Saturday 28 February 2015

মনমোহিনী ‘সৌলা’, মনভূমে তুই রইলা

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

2015 ফেব্রুয়ারী সংখ্যায় 'দু-কূল'-এ প্রকাশিত লেখা। 28.02.15



আকাশে মেঘছেঁড়া ফুটি ফুটি আলো, সৌলা আড়মোড়া ভেঙে দূর সমুদ্রের ধোঁয়া-ধোঁয়া ছায়া দ্যাখে কুয়াশার। সূর্য্য উঠতেই ঘোমটা ফেলে চোখ তুলে সে তাকিয়েছে যেই আমি চমকে গেছি। সারি দিয়ে চলা লাল কাঁকড়ার সারি, লাখে-হাজারে ঝিনুক, চলন্ত তারামাছ আর ভরন্ত ঠেউ-এর দোলায় দুলছে চুমকী জ্বলা আগুন ফেনার রাশি।

কিন্তু এসবে আসব পরে, যেখান দিয়ে ছাড়া সৌলা যাওযা যাবেনা আগে সেটায় আসি। বাঙালীর চির পরিচিত দী-পু-দা মানে দীঘা, পুরী, দার্জিলিং-এর মধ্যে কবে যেন স্যুট করে সেঁধিয়ে গেল... না, বলা যাবেনা- নাম শুনে যদি অনিচ্ছে রোগে ধরে! সাদা-রঙের বাইরের পৃথিবীকে দেখতে চাই বলেই ভিতর-রঙের ডেট এক্সপায়ার হতে দিইনি- তাই খুঁজে পেয়েছি সৌলা। তবু প্রাথমিকভাবে ইচ্ছে ছিলনা যাবার। এত চেনা জায়গা মাড়িয়ে যেতে হবে... সত্যি যদি পাড়ার দীপুদা ডেকে ওঠে- মঞ্জু--- তখন? যে নাগরিক পরিচয় খুলে রাখতে চাই বলে পালাই সেখানেও দীপুদা? অথচ নাম ধ্বনিতে জায়গাটি এত মোহময়ী যে এড়ানো মুশকিল। অতঃপর ইচ্ছে অনিচ্ছেকে নিয়ে টস্ করলাম। মোহময়ীর আদ্যাক্ষরকে দী-পু-দা-র ফ্রেমে ফেলে খুঁজতে থাকলাম পরিচিত নাম। কি আছে, মিলে গেলে যাবোনা। প্লেসড হল- দী-পু--দা, পু--দী-দা বা -দী-পু-দা হয়ে। নাঃ চেনা নাম নেই, এমন কি কোন নামও তৈরী হলনা। মন বললো এটাই নির্দেশ, কোনো পরিচয় কাঁটায় বিঁধবে না তোর উধাও হবার ইচ্ছে। সুতরাং...

 এই তো বোঝা গেছে আমি মন্দারমণি মাড়িয়ে সৌলা যাচ্ছি। এখনো অধরা এ রূপোময়ী যে সারল্যে আছে- তাকে এড়ানো কঠিন। তাবলে যে গেছে সেই জানে এ’ব্যাপার তা নয়। বরং যে গেছে তার দুর্গার মত তৃতীয় নয়ন ছিল, রূপের খনি খোঁজার ইচ্ছে ছিল আর ছিল ইতিবাচক মেদুর ভিজে মন- তবেই। অভিমানী কিনা... সেজেগুজে তার বসে থাকতে বয়েই গেছে। সবাই আসবে, চোখের কোণে চাইবে আর খেলা শেষে বালিতে বানানো ঘর ভেঙে অন্য ঠিকানায় উঠবে... না, এ হতে দেবেনা সে। তার ভূষণহীন আরণ্যক অবস্থিতি সম্মান দাবী করে। তবে এই মন্দারমণি আর বেশীদিন অধরা নয়। নাগরিক পাঠশালায় পড়তে পাঠিয়ে তাকে শীলিত করার ব্যবস্থা চলেছে।

