Tuesday, 7 June 2011

অজেয় ডানার ছন্দবিদ্যুত


হাওয়া এসে পর্দা উড়িয়ে দিলে আমি চমকে তাকিয়ে দেখি আকাশ একেবারে কালো হয়ে উঠেছে। দূরে মেঘের গায়ে গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা কিছু সুপারীগাছ। জানলা দিয়েই দত্তবাড়ির পুকুরঘাট নজরে পড়ে। দত্তদের মেয়েটা একা পুকুরঘাটে বসে আছে, আচমকা মনে একটা ভয় উঠে এল, আলো নিভে যাওয়া দুপুরে ও একা বসে কেন? কোনো দূর্ঘটনা ঘটতে যাচ্ছে কি! একটা সাময়িক অস্বস্তি শুরু হয়েই আবার পরমুহূর্তেই বুদ্বুদের মত ছড়িয়ে যেতে যেতে ক্রমে মিলিয়ে যেতে থাকল, মনে পড়ে গেল মৃত্তিকা প্রায়ই বলে বিভ্রান্তিতেই নাকি আরও এক যুগ কেটে যাবে আমার!

উঠোন থেকে মাত্র দু’ধাপ উঠলেই বারান্দা। মৃত্তিকা দৌড়ে দৌড়ে উঠোনে যাচ্ছে আর রোদে শুকোতে দেওয়া কাপড়, বড়ি, আচার এনে বারান্দায় তুলছে। ঘরের ভেতর থেকে দেখছি ওকে, মনে হচ্ছে একটা চন্দনা পাখি নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। হাওয়ার জোর বাড়ছে, হাওয়ার সাথে ঘরে ঢুকে পড়ছে বৃষ্টিগন্ধ, পর্দাগুলো হাওয়ার দাপটে জড়িয়ে যেতে যেতেই টেবিলে রাখা জলের গেলাস দিল উলটে। সদ্য লিখতে থাকা কবিতাটা টুপ করে ডুবে গেল জলের মধ্যে। কড়াৎ করে একটা বাজ পড়ার আওয়াজ আর তখুনি মৃত্তিকা দৌড়ে ঘরের মধ্যে ঢুকে গেল। সাথে সাথেই শুরু হল ঝড়। মৃত্তিকা ঝড় ভয় পায়। ঝড় এলে ও বরাবর একেবারে বুকের কাছে সেঁটে যায়। ওকে কাছে টানতে টানতেই চোখের কোণ দিয়ে বন্ধ জানলার কাঁচের ফাঁক দিয়ে দৃষ্টি চলে গেল পুকুরঘাটে। কী আশ্চর্য! মেয়েটা এখনও পুকুরঘাটে এই তান্ডবের মধ্যে, একলা। কেন?

ঝড় থেমে গিয়ে এখন শান্ত সব, শুধু কার্নিশ থেকে জানলার কাঁচে টুপটাপ জল চুঁইয়ে পড়ার হালকা মোহন শব্দ। পাশে মৃত্তিকা ঘুমিয়ে পড়েছে। কবিতার কথা মনে হতে নিজের মধ্যে ঝড়জনিত অবসাদ নিয়ে উঠে বসলাম। জন্মমুহূর্তেই মৃত্যু ঘটে যাওয়া কবিতার পাতা একলা হয়ে জলে ভাসছে। ক্লান্তিতে ভর করেই জানলা খুলে দিতে গিয়ে আবার চোখ চলে গেল পুকুর ঘাটে। জায়গাটা ফাঁকা পড়ে আছে। গাছের পাতাগুলো জলে ভিজে একেবারে সতেজ হয়ে উঠেছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আবার মৃত্তিকার গভীর ঘুমে থাকা মুখটার দিকে তাকাতেই মনের মধ্যে সেই পুরোনো ইচ্ছার ঘাই মেরে ওঠা টের পেলাম।

রাতে খাবার পালা শেষ। আকাশ গুমড়ে উঠছে বারবার। বোধহয় আকাশ আবার ভেঙে বৃষ্টি নামবে এখুনি। মৃত্তিকা সাদা-সবুজ দুটো বড়ি টেবিলে ফেলে দিয়ে বলল : খেয়ে নাও। তারপর চলে গেল সব গুছিয়ে রাখতে। আমার বুকের মধ্যে মেঘ জমতে শুরু করল। ঠোঁটের কোণে চিলতে হাসি ধরে রেখে ড্রয়ারের গোপনতম চোরাকুঠুরী থেকে বের করলাম টিনের চৌকো কৌটোটা। সব মিলিয়ে পঁচানব্বইটা বড়ি। সবসময় লুকোতে পারি না। কখনও মৃত্তিকা সামনে দাঁড়িয়ে খাওয়ায়। তখন বাধ্য ছেলের মত দুটো বড়িই গিলে ফেলি। আর ও কাছে পিঠে না থাকলে সবুজ গোল বড়িটা লুকিয়ে রাখি কৌটোতে। সবুজ বড়িটাই সেই বড়ি যেটা খেলে অনেক আনন্দ হয়। মাথার মধ্যে হুটোপাটি করে আলোর মশাল। তারপর ধীরে ধীরে প্রশান্ত হয়ে ওঠে মন, শরীর। ঘুমের মধ্যে কেবল তখন তলিয়ে যাওয়া। অনেকদিন ধরে আস্তে-ধীরে আমার কবিতাদের মত বড়িগুলোকে সাজিয়ে রেখেছি এই কৌটোয়। প্রথমটায় অবশ্য জানতাম না কোনটা খেলে ঠিক এরকম লাগে। তারপর আলাদা করে একদিন সাদা বড়ি আরেকদিন সবুজ বড়ি খেতে গিয়ে মজাটা বুঝে গেছি।

