ভাল
লাগেনি ওর। তাও হুড়োতাড়া করে ভেতরে যাচ্ছিল ওরা। আনু বলল, ‘আধঘন্টা আগে শুরু হযে যাওয়া ছবি... কি হবে আর... কিই বা বুঝবো...
একটু আগে বেড়লেই যদি...’ সৌভিক শেষ হতে দেয়নি কথা। ওর
হাত থেকে টিকিট দুটো নিয়ে ছিঁড়ে হাওয়ায় উড়িয়ে দিয়ে বলেছিল ’সত্যি তো কি হবে দেখে? আমার প্রবলেমের চেযে সিনেমাটা তো বেশী
ইম্পর্টান্ট... কি দরকার... এভাবে?’ বলেই উল্টোদিকের
বাস ধরে সোজা নিজের বাড়ী। কীহোলে চাবী ঢুকিযে তখনো তালাটা খোলা হয়নি, দেখলো আনু
ট্যাক্সি থেকে নেমে ছুটতে-ছুটতে ওপরে আসছে। সৌভিকের আজও কানে বাজে আনুর সেদিনের
অনুতাপের স্বর, আনুর ক্ষমা চাওয়া, আনুর কান্না। অথচ পরে চিন্তা করতে গিয়ে সৌভিক এই
সিচ্যুয়েশনের জন্য কিন্তু নিজেরই দোষ খুঁজে পায়, যা আজও জানায়নি কারুকে, আনুকেও
না। আসলে আনুর মনোযোগ, আনুর তীব্র অনুরাগ, আনুর পৃথিবীতে শুধুমাত্র নিজের থাকতে
চাওযার ইচ্ছেগুলো মাঝেমাঝে এমন কত য়ে অন্যায় কাজ ওকে দিয়ে করিয়ে
নিচ্ছে... সেকথা কেন বোঝেনা আনু- আর?
হায়াতে
পার্টির কথা শুনেছিল সৌভিক। এত রাত হল, আসবে কিভাবে? একবার
আনুর এক কলিগ ওকে ছাডতে এসেছিল এ’রমই রাত করে। সেদিন সৌভিক
স্পষ্ট বলে দিয়েছিল যেন অন্য কারুর গাড়ীতে এভাবে আর কখনো না আসে। বরং ফোন করে
দিলে ও নিজেই পৌঁছে যাবে আনতে। গ্যারাজ থেকে গাড়ীটা বার করল সৌভিক। চিন্তার পারদ
ওপরে উঠছে অথচ সারা মন জুড়ে অভিমানের চোরাস্রোত দিব্যি বহমান। সাতপাঁচ
ভাবতে-ভাবতে সৌভিক পৌঁছে গেল হায়াত। নজরে না পড়ে এমন দূরত্বে গাড়ী পার্ক করে বসে
রইলো সৌভিক, বসে রইলো, বসেই রইলো। কোথায় কি? সময এগোয়, মশার অত্যাচারে অস্থির
সৌভিকের হাত বারবার মোবাইলের দিকে যায়, আবার রাখে...। হঠাত্ ওর মনে পড়ল ঘরের
এসিটা তো বন্ধ করেনি। তাছাড়া সৌভিক যেসময় বেড়িযেছে, তখন এ্যাদ্দুর আসার হিসেবে
অনেক দেরী হয়ে গিযেছিল। হয়তো আনু তখন ফিরতি পথে, হয়তো এতক্ষণে
বাড়ীতে...
একথা মনে হতেই ফের গাড়ী ঘুরিয়ে রাতের নিঝুমে মাত্র ১৫ মিনিটেই ও পৌঁছে গেল বাড়ী। যতটা নিশ্চুপে সম্ভব ততটা শান্ত, অতল অন্ধকারকে সঙ্গী করে সৌভিক ভেতরে ঢুকলো। আলো না জ্বেলে বেডরুমে গিয়ে কিছুই আন্দাজ করতে পারলো না। রাত দুটো বেজে গেছে। বারান্দার কাছে গিযে কাচের এপার থেকে দেখলো নিঃসাড় প্রতিমার মত বসে আছে আনু, ঘুমন্ত পৃথিবীর ধাত্রী য়েন। আর এই নিরিবিলি পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে যে পুলটা কখনো তেমনভাবে নজরেই পড়েনি ওর, তা এক অদ্ভুত তন্ময়তা নিয়ে ধরা দিল সৌভিকের চোখে। মনে হল ওটা আছে বলেই এখানে থাকাটা অর্থবহ। চারতলার এই উঁচু থেকে ফ্লাইওভার একটা কল্কা আঁকা সাড়ীর পাড়ের মত লাগছে আজ। মনে হল একস্ট্রা পয়সা না দিয়েও এই য়ে শিল্পিত সমৃদ্ধি অমনি পেয়েছে, তা ও ভাগ্যবান বলেই। ভাস্কর্যের ভারে, প্রাচুর্য্যে আর ডানা মেলা উড়াল নিযে পুলের এই প্রোভোকেটিং এ্যাপ্রোচে বারান্দাটা যে সবচেযে ধনী, তা আজই বুঝলো সৌভিক। ওর ইচ্ছে হল আনুর কাছে গিয়ে পাশে বসতে, মাথায় হাত রেখে বলতে- ‘আজ থেকে তুমি আনু নও; প্রজ্ঞা, প্রজ্ঞা, একলা আমার কাছে একলা তুমি আমার পূর্ণপ্রজ্ঞা।’ কিন্তু কিছুই বললো না সৌভিক, কিছুই করলো না। স্থানুর মত দাঁড়িয়ে থাকলো পর্দার খুঁটকে মুঠিতে ভরে, আবছায়াকে সঙ্গী করে- ঘরের ভিতরে। কে য়েন মাটীর সঙ্গে আঁকড়ে রেখে দিল পা।
পুলের
ওপর দিযে এই রাতেও বিন্দু-বিন্দু আলো মুখে ছুটে যাচ্ছে ট্রাক। ছড়ানো হ্যালোজেন
আলোয় রাস্তা মায়াময় লাগার কথা ছিল কিন্তু লাগছে না। সন্ধ্যে থেকে ঝোড়ো
হাওয়ায় ঝরাপাতা, ধূলো-বালী মেখে পুল
ধোঁয়া-ধোঁয়া, চিপচিপে। আঁধির মত ধাঁধানো রাস্তা দিয়ে ছোট গাড়ীগুলো তীরবেগে ছুটছে।
কোনো ডেফিনিট ডেস্টিনেশনে পৌঁছতে চায়।
দূর
থেকে এবার যে গাড়ীটা এল, সেটা ভিজে-ভিজে লাগছে না। চকচক করছে, গাড়ীর সাইড
লাইটগুলোও জ্বলছে। খুশীর জল ছড়িয়ে একদম মাথা উঁচু করে ছুটছে গাড়ী। তার মানে
বৃষ্টি হচ্ছে কাছেই। আসছে, আসছে, এতক্ষণে আসছে তাহলে...।
ঝুপ্পুস বৃষ্টিতে আপ্রাণ
ভিজবার আকাঙ্খা নিয়ে পুল আকাশের দিকে হাত বাড়ালো। বাড়ালো না? তেমনই তো যেন মনে
হল পূর্ণার।
স্বপ্ন-কল্প-দ্রুম
অধরামাধুরী
অদ্ভুত একটা জায়গায় বাড়িটা । রাস্তা থেকে সিঁড়ি উঠে গেছে প্রবেশমুখ অবধি ।হ্যাঁ প্রবেশমুখই বলব কারণ ওটাকে দরজা বলা যায় না ।হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকতে হয় ওখানে । জয়িতা প্রতিবারই চেষ্টা করে কিন্তু পারেনা ।ফোকর গলে তার দৃষ্টি চলে যায় ভেতর অবধি ।ঘরের মধ্যে অনেক পরিচিত লোকজন ।মা , বাবা, ভাই,বোন আরো অনেকে ।সবাই ভীষণ গল্পে মত্ত ।কেউই জয়িতাকে দেখতে পাচ্ছে না এখন ।অসহায়ের মত সরীসৃপ হয়ে কাঁদতে থাকে জয়িতা ।
এই কি হল?কি হয়েছে ‘জয়ি’ তোমার? কাঁদছ কেন?
ধড়মড় করে উঠে বসে জয়িতা ।ঘেমে নেয়ে একসা ।উফ! কি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন! আমি আমাদের বাড়ীতে ঢুকতে পারছিনা!
ধুর্ ও তো স্বপ্ন!কালই নিয়ে যাব তোমাকে বাড়ী ।দেখা যাক্ কেমন ঢুকতে পারছ না । আর্যের সান্ত্বনায় জয়িতা আশ্বস্ত হওয়ার চেষ্টা করে।
আর্য আর বিহু মুচকি হাসে ।আজকাল তাদের দৈনন্দিন জীবনে এ ঘটনা উপরি পাওনা ।একেক দিন যে কি লজ্জায় পড়তে হয় জয়িতা কে, সে আর বলার কথা নয় ।
এই তো গত রবিবার ।চায়ের টেবিলে হেসে গড়িয়ে পড়ছিল ওরা দুজন……সাথে কাজের মেয়েটাও ।স্বপ্নেরও বলিহারি! আগের দিন জয়িতা গিয়েছিল রথবাড়ী বাজারে ।পুজোর ফলটা ওখান থেকেই কেনে সে। হঠৎ পেছন থেকে, ‘দিদি সামলে সামলে!’ ঘাড় ঘোরাতেই বিশালাকৃতি এক ষাঁড়……গম্ভীরভাবে আওয়াজ ছাড়ল ‘হুমম্’। আর যায় কোথায়! ‘মাগো!’ বলে জয়িতা ফল ফেলে কুঁচি তুলে দৌড়। দোকানী হাঁক পাড়ে, ‘ও দিদি ও কিছু করে না’…কিন্তু কে শোনে কার কথা । একেবারে বাড়ী এসে হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।ঐ একটা প্রাণীকে সে দুচোখে দেখতে পারে না ।ভুলেই গিয়েছিল সকালের ঘটনাটা … দুপুরে একটু নিশ্চিন্তে ঘুম দিচ্ছিল । পাশের বাড়ীর মেয়েটার ডাকে ঘুম ভাঙ্গল।‘আর্য্’র সাধের ‘বামচাম্’টা উড়ে গিয়ে পাশের বাড়ীর ছাদে ।উফ্ এই মণিটাকে কতবার বলেছি কাপড়ে ক্লিপ লাগাতে!দুদ্দাড় করে দৌড় লাগায় জয়িতা। ঐ ‘বামচাম্’ই হল কাল। শনিবার সারারাত ধরে একটা ষাঁড় ‘বামচাম্’ পড়ে গোটা বাজার ধাওয়া করে গেছে তাকে।
আর সে নির্বাক চলচ্চিত্র নয় একেবারে ‘রানিং কমেন্টারি’ সমেত!
কাজেই রবিবারের চায়ের আসর থেকে নিস্তার পাওয়া অসম্ভব ব্যাপার!
ছোটোবেলায় নাকি ঘুমের ঘোরে এক ঘর থেকে আরেক ঘরে চলে যেত সে!বিয়ের আগে এরকম বাড়াবাড়ি হত! আজকাল জয়িতা বেশ ভয়ে ভয়ে থাকে ।স্বপ্নের কথা সব ফাঁস হয়ে পড়ে রোজ আর এ নিয়ে হাসাহাসি কাঁহাতক ভালো লাগে!তাই গরমের ছুতোয় পাশের ঘরে শোয় । আর্যের মুখ তাই হাঁড়ি,বিহুর চোখেও অভিমান । মায়ের পাশে শোওয়া দশ বছরের অভ্যাস তার।কদিন সহ্য করার পর আজ সে জেদ ধরে মায়ের কাছে শোবে । অগত্যা মেনে নিতেই হয়।
সারাটা দিন নির্বিঘ্নে কেটে যায় ।জয়িতা মনে মনে আশ্বস্ত হয়!যাক্ গতরাতে তাহলে সে ভুলভাল বকেনি । বিহু স্কুল থেকে ফিরে আসে । আর্য অফিস থেকে ।বিহু আজ খুব লক্ষী মেয়ে হোম টাস্ক করে নেয় নিজে নিজে। খাওয়া নিয়েও মোটে ঝামেলা করেনা । মেয়ের আচরণে জয়িতা একটু অবাকই হয় । ‘হ্যাঁরে বিহু আজ তোর কি ব্যাপার বলত? স্কুলে বকুনি জুটেছে মনে হচ্ছে’ ।‘কই নাতো!!’বিহু স্পষ্ট চোখে মায়ের দিকে তাকায় ।
আর্য
রোজকার মত খাওয়ার টেবিলে বিহুর সাথে খুনসুটি করে......বিহু অন্যদিনের মত
রেগেও যায়না । জয়িতার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভুতই ঠেকে......হল কি
মেয়েটার!!
