শিয়ালদা স্টেশন শেষ দুপুরে একটু ফাঁকাফাঁকা। মানুষজনের হাঁটার গতি বেশ স্লথ। অফিস কাছারির লোকজন সব বিকেল থেকে ভীড় জমাতে শুরু করবে। আপাতত কিছু নিশ্চিন্তমনা সুটকেস সহ স্বামী ও বাচ্চাকোলে স্ত্রীদের ইতস্ততঃ প্যাকেজ। কোথায় যাচ্ছে সব? শ্বশুরবাড়ী?
সিদ্ধার্থ একটা ভিখিরি বুড়োকে দুটো পয়সা ছুঁড়ে দিয়ে স্টেশনগুলোর নাম লেখা বোর্ডটার দিকে তাকাল। নিচেই টিকিট কাউন্টার। এই স্থল হইতে শহরতলীর সমস্ত স্টেশনের টিকিট পাওয়া যাইবে। তা ভাল। সমস্ত নয়, সিদ্ধার্থর শুধু একটা নির্দিষ্ট স্টেশনের টিকিট দরকার। ওই যে থার্ড রো, লাস্ট কলাম। নামখানা জ্বলজ্বল করছে। ওইটিই হলো তার গন্তব্য।
মিনিট কুড়ি পর একটা ট্রেন রয়েছে। নৈহাটি লোকাল। তারপর ঘন্টাখানেক পরে আরো একটা। তারপর আরো। আরো। দিবানিশি নৈহাটি লোকালরা চলে ফিরে বেড়ায় স্টেশন থেকে স্টেশনে। লোক ওঠে, কত লোক! ঠাসা ভীড়ে প্রত্যেক হাঁস মুরগীরা মুখ উঁচু করে শ্বাস নেয়। পাদানির হাতল ধরে ঝুলতে ঝুলতে ঠিক দেখে ফেলে নিজেদের বঞ্চিত জীবন। গলা বুক জ্বলা ভীড়ে, এ ওকে ধাক্কা মেরে লোক নামে, কত লোক! একদল নেমে গেলে আরেকদল উঠে আসে। প্রাণপণে লড়াই চালিয়ে ওরা হয়তো কখনো খুঁজে পায় শেষতম সিটের আভাস। পাদানির হাতলের মালিকানা বদল হয় শুধু। নতুন পোশাক পরে নৈহাটি লোকালরা স্টেশনে স্টেশনে খোঁজে উচ্ছিষ্ঠ প্রাণ।
সিদ্ধার্থ নৈহাটি লোকালকে পছন্দ করে ফেলল। ট্রেনটা দাঁড়িয়ে আছে ছ নম্বর প্লাটফর্মে। শেডের ফাঁক দিয়ে চলকে পড়া রোদ লেগে রয়েছে গায়ে। ট্রেনটা ঝিমোচ্ছে।
হাতে ধরা টিকিটটার দিকে তাকিয়ে সিদ্ধার্থ ফের দোটানায় পড়ল। কাজটা কী ঠিক হচ্ছে? এরকম হুট্ করে শ্রবণার বাড়ী চলে যাওয়া কী ঠিক হবে? সে তো সিদ্ধার্থকে প্রায় চেনেই না বলতে গেলে। কোনোদিন কথাও বলেনি মুখ ফুটে। হাই হ্যালো নয়, সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং নয়, গায়ে পড়ে আলাপটুকুও নয়। কোনো সুযোগই আসেনি ফোন নম্বর চালাচালির। শ্রবণা জানেই না সিদ্ধার্থ বসু কে? এরকম আচমকা অঘটন সংক্রান্ত প্রতিবর্ত ক্রিয়া ঠিক কী হতে পারে? সাইকলজির পেপার গুলোয় কোন ক্লু পাওয়া যেতে পারে কী?
অবশ্য সিদ্ধার্থ শ্রবণার সব কিছু জানে। মানে যতটুকু জানা যায় আর কী। ফোন নম্বর, ইমেল, বাড়ীর ঠিকানা, বাবার নাম আর পেশা। গুগল ম্যাপ থেকে বাড়ীতে যাওয়ার পথ নির্দেশ। কোন স্কুলে পড়েছে, বাড়ীতে কে কে আছে, কোথায় নাচ শিখেছে, লেডিবার্ড সাইকেল আছে কিনা, ইত্যাদি ইত্যাদি। অবশ্য জানে না, কেন সে মাথা নীচু করে মনমরা হয়ে হাঁটে? কেন মিষ্টি খেতে ভালোবাসে না? কেন ও মুছতে চায় না ওর মফস্বলের গন্ধ, কেনই বা ও হাতব্যাগে লুকিয়ে রাখে ওর ছোট বেলার পেন্সিলে আঁকা ছবি। কে জানে এসব? এই যে, নৈহাটি লোকাল, পিতমহ ভীষ্মের মত পড়ে আছ, আপাত পরিত্যক্ত, জানো নাকি এসবের হদিস?
আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে, এই প্রশ্নোত্তর পর্ব আর্মহার্স্ট স্ট্রীট থেকে শুরু হয়েছে। ঐ যে, মিউজিক্যাল ব্যান্ডপার্টির দোকানগুলো আছে না, জগঝম্প ড্রাম স্যাক্সোফোন ইত্যাদি নিয়ে ফি দিন মকশো করে, ওই খানেই, সামান্য টুকরো ইঁটে হোঁচট খাওয়ার পর থেকেই। তার আগে তো রীতিমতো রিহার্সাল চলছিল। শ্রবণা কেমন তাকে দেখে চমকে যাবে। রীতিমতো সংলাপ বলার মতো করে বলতে হবে দুদন্ড শান্তি দাও হে নাটোরের বনলতা। তারপর কিছু সহানুভুতি জর্জিত সংলাপ ও একদম ঘেঁটে যাওয়া কোন বিকেল।
আসলে কীই বা বলার আছে তার? কেন সে যেতে চায় শ্রবণার কাছে? সুস্থ সবল দুকেজি ওজনের প্রেম, মাসপয়লা টিউশনির টাকা, বাপের হোটেলে ফি দিনের খোরাকি এসব কী কম হল সুখে থাকার জন্য। তার জীবনে দুঃখ কোথায়? প্রাণপণ খুঁজেও সে কী বার করতে পেরেছে কোন লুকোনো অসুখী মন, যার জন্য ধরা গলায় নানান কাঁদুনি গাওয়া যায়। খুঁটিকে অস্বীকার করার মতো সাহস বা মুরোদ কোনটাই তার কাছে নেই, তাহলে এই ধীরে ধীরে পেরিমিটারের দিকে এগিয়ে যাওয়া কেন?
মুশকিল হচ্ছে, হোমোস্যাপিয়েন্সরা দ্বিধায় পড়লে থমকে দাঁড়ায়, সিদ্ধার্থ বসু কিন্তু ধীরে ধীরে শিয়ালদার দিকে এগিয়েছে। হোঁচট খাওয়ার পর থেকে যতবার মনে হয়েছে, এমন করাটা পাগলামি, তত যেন গতি বেড়েছে তার। এই অনাস্বাদিত অ্যাডভেঞ্চারটা যেন ভীষণ রকম দরকার, কিন্তু শত চেষ্টা করেও কারণ খুঁজে পায়নি সে।
কলেজ স্কোয়ারের স্থির বেঞ্চিও কোন হদিস দিতে পারেনি, দ্রুত গতিশীল দোকানপাটও নয়। আসলে এ হয়তো নিজের কাছে একরকমের পরীক্ষা। কতদূর যেতে পারে সে? বেস ক্যাম্প, নর্থ কল না কি একেবারে সামিট। একবার দুঃসাহসী হয়েই দেখা যাক না। বনামী তো আর জানতে পারছে না রে বাবা।
অতএব, নৈহাটি লোকালের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে সিদ্ধার্থর মনে হল, এই অলস ট্রেনটার জীবনে কিছু বৈচিত্র্য আনা দরকার। নৈহাটি লোকাল জানুক সে আজ এক বিপ্লবীকে টেনে নিয়ে বিপ্লবের দোরগড়ায় হাজির করানোর মহান সুযোগ পাচ্ছে।
চট করে ট্রেনে উঠে ছায়াময় জানালার ধারে বসে পড়ল সে। মোবাইল সুইচ অফ করল। পকেট থেকে রুমাল বার করে মুছে নিল ঘাম। হাতঘড়িতে দেখে নিল সময়। তারপর মানিব্যাগ খুলে টিকিটটা যত্ন করে ঢুকিয়ে রাখল খোপের ভিতর।
এই টিকিটটা সে আজীবন রেখে দেবে। লুকিয়ে। বনামী কখনো টের পাবে না এই টিকিটের কথা।
1 comment:
পড়ছি.... শেষে বলব.... অন্য লেখাপত্র না পড়লে বা বললে এ'টুকুও বলব না।
Post a Comment