মৃত্তিকা ঘুমিয়েছে অনেকক্ষণ। ঘুমন্ত মুখটা দেখে মনেই হচ্ছে না একটু আগে ও কীরকম রেগে গিয়েছিল! কেন আমি ওষুধ খেয়েও ঘুমোতে যাচ্ছি না সেই রাগে ও অন্যপাশ ফিরে শুয়েছে। আর আমি জলের গেলাস হাতে ওর মুখের দিকে নির্নিমেষ তাকিয়ে আছি। মৃত্তিকাকে বলা হল না যে কোনো বিভ্রম নয়। সুচেতা, মানে দত্তবাড়ির ওই মেয়েটা অলীক কিছু নয়। ওকে আমি দেখতে পাই ও এখনও আছে বলে। এরকম এক ঝড়জলের দুপুরে যা ঘটবার ঘটে গেছিল। সুচেতা কেন এসেছিল সেদিন এখন আর মনে করতে পারি না। ভুলে গেছি পূর্বপরিচয়ে কোনো প্রণয় ছিল কিনা! কিন্তু সেই ঘটনাটা মনে আছে। আর মনে আছে পুরো বিকেল এই পুকুরঘাটে বসে থেকে সন্ধেবেলায় ও ডুবে যায় ওই পুকুরে। তারপরই ও পরী হয়ে যায়। আর আমার সঙ্গে সঙ্গে থাকে, আর ইচ্ছে হলেই যখন তখন পুকুরঘাটে গিয়ে বসে।
৬.
গেলাসের জল শেষ। মাথার মধ্যে আলোর ঘূর্ণিপাক। মৃত্তিকা মুখ একটু কুঁচকে ঠোঁট নেড়ে পাশ ফিরছে দেখছি, কিন্তু ওর মুখ থেকে শব্দটা ধরতে পারছি না। কোথায় যেন তলিয়ে গেল শব্দটা..যেতে যেতে মিলিয়ে গেল। মৃত্তিকার মুখটা কি সুন্দর লাগছে। সুচেতাও কখন যেন ওর পাশে এসে বসেছে। আমি মুগ্ধ হয়ে ওদের দুজনকে দেখি। স্পষ্ট শুনতে পাই আমার জলবিষাদের পরী সুচেতা বলছে :


এবার নাও অপেক্ষাব্রত, প্রকৃত মৃত্যুহীনতা…
অপেক্ষার মৃত্যু নেই কোনো - জেনে
সত্যাসত্য মানিনি, আমি ভাঙনমুখী-
স্মৃতির আবহ ভেঙে, কোথাও তো যেতে পারিনি
চরাচরে মেলে দিই অজেয় ডানার ছন্দবিদ্যুত।



[পঙক্তি : তুহিন দাসের ‘বনসাই প্রকল্পের মানুষ’ কাব্যগ্রন্থের ‘নেপথ্য-ছায়া’ কবিতা থেকে]


মেঘ

6 comments:

Unknown said...

তুমি হচ্ছো আদত অর্থের সাহিত্যিক মেঘ। কি ভাল লিখেছ তার পরিমাপ কি তুমি নিজে করতে পেরেছ? এবার আমার হিংসে হচ্ছে ও তোমার জন্য কষ্ট। এমন দুরন্ত লেখা এখানে দিলে অথচ পড়ুয়ারা সব আসে-যায়-পড়ে বলে বেশ কম। যাকগে... নাহয় মঞ্জুর জন্য তোমার এই মনফসল সমৃদ্ধ করুক আমার 'মনফসল'-কে। অসামান্য।

মেঘ said...

ধন্যবাদ মঞ্জু, এই লেখাটা আমার ভালোবাসার একটা লেখা। বরিশালের একটা পত্রিকার সাহিত্য পাতায় ঠাই পেয়েছে। মনফসলের প্রথম লেখা হিসেবে তাই এখানে রাখলাম।

Unknown said...

আরে.... তোমায় নয় এবার আমার নিজেই নিজের পিঠ চাপড়ানোর পালা। কোন্ পেজে প্রকাশিত? না,সাহিত্য পাতায়। আগাম না জেনেই কে বুঝলো তা? না মঞ্জু। এবার ভাবছি প্রকাশকের দপ্তরে চাকরী নিই মেঘ.... নব্য প্রতিভা খুঁজে দিতে। কি বল?

chandan roy choudhury said...

নামের সঙ্গে থীমের অমিল। থীম বেশ ভাল। অজেয় ডানা বুঝলাম। যে ডানা জেতবার জন্যই- তাও বুঝলাম। বুঝলাম না ছন্দবিদ্যুত কি বোঝাতে ব্যবহার হল। ওটা যে কবিতার শেষ লাইন তা দেখেছি, কিন্তু থীমের সঙ্গে কোথায় সম্বন্ধ।

মেঘ said...

আরে বাহ! আমি নিজেও এত চিন্তা করে শিরোনাম দিইনি!!! আপনি ভালো একটা বিষয় তুলে ধরেছেন চন্দন রায় চৌধুরী।

আল ইমরান said...

উপস্থাপন চমৎকার হয়েছে দাদা। আমি নিশ্চিত এসেই যখন পড়েছি মনফসলে, পদার্থবিদ্যার ছাত্র হয়েও আমি সাহিত্য একদিন ঠিক শিখে ফেলব।