ছুটি পেয়েছি দুদিনের তাই যাচ্ছি। এ্যালার্ম ক্লকে ভোর চারটের চীত্কার রেখে শুতে গেলাম, পরদিন হাঁপাতে-হাঁপাতে ধর্মতলা- দীঘার বাস সাড়ে পাঁচটায়। তখন হাল্কা শীতের আমেজ, মার্চের প্রথম সপ্তার প্রথম শনিবার। বেলা বাড়তেই রোদে চোখ কুঁচকানো ভুরু ব্যাথা করা তাপ। অথচ দ্বিতীয় হুগলী সেতু পেরোতেই থৈ-থৈ কুয়াশায় গাড়ীর দৃষ্টি গেল আটকে। সামনের উইন্ডশিল্ড আবছায়ায়- গতি কম নিয়েও ছুটছে। ফগ লাইট জ্বেলে, ইলেক্ট্রনিক হর্ন চেপে ধরে ড্রাইভারের আত্মবিশ্বাসী ড্রাইভিং ঠিক ঘন্টা চারেকে পৌঁছে দিল চাউলখোলা- দীঘার তিরিশ কিলোমিটার আগে। ব্যস, নেমে পড়লাম ব্যাগপত্র ও মনের উড়নতুবড়ি চুলবুলী নিয়ে। কিন্তু জায়গাটা দেখি নেহাত্ই বেরসিক এক বাণিজ্যপুর। এইদিকে তেলেভাজা ওইদিকে কয়লার গুদাম অন্যদিকে স্টেশনারী শপ, লিকার বার... মোটকথা হাবিজাবি দিশপাশে খাবি খাওয়া দশা। প্রায় সাথে-সাথেই সমুন্দুর-সমুন্দুর-সীবীচ-সীবীচ চিল্লিয়ে হাজির হল যত হাড় জিরজিরে মোটরভ্যান, কেঁদো কোয়ালিস, গেরস্থপোষ্য এ্যামবাসাডার থেকে স্লিম মারুতির চালক দল। তাদের অভিজ্ঞ চোখ আমাদের পাঁচন গেলা মুখোচ্ছবির ভাষা পড়ল আর মূহুর্তে অভয় দিল- এইখান দেইখ্যা দিদি ওইহানের কদাডা ভাইব্যান না। একবার তো পৌঁসান, দ্যাখবাননে মজাডা... মেলা-মেলা।  


মজা মেলা ছিল কিনা জানিনা- তবে ঝাউপাতা, বালিপথ, গ্রাম্য দিশপাশ এখনো সরলতা ছিঁড়ে নাগরিক তামারং মাখেনি মুখে। আলগা চটক তার শরীর জুড়ে ঠেউএর মতন অবিরাম। তার বালিয়ারী, তার বাইশ কিলোমিটার বিস্তৃত বীচ, এলাকার মানুষজনের আপনপুরকে অবুঝ চোখে দেখা, দাম বুঝতে না পারা জায়গায় হেলাফেলার মুক্ত ক্রিয়াকাজ, শক্তপোক্ত বীচ-এর ওপর দিয়ে হর্ন বাজিয়ে ছুটে চলা গাড়ি- মন্দারমণির সবটাই অন্য। সবটাই নম্র একদিকে অন্যদিকে কঠিন। সবটাই যেন কোলে তোলার ও দূরে ঠেলার মিশেল দিয়ে তৈরী এক অপাপবিদ্ধ ঢঙ্। এ ঢঙের সঙ্গে সোফাতে নয়, পাটী পেতে বসে মুড়ি কাঁচালঙ্কা ভাঁড়ের চায়ে অফুরান আড্ডার ধারাপাতে কেটে যাবে রোদালো বেলা। ইচ্ছে করে উধাও হতে একা, ঝাউবনের ফাঁক দিয়ে দূরে যেখানে মোহনায় নদী, নদীতে মাঝির খেয়া বাওয়া, মোটরভ্যানের ঝিমঝিম শব্দে চালক বৌ-এর খড়কুটোর দরজা ঠেলে লাজুক চোখের চাওয়া।