রাতে আজও বিহু মায়ের কাছে শোবে ।জয়িতার
খাবার দাবার গুছিয়ে আস্তে একটু রাত্রিই হয়ে যায়।বিছানায় চোখ পড়তেই
দেখে বিহু ‘ ফেয়ারী টেল’ এ মুখ গুঁজে । কি রে ঘুমোস নি এখনো? ‘না তুমি এলে
তারপর ঘুমোবো’...... ‘উফ্ বিহু যত বড় হচ্ছ তত ন্যাকা হচ্ছ!’ জয়িতা
মেয়ের পরদিন ভোরে ওঠা নিয়ে যথেষ্টই চিন্তিত তাই আলো নিভিয়ে চটপট
বিছানায় আসে। রাতে মায়ের কোল ঘেঁষে শোওয়া বিহুর বহুদিনের
অভ্যাস । মাকে জড়িয়ে ধরে বলে ‘মা তুমি আমাকে ছেড়ে চলে যাবে নাতো?
জয়িতা এ ধরনের প্রশ্নে হোঁচট খায় ... এ আবার কি কথা বিহু!! তোর কি হয়েছে
বলত?
বিহু প্রশ্ন করে, ‘মা তূণীর কে’?
চমকে ওঠে জয়িতা, ‘এ নাম তুই কোথায় শুনলি!’
‘কাল রাতে তুমিই তো ঘুমের মধ্যে তূণীর তূণীর করে ডাকছিলে’।
‘আর কি বলেছি আমি!!’ জয়িতা ফ্যাসফ্যাসে গলায় প্রশ্ন করে ।
‘ওই জড়ানো গলায় কি যেন বলছিলে ......তূণীর চল ...আমাকে নিয়ে চল...এরকমই কি যেন...’
জয়িতা ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে ‘বিহু’র দিকে ।
Monday, 16 May 2011
স্বপ্নপথ বেয়ে
আজ 17.05.11-র ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রকাশিত গল্প
তবু আলেখ্যর খেলার মাঝে সেদিনও কীসের একটা গন্ধ নাকে ঝাপট দিয়েছিল। মাত্র মিনিট দশেকের জন্য চা করতে গিয়ে, ফিরে ঘরে ঢুকতেই আলেখ্য খেলায় ফিরেছিল স্যাট্ করে । হাল্কা একটা ইমপ্রেশনও রেখে গেল তবু চোখে। ওটা যেন নারী-পুরুষের আঁকড়ে ধরা শরীর দেখেছিল ও। আঁকাজোকা বা এ্যানিমেটেড নয় একদম জলজ্যান্ত্ রক্তমাংসের দেহযোগ। এ’ নিশ্চই মায়াঙ্কের কাজ। পাকটুস্ ছেলে কায়দা করে আলেখ্যর সিডিতে বাজে ছবি গুঁজে দিয়েছে। মনে সংশয় নিয়ে প্রিয়দীপা জিজ্ঞেস করল-
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
বুকে দমচাপা কষ্ট নিয়ে ঘুম ভাঙলো প্রিয়দীপার। এমন কি রাতে যতবার হাল্কা হয়েছে ঘুম, ততবারই চিন্তাটা জ্বালিয়েছে এত যে কসরত করে ঘুমতে হয়েছে। কখনো বকুলফুলের সদ্য গজানো কুঁড়িটায় মন নিতে হয়েছে, কখনো মন নিতে হয়েছে বেড়ানোর অনুষঙ্গে, তবে ঘুম। আজ ছুটি। সকালে উঠে ভেবে রাখা মত কাজে লেগে পড়েও ছাড়ান নেই। এই অস্থিরতা না পারছে কারুকে বলতে, না পারছে কাদা থেকে বেরোবার রাস্তা। ঠিক আগেরগুলোর মতই। তীব্রতমর রঙ কী তাহলে এতই লজ্জার যে তা লুকোতে বলে? যখন কন্যা সৃজা কাছে থেকেও পর হল, যখন দেওর সুযোগ পেতেই সন্ধানী হল ও যখন নিজেই সংসারে নত, হতচেতন এক কুকুর হিসেবে নিজেকে আবিষ্কার করলো প্রিয়দীপা, তখনো ছিল কষ্টের রঙ আজকেরই মতন এক, ঘেন্নায় তিতকুটে, কালো। সেই একই উচাটন, রাতভোর একই অনুভবের সঙ্গে দেখা। অদ্ভুত কি, কষ্টের এ’ রঙ আজ পরোক্ষ হয়েও তীক্ষ্ণতায় সূচীমুখ। বুকের খাঁচায় আহত সিংহর দাপাদাপি। একেকটার বোধ একেক রকম হয়ে কেন আসে না? হতেই তো পারতো একটা বেবুন, একটা হাতী, একটা সাপের মত ভিন্ন। তা’হলে প্রতিটাকে আলাদা সামলাতে-সামলাতে একটা আন্দাজ পেয়ে যেত আর ভিন্নভিন্ন কষ্টের সেই ভিন্ন চাবুকে ব্যাথাগুলোকে মোকাবিলা করে নিত। ধুস্, কোথায় কি- সেম ঘৃণা, সেম অস্থিরতার আঁচে চলছে ধিমধিমিয়ে পাক।
ঘুম থেকে উঠেই প্রিয়দীপা দেখেছিল আলেখ্য বাইরে যাবার পোশাকে রেডী হয়ে বসে- টানটান ও সতর্ক। কাল যখন প্রিয়দীপা দুম করে ঘরে ঢুকেছিল তখন ও ঠিক বোঝেনি। কত কিছুই তো এমন বাধ্য হয়ে দেখছে ছোটরা, এও বোধহয় তেমনই কোনো এক নষ্ট পর্বের ভুল ঠিকানায় হঠাত্ গিয়ে পড়া ভেবে ফিরেই যাচ্ছিল প্রিয়দীপা। কিন্তু তড়িঘড়ি সাইটটা কেটে গেমে ফিরতেই মনে তড়িত্গতির চমক। কি হল? তাহলে কি নির্দোষ নয়? কী নিয়ে ছিল কম্প্যুটারে? কথাটা মনে হতেই ফের ড্রইংরুমে গেল ও গেমে ব্যস্ত আলেখ্য তখন চোরাচাহনীর ‘কী হয়,’ কী হয়’ দোনোমনায়। মূহুর্তের ফাঁক গলে তবু যে’টুকুর আভাস প্রিয়দীপা পেল, তার পর থেকেই চলছে ওর এই মনমরুনী দশা।
এই আলেখ্যকেই একটা গেম খেলতে দেখেছিল প্রিয়দীপা আজ থেকে পাঁচবছর আগে। কতই বা বয়স তখন ওর- আজ বারো হলে, সেদিন সাত। সেটা ছিল ক্রমাগতঃ লেবেল পেরতে পারলে কিছু প্রাপ্তির। প্রিয়দীপা দেখল, ওর খেলাঘরের সবুজ আলো দিপদিপ করে জানাচ্ছে একটা সানগ্লাসের কথা। বাঃ বেশ তো, ভার্চ্যুয়াল সানগ্লাস। প্রিয়দীপা বসে গেল পাশে। এবারেও সাংঘাতিক খেলে আলেখ্য পেরিয়ে গেল লেবেল। স্ক্রিনে একটি এ্যানিমেটেড মেয়ে এল, দাঁড়ালো মডেলের মত পা ফাঁক করে। গুরু-নিতম্বিনীর দেহজ উল্লাস এতই উপচানো, যে মন চিড়পিড় করবেই। ললনা শকস্, স্কার্ট, হ্যাট, বেল্টে চাবুক। আলেখ্য খেলছে, হঠাত্ মেয়ের স্কার্টটা খুলে গেল ও লেবেল পেরোবার পুরস্কার হয়ে এল সংগ্রহে। ও... তার মানে ব্যাপারটা এই। বোনাস হিসেবে কন্যা লজ্জা দাঁওতে তুলেছে আর একে-একে লেবেল পেরতে পারলেই শরীর থেকে যাবে যাবতীয় সজ্জা। স্কার্ট গেছে- তা’বলে সুন্দরী নাঙ্গা নয়, জমকালো জাঙ্গিয়াতেই চলেছে তাথৈ নাচ। আলেখ্য নির্বিকার, মন-প্রাণ কেন্দ্রীভূত হ্যাটে।
- দেখো দীপমৈ, হ্যাটটা কীর’ম সাইডে ঠেউ খেলানো, পাশে আবার লম্বা পালক….
- হুঁ,
- হুঁ মানে কী? একটু ভাল করে দেখ।
নিজের সঙ্গে প্রিয়দীপারও মনোযোগের দাবী রাখে আলেখ্য। মনোযোগ তো দূর, আতঙ্কিত প্রিয়দীপার ভিতরে তখন অন্য প্রশ্ন।
- দেখছি তো।
- ওটা কিছুতেই পাচ্ছি না। কোন লেবেলের পরে যে হ্যাটটা....
- কি হবে পেয়ে? এই তো অনেক কিছু পেয়েছ।
- ও’সব লাগবে না, হ্যাটটা চাই।
- মেয়েদের হ্যাট- তুমি নিয়ে কি করবে?
- তোমার জন্য। তোমার লম্বা চুল, ওটা পড়লে যা লাগবে না।
- না, না ও আমি পড়বো না। তা’ছাড়া সালোয়ার-কুর্তার সঙ্গে ওসব মানায়?
- কেন, যখন জিন্স পড়বে, তখন।
- ওরে ছেলে- নজর তোমার সবদিকে না.....
বলতে-বলতে গালটা টিপে দেয় প্রিয়দীপা।
- উঃ, এখন ডিস্টার্ব কোরোনা, দেখছো না লেবেল পেরোচ্ছি…..
আলেখ্য এতই তুখোড়, যে কথা বলতে-বলতেই আঙুল ছোটাচ্ছে ও পেরিয়ে যাচ্ছে লেবেল। মেয়ের পনিটেল করে রাখা চমকিলা ব্যান্ড এল সংগ্রহে। আলেখ্য খেলছে... পরের লেবেল- ঊর্দ্ধাবাস উড়ল, উপচে গেল চুল মেয়ের উদোম গায়। বাঁচোয়া, কোনো এমব্যারাস সিচ্যুয়েশনের সামনে পরতে হল না। কোনোদিকে নজর নেই- হ্যাট ওকে পেতেই হবে। নেক্সট লেবেল- শকস্, নেক্সট লেবেল- ওফ্, অবশেষে হ্যাট। ব্যস্, প্রাপ্তি আসতেই আলেখ্যর তৃপ্তির কোটা ফুলফিল্ড। কন্যে ওদিকে খাপছাড়া পোষাকে খাপখোলা তলোয়ার। নাঃ, ও’সবে মন নেই। অশেষ অনুকম্পায় প্রিয়দীপাকে কম্প্যুটার ছেড়ে দিয়ে ও উঠে গেল আর হতচকিত প্রিয়দীপা ‘আরো কি দেখতে হয়’-এর দুর্ভাবনা থেকে বাঁচলো। গেমে প্রিয়দীপা এমন সড়গড় নয় যে লেবেল পেরতে-পেরতে খেলার শেষে পৌঁছবে। যদি পারতো তো দেখে আসতো মেয়েটি সব দিয়ে শেষে ন্যাংটা হল কিনা, হলেও আরো কি করল। নি্র্দোষ খেলাতেই যদি বোনাসের এই তরিখা তো কেজানে কি ছিল শেষে। মানতেই হবে গেম সৃষ্টিশীল কিন্তু বাচ্চাদের মত কী? আদিরসের আঁচে ফেলে এ’ কেমনতর সেঁকা? ভাগ্যিস্ হ্যাট ছাড়া বাকীতে ও নিরুত্সাহ ছিল।
তারপর দিন গেছে, আলেখ্য বড় হয়েছে, কিন্তু কত আর- এই পাঁচবছরে বছর বারো। স্কুল ছুটি থাকলে প্রিয়দীপার কাছে চলে আসে আর কম্প্যুটার তখন আলেখ্যর দখলে। ইস্..... এই বড় হওযটা মনে হতেই কালকের রাতটা মনে পড়ল প্রিয়দীপার আর গায়-গায় ঝেঁকে এল কষ্টের ইতিবৃত্ত। এ’ নিয়ে ওর ইচ্ছে করছে না ভাবতে, তবু ছাড়ান নেই। নিজের সঙ্গেই প্রিয়দীপার এখন একশো কাহন কথা। গত পরশুও আলেখ্য খেলছিল। গুলিগোলার শব্দে প্রিয়দীপা বসে পড়েছিল পাশে।
- কি খেলছিস্ সোনা?
- চিনাংশুক ওর জন্মদিনে যে গেম-সিডিটা পেয়েছে.....
- তা তো বুঝলুম কিন্তু খেলাটা কি?
- দেখো না দেখো।
খেলাটা চালু করলো আলেখ্য।
- এই দেখ এইটা হলাম আমি, আর ওরা আমায় ধরতে আসছে। আমি সবাইকে মেরে... তুমি দেখলেই বুঝবে।
প্রিয়দীপা দেখল হাতে বন্দুক একটা মানুষ, যার চতুর্দিক ঘিরে বৃষ্টির মত গুলিগোলা আর সে’সব কাটিয়ে তীরবেগে ও ছুটছে। কোথাও কেউ আটকাতে গেলে তার খুলি উড়িয়ে দিচ্ছে, কারুকে বক্সিং-এর পাঞ্চে শুইয়ে দিচ্ছে। এমন কি ধরা পড়ার অবস্থায় পড়লে বন্দুক দেখিয়ে চলন্ত গাড়ির চালককে ফেলে সেই গাড়ি নিয়েই পালাচ্ছে, সিগনাল পোস্ট, ট্রাফিক রুলকে কলা দেখিয়ে। পিছনে ওদিকে হুটার বাজিয়ে পুলিশও যথারীতি, কিন্তু তাদেরকেও রক্তাক্ত করে, মেরে।
- এটা তুই?
