যান জট বাঁচিয়ে, কোলকাতার রাস্তায় গাড়ি নিয়ে নানা রকম ডজ করে আমরা যখন দক্ষিণেশ্বরে-এ এসে পৌঁছালাম, তখন বেলা প্রায় মধ্য গগনে। আর এক দেড় ঘন্টার মধ্যে মায়ের মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে দুপুরের ভোগের জন্য। ছোট বেলার দেখা দক্ষিণেশ্বরকে কে যেন এক বালতি জল দিয়ে ধুয়ে দিলো, আর সামনে এখন নতুন দক্ষিণেশ্বর। গংগার পাড় ধরে আগে যেখান থেকে ফুলের ডালা নেওয়া আর জুতো রাখা হতো, সেই জায়গাটাই নেই। এখন সেসব আরো ভেতোরে সরে এসেছে, মন্দিরের বাহির চত্বরের দিকে। রাণী রাসমণির মন্দিরের ঠিক সামনে আগের ওরিএন্টাশানেই এখন ফুল আর পূজোর ডালা নেবার নতুন স্থান হয়েছে। যেটা পাথর আর সিমেন্ট দিয়ে তৈরী, মাথার ওপর ছাদ রয়েছে। লোকগুলি অবশ্য সেই আগের মতোই আছে। সকলেই ডাকছে তাদেরই দোকানে যাবার জন্যে। এ জায়গাটার একটা গাল ভরা নামও ওপরে লাগানো রয়েছে ‘ডালা আর্কেড’। মায়ের মন্দিরে আগে ছ-আনা, দশ আনা আর ষোলো আনার চ্যাঙারী তৈরী হতো পূজার জন্যে। বাবা সোয়া–টাকার পূজা দিতেন আমার বেশ মনে আছে। এখন আমরা সেই পূজাই নিলাম চ্যাঙারী প্রতি পঞ্চাশ টাকা করে। আমি নিশ্চিত নই সব ফুল গুলো বাসী নয় বলে। কি আর করা। যেমন দেশ তার তেমনি চাল। অন্য চাল দিতে গেলে মাত করে দিয়ে বেরিয়ে যাবে, মাঝ খান থেকে আমার মনের ভাবটাই নষ্ট হয়ে যাবে। মনে মনে বোললাম মানসিক ভাবে পূজাটা ঠিক মতো দিতে পারলেই হয়।
হাতে পূজা নিয়ে আমরা এবার মন্দিরের মেইন চত্বরে এলাম। আজ মাঘ মাসের শেষ মংগলবার। মায়ের মন্দিরের চারটে দরজাতেই পূজা নেওয়া হচ্ছে, সেই অনুপাতে লাইন-ও পড়েছে। কিন্তু কোনটার কোথায় শুরু আর কোথায় শেষ বোঝার কোন উপায় নেই। সারা চত্বর জুড়ে মানুষ, স্ত্রী পুরুষ নির্বিশেষে দাঁড়িয়ে। যদিও কোথাও কোন অশান্তি বা হুটোপাটি নেই। শীতের সকাল, বেলা হলেও, গংগার পাড়ে বলে, সামান্য ঠান্ডা ভাব আছে। নানা রং এর পোষাকের মেলায়, আর মানুষের সমাগমে সমস্ত মন্দির চত্বর গম গম করছে। একটু স্থিতু হয়ে একটা লাইন পাওয়া গেলো, যা সবার মধ্যে ছোট, কেননা সেটি আমাদের পৌঁছবার একটু আগেই শুরু হয়েছে। মন্দির কর্তৃপক্ষ এতো মানুষের ঢল দেখে চতুর্থ দরজাটিও খুলে দেবার পরামর্শ দিয়েছেন। আমরা সেই লাইনে জায়গা করে নিলাম। রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দের সব মন্দিরেই ভারতের বাইরের লোকেদের চোখে পড়ে থাকে, এখানেও তার বেশ ভিড় চোখে পড়লো। আমাদের মতোই তারাও ফুলের সাজি নিয়ে খালি পায়ে মন্দিরের লাইনে দাঁড়িয়ে। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের থেকে অনেক বেশী শান্ত হয়েই তারা দাঁড়িয়ে। আমাদের সব লাইনই যেন খাবার লাইনের অনুরুপ। সব সময় বকবকানি, আর কোন না কোন সমালোচনা অথবা আলোচনা। বাঙ্গালির মতো আলোচনায় পরাংগম জাতি ভারত বর্ষে খুব কমই আছে। লাইনে দাঁড়ালে পুরো ভারতের এক অদ্বিতীয় ছবি আপনার সামনে দেখা দেবে। যারা কোলকাতার তথাকথিত বনেদী (মানে কোলকাত্তাইয়া), তারা ধুতি, চাদর, রেশম ,তসরে মোড়া, রোদে লাল টকটকে মুখে দাঁড়িয়ে আছেন, মাঝে মাঝে কব্জিতে বাঁধা রোলেক্সে চোখ রাখছেন, কতটা সময় খালি পায়ে এই রোদ্দুরে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। মা’কে দেখতে এসেছেন, এটা তো করতেই হবে। এরা নিজেদের ১০০ভাগ বাংগালি বলেন, কিন্তু ফোনে বাড়িতে ইংরাজীতেই জানান কখন রিচ করছেন। রিষড়ে থেকে সপরিবার এসেছেন সাধন নন্দী। আজ কারখানা বন্ধ, তাই ছেলে মেয়েদের নিয়ে এই একটু ঘুরতে বেরিয়েছেন। সকালের টেরেন ধরে এসেছেন, বিকেল বিকেল ফিরে যাবার ইচ্ছে আছে। এখানে পূজো দিয়ে আলিপুরে যাবেন চিড়িয়াখানা দেখতে, সেখান থেকে মমতা দিদির আপিসটা বৌ’কে দেখিয়ে সোজা হাওড়া যাবেন। কিন্তু এতো ভীড় হবে ভাবেন নি। সংগে মা থাকায় পূজো দেবেন না, মুখ ফুটে বলতেও পারেন নি। এখন ফেঁসে গেছেন। লাইনে দাঁড়িয়ে একবার বৌ-এর কথা, একবার ছোট ছেলেটার চিড়িয়াখানা যাবার তাড়া সামলাচ্ছেন। মুখে ওদের শান্ত্বনা দিচ্ছেন, এইটুক তো নাইন, আর দশ মিনিটে হয়ে যাবে। আমায় একবার জিজ্ঞাসা করলেন, চিড়িয়াখানার সময় কি ? আমি তো সেই কবে গেছি, এখনকার অবস্থা ঠিক জানি না, তাও ভরষা দিলাম, আপনি আরামসে পৌঁছে যাবেন। সেতো শেষ বিকেল পর্যন্ত খোলা থাকে বলে জানি। বাংলার বাইরে থেকে যারা এসেছেন, তাদের আলাদা করে চিনতে হয় না, বেশীর ভাগই উড়িষ্যা বা বিহার থেকে আসা। কেউ মানত করে এসেছেন, কেউ মানত পুরো হয়েছে বলে ধন্যবাদের পূজা চড়াতে এসেছেন। এরা সকলেই বিশ্বাসী ভক্তের কুল। এদের কোন অভিযোগ নেই, কোন ধৈর্য্যচ্যুতি নেই। এরা জানেন বা মানেন, কালী মাই-কো এয়সাই মিলনা পড়তা হ্যায়। কিরপা হলে তখন তো দেখা মিলবেই। আজ থেকে দেড়শো বছর পূর্বে দু জন ভদ্রলোক মিলে এই দক্ষিণেশ্বরকে চেনালো সারা জগৎকে, আর আজ পৃথিবীর মানুষের জোয়ারের নিত্য আনাগোণা এই তীর্থভূমিতে। ভাবতে খুবই অবাক লাগে। ভক্তি মানুষকে স্থির হতে, একনিষ্ঠ হতে আর অপেক্ষা করাতে শেখায়। ঠাকুর বলতেন ‘যে সয়, সে রয়’। এই মহা মিলনের চারণ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে থেকে অনুভব করলাম, ব্যাক্তি হিসেবে আমরা কত তুচ্ছ, কিন্তু সমষ্টি গত ভাবে সমস্ত মানবকুল আজ এক পথের অনুগামী। একই বিশ্বাসের হাতে হাত ধরা। পর্যায় ক্রমে কেবল আসা আর যাওয়া। এই পথেরই কোথাও আছেন তিনি, যেখানে সকলেই পৌঁছাতে চাই। এই জন্মে না হলে, আগামী কোন জন্মে। একটাই আফশোষ, যখন ছিলেন তিনি আমাদেরি মাঝে তখন কোথায় ছিলাম