হোটেলগুলো কিন্তু সাজসজ্জা বৈভবে একে অন্যে টেক্কা দিচ্ছে। তকতকে, ঝাঁ-চকচকে বিলাসী- পরিপাটী। সমুদ্রস্নানের পর গা-কিড়কিড় বালী মুছে তনদুরস্ত হতে কোথাও বাথটাব, হাজারো ফিটিংস, বাহুল্যযুক্ত সাওয়ার, কোথাও আধুনিক জাকু্Zী টাবের গোপন আলাপন। কী নামে ডাকবো তোকে, দেখবো কী চোখে, কোন পরিচয়ে সাজতে ভালবাসলি তুই- মন্দারমণি? শ্যাওড়া গাছের পেত্নীরাণী বেনারসী পরেছিস না রূপসী ললনা তুই ছেঁড়া শাড়ীতেও উন্মুখ? জানিনা কোন উপমাটা ঠিকঠাক। তবে কামনার আগুন যেভাবে সাজিয়ে বসে আছিস তাতে পতঙ্গ হয়ে পুড়েছি আমি- পুড়বে আরো ঢের। তোকে ঘিরে সূর্যোদয়, সুর্য্যাস্ত, শনশন হাওয়া, ঝিনুক আর ঝাউবন বন্দনা গানে মাতাল। এ টান এড়ানো যায়না। যে গান গাইছিস্, সে সুর হ্যামলীনের বাঁশীওয়ালার কাছে শিখেছিস তাই মোহময়। দূরে ভেসে চলা ট্রলারের টিমটিমে আলোয় ঝাঁপানের ডাক, আরতির ঘন্টা বাজছে সন্ধ্যা নামলো যেই।

এত সৌখিনতা স্বত্ত্বেও ওখানে কারেন্ট নেই বলেই সন্ধ্যা নামতেই হোটেলে-হোটেলে জেনারেটরের গুঞ্জন। ঐ যে বললাম- এখানের সবটাই নম্র একদিকে তো অন্যদিকে কঠিন অপরিচয়। এই অপরিচয়কে, এই অচেনা কাঠিন্যকে মন্দারমণি ধীরে সরানোর চেষ্টায়। জানিনা তখনো এত মাধুরী থাকবে কিনা, তবে নিট্-ক্লিন-মেদহীনতা আরেক রকম রূপকথা শোনায়। আমার মত আবেগ চাপ বইতে-বইতে অম্বুলে পর্যটকই শুধু নয়- আছে চাঁদির নিক্তিতে সবকিছু মেপে সোহাগ করারও পাবলিক। তাদের জন্য কিছু রেখে-ঢেকে, একটুও না সেজে তুই দাঁড়াস যদি মন্দারমণি, তবে এটা জানি- আমি, সে ও সখা সব্বাইকে তুই খুশী দিবি। এই বসন্তেই বিদ্যুত দফতর সবুজ সিগন্যাল দিয়েছে, বীচের ওপর ইলেকট্রিকের খুঁটি পোঁতা সারা। বছর ঘোরার আগেই বাজবে আলোর দামামা। অন্ধকারে যে বীচ ছিল ভয়ে হাঁটার, তাতে বন্ধ হবে গাড়ীর চলাচল। মন্দারমণির সমস্ত মেঠো রাস্তা এবার কংক্রিটের চাদরে ঢাকা পড়ল বলে।


বীচের ওপর যেখানে হোটেল বা রিসোর্টের কেতা শেষ, সেখান থেকে শুরু হয়েছে স্থানীয় মানুষের ছেঁচাবেড়ার ঘর। সেখানে ওরা লোকশিল্পের নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে। এই চেষ্টার আন্তরিকতা খুব- সামর্থ্য কম। কোথাও কড়ির হার-দুল-বাজু, কোথাও মুক্তোর পসরা, দড়ির চটি, আয়না ঘিরে ঝিনুক গেঁথে ওয়াল হ্যাঙ্গিং, পর্দা, এ্যাসট্রে, শঙ্খ, এমন কী কাঁকড়ার খোলা দিয়েও ঘর-সাজানোর জিনিস। এখানকার এই সবকিছু দী-পু-দা তেও মেলে কিন্তু চিলতে হাসির ফাঁকে তা লুকনো ব্যাথার মত্। মনোযোগ তো কাড়েই না উপরন্তু বীচ জুড়ে রোলের দোকান, ফুচকা, ঝালমুড়ির বাড়বাড়ন্ত বিরক্তি তৈরী করে। যেন বেলাভূমি নয়, চড়েছি লোকাল ট্রেনে- ফেরি হচ্ছে সস্তার টিপ-চিরুণী-নরুণ- লেলে ছেআনা, ছেআনা, ছেআনা... ঐ দৈনতার পাশে মন্দারমণির বীচকে রেখে বুঝলাম ছেঁচাবেড়ার এই দোকানগুলো আছে বলেই মন্দারমণি ঊজ্জ্বল। একে প্রাকৃতিক ও গ্রামীন সৌকর্য্যের মিলিত উদ্ভাস বলা যায় অথবা কাব্য।