- হ্যাঁ।
- ব্বাবা, এমন কেন রে? কোনো কিচ্ছু মানামানি নেই, যা খুশী করছিস্।
- আহা ওরা আমায় মারবে আর আমি বুঝি.....
- তা’বলে যেমন-তেমন করে তুই এসকেপ্ড হবি?
- ধুস্, তুমি না কেমন- মজা করতে জানো না? এটা তো খেলা।
ঠিক-ঠিক এটা তো খেলা। বদলে যাওয়া সময় ও সহজকে সহজ ছন্দে গ্রহণের দর্শন এই শিশুর থেকে পেয়েও নিজেকে ঋদ্ধ লাগলো প্রিয়দীপার। নিজেকে শক্তিধর ভেবে বাঁচার মধ্যে একটা বীরত্ববোধ আছে। সবেতে এত নৈতিকতার পাঠে থাকলে চলে? এই যে ভিতরমহলে উত্তেজনার ওঠা-পড়া, এর ক্রেডিটটা খেল-বানিয়েদের প্রাপ্য বৈকি। তবু.... নিজেকে বোঝালেও একটা অস্বস্তি ভিতরে রানিং। সব মেনেও মনে হচ্ছে হিরোর উদ্দেশ্য একটু মহান দেখালে রক্তারক্তিটা জাস্টিফায়েড হতো না? নাকি ঐ ‘মহান’ ভাবনার উপস্থিতিটাই তেতো করে দিত খেলার ইচ্ছে! কেজানে। নাঃ, সবেতেই এত ঠানদিদি ভাব কাজের নয়, কিছুতেই বুড়ো হবেনা প্রিয়দীপা। সত্যিই অত হিসেবপত্র করে মজা নেওয়া যায়?
তবু আলেখ্যর খেলার মাঝে সেদিনও কীসের একটা গন্ধ নাকে ঝাপট দিয়েছিল। মাত্র মিনিট দশেকের জন্য চা করতে গিয়ে, ফিরে ঘরে ঢুকতেই আলেখ্য খেলায় ফিরেছিল স্যাট্ করে । হাল্কা একটা ইমপ্রেশনও রেখে গেল তবু চোখে। ওটা যেন নারী-পুরুষের আঁকড়ে ধরা শরীর দেখেছিল ও। আঁকাজোকা বা এ্যানিমেটেড নয় একদম জলজ্যান্ত্ রক্তমাংসের দেহযোগ। এ’ নিশ্চই মায়াঙ্কের কাজ। পাকটুস্ ছেলে কায়দা করে আলেখ্যর সিডিতে বাজে ছবি গুঁজে দিয়েছে। মনে সংশয় নিয়ে প্রিয়দীপা জিজ্ঞেস করল-
- গেমটা তুই চিনাংশুকের থেকে নিয়েছিস্?
- হ্যাঁ, কেন?
- বল না।
- নিয়েছি, কিন্তু দিয়েছে মায়াঙ্ক- বললাম না গিফ্ট পেয়েছে।
- সেই ডেঁপোটা?
- কে মায়াঙ্ক?
- হ্যাঁ, মায়াঙ্ক। কেন যাস্ ওর বাড়িতে? তোর মাকে বললাম।
- কি বললে?
মনে রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে পায়চারি করতে থাকল প্রিয়দীপা। না, সন্দেহ নয়….. অন্ততঃ তখনো অবধি নয়। আলেখ্য নামক মানুষটির এগারো/বারো বয়সকে কতটা বড় বলা যায়? গলার স্বর ভাঙেনি, দাড়ি-গোঁফের রেখা নেই, দেওয়াল থেকে টিকটিকিকে খসে পডতে দেখলে খিলখিল হাসিতে যে গড়িযে পড়ে, সে ছেলের চোখের ওপর ন্যাংটা কেত্তন নজরে এলে মাথা স্থির থাকে? অতি সামান্যতাও যার কাছে অমূল্য, সে আলেখ্য কতটা ডিসেন্ট, ইনোসেন্ট, কতটা ডিফারেন্ট তা ওর জানা। ভার্চ্যুয়াল ফিল্ডে গাড়ি ছোটায় আর বাস্তবের রাস্তায় গাড়ি দেখে দৌড়ে নর্দমায় নামে, ষাঁড় দেখে সঙ্গীজনের জামা খামছে ধরে। এটাই স্বাভাবিক। এখনো আকাশে ফুটি-ফুটি আলো, কুয়াশা ছিঁড়ে সূর্য্য উঠতে এখনো যে কিছু দেরী।
প্রিয়দীপা সন্দেহ নিয়ে বসে গেল দূরের সোফায় আর আলেখ্য খেলায় ডুবেছিল তত্ক্ষণাত্। ওর সমস্ত রাগ গেল বুবলীর দিকে। মেয়েটা কিচ্ছু খেয়াল করে না, কতবার বলেছে-
- ওরে একটু নজর রাখ- ছেলে বড় হচ্ছে। দীপ্ত নেটে বসে আর সেই কম্প্যুটারেই আলেখ্য। সতর্ক হলেও নাহয় কথা ছিল কিন্তু এমন হাঁদা তোমার বর.....
- কেন গো পিসি কি ব্যাপার, আমি নাহয়.....
- খুব হয়েছে। মা-বাবা হয়ে বসে আছো অথচ পেরেন্টিংটাই জানা নেই।
- কি করে জানব, এই প্রথম মা হলাম।
- প্রথম তো অনেক কিছুই করেছ, সেখানে তো ভুল হয়নি....
- যেমন?
- আমি তোমায় কৈফিয়ত্ দেব না বুবলি। শুধু বোঝ ব্যাপারটা সিরিয়াস।
- সেটাই তো বুঝতে চাইছি। হেঁয়ালি না করে বলে ফেল পিসি। আমি যদি তোমার মত কম্প্যু-ফান্ডায় দড় হতাম তো ঈঙ্গিতই কাফি ছিল, পাত্তা ঠিক লাগাতাম।
- যা পারছো না তা না ভেবে যা পারতে পারো সেদিকে মন দাও। ছেলে কার সঙ্গে মিশছে, কি করছে, অন্ততঃ সে’টুকু খেয়াল। মায়াঙ্কের সঙ্গে ছেলেকে মিশতে দিতে বারণ করেছিলাম?
- হ্যাঁ তা করেছিলে, কিন্তু বার্থডে পার্টিফার্টিতে তো দেখা হয়েই যায়। কি হয়েছে তা’তো বল। কবে থেকে বলছি আমায় কম্প্যুটারটা শেখাও।
- ও না জানলেও চলবে বুবলী। খালি একটু চোখ কান খোলা রেখো আর দীপ্ত উঠে গেলে জিজ্ঞাসা করো- সব সাইটগুলো বন্ধ করেছে কিনা- ব্যস্ আপাততঃ এই।
- কেন বল তো, উল্টোপাল্টা কিছু?
- না রে না, আসলে সাবধানতার মার নেই, বুঝলি?
- ও....
কম্প্যু-অজ্ঞ বুবলি কি সহজে মুক্তি পেল। একটা ছোট্ট ‘ও’ র মধ্যেই নিশ্চিন্তির কাঁথামুড়ি ওম। আহা, কিছু কিছু অন্ধকার বড় দরকার। জ্ঞানের পাঠশালায় না গেলে আলোও নেই, পাপও নেই। কত অজস্র অজানা নিয়ে আমরা দিব্যি বেঁচে থাকি। সেই অগুন্তির মধ্যের এই ক্ষুদ্র অ়জ্ঞানতাও ওকে যে শান্তিটুকু দিল, এই মূহুর্তে তা মহার্ঘ্য মনে হল। তবু রাগ হচ্ছে প্রিয়দীপার। স্পেশালি মায়াঙ্কের কথা বলে ওকে সাবধানতার পরেও কেয়ার না নেওয়ায়।
- দীপমৈ, মা ফোন করেছিল- বিকেলে গেনুপিসি আসবে.... সোহমও। আমায় তার আগে বাড়ি পৌঁছে দেবে?
আলেখ্যর ডাকে চটকা ভাঙল প্রিয়দীপার। এতটাই ও আত্মমধ্যে ছিল যে কখন গড়িয়ে-গড়িয়ে বেলা গেছে... ঘড়ির দিকে নজর যেতে ধেড়েমেড়ে উঠলো। আলেখ্য জিরা-রাইস পছন্দ করে বলে ভেবেছিল খেতে বসার আগেই বসাবে। কতক্ষণ আর, মাইক্রোওয়েভে রান্না। কিন্তু কোথা দিয়ে দুটো বেজে গেল। অপ্রস্তুত সময় প্যাঁচে এবার কখন রান্না কখন খাওয়া কখনই বা পৌঁছতে যাওয়া। ফিরে এসে গুচ্ছের কাজ। ভাবতেই অস্থির লাগছে প্রিয়দীপার। সারা সকালটা খেলে, হেজিয়ে আর সন্দেহে কেটে গেল, কালকের মধ্যে আর্টিকেলটা শেষ না করলেই নয়।
তড়িঘড়ি রান্না-খাওয়া শেষ করে বিকেল পাঁচটার মধ্যে প্রিয়দীপা রেডী। আলেখ্যকে নিয়ে বেরতে যাবে তখনই বুবলী, দীপ্ত, দীপ্তর বোন গেনু ছেলে সোহমকে নিয়ে হৈ-হৈ করে হাজির। গাড়ি ভর্তি করে বেড়িয়েছে বেলুন, বল, থ্রোয়িং ডার্ট সব নিয়ে। সায়েন্স সিটি হয়ে রাতে বাইরে খেয়ে ফেরার প্ল্যান। প্রিয়দীপা বুবলীকে বলল-
- ভালই হয়েছে বাপু এসেছিস, এত কাজ পড়ে আছে.... কিছুটা সময় বাঁচলো।
এই আনএক্সপেক্টেড খুশীর সামনে পড়ে আলেখ্য কী যে করবে বুঝে ওঠে না। একবার সোহমের হাত ধরে এনে সোফায় বসায়, একবার নিজে গিয়ে গাড়িতে ওঠে, কখনো অকারণেই হাবুডুবু হাসি। কিন্তু প্রিয়দীপার কথায় ও নাও যেতে পারে আঁচ করেই আলেখ্য দৌড়ে নেমে এল গাড়ি থেকে। ফ্রন্ট সীটে বসা নিয়ে সোহমের সঙ্গে যে এতক্ষণের ঘ্যাচাঘেচী- সব ভুলে। হলও তাই, ফাঁকা পেতেই সোহম এক দৌড়ে সামনে। আলেখ্য দিলদরিয়া, সামান্যে আর মায়া নেই। নেমে এসে জাপ্টে ধরেছে প্রিয়দীপাকে- হয় ওকে যেতে হবে, নয় আলেখ্য নিজে যাবে না। মেলা ঝামেলা, ঠেলেঠুলে ছেলে গাড়িতে ওকে তুলেই ছাড়বে। জো পেতেই সব বাকীদেরও এক রা। যেতেই হবে, কোনো বাহানাতেই ভবীরা আর ভোলবার নয়।
এই যে আলেখ্য মাঝমাঝে থাকতে আসে, তা প্রিয়দীপার দিনগুলোকে সোনায় মুড়ে দেয়। যদিও তখন কম্প্যুটার হাতছাড়া, তবুও বেশ। আলেখ্য কার্টুন দেখতে উঠলে সেই ফাঁকটুকুর সদ্ব্যবহার করে ও। এই আব্দার ইচ্ছে করেই মেনেছে প্রিয়দীপা- ওর উপস্থিতির লোভে। মাপা ঐ সময়টুকুর যে কি ক্ষমতা, কি যে সুখের বর্ষা নামে ওর একলা দিনে, তা ওই জানে। আলেখ্য চলে গেলে সেই একই রুটিন, একই ফের উচ্ছ্বসিত আবেগগুলোর রন্ধ্রপথ বন্ধ করে বাঁচা। ওকে কেন্দ্র করে উত্সারিত যে স্নেহের ক্ষরণ, তা দিয়ে প্রিয়দীপা নিজেকে নার্চার করার সুযোগ পায়। এ’ অমূল্য না? বাসী-ঘষটানো দিনগুলোকে শিশুর তারল্য দিয়ে ধুয়ে-মেজে চকচকে করে তোলা? এই পালন ধূপের ধোঁয়ার মত ওকে জড়িয়ে থাকে বেশ কিছুদিন। ওর সঙ্গে সম্পর্ককে সরলতায় রেখে, ওর কথাকে গুরুত্ব দিয়ে বা নেতি ভঙ্গীমাকে যতটা সম্ভব এড়িয়ে বন্ধুর মত মেশে দেখে কত কথাই যে বলে আলেখ্য। সেখান থেকেই তো ডেঁপোটার কথা জানা। পাকটুস্, চতুর, এঁচোড়েপাকা মায়াঙ্ক। কবে নাকি শাল্মলীকে চুমু খেতে গিয়েছিল আর শাল্মলী ধাক্কা দিয়েছে এমন যে মায়াঙ্ক পড়ে গিয়ে চোট পেযেছে জোর।
- ওমা, হঠাত্ চুমু খেতে গেল কেন?