মন্দারমণি পৌঁছেই আমরা জলে নামলাম। তখন জোয়ার, ঠেউ-এর পিঠে ঠেউ। বড় ঠেউ এলে বসে যাচ্ছি আর ছোট ঠেউ নিয়ে চলেছে খুনসুটী। এসবে বেলা গেল, দুপুরের খাওয়া সেরে এবার হোটেলেরই আনাচ-কানাচে ঘুরে, ঝুপড়ীর ঝিনুক-মুক্তো কিনে বিকেলে গেলাম মোহনার দিকে। সেই ডিজেলচালিত মোটরভ্যান, সেই বীচের ওপর দিয়ে বাঁয়ে সমুদ্র ডানদিকে হোটেল-দোকান ফেলে এগোনো। বাইশ কি.মি বীচের ঠিক মাঝেখানের হোটেলে ছিলাম বলে আমাদের জার্নি ছিল এগারো কি.মি-এর আধখানায়। যেতে-যেতে দৃষ্টিসীমার দূরে সরে গেল হোটেল-দোকান-রঙমহল- এবার নিবিড় প্রকৃতি, উল্টে থাকা ডিঙি নৌকা, নীলচে জাল ও ঝাউবনের সঙ্গ। এও শেষ হল, এসে পৌঁছলাম নীল সমুদ্র আর অস্ত সূর্য্যে রাঙা নদীর মোহনায়্। ফুরফুরে হাওয়ায় জলে হাল্কা কাঁপন, অতি স্নিগ্ধ ঠেউ। প্রকৃতির এই অসামান্যতা এত প্রভাবী যে ব্যাখাতীত বেদনার মত বেজেছে, বর্ণনা তাই সম্ভব হল না- মন ঈশ্বরে গেল। এ অনুভবে যেতে গেলে আসতেই হবে এখানে।

নদীতে বহমানতা থাকলেও কোথাও কাদাজল কোথায় শুকনো-শুন্য ঢিবি। ছেঁড়া-ছেঁড়া সেই কিছু জল আর ভাঙা-ডাঙা দূরের দ্বীপ দেখিয়ে ভ্যানওয়ালা বলল-
- হোইডা তাজপুর গ দিদি। যাতি হলে কাল সকাল-সকাল আইসো, লৌকা পারাইয়া দেইখ্যা আসবা।
 হাঁকপাঁক করে বলি-
- তা কাল কেন? আজই দেখ না, ঐ তো নৌকা যায়।
- নাই গ... বোঝো না কেনে। নৌগাডা হুইপাড়ে বান্ধা- জলের কাঁপনে দুলতিসে। তাশাড়া অহন ভাঁটা...
- কিন্তু তুমি যে বললে কাল সৌলা নিয়ে যাবে?
- হেইডা বাসনা অইলে যাইয়ো। আসলে উদিকে কাদা আর কাঁকড়া ছাড়া জেইল্যা ছাওলের ঝাউ-ছাউনীর ঘর। হুটেল-উটেল নাই দেইখ্যা মানষে যাতি চায় না। আর হুইপারে যে তাজপুর, হোথায় সব্বস্ব আচে গ দিদি। একখান কী সোন্দর হুটেল হইছে। উআরা খেলার মাঠ বানায়ে দিছে, সিলিপ. খাবার দু’কান... মানষে জলে নাইম্যাও কিসব নিয়া খেলে গ।


আমি বললাম- ভাল তো, তবু সৌলাই যাব।
পরদিন ভোর হতেই ভ্যানওয়ালা হাজির। আমরা চললাম বাকী এগারো কিলোমিটার দূরের অন্যদিকের মোহনায়। এ পথে গাড়ির যাওয়া-আসা নেই, মোটরভ্যানও নয়- তাই পথ চলার শুরু থেকেই সবটা অনাঘ্রাত সৌরভের মত। দী-পু-দার রোল-চাউমিনময় পরিবেশ দেখেও যাদের প্রীতি কমেনি বরং বেড়েছে, তাদের ওপথ ভাললাগার নয়। এমনিতেও কেউ আসেনা। পূর্বদিকে সূর্য্য ওঠার তোড়জোড় চলেছে আর আমরা আলো-আঁধারী ডিঙিয়ে ভিজে বালী মাড়িয়ে, মোটরভ্যানের বসে যেতে চাওয়া চাকাকে ইঞ্জিন শক্তিতে এড়িয়ে- পৌঁছে গেলাম সৌলা। এখানকার বর্ণনা কীভাবে দেব জানিনা- এই অপরূপকে বাক্যে বাঁধা আমার সাধ্যের অতীত। যতদূর চোখ যায় শুধু ঝিনুক আর কাঁকড়া। নদী, নৌকা, কুয়াশা, সূর্য্য সব মিলিয়ে আমরা স্পষ্টতঃই স্তব্ধবাক। ঝিনুকের পরিমাণ এত বিপুল যে বালীতে দুহাতের বেড় ছোট করে আনতে থাকলে কম করেও দেড়শো ঝিনুক আঁটছে। বেশীরভাগই জ্যান্ত ও আনকমন। এই বাহুল্য অস্বস্তিদায়ক ও বাহারকে বিপদে বদলাচ্ছে। কেননা হাঁটা-চলা দায়, কখন যে পা কাটে। ললনার কালো চুলে একটি-দুটি তারাফুলে যে রূপ ফোটে সেই বাহার কি চুল ঢেকে দেওয়া লক্ষ ফুলে ফোটে? লক্ষ্যের চেয়ে উপলক্ষ্য বড় হয়ে উঠে ম্যাসাকার কান্ড। তবে স্বস্তির কথা এই যে একটু বেলা বাড়তেই দু-পাঁচজন জেলে-জেলেনী এল ও নদীতে জাল ফেলার পাশাপাশি ঝিনুক কুড়িয়ে বস্তায় ভরতে থাকল। জিজ্ঞেস করলাম-   
- সব দিয়ে কি হবে গো?
- ব্যাচবো।
- কোথায়?
- হাটে।
- কবে হাটবার?
- বুধবার।
ইস্, এটাও একটা মিস্, আমরা তার আগেই ফিরব।

ওদিকে কাছে-দুরে লক্ষ-কোটি কাঁকড়া দৌড়ে চলেছে, কেউ গর্তে নয়- সব পাড়ি দিচ্ছে সমুদ্রে। এ এক অভুতপূর্ব দৃশ্য। সোনালী বালী, কাঁকড়া আর তাদের গতির মিলমিশে বালিয়ারীর রং গোলাপী। অথচ আলস্য মেখে কাঁকড়াকুল যেখানে রোদে বসে সেখানটা কৃষ্ণচূড়ার পাপড়ি ছড়ানো লাগছে- বেলাভুমির আদি-অন্ত একবারে লালে লাল। এক ঝিনুককুড়ুনীকে বললাম-
- কাঁকড়াগুলো ধরছো না যে... 
- নাই গ।
- কেন?
- কংকডাগুলান সমুনদ্দুরের শভা।
- তা শোভা তো আরো অনেক কিছুই, সেগুলো যে ধরো।
- তি পারবো না দিদি। সেই ছুট থিকা শুইন্যা আলাম, বাপ-দাদারা কলো... তাই তোমারেও কলাম।
কি সুন্দর বিশ্বাসের সমর্পণ। তারা যা শিখিয়েছে সেই মত প্রজন্ম চলছে বলেই না ভারসাম্য প্রকৃতিতে। কাঁকড়ারা কেন নির্ভয় তার আন্দাজ পেলাম। জেলেরা এলে-গেলেও তাদের সঙ্গে বিরোধের আভাসমাত্র নেই- যে যার কাজে ব্যস্ত। শেখবার মত সহাবস্থানে প্রকৃতি, মানুষ ও প্রাণী। কাঁকড়ার লালাভ মিছিল শুধু চোখ চেয়ে দেখবার, ব্যাখ্যা করে সে সৌন্দর্যের কাছে পৌঁছনোর চেষ্টা বাতুলতা। গায়ে-গায়ে জড়ামড়ি ঝিনুক, কড়ি, অগোছালো ঝাউবন, নদীতে বয়ে চলা খেয়া-নৌক- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি‍! তখন জোয়ার আসছে- ধীরে হাওয়া বইতে শুরু করল, তিরতিরে ঠেউ জানান দিচ্ছে জল বাড়ছে, জেলেনীরা গেল। সৌলাভূমির রূপে মজে আমরা শৈশবে পৌঁছে গিয়েছিলাম। কাদা-বালী মেখে, ভিডিওতে ছবি তুলে সময়ের হিসেবে দেখি বেলা বেশ। মোটরভ্যানের সওয়ার হলাম ও চেনা চৌহদ্দির হোটেলপুরে ফিরে এলাম। 