- ওই যে টিভিতে দেখিয়েছে না- করিনা কাপুর আর..... আর একটা কে যেন জিভ চেটে-চেটে চুমু খাচ্ছে।
- শাহিদ কাপুর।
- হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক বলেছ, শাহিদ কাপুর।
- তুইও দেখেছিস্?
- কি?
- ঐ চুমু?
- হ্যাঁ। ক্লাসেই তো মায়াঙ্ক সবাইকে বলেছিল- হিন্দী কি একটা চ্যানেল যেন..... মনে নেই.... ‘চোখ রাখিস, আজ সারাদিন খবরে দেখাচ্ছে।’
- তা ওর তা’তে কি? নাহয় দেখেইছিল, বাহাদুরী করতে গেল কেন?
- কিছু না....
- কিছু না মানে?
- মানে ইচ্ছে হলো.... বললো যে দেখছিলাম, জিভে চেটে চুমুর কেমন টেস্ট।
- কেমন বলল?
- বলবে কি, ফেলে দিয়েছে না? এখন মাথায় আলু নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
এর কি প্রতিক্রিয়া হওয়া উচিত্, কি বলবে প্রিয়দীপা? অদ্ভুত ঘটনা, কিম্ভুত তার পরিপ্রেক্ষিত। এখন কিশোরীর ঋতুর কাপড়ও বাচ্চাদের কৌতুহলের সামনে পড়ে হাঁফাচ্ছে। প্রচারের বাহুল্য বিনা কিছুই নাকি বিকোয় না। তা আদি কালে যে প্রচার-মোচার ছিল না.... কেজানে মেয়েরা তখন কী করছিল? পাব্লিসিটির অপেক্ষায় ঘুমোচ্ছিল নারীত্ব আর আজ মওকা পেতেই..... যাকগে, বাণিজ্যের পাঁকে পড়ে বাচ্চারা খাবি খাক, শৈশব যাক্- কার কি? সব ঘুমোক-ঘুমোক। আপন স্বার্থের গানিব্যাগে পাঞ্চ মেরে-মেরে শক্ত করুক যে যার ধনের মুঠি। ওদিকে শৈশবকে ছিঁড়েখুঁড়ে অবেলার যৌবন টেস্ট করুক জিভের সঙ্গে জিভের চাকুমচুকুম। হঠাত্-হঠাত্ এমন বেয়ারা অবস্থায় পড়ে এত অসহায় লাগে। তেমনি হয়েছে ওর বাপ। ক’দিন বুবলীর বাড়িতে থাকতে গিয়ে কম্প্যুটারে বসে তো দেখেছে, একশোবার নানা ভালগার ছবির সামনে পড়ে খাবি খাওয়ার দশা। কখনো হ্যাংলা রোগা মেয়ের ভোঁদকা মোটা বুক ছলকে ওঠে স্ক্রিনে তো কখনো নারীশরীর ছুঁয়ে পুরুষ লিঙ্গ লাফিয়ে নামে পর্দায়- উইথ এ্যাকশান। ছানাবড়া চক্ষুতে সে’সব জ্বালার ওপর জ্বালা। বুঝে গেছে প্রিয়দীপা, ওদের বাড়ির চারটি প্রাণীর একটি শিশু, একটি কুকুর, একটি কম্প্যু-আনপড় ও একটি বুবলীর বর। এ’ আর কারো না দীপ্তরই কাজ। তিনি একলা নেটে ঘুরেছেন, আয়েস করেছেন, উঠেও গেছেন। আরে সাইটগুলো খুলেছিস তো বন্ধ করে ওঠ। ওদিকে নেট মহল্লায় চড়ে বেড়াতে আনলিমিটেড এ্যাক্সেস নিয়েছে ও বাহানাও তার রেডী।
- জানেন পিসি, অনেক ডাইনলোড লাগে, তাই ভাবলাম....
- তাই বুঝি? তবে আমার লাগে না জান। কত আর কাজ, নেটে একা বসি, নির্দিষ্ট বরাদ্দই কখনো-সখনো রয়ে যায- ফুরোয় না।
- আমারও বেশী অফলাইনেই কাজ। আসলে ছেলের কথাটাও ভাবলাম। এখন আর গেম সিডিতে পোষাচ্ছে না তার- নিত্যনতুন খেলা চাই। আর মাঝেসাঝে আমাকেও এত কাজ নামাতে লাগে.....
কৈফিয়তের যে কি দরকার। তুই এ্যাডাল্ট, যা খুশী কর- শুধু একটু খেয়াল রাখবি না? ঐ মেশিনে ছেলেও বসছে, কখনো যদি তার চোখের ওপরেই..... আসলে ব্যাপারটা খেয়াল রাখারাখির নয়- বিবেচনার। সব স্বার্থপরের ডিপো, নিজস্ব ইচ্ছেপত্র মিটল তো কাজ শেষ। পিছনে কে, কি, কেন ভাবার সময় কই? অথবা এমনও হতে পারে, যে দীপ্ত এ’সবে এতই থাকে যে বন্ধসন্ধ করলেও কিছুকিছু মেমরীর হাত ধরে ঘাপটি মেরে থাকে আর উঁকি দিয়ে যায় ফাঁকে-ফোঁকড়ে। ভাবতে পারেনা প্রিয়দীপা- রাগ প্রকাশের জায়গাও পায় না। মিথ্যেই বুবলী সঙ্গে করে ছেলেকে স্কুলে নিয়ে যায় আর আসে। গাড়ি চাপা পড়া থেকে বাঁচাবি আর কচি মনের ওপর টন-টন অচেনা চাপে শৈশব মরছে কিনা তা দেখবি না? ঢঙ, ঢঙ.... এ’সবও ঢঙ। ন্যাকার মত ছেলের সঙ্গে জুড়ে আছির ঢঙ।
2
সারাদিনের শেষে নিজের কাছে বলার মত কিছু কাজ না করতে পারলে বড় অপরাধী লাগে। মন ঘুরতে-ফিরতে গেয়ে চলে- ফাঁকী দিলাম, ফাঁকী দিলাম, বেকার গেল দিন। এই যেমন এখন, বাড়িতে ঢুকে থেকে প্রিয়দীপার কানের কাছে সেই চেনা গান। আসলে সবাইকে এড়াতে পারলেও, আলেখ্য যে কি জাদু করেছে। ওর চাপাচাপিতে যেতেই হল। শুধু তাই নয়, লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে ফ্লাইং সসার, থ্রোয়িং ডার্টও খেলল সমানতালে। বাকীরা গল্পে ছিল কিন্তু ও পারেনি। ছুটকোগুলোর সঙ্গে কিছুক্ষণের ছুটকোপনাই এত সজীবতা দেয়- ভিতরের সোজা-সরল-সুখীসুখী ইচ্ছেগুলোর সঙ্গে দিব্যি টুকটাক দেখা হয়ে যায়। তবু এখন গা–মাথা আর কাবুতে নেই। মন লাফালে কি হবে- তন্ জানান দিচ্ছে খুকী, বেলা অনেক হল। আসলে কাযিক শ্রম না করে আর গাড়িতে ঘুরে-ঘুরে অভ্যাস এমন, যে তা মালুম দিচ্ছে বেশ। এদিকে ঘুরতে ক্যাঁক, ওদিকে ঘুরতে কোঁক্, সিঁড়ি দিয়ে উঠতে কোঁককোঁক্। বাড়ির গ্যেটে পা রাখা মাত্র শরীর ছেড়ে দিয়েছে। বিছানা ডাকছে আয়, আয়- একটু গড়িয়ে নিয়ে তারপর নাহয়..... কিন্তু উপায় নেই। লেখাটা নিয়ে বসতেই হবে। বেশ ক’দিনের দিচ্ছি্ দেব করে ঠেকেছে এসে কালকের ডেডলাইনে। কোনোমতে চেঞ্জ করে বেডরুমে ঢুকেই খাটের ওপর ছড়িয়ে ফেলল খাতাপত্র। বুকের তলায় বালিশ নিয়ে- যতটা রিল্যাক্সেশন সম্ভব উপুড় হয়ে শুয়ে শুরু হল লেখা। দেখা যাক্- কিছুটাও যদি ম্যানেজ করা যায়। কিন্তু এমনই গেরো, লিখতে-লিখতে সেই গিয়ে আটকালো সন-তারিখে। ভেবেছিল আজ আর নেটে বসবে না। এক সাইট থেকে অন্য, সেখান থেকে অন্য যেতে-যেতে কোথা দিয়ে যে উড়ে যায় সময়, তাই রাত দুপুরে না বসারই চেষ্টায় ছিল। ঝালে-ঝোলে-অম্বলে এক ফোড়নের মত এই নেট নির্ভরতা সব গন্ডগোল করে ছেড়ে দিয়েছে। বই খুলে খোঁজায় আলসেমী আসে, চোখে ভাসে একটা শুধু ক্লিকের অপেক্ষায় নেটের বাড়ানো হাত। বদল প্রযুক্তির সঙ্গে-সঙ্গে বদলাচ্ছে যে ইচ্ছাপত্র তা’তে নিজেকে নিয়েই অবাক প্রিয়দীপা তো বাচ্চাদের আর দোষ কি। ওরা সাদা পাতা- বুকে রং ভরতেই এসেছে, যে কোন প্রযুক্তিতেই গ্রহণ ক্ষমতা ইউনিক। পিছুটানহীন, নেতি ভাবনার দ্বিধামনবিহীন শুধু সামনে তাকানো বলে ওদের প্রাপ্তিটাও ঢের। গুছিয়ে বসা বিছানার মায়া ছেড়ে উঠতেই হল- কম্প্যুটারে যেতে হবে। ড্রইংরূমের টেবিল জুড়ে ছড়ানো-ছিটনো সিডির রাজ্য, আলেখ্যর ছেড়ে যাওয়া জামা মনিটরের মাথায়। ওফ্, আর জায়গা পায়নি। অবশ্য দোষ দেবে কি- যা তাড়াহুড়ো গেল, একদম ঝড় বইয়ে এসেছিল সব। জামা সরিয়ে প্রিয়দীপা নেট খুলতেই চমকে গেল একদম। আলেখ্যর ই-মেল ঘর দু’হাট খোলা। ও- তারমানে ছেলে সিডিতে গেম খেললেও চুপিসারে নেটে ঢুকেছিল। অথচ প্রিয়দীপা বলে রেখেছে-
- আমি না থাকলে তুমি নেট খুলো না যেন।
- না, এ’বাড়িতে খুলি না তো। জান দীপমৈ, গেমটা নামিয়েই কানেক্সান অফ করে দিলে হার্ডডিস্কের মেমরীতে ওটা থেকে যায়, আমি তখন অফলাইনেই খেলি।
- বাবা, তুই এ’সবও শিখে গেছিস! তোদের বাড়িতে এত ভাবাভাবির কী দরকার, আনলিমটেড এ্যাক্সেস যখন।
- না এমনিই বললাম। তুমিও পারো, টুক করে কোন গেম নামিয়ে এবার যতক্ষণ খুশী খেল।
- বেশ বুঝলাম। তবে এ’বাড়িতে ও’সবের দরকার নেই।
- এ’জন্যই তো এখানে সঙ্গে করে সিডি আনি।
- লক্ষী ছেলে। তা তোদের বাড়ির ব্যাপার কী- সিডিতে না....
- না, না, ও’বাড়িতে যা কিছু সব নেটে।
- তা এত গেম সিডি থাকতে তোর অনলাইনের কী দরকার?
- কত নতুন খেলা ওখানে পাই বল।
- তা তো পাও, কিন্তু নেটে কত কাজও করা যায় তা জান?
- জানি, কিন্তু কেন করবো? বাবাই আমায় সপ্তায় দু’দিন মোটে বসতে দেয়। তাও তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে উঠিয়ে দেয়, ঘরে বসতেও দেয়না।
- বাবার কাজের সময় তুমি বসে থেকে কী করবে?
- এমনিই.... দেখব, বাবাইও তো খেলে।
- কে বলল?
- আমি জানি। দরজা বন্ধ করে বাবাই খেলে। আমি খেলবো না বুঝি?
- হুম।
বুঝেছে প্রিয়দীপা, ভিতরের আক্ষেপ উঁকি দিয়ে গেছে। আলেখ্য নিজ-আবিষ্কৃত অনলাইন-অফলাইনি পন্থায় নিশ্চই গেম নামিয়েছিল আর সেকারণেই..... দীপ্ত একটা হাঁদা। বাপ্ হয়েছে, ছেলে মানুষ করার একটা স্টেপও যদি ঠিকঠাক নিতে জানে। রেশনের মত বরাদ্দ করেছিস্ সময়, তো নিজেও তা মেনে চ’। তা না- আগে ফিরলে উঠিয়ে দেয়, দরজা বন্ধ করে বসে। কি শিখছে ছেলে? যার হাতে ক্ষমতা তার কাছেই এক্তিয়ার। এত ইন্টেলিজেন্ট ছেলেকে কপাল করে পেয়েছিস, এমনি করে সে খেলে যাবে আরো কতকাল? ইন্টারেস্ট বাড়াবার কতরকম সফ্টওয়্যার, ইনোভেটিভ কাজের একশো দিশা। সেসব জলাঞ্জলি দিয়ে....
প্রিয়দীপার জরুরী কাজ মাথায় উঠল, আলেখ্যর খোলা ই-মেলে তদন্তে নামল। ছেলে স্টে সাইন ইন রেখে নেটে ঢুকেছিল আর লগ আউট না হয়ে সাইট কেটেছে বলেই ঘর খোলা খাতা। ইনবক্সে রাজ্যের কোম্পানীর পাঠানো গেম। কী মনে হতে ওর স্প্যাম ফোল্ডারেও গেল ও খুব অস্বস্তিতে পড়ে গেল প্রিয়দীপা। সব ভুলভাল সাইট থেকে পাঠানো মেল। খেলার বাইরে কিছু বোঝেনা দেখেই ও’সব আনফোল্ডেড পড়ে আছে অপেক্ষায়। একটা ফোল্ডার খুলল প্রিয়দীপা। কিন্তু কী এটা? একটি মেয়ের নগ্ন বুকে ধীর গতির একটি মাকড়সা চলে বেড়াচ্ছে। সরুসরু ঠ্যাং নাড়িয়ে সুতোর আগায় শরীর ঝুলিয়ে টিপ করে সেটি পৌঁছে গেল নিপলের কাছে। তার ভাঁটার মত ঘুর্ণি চোখে বদল আলোর উত্সব। ঠিক তখনই একটি পুরুষ হাত ঢুকল স্ক্রিনে- মাকড়সাকে তাড়াবার ছল করে। মাকড়সা দৌড়ল, গুটিসুটি দাঁড়াল এক কোণে, স্থির চোখের তারায় তখন সবুজ রঙা রাগ। শিহরিত নারী শরীরও কম নয়, দিব্য উদগ্রীব- পাল্লা দিয়ে যৌনবোধের জানান দিচ্ছে। এবার পুরুষ হাতের পাঁচটা আঙুল হঠাত্ পাঁচটা ঠেউ হয়ে বদলে ফেলল চরিত্র। হাতের ভঙ্গীমায় লোভের রোশনাই মেখে স্রোতের মত সে’সব ধাবমান। মাকড়সার দিকে নয়, লক্ষ্য গুরুস্তনীর শরীর অভিমুখ। এবারে আর কি, দিয়া জ্বাললেই হয়- নারীশরীরের উন্মুখ উল্লাস তো ধরা দিচ্ছেই তার বোঁটার চুড়ায়। আলতো এবার পুরুষ হাতের আঙুলখেলার লোম-অনুলোম-বিলোম। মাকড়সা কিন্তু পালায়নি- অল্প দূরে অপেক্ষায়.... কীসের? কেজানে। খেলা পাগল হয়েও প্রিয়দীপার আর কিছু ইচ্ছে হল না। আলটিমেটলী এটা আলেখ্যর ঘরের পোস্ট। যদি ওর চোখে এটা পড়তো? ইস্। বছর বারোর মেল-এ এসেছে এই গেম? নাঃ। আর কিচ্ছু জানতে চায়না, নিশ্চুপে প্রিয়দীপা স্প্যাম ফোল্ডারের সমস্তটা ডিলিট করে দিল। ওর মেল ঘর বন্ধ করে এল নিজেরটায়। গোটা দু’য়েক মেল যা এসেছিল, তা পড়ে নিয়ে উঠল। মেজাজ এমন নষ্ট হয়েছে যে কাজের উত্সাহ শেষ। মনে চিন্তার স্রোত- কীভাবে রক্ষা পাবে আলেথ্যর আদত শৈশব, ওর বাবা দীপ্তর আপাত বয়ঃপ্রাপ্ত শিশুবেলা?
কাজের কাজ কিচ্ছু হলো না, মাঝখান থেকে রাত হল অনেক। আলো নিভিয়ে শুতে গেল যখন, তখন রাত দুটো। এ্যালার্ম দেওয়াই ছিল, ছ’টা বাজতে উঠতে অসুবিধে হল না। চা নিয়ে সোজা এসে বসল পড়ার টেবিলে। আগামীকাল গান্ধীজয়ন্তীর ছুটি, আজ দিতেই হবে নোটস্। সকালের ঠান্ডা আবহ আর ফ্রেশ মাইন্ডে ঘন্টা দুয়েকে নেমে গেল লেখাটা। বেশ ফুরফুরে লাগছে, চেয়ার ছেড়ে উঠল প্রিয়দীপা। কালকের কাজপত্র সাজিয়ে ফেলল মনে মনে। পুরোপুরি ছুটি আজকাল এত কম, যে কিছুতেই সব সামলে ওঠা যায়না। চিরদিনের সেই চব্বিশ ঘন্টাই দিনের হিসেব, তবু ফিঙের মত সময় লাফিয়ে পালায়। সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরছে যখন আলেখ্যর ফোন-
- আমায় নিয়ে যেও দীপমৈ।
- কী রে, কালই এসেছিলি আবার আজ তোকে ছাড়ছে যে!
- বাবার একটা কাজ করে দিয়েছি, তাই।
- কি কাজ?
- ভিডিও ডাউনলোডারটা বাবা নামিয়েছিল কিন্তু দু’ মিনিটের বেশী সেভ হচ্ছিল না। আমি পুরোটা করে দিয়েছি।
- তাই বুঝি? তুই এবার এ্যাটাচী হাতে বেড়িয়ে পড় সোনা, কত কিছু পারিস। আচ্ছা আমিই নাহয় তোর প্রথম কাস্টমার হব, আমাকেও নামিয়ে দিস্ ওটা।
- তোমার তো লিমিটেড এ্যাক্সেস।
- ঐ জন্যই তো, বরং তোদের থেকে আমারই বেশী অফলাইনের প্রয়োজন।
- তবে ঝটপট চলে এসো সোনামৈ, বাবা আমায় নিয়ে যাচ্ছে না। বলছে ‘গেলে যাও, আমরা যেতে পারছি না।‘
- আরে পারমিশান পেয়েছিস্ এই কত, দাঁড়া আসছি। কাল ছুটি, থাকবি তো?
- না, না, মা কাল গড়িয়াহাট যাবে, ফেরার পথে আমায় নিয়ে আসবে বলেছে।
বেশ রাত করেই ফিরল প্রিয়দীপা। আলেখ্যকে নিয়ে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে। বাড়িতে এসেই কাপড়-চোপড়, ওয়াশিং মেশিন নিয়ে পড়ল। এখুনি শোবেনা, তাই যতটা কাজ এগিয়ে রাখা যায়। মন হাল্কা, দিনটা ভাল কাটল। স্টুডেন্টস খুশী কি অখুশী তা জানেনা, কিন্তু আর্টিকেলটা লিখে ভাল লাগাটা বেশ। এমন ওর প্রায়ই হয়। রোজের ধরাবাঁধার বাইরে একটু অন্য টাইপের লেখালিখিতে চিন্তা যেমন, মনোমত লিখতে পারলে খুশীও তেমন। যদ্দিন এই ভাল লাগাটা আছে, তদ্দিনই লাভ। আজ রাতে আবার পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনার মত আলেখ্য, রেস্টুরেন্ট, কাঠি আইসক্রীম। গাড়িতে ফেরার সময় সিলিন ডিওন-এর গান চালিয়ে গলা মিলিয়েছিল দু’জনে। এই হাল্কা শীত, রাতের ফাঁকা রাস্তায় যেতে-যেতে কতদিন পর ড্রাইভ করাকে যে এনজয় করল প্রিয়দীপা।
যথারীতি আলেখ্য বাড়ি ঢুকেই কম্প্যুটারে। সেই গেম সিডি, সেই গাড়ী, বন্দুক, বোমা..... ওয়াশিং মেশিনে কাপড় দিয়ে ওর সঙ্গে থেলায় বসল প্রিয়দীপা। কিন্তু ছেলে এতই দড়- খেলবে কি, হেরে-হেরে ভূত-ভবানী, ইন্টারেস্টই গেল। ছেড়েছুড়ে বলল-
- খুব হয়েছে, এবার আমি শুতে যাব তুমি ভিডিও ডাউনলোডারটা নামাও।
- তুমি শুতে যাওনা, আমি নামিয়ে আসছি।
- ওরে ব্বাবা, তুই বেশী সময় নিলে? আমার মোটে 0.15 জিবি প়ড়ে আছে।
- তুমি দীপমৈ সত্যি- আমি জানিনা বুঝি।
পাগলা যে সবেতেই তুখোড় তা জানে প্রিয়দীপা, তবু বলা- অপচয় ওর সয় না। প্রিয়দীপা ব্যস্ত হয়ে পড়ল ভিজে কাপড়চোপড় নিয়ে। শুকতে দিল বারান্দায়, বেডরুমে। এই এক সমস্যা ফ্ল্যাটের- একার জন্যও অকুলান। তা’ছাড়া পুরো সপ্তাহর জমানো বলে কথা, চাট্টিখানি? কিছু কাপড় মেলতে ড্রইংরুমে গেল আর ধাক্কা লাগল সেখানেই। আনএক্সপেক্টেড কিছুর সামনে পড়ে যে শক লাগে, তা লাগল মারাত্মক। সেই থেকে যে যন্ত্রণার শুরু, তা আর যাচ্ছে না। কাল সারারাত ছেঁড়াছেঁড়া ঘুমের পরে আজও দিনটা গড়িয়ে গড়িয়ে যাচ্ছে, ছুটিটাই বরবাদ। সকালে বিছানা তুলে এসে দেখেছিল আলেখ্য রেডী হয়ে বসে- পালাতে চায়। দুজনেই দুজনের মনোভাবটা বুঝছে অথচ....
প্রিয়দীপা ঠিকমত কথা বলেনি, চোখে চায়নি ওর, আলেখ্যও ছিল দ্বিধায়। বেলায় বুবলী এসে ওকে না নিয়ে যাওয়া পর্যন্ত একটা অস্বস্তি ছিল দু’পক্ষেই। যতক্ষণ ছিল, স্টাডিরুমেই ছিল- না কম্প্যুটার, না টিভি, না আঁকাআঁকি। কষ্ট বুকের এতই গভীরে প্রিয়দীপার যে না পারছে কারুকে বলতে, না পারছে সইতে। এটা বুঝেছে বেশ যে বারণ স্বত্বেও আলেখ্য নেটে যায়- অশ্লীলতায় যাবে বলে। শুধু কাল নয়, পরশুও ও নেটেই ছিল আর প্রিয়দীপা ভেবেছে নষ্ট বন্ধুর পাকামীতে....
হায় কী দুঃসময় তোর। ঘর পরিবেশ থেকেই হয়তো অন্যায্যতার শুরু। এবার সবটা স্পষ্ট, এ’ দায় দীপ্তর। ঘরে শিশু থাকলে যে সতর্কতা দরকার, তার কানাকড়িও নেই, আলেখ্য বাধ্য হয়েছে দেখতে। ও ইন্টেলিজেন্ট, খুঁজে নিয়েছে আপাত গোপন রাস্তা আর তারপর যা- তা অভ্যাস। আহা রে, বড়র ভুলকে কষ্ট দিয়ে, লোভকে অস্থিরতা দিয়ে মেটাচ্ছে কচি শরীর। মনহীন শরীর ঘিরে একতরফা ফ্যান্টাসি যদি বিশ্বাসে বসে যায়, কী হবে? ওর জীবন ওকে ভালবেসে কখনো কি ‘ভালবাসা’-র খোঁজ দেবে? নিজের নয়, ভাইঝির ছেলে আলেখ্য। মরুগ্গে বলে ইগনোর করে প্রিয়দীপা ঢুকতেই পারতো নিজস্ব ছান্দিক ঠিকানায়, কিন্তু পারছে কই? যন্ত্রণার আসলে প্রত্যক্ষ পরোক্ষ বলে কিছু নেই। রঙ তার চিরকালই কালো। গতকাল ড্রইংরূমে ঢুকতেই, ঈগল পাখীর ক্ষিপ্রতায় সাইট কেটে খেলায় ফেরার মধ্যে মূহুর্তের সময় নিয়েছে আলেখ্য। কিন্তু যা দেখার তা ও’টুকুতেই ঢের। পরশু স্টিল পিকচার থাকলেও কাল ছিল নড়াচড়ার ভিডিও ফাইল। বাইরে চলে গিয়েও তাই ঘরে ফিরেছিল প্রিয়দীপা আর তখনই অনুভব করেছিল বদল। মূহুর্তের ঐ ফাঁক গলে কি দেখেছিল ও? দেখেছিল উলঙ্গ্ দুটো শরীর, যারা যৌনখেলার ক্রিয়ায়। আলেখ্যর অবস্থা তখন ভ্যাবলাকান্ত ভোম্বলনাথের মতন। চোখে অচেনা নজর আর বাঁ-হাত দিয়ে খামছে ধরে আছে নিজের পুরুষাঙ্গ। প্রিয়দীপা ঠিক জানে, ওটা উত্তেজনা না, ওটা ব্যথা। অচেতন, অবোধের ওপর চেপে বসা ঘোড়া রোগ। পালাতে পারছে না, কারুকে বলতে না, বুঝছেই না কি হচ্ছে, অথচ উচাটন- নারী-পুরুষ মানে এই? মেয়ে শরীর এ’ভাবে ঘাঁটে? মা-বাবা মানে......
সুস্থ জীবন চেনার আগেই চেনা প্রিয় মুখগুলো অন্য প্রশ্নের সামনে। কৌতুহলের ছদ্মবেশে ছেলেবেলার চাপল্য, উন্মাদনা এক বুক কষ্ট হয়ে থমকে গেছে নষ্ট পথে। জানে প্রিয়দীপা, কষ্টেই ছিল আলেখ্য, অন্য কিচ্ছু হতেই পারেনা। মানুষের হাজার প্রবনতার মধ্যে যৌন কৌতুহল প্রধান প্রবণতা জেনেও মনে প্রশ্ন- প্রি-এ্যাডোলেসেন্স-এ? কোনোকিছু না বুঝে গ্রহণ হলে মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের ভুল ব্যাখ্যা পৌঁছবেই। আলেখ্য পর্ণোগ্রাফিতে দুটো শরীরকে ক্রিয়া করতে দেখেছে। অথচ বাস্তবে পাশাপাশি একটা মনও চলে, যাকে দেখা যাচ্ছেনা বলে জানছেই না ‘ভালবাসা’-র বৃত্তান্ত। আগ্রাসী ক্রিয়াকলাপ যা মনের উপস্থিতি বিহীন জান্তব। সবটা বুঝতে আরেকটু সময়, পাশে গার্জেন, নিদেন প্রেমের বোধে যাওয়া চাই। প্রিয়দীপার বুকের মধ্যে খলবল করছে পাঁক- মনে হচ্ছে পৃথিবী গোল্লায় যাক্, আলেখ্য ভাল থাক্। বেচারী অনেক কিছু না বুঝেও এটা বুঝে গেছে যে এ’ লুকোবার, বন্ধ দরজার। আহা, ফুটে উঠতে চাওয়া কৈশোরকে কুঁড়িতেই খুন। স্থিরতা নেই, ধীরতা নেই, সোহাগ নেই সোজা সংরাগের সঙ্গে আলাপ?
রাতটা কুয়াশা জড়ানো অন্ধকারে মোড়া, ফাঁকেফুঁকে উপচে পড়া হাজার তারার ভিড়। মনে হচ্ছে ছেঁদা হয়ে গেছে আকাশ আর বিন্দু-বিন্দু আলো ঠেলেঠুলে বাইরে আসার চেষ্টায়। প্রিয়দীপা হাত বাড়াল কাছের তারার দিকে। পেড়ে আনতেই টুপ করে তা গড়িয়ে গেল জলে। না, না, হারালে চলবে না। স্কুলের স্ক্র্যাপ বুকে বেদানাদানা দিয়ে হার্ট তৈরী করেছে, তার মধ্যিখানে চিপকাতে হবে- লহনার চেয়ে সুন্দর হতে হবে খাতা। গান ভেসে আসছে, গায়িকা সিলিন ডিয়ন। ঠিক তখনই দাদীর ভাত রান্নার ডেকচী থেকে উড়ে এলো তারা। আরে, এটার রঙ তো লাল। কী হবে? কী করে লাল হার্টে লাল তারাকে সাঁটবে, হারিয়ে যাবে যে। তবে কি এ’বারেও সেরা লহনাই! কান্না পাচ্ছে প্রিয়দীপার, চোখ বালি-বালি-বালি। কিন্তু মনে আছে, মুঠোয় খাবলা সোনার কুচি কুড়িয়েছিল ও। এই কারণেও কান্না পাচ্ছে আরো। রূপোলী তারা রূপোর হয়েও ছড়াচ্ছে সোনার কণা। কেন? ভয় লাগছে প্রিয়দীপার, মুঠো খুলে ছড়িয়ে দিল দানা। আরে, সমুদ্রের মাথায় দুলতে-দুলতে দানাগুলো কী সুন্দর ক্যালিডোস্কোপের মতন সিফটিং প্যাট্যার্ন তৈরী করছে। কোথা থেকে এল এত রঙ? আঃ, কি প্রশান্তি, জলকণার ঝাপটা চোখে-মুখে, হাওয়ায় সেই গান- সিলিন ডিয়ন।
ঘরের ল্যান্ড ফোনটা ঝনঝন করে বেজে ঊঠতে ধড়মড়িয়ে এসে ধরল প্রিয়দীপা।
- দীপমৈ?
- হ্যাঁ আমি, বলো।
ও’প্রান্ত নিশ্চুপ-
- বলো কি বলবে?
- দীপমৈ-
- বল, কথা বলছ না কেন?
থমকে থাকা আলেখ্য চুপ-রাজ্যের বাসিন্দা। মিনিটখানেক বাদে-
- দীপমৈ-
- হ্যাঁ আমি দীপমৈ বাবা, কিছু তো বলো।
- তুমি আমায় ডঃ.বাবুর কাছে নিয়ে যাবে?
- মানে?
- তুমি আমায় বকবে?
- না তো।
- আমি জানি।
- কি জানিস?
- রাগ করেছ।
- আরে না....
- তবে মোবাইল কেন ধরছিলে না?
- ও, তাই বুঝি... আসলে লিখতে-লিখতে ঘুমিয়ে পড়ে স্বপ্ন দেখছিলাম, ঘুম ভাঙেনি রে।
- কি দেখলে?
- দেখছিলাম আকাশের তারা নিয়ে খেলছি, আমার স্কুলবেলা, স্ক্র্যাপবুক, ক্যালিডোস্কোপ- আর ফোনটা যখন বাজছিল তখন সমুদ্দুরে ছিলাম, শুনছিলাম- সিলিন্ ডিয়ন, সেদিন তোর সঙ্গে গাড়িতে যেটা গাইতে-গাইতে এলাম। আসলে মোবাইলেরও রিং টোন তো এটাই, কি করে যেন সব জড়িয়ে-মড়িয়ে একশা। ভাগ্যিস তুই ল্যান্ডলাইনে করলি। উঠে দেখি জানলা খোলা, বৃষ্টির ছাটে ভিজছি আমি, ভিজে যাচ্ছে বইখাতা- ও’দিকে স্বপ্নে ভাবছি সমুদ্রের হাওয়া, জলের ছিটে.... তবে তোর কি হল, ডঃ-এর কাছে কেন যাবি?
- তুমি এসো।
- কোথায়?
লাইনে কোঁ-কোঁ আওয়াজ। ‘এসো’-টুকু বলেই ছেলে কেটে দিয়েছে লাইন।
3
রাত প্রায় এগারোটা, এইমাত্র বাড়ি ফিরল প্রিয়দীপা। সারাদিন পরে মনে মিশ্র অনুভূতি, সকালের স্বপ্নটার মত। কখনো ভীতি, কখনো খুশী, কখনো অপ্রাপ্তি, কখনো প্রশান্তি। অথচ ভাবনাগুলো ক্যালিডোস্কোপের মত কালার্ড, কমপ্লেক্স, সিমেট্রিক্যাল।
সকালে আলেখ্য লাইন কেটে দিতে ফের ফোন করেছিল প্রিয়দীপা, বুবলী ধরল। ওরা বিকেলে কোথাও যাবে, আলেখ্য যাচ্ছে না। প্রিয়দীপা রাত নটা-দশটা অবধি ওদের বাড়ি থাকতে পারে কিনা জানতে চায়। অন্যসময় হলে জানেনা কি করত, কিন্তু আলেখ্য কিছু বলতে চেয়েছিল, যা জানাটা জরুরী। আহা, বেচারীর কষ্টের বোঝাটা যদি কিছু হাল্কা করা যায়। সময়মত পৌঁছে যাবে জানিয়ে দিল বুবলীকে। ওরা রেডীই ছিল, তিনটেয় পৌঁছতেই বেরিয়ে গেল আর ঘরের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ল ঠান্ডা-শীতল বরফকুচি অনুভব- ফের। মুখোমুখি দু’জনের কাছে দুজনের সেই অস্বস্তির ঘেরাটোপ। প্রিয়দীপা দমচাপা অবস্থা থেকে বেরোতে সঙ্গে আনা গেম সিডিটা দিয়ে বলল-
- এটা নতুন বেরিয়েছে, খেলে জানাস্ কেমন। আর তুই যে ফ্রায়েড চিকেন-
কথার মাঝখানেই আলেখ্য বলল,
- তুমি কবে নিয়ে যাবে আমায়?
- কোথায় সোনা?
- ডঃ-এর কাছে?
- কেন, কী হয়েছে?
- আমি বড় হবো না দীপমৈ।
- তো ডঃ কি করবে?
- থামিয়ে রাখবে। আমি ফুটবল চাই, হুইশিল বাজান ট্রেন চাই, রিমোট প্লেন চাই দীপমৈ।
- তা তো এখনো পেতে পারো বাবা।
- না।
- কি না?
- আমি বড় হব না।
ইস্। যন্ত্রণার ছায়া কত গভীরে নেমেছে ওকে ছুঁয়ে। যে’জন ভাবে ডক্টর মানে ম্যাজিসিয়ান- চাইলে সব পারে, সে’ অবুঝের কপালে কিনা এই দুর্ভোগ। চোখে জল এসে গেল প্রিয়দীপার। দু’হাতের বেড়ে জড়িয়ে নিল আলেখ্যকে। কপালের ওপর ছড়িয়ে পড়া চুলগুলোকে গুছিয়ে দিতে দিতে বলল-
- আমিও তাই চাই রে সোনা। সেই স্কুলবেলার দিন, সেই এ্যান্টেনায় লটকানো ঘুড়ি পাড়তে ধরা পড়া বকুনী, সেই দুর্গাপুজোর চারটে দিনে একার সঙ্গে একার খুশী.....
উত্ফুল্ল আলেখ্য ওর হাত ছাড়িয়ে লাফিয়ে উঠে বলল-
- চল দীপমৈ, দু’জনেই যাই। তুমি আর বাড়বে না আমিও না।
- কিন্তু মুস্কিল যে একটা আছে বাবা।
- কি?
- যদি বড় না হতাম, তবে তোকে কোথায় পেতাম? তেমনি তুইও থেমে গেলে অনেক কিছু মিস করবি সোনা। একই অবস্থায় থেকে বোর হতে-হতে একটা বিশ্রী দশা হবে।
- তা ঠিক, কিন্তু আমার ভাল লাগে না।
- ভাল লাগবে বাবা- আমি আছিনা, তোমার দীপমৈ। তুমি কথা শুনে চললে দেখবে বড় হওয়াটা কত সুন্দর।
প্রিয়দীপার কোলে মুখ গুঁজে আলেখ্য শুয়ে রইল অনেকক্ষণ। কেটে গেল বাকী সময়টা তারপর একসঙ্গে সিনেমা দেখে, খেয়ে, গান গেয়ে। দীপ্ত-বুবলী ফিরল নটায়। প্রিয়দীপা কোন ব্যাখ্যায় না গিয়ে শুধু বয়সের দাবী চাপিয়ে দীপ্তর নেটে ঢোকাকে পাশওয়ার্ড সিস্টেমের আওতায় আনল, তবে ছাড়ান।
শরীফ মেজাজে বাইপাশ দিয়ে ফিরছে প্রিয়দীপা, ড্রাইভিংটা আজকেও ভারী এনজয়েবল। গান বাজছে- সিলিন ডিয়ন। চোখে স্বপ্নের রেশ, মনে বিশ্বাস- লহনার চেয়ে ওর স্ক্র্যাপবুক বেটার হবেই। কেননা দূরের ঐ তারাটা আর সোনালী নয়, লালও নয়, রূপোলী প্লাবনের মধ্যে ঝকঝকে রূপোর মতন। প্রিয়দীপা হাত বাড়াল আকাশে।
গ্যারাজে গাড়ি তুলে পোষাক বদলে প্রিয়দীপা সোজা বিছানায়। স্ক্র্যাপবুক রেডী করতে হবে, লাল হার্টে রুপোর তারা চিপকাতে হবে, লহনার কাছে হারবে না কিছুতেই। দেখে নিয়েছে প্রিয়দীপা- হাওয়ায় সফলতার ঘ্রাণ নিয়ে জেতবার আভাস ছিল আকাশে।
Subscribe to: Posts (Atom)
ঈশানী, ঈশানী- পদ্মকুড়ানী
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
‘আজ পদ্মকথা কই। নষ্টকথা, নষ্ট-অনুভব, সারাটা জীবনে যে কত নষ্টদিন দিল, তাই
কাছেপিঠে ভাল কিছু পেলে এখন আঁকশী আঁকড়ে ঝটাস্ টেনে ধরি। যা লিখছি, তা নিকট
সময়সীমারই এক তাত্পর্য্যহীন ঘটনা... সাদামাটা। মধ্যে কোন অন্তর্নিহিত বাক্য নেই,
অন্যের মনোকেন্দ্রে বসবে এমন কোন নিশ্চয়তাও নেই। তবু অনুভবটি আমার কাছে স্বর্ণসুষমা
মাখা। ‘রংroute’ থেকে ‘বন্ধুকথা’ শিরোনামে লেখার আজ্ঞা পেয়ে তাই এটা নিয়েই বসলাম। না চাইতেই দুঃখ হাজির
হয়, আর সুখের বোধ? এলেও তাকে ঠিকঠাক নোটিশ করিনা বলেই বোধহয় অভিমানে সে যায়। সুযোগ
পেয়েছি যখন- অন্ততঃ ঘন্টাখানেকের জন্য তো সুধাধারায় অন্তর ধুয়ে যাক্।‘
হঠাত্
রান্নাঘর থেকে সিটির শব্দে চমকে সব ফেলে দৌড়ল
ঈশানী। লেখাটা কালই দিতে হবে- অথচ কুকারের ফাঁকে এখনই সময়ের লুকোচুরি খেলা। ক’দিন ধরে শুধু ভেবে গেছে। তারপর একদিনের মার্জিনে এসে কীভাবে সাজাবে, কত
শব্দসংখ্যায় ভাবতে-ভাবতে যেই বসেছিল, ব্যস্। নাঃ, এ’ভাবে
এগোবে না। গ্যাস অফ করে শান্তচিত্তে চেয়ারে এসে বসল ঈশানী।
‘...আমার মন কখনো ঈশ্বরমুখী ছিলনা এবং হোক্ যে সেটা চাইতামও
না। কিন্তু অচেতন, অহংকারী আমাকে
তিনি এমন নাড়া দিলেন, যে এতকালের পুরুষকারে বিশ্বাসী নাস্তিক আমি পপাতধরণীতল ও আজ আস্তিকস্য আস্তিক। যে যা বলে আমি তাই
করি, ভাল থাকার সোজা-বেঁকা রাস্তা ধরে হাঁটি, পেরোতে চাই
চড়াই-উতরাই-এঁদোগলি... ‘
ব্যস্, ‘এঁদোগলি‘-তে
এসেই ঈশানী খেই হারাল, নিজ জীবনছবি ভেসে উঠল মূহুর্তে। দিব্যানীর
ছলনা, অর্কপ্রভর বিশ্বাসহীনতা... থমকে গেল ও,
ইচ্ছাস্বত্ত্বেও লেখা এগোচ্ছে না।
যন্ত্রণার নীলবিষ আঁকড়ে ধরেছে হাত, মন ক্লান্ত, জ্বালা শরীর জুড়ে। এই এক বিপদ
আজকাল। আগে সাঁ-সাঁ লিখত আর এখন... চেতনার পরতে-পরতে কুগন্ধ এমন জড়িয়েছে, যে খাতা
নিয়ে বসলেই চোখে জল আসে, কষ্টকথা গলার কাছে বলের মত পাক খায়। পেন রেখে চেয়ারে
হেলান দিল ঈশানী, ভোমলা হয়ে বসে থাকল- কিছুটা নিশ্চেষ্ট সময় দিল নিজেকে। দেওয়ালে
তাকিয়ে-তাকিয়ে মাকড়সার মশা ধরার ছল-চাতুরী দেখতে-দেখতে স্থির করল- না, কষ্ট নয়-
কারুকে আর এককণাও রাজ করতে দেবেনা নিজের ওপর্। ছলনা থেকে মুখ ঘোরানোর একশো
প্রচেষ্টা এতদিনে কিছু দিয়েছে, সেদিকে ফেরা যাক। ঈশানী সচেতনভাবে অচেতনতার সাধনায়
গেল, এল সাম্প্রতিক ভাবনায়-
‘... তিনি যতদিন না চান, ততদিন
আমরা একটা পা-ও মাটিতে ফেলতে পারিনা- এ’ বিশ্বাস মনে জড়িয়ে গেছে আস্টেপৃষ্ঠে। এটা বুঝেছি যে-
যা যখন হবার তাই-ই তখন হয়, আমি শুধু চেষ্টা করে য়েতে পারি। য়েমন হালের ঘটনাটি- যা
সাম্প্রতিক ও এই সময়কালের প্রযুক্তি দুনিয়ার সঙ্গে জড়িয়ে। ইন্টারনেটে বেশ কিছুদিন
একজন মানুষ, নাম কান্তি (যার প্রোফাইল পিকচার রাধাকৃষ্ণের) ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট
পাঠিয়েই যাচ্ছিল আর আমি ইগনোর করছিলাম। আরে আস্তিক মানে যে আমি ঈশ্বরে মজে আছি তা নয়।
আমার এখন নিজের দিকে মন। লিখছি- লোকে পড়ুক, আঁকছি- জনেজনে জানুক, সমমনস্কের সঙ্গে
দু’-পাঁচটা মনলোভানো কথা কই- ব্যস, এ’টুকুই এলোঝেলো ইচ্ছে। তা’ছাড়া আরো কিছু হয়তো ভাবছিলাম...
মোটকথা ইচ্ছে ছিল না। সবসময় সীমার মধ্যে রাখতে চেয়েছি যোগাযোগ, হলেই বা তা
স্ক্র্যাপ। আমি অল্প হলেও চিনি নিজেকে। ঐ ‘খাজা খাচ্ছি এবার
গজা টেরাই করব’- বাক্যে আমার মন ওঠে না। তাই সঠিক জনকে
খোঁজা, তাই দেখেও না দেখা চুপচাপ থাকা। যোগাযোগ খালি বাড়িয়ে যাব আর পালন হবে না-
এ’ চাইনি, চাইওনা। অথচ কান্তির কিন্তু ক্লান্তি ছিল না যোগাযোগের
নানান ধাঁচকে কাছে টেনে মনোযোগে আসবার। অবশেষে তাঁকে এড়াতে লিখলাম- ‘তোমার নাম কান্তি, অথচ কান্তশ্রীকে আড়ালে রেখেছ কেন ভাই? তোমার ফ্রেন্ডলিস্টে দেখেছি 363-টি মানুষ। তারমানে বন্ধু ধনে তুমি ধনী... আরো কেন? আমি বাড়ানোর ব্যাপারে খুব হিসেবী। যাতে
স্বীকৃতি দেবার পর ‘বন্ধু’ শব্দের
মর্যাদা দিতে পারি, দায়বদ্ধতা সামলে চলতে পারি কিনা তা দেখি। তাই দ্বিধা, তাই অপেক্ষায় রাখা। তোমার সঙ্গে এমন
আপাত অমিল মানুষের বন্ধুত্ব…‘ ইত্যাদি-প্রভৃতি গা-বাঁচানো, পাশ-কাটানো ফুলঝুরি কথার মারপ্যাঁচ…‘
ঈশানী মনোযোগ দিয়ে লেখায় ছিল, হঠাত্ই এজেন্টের ফোন- ‘এলআইসি-র
চেকটা দিতে হবে ম্যাম, ওটা জমা দেবার আজই লাস্ট ডেট।‘ সব ফেলে ধড়ফড়িয়ে উঠতে হল। চেকবইতে দেখল- দিন পনেরো আগেই ওটা দিয়েছে।
অর্কর অফিসের থার্ড ফ্লোরে এজেন্টের অফিস- অর্ককে দিয়েই পাঠিয়েছিল। তাহলে কি দেয়নি? বুঝে নিতে পাশবুক খুলে অবাক। ঐ এ্যামাউন্টের কোন ডেবিট রেকর্ড নেই।
একে অর্ক-র অবিশ্বস্ততায় ফেঁসে ঈশানী মৃতপ্রায়, তায় ব্যবহারিক ক্ষেত্রগুলোতেও যদি... অথচ স্বার্থসংশ্লিষ্ট বাকি
কিছুতে তো ভুল হয়না অর্কর? জানে ঈশানী, দিনের আলোর মতন আজ সবটা স্পষ্ট। দিব্যানীও ফোন করা বন্ধ করেছে কেন তা কি বোঝে না? আসলে
যবে থেকে ও...
ওফফ্ না। ঈশানী বিপর্যস্ত হচ্ছে, মন ফের ছায়াপথে। দুঃখের
লন্ঠন ঝুলিয়ে সম্পর্কের ঘরে এখনও কীসের খোঁজ?
কি পেতে চায়? যা যায় তা কি ফেরে? পচাগন্ধ উড়ছে হাওয়ায়- মর্গ থেকে মন বাইরে আনা
চাই। কত মেপেজুপে নিজেকে সুখে নিতে চাইছে, অথচ ক্রমাগত চ্যালেঞ্জে ফেলে লোফালুফি
খেলছে ভবিতব্য। না, হারতে দেবে না ঈশানী নিজেকে নিজের কাছে আর। দেখতে-দেখতে বেলা
গেল, বিকেলের পড়ন্ত রোদে- সরলতার সহজ সোজা রঙ। ফেলে আসা খাতাটা টানছে আবার।
‘...পরে একসময় কান্তিকে লেখা নিজের স্ক্রাপ পড়তে গিয়ে
ভাবছি, ঠিক এই লেখা আমি পেলে কি করতাম? আপাত সরলতার সহজপাঠ হাতে ধরা আত্মম্ভরী মানুষকে ফের
লিখতাম? সন্দেহ। কিন্তু ক্লান্তিবিহীন কান্তি জানে মিথ্যে ‘অহং’-এর ফুটো সারানো না হলে একজাহাজ প্রাপ্তিও সে ফাঁক গলে যায়। পেতে তাকে হবেই- যা
সে চায়। তা রাজৈশ্বর্য্য
হোক কিংবা বায়বীয় বন্ধুত্ব। পজিটিভ, পজিটিভ। একেই বলে পজিটিভ ভাবনার পজিটিভ দূর্বার জন। আমার স্ক্রাপ পেতেই হাওয়ায় যেই উড়েছে
সংযোগী আঘ্রাণ, আর রোখা যায়? তীব্র এ্যাপ্রোচ নিয়ে আগ্রসী
কান্তি এল তত্ক্ষণাত্।
‘-tumi ekbar add korey dekho ami jogajog rakhtey
pari kina --- i think i shall be able to become good freind of yours. request give a trial.’
ট্রায়াল? আমি কে এমন যে ট্রায়ালে রেখে গ্রহণে নেব? হা ঈশ্বর, কিছুতেই এর অপমান বোধ নেই!!!! হারিপারি আমি শেষে এ্যাকসেপ্ট
করলাম। ভাবলাম- মনোমত না হলে আপনিই সব যায় আর এ’ তো
আত্মশ্রীহীন অবোধ।’
: মা, আমি বেড়োলাম। ফিরতে দেরী হলে ভেবোনা।বাবার সঙ্গে যোগাযোগ করে রাতে গাড়িতে ফিরবো।
হেঁকে-ডেকে প্রবুদ্ধ বেড়িয়ে গেল ঈশানীর সব
ছন্দটুকু ছিঁড়ে নিয়ে। মন চিন্তায় ডুবল- কোথায়, কোথায় রে ছেলে... বলে গেলি না তো?
সবে পনেরোর পানপাতা তুই। কত রেখে-ঢেকে আড়াল টেনে এই অবধি আনলাম, আর এখন কিনা...
ঈশানী দৌড়তে-দৌড়তে বারান্দায় গেল। রাস্তার বাঁকে ‘পূব’-এর ঝোলানো লালরঙা ব্যাগের অবশেষটুকু নজরে এল- তা বাদে ও মিলিয়ে গেল টু্প্
করে। ঈশানী ঘরে ফিরল, অন্যমনস্কতার মধ্যেই লিখতে শুরু করল।
‘... এবার চক্ষু কপালে তোলার পালা আমার। দু’-একদিনের মধ্যেই বুঝে
গেছি ভদ্রলোক বয়ঃজ্যেষ্ঠ। খারাপ লাগলেও কিচ্ছু করার নেই- হাতের তীর বাইরে। তিনি বন্ধু
স্বীকৃতি পেতেই ঘুরে এলেন আমার ব্লগ(যা কেঁদে-ককিয়েও কারুকে নিতে পারিনা)। তাঁর কম্প্যুটার বাংলা পড়তে পারেনা,
অসীম ধৈর্য্যে তিনি ‘কম্প্যু’কে বাংলায়
নিলেন, লেখা পড়লেন, আমার হেঁজিপেঁজী আঁকাআঁকির প্রদর্শনী ভিডিও দেখলেন ও নিজের
ঘরের ফেভারিট লিস্টে সে’সবের লিংক রাখলেন। এ’ বাবদে আমি খুশী হতেই পারি, হচ্ছিলামও। স্বার্থসুখে টলোমলো, আত্মগরিমায়
উঁচু বুকের ছাতি নিয়ে- চোখের কোণে তাকানো কি না কি করেছি এমন অনুকম্পা-টম্পা ভাব। স্ক্রাপ বিনিময়ের মধ্যেই একসময় ওঁনারও ব্লগ-বিলাস কথা জানালেন। দয়া-দাক্ষিণ্যের সময়
খুঁজে নিয়ে অতঃপর পৌঁছন গেল ব্লগে। কি বলব- মানুষটার জ্ঞানের পরিধি, কর্মকুশলতা,
জীবনদর্শন ও বিশ্ব ঘুরে নিজেকে সময়ের মাপে আপগ্রেডেশনে রাখা ধরণ দেখে আমি থ। প্রথমে
য়ে ‘কান্তি’ ডাকে ছিলাম,
এবার লজ্জায় মরতে-মরতে তাকে ‘দাদা’-য়
নিতে হল। এই অবধি এসে ক্ষান্ত দিলেও হত- আসলে থোঁতা নাক ভোঁতা হবার তখনও যে বাকী-
পুলটিস দেওয়া বুকে আমার অহম্ স্রোতের তোলপাড়। পোকা মারতে হবেনা?
একদিন
মেলবক্স খুলে দেখি ওঁনার আরেক রিকোয়েস্ট পড়ে আছে নিশ্চুপ। উনি নেশায় এ্যস্ট্রোলজার,
আমার বার্থডেট জেনে বুঝতে চান কেন আমি আর্ট-এর পরিধিতেই ঘুরেফিরে মজা পাই,
স্পেশালিটি কোথায়। তো দিলাম ও দু’দিনের
মধ্যেই উনি দ্বিধাহীন স্পষ্টতায় অর্কর মনোভঙ্গী, আমার মনোজগতে অর্কর অবস্থান, আসছে
যে আগামী তা পালকদিন না পল্কা বা প্রবুদ্ধর বিষয়ে এমন আলো ফেললেন, যে আমার বিশ্বাস
বসতে বাধ্য হল ভবিতব্যের অস্তিত্বকথায়। তবু তাঁর দান তখনও বাকী। সুস্থ জীবনের
সাফল্য কামনা করে ও চৈতন্যবোধে ঋদ্ধ হয়ে উঠতে এবার একটা মন্ত্র লিংক পাঠালেন- যার
উচ্চারণে উচাটন কমবে, স্থিতি আসবে জীবনে। অথচ কী আশ্চর্য্য... কোনো কিছু
প্রাপ্তিহীন, চাহিদাহীন, উদ্দেশ্যহীন শুধুমুধু- খালি স্নেহ-স্নেহ
হাসি-ঠাট্টা-খেলায়।‘
ব্যস্,
লেখা ফের মাথায় উঠল। হৈ-চৈ করে বাদ্যি-কাঁসি বাজিয়ে হাজির হল বিনতা, রুদ্র, সঙ্গে
দু’টি কচি। আহা, কি টইটুম্বুর বোধ। সেই
ছোট্টবেলাটা লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ঈশানীর কোলে এসে উঠেছে। সেই স্কুল জীবনের বিনতা-রুদ্র,
সেই পাগল সময়ের অযথা খুশী, কাড়াকাড়ির আমের-আচার... ঈশানী ভুলে গেল কালই দিতে হবে
লেখাটা। মন এখন কানের কাছে অন্যকথা বলছে- বলছে উবজে আসা প্রাপ্তিটুকু আগে গুছিয়ে
তোল্, চকিত আসা সুখের দোরে থাক্।
বিনতা-রুদ্রর
ছুটকো দুটোর সঙ্গে সারা সন্ধ্যে ঈশানী যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলে, কার্টুন দেখে কাটালো আর
ওরা সামলালো রাতের রান্না। সঙ্গে এনেছিল প্যাকড্ ফুড- মাইক্রোওয়েভে শুধু গরম আর
পরিবেশনা। এ’রকম উড়ে এসে জুড়ে বসা, মাপা সময়কে
কেড়ে নেওয়া সময়েও যে এত জ্যোত্স্না ছিল, জানা ছিল না ঈশানীর। যেমন করে জানা ছিল
না- জ্যোত্স্না তালিকায় এন্ট্রি নিতে চাওয়া কান্তিদাদার সহায়ক ভঙ্গীর
ইচ্ছে-খুশী-কথা। কান্তি মনে পড়তেই স্টাডিরুমে এল ঈশানী। অর্ক, প্রবুদ্ধ ঘুমে
অচেতন্। রাত অনেক। ঈশানী আলো জ্বালল ডেস্কের-
‘... এবার খটমট মন্ত্র নিয়ে আমি বেশ নাকাল। একে সংস্কৃত তায় রোমান হরফে লেখা। অডিও-ভিডিও লিংক থাকলেও বাক্যে হাজার ধোঁয়াশা। যখন
হাল ছাড়ার উপক্রম, তখন মেল-এ দেখি সেই মন্ত্রপাতা উড়ে এসে জুড়ে বসেছে ঘর আলো
করে... গা এলিয়ে, পা ছড়িয়ে- আহ্লাদী প্রশ্রয়কথার মত। আর কি, দেবনাগরী হরফ পেয়ে
গেছি, এবার উচ্চারণকে আয়ত্বে নিয়ে শরীরে-মনে জারিত করতে থাকলাম। কেন য়ে এটা
দেবভাযা, তার আন্দাজ পেয়ে গেলাম আবৃত্তি করতে গিয়ে। গভীরতম বাক্যে মন জুড়তেই
ভাষাও শিকড় ছুঁয়ে গভীরে নিল আমায়- স্থির-ধীর-আনন্দস্বরূপে। আমার কিছু হোক বা না
হোক্- এটা অনুভব করলাম, যে উচ্চারণের সঙ্গে যখন থাকছি তখন পারিপার্শ্বে ঘন্টাধ্বনি
শুনছি, ধূপের গন্ধ উড়ছে হাওয়ায়। কি প্রশান্তি, কি আনন্দ-আবিষ্ট ভাব, কি মন-ভাল-করে-দেওয়া অবস্থার ঘেরাটোপে
জড়িয়ে যাচ্ছি
তা বলার নয়। আবৃত্তিতে সুর বেঁধেছি আমার চেনা হিসেব দিয়ে, যা আরো মনোহারী করেছে
মন্ত্রকে। এখন আমি হরিণ, এখন আমি ফড়িং, হাল্কা হাওয়ায় উডে- দিব্যি দু’বেলা
মন্ত্রআবেশে মস্ত্। অথচ ঐ মৃণালকান্তি মানুষটা কোথায় যেন গেল। আমার অহংবিষ তরল
হতেই তিনি আনমনা, নির্বিকার। অত ডাকেন না, আসেনও না। হয়তো অন্য বন্ধু খোঁজে! মনভরা পজিটিভ এনার্জি নিয়ে বিলোতে বেড়িযেছেন সর্বধর্মজনে। বন্ধুজনের হাতে মৃণাল তুলে না দেওয়া অবধি স্বস্তি নেই।
মানুষের মনের বাঁকাচোরা নষ্ট অলিগলির- অলিখিত, স্ব-নিয়োজিত সাফ-সুতরো-জন। ওঁনার
কাছে শিখলাম- অহংকার শব্দটা কত ফাঁপা, কতখানি আত্মবিধ্বংসী।
মৃণালকান্তির সঙ্গে সংযোগ তৈরী হতেই পজিটিভ ভাইব্রেশনের আওতায় এসে পড়েছিলাম। ঠিক এ’ কারণেই না-বোঝা কত কথা স্পষ্ট হল, অন্তরগহনের গুদামঘরে চিলতে মাপের আলো এলেও এলো। আমি বুঝি... সব বুঝি। কিন্থু জীবনচর্চায় তার ইম্লিমেন্টেশন? হয়নি-
আজও হলনা। হযতো কখনো হবে!
সেই চেষ্টাতেই মন্ত্র-উচ্চারণ দিয়ে ধুচ্ছি
আপন বোধ, ফুটোবুকের অহংকার। বয়সকে জব্দ করতে পারা নিঃস্বার্থ মৃণালকান্তি, অহংকার
অসুরকে বন্দীত্বে রাখা ‘শ্রী’যুক্ত মৃণালকান্তি, ‘বন্ধুত্ব’
শব্দকে সম্মানে নেওয়া নিরভিমান মৃণালকান্তি বেশ আছেন নিজপুরে অন্যরকম মস্ত্। তবে? কে বলেছে পৃথিবী শুধুই স্বার্থজনে ভরা? এমন কান্ত মানুষ
আছেন বলেই না শ্রান্ত পৃথিবীতেও পদ্মগন্ধ ওড়ে, আজও মৃণাল ফোটে।‘
এই প্রথম আত্মবাচনিক ভঙ্গীমায় ঈশানী প্রথমপুরুষে লিখল। উপায় ছিলনা, পত্রিকার
দেওয়া থিমের দাবী মেনে মৃণালকান্তি আপনি উঠে এলেন। এতো সাজানো কলকাকলী নয়- ঘটনা... বাদ দেওয়া যায়না। লেখা শেষে তাই পূণ্যজলে স্নান সেরে ওঠার
পবিত্র অনুভব, সত্যি-সত্যি হাওয়ায় যেন পদ্মফুলের সৌরভ। ঈশানী শান্ত এখন, পরিতৃপ্ত,
ক্ষমাময়। রাত ধীরে ভোরের কাছে এসে পৌঁচেছে, চারটে বাজল বোধহয়।
সকালেই অর্কর ফ্লাইট, প্রবুদ্ধর পড়তে যাওয়া, নিজের স্কুল সামলে সারাদিনের
জন্য তারপর কত কি- তবু... এতকিছুর পরেও মনে প্রশান্তির রেশ। বেশ কিছুদিন ঈশানী নেতিকথা, ব্যথা, বিচ্ছ্বিন্নতা ছাড়া লিখতে
পারছিল না। আজ এই সুখী
স্বীকারোক্তি দুঃখকথার আড়মোড়া ভেঙে নতুন দিশায় নিল্।
যাকে ও ভালবেসেছিল, সে যে কেন অন্য কারুকে... সেই অন্যকেউ যে কেন ফের অন্য
কারুর প্রতি... এ’ ধাঁধার
উত্তর নেই। ঈশানী শুধু বোঝে, যাকে ও যতটা ভালবেসেছিল সে যদি ততটাই ফিরিয়ে দিত তবে ‘আঁধার’ বলে কিছু থাকতো না। যে এনার্জী তৈরী হত, তা দিয়ে মানুষ ইচ্ছেডানায়
চড়ে বেহেস্ত আনত ধরায়। ঐ অচেনা সহজ-জনের একটুকরো বন্ধুত্বেরই যদি এত জোর, তবে...
ভোর অবধি জেগে আছে ঈশানী- গোটা রাতটা চোখের ওপর দিয়ে হেঁটে গেল। পর্দা সরিয়ে জানলায় এসে দাঁড়িয়েছে, ক্রমশঃ আকাশের কালো মুছে
আলোর আভাস। সুরেলা, শান্ত আবহে দূর থেকে ভেসে আসছে আজানের ধ্বনি। অন্যমনস্ক মনে হল- এ সুর ওর চেনা, খুব চেনা। এটাই প্রাণে
বেজেছে এতদিন, রোজরোজ বুকের মধ্যে সূর্য্য এঁকেছে। একান্তের এই ধ্বনি শুধু ওরই
ধ্যানের...
অবচেতনের
তীব্র আবেগ থেকে মন্ত্র উঠে এল উচ্চারণে আর অনুরণন তার সাক্ষর রেখে গেল চেতনায়।
একই সুর, একই ভঙ্গী নিয়ে দু’ধারের
দুই প্রকাশ কি করে মিলেমিশে গিয়েছিল? অসাক্ষাতে, অসচেতন
অভ্যাসে, নাকি ঈশানী ধীরে উত্তোরিত হয়েছিল বোধীর স্তরে! ঘটনাটা আবিষ্কার করে চমকে
গেল ও। অস্পষ্ট
আলো-আঁধারী বিভার মধ্যে দাঁড়িয়ে, চেনা শব্দ-সুরের অনুষঙ্গে ঈশানী আবৃত্তি করতে
থাকল- ‘ওম্
ত্র্যযম্বকম যজামহে, সুগন্ধিম পুষ্টিবর্ধনম্... ‘
10 comments:
এটা উল্টে লিখেলে বেটার হত না? যেমন-
:: একটী ছেলে একটী মেয়েকে প্রপোজ করল্।
:: মেয়েটি রিফিউজ করল্।
:: তারপর ছেলেটি বাকি জীবন সুখে বাঁচল, আনন্দে কাল কাটালো।
একটু অন্যরকম করে......।
'''' একটি মেয়েকে কেউ কোনোদিন প্রপোজ ই করলনা।
'''' মেয়েটা সুখী হল... সারাজীবন...
'''' কোনোদিন তার কোনও স্বপ্ন ভঙ্গ হয়নি.....
নাঃ, তোমাদের দু'জনের ভাবনাতেই কোনো গোলমাল নেই বরং ইন্দিরারটা তো বে----শ বেশ। তবু উস্কে দেওয়ার জন্য, তোমাদের এই রাস্তায় ভাবনা যাবার জন্য ভাই আমি আমাকেই দেব পিঠ চাপড়নী। সমঝা?
bah re!!!!!!!!!!! nijei nijer pith chapracchhe...
ঈশানীর গল্প খুব সুন্দর।খুবই মিনিংফুল লেখা।এ লেখার মধ্যে পাঠকের মনভরানোর চেষ্টা নেই, পাঠকের মন-ভাবানোর চেষ্টা রয়েছে।এমন লেখাই দরকার শেষপর্যন্ত।
দলছুট পড়লাম।অসাধারন লিখেছো।কি ভীষন নিষ্ঠুর সত্য।
অতনু, তোমায় পাঠক হিসেব পেয়ে খুব ভাল লাগল ভাই। তবে অপেক্ষায় আছি... কবে তোমার শ্রীহস্তের এককপি লেখা পাবে মনফসল।
পূর্ণপ্রজ্ঞা পড়লাম মঞ্জুদি।অসাধারন। দুটো মানুষের মনের কথাগুলো খুঁড়ে দেখালে একেবারে...
অতনু, হঠাত্ এই ভাবনারই প্রকাশ দেখলাম তোমার ফেসবুকের লেখায়... কেন? অন্যভাবে কেন ভাবলে না? তুমি তো দারুণ ভাবুক... তবে? আমি যে এ'গল্প পত্রিকায় পাবলিশড্ হতে পাঠিয়ে দিয়েছি ভাই... তখন? কি হবে?
এটা ফেসবুকে লিখবো না বলেই নিজের ঘরে এসে লিখলাম... যদি পথ ভুলে কখনো আসো... আমি না বলে পারলাম না অতনু...
Post a Comment