এখানে স্থানীয় মানুষজনের গরিব অবস্থাকে ব্যবসায়ীরা অনুকম্পার মুল্যে কিনেছে। শুধু তাই নয়, জায়গার সম্ভাব্য পরিণতি চিনিয়েছে টাকার রঙে। তাদের চাষের জমি ছিল বীচের ওপর- এখন হোটেল। অবশ্য স্মৃতি ছুঁয়ে থাকা বিঘেখানেক জায়গাও কিছু নজরে এল যেখানে সব্জি চারা, লাউমাচা বা কাকতাড়ুয়ায় মিলে বিপ্লবী সবুজ ক্ষেত। তবে নগরায়নের যে ব্যস্ততা দেখলাম, গরবিনীর সবুজ চোখে সুর্মা পড়ল বলে। যেমন জোয়ার এলে জলে যখন বীচ টইটুম্বুর, সারি-সারি হোটেলের কোল দিয়ে তখন না চলতে পারে ভ্যান, না গাড়ী, না মোটরবাইক। ইতিমধ্যে পর্যটক এসে পড়ল তো সর্বনাশের মাথায় পা। থাকো বসে দু/তিন ঘন্টা... ভাঁটার টানে জল নামুক, তবে যাত্রার কথা ভাবা। ওদিকে মাথার ওপর তখন হয়তো চাঁদিফাটা রোদ্দুর কিংবা ক্ষুধায় কাতর প্রাণ। একদিকে হোটেলমালিক রেঁধেবেড়ে হাত বাড়িয়ে বসে, অন্যদিকে পর্যটকের সঙ্গে সমুদ্র খেলাধূলার ডাক পাঠাচ্ছে। কী জ্বালা, তারই কাছে এসে কিনা জব্দ তারই হাতে! এভারী সৃষ্টিশীল গল্প, একেবারে মন্দারমণির নিজস্ব। এই জলখেলা থেকে অসহায় (?) কে বাঁচাতে এখন ব্যবসায়ীকুল উঠেপড়ে লেগেছে, অন্যপথে পৌঁছনোর ব্যবস্থা সারা। বছরখানেকের মধ্যেই বীচের ওপর দিয়ে গাড়ীকুলের যাত্রা থামবে। স্বার্থবুদ্ধির থেকে একটা ভাল কাজ যেমন হল, তেমনি খোয়া যেতে বসেছে এর নিজস্বতা। যাক্ গে, হয়তো ভালই হল। যদিও জোয়ার-ভাঁটার এই ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা আমার কাছে হীরের মত দামী হয়ে আছে।


কাঁকড়াখনি সৌলা, মনভূমে তুই রইলা। স্বপ্নে হলুদবালী, ধুধু দিগন্তে সূর্য়ের ঘুম ভাঙা, খাড়া সাদা চোখে লাল কাঁকড়ার রোদরঙে লুটোপুটি আর অপর্যাপ্ত ঝিনুক- কাকে ছেড়ে কার কথা বলি! এই দুদিনের প্রাপ্তি আমায় দশ বছরের অনেক কান্না মোছাল- অনেক অপ্রাপ্তি ভুলিয়ে। এই আবেশ তাই অশেষ, এই ভাল লাগা অনিঃশেষ।      
............................................................................................................................

কীভাবে যাবেন- ধর্মতলা থেকে দীঘাগামী যেকোনো বাসে নামতে হবে চাউলখোলা, সেখান থেকে ভ্যানরিক্সা বা গাড়িতে মন্দারমণি। কোথায় থাকবেন-পান্থতীর্থ 91635-18060, 0322-0234418 ছাড়া সমুদ্রপাড়ে অজস্র হোটেল আছে। গাড়ির জন্য যোগাযোগ- বিশু- 9933941436, 9564236399  কীভাবে বেড়াবেন- ভ্যানরিক্সায় করে বীচের ওপর দিয়ে একদিকে তাজপুর মোহনা ও অন্যদিকের মোহনা সৌলা যাওয়া যায়, যেখানে কাঁকড়ার প্রাচুর্য্যে বালিয়ারীর রঙ কখনও গোলাপী কখনও লাল।
‘দুকূল’ এ্যামেরিকা থেকে প্রকাশিত একটি সাহিত্য পত্রিকা। আজ 28.02.15-য় একটি কমপ্লিমেন্টারি কপি (ফেব্রুয়ারী সংখ্যা) পেলাম। আক্ষরিক অর্থেই এটি দু-কূল মানে প্ররাচ্যে ও প্রতীচ্যের লেখকদের লেখা নিয়ে প্রকাশিত হয়।

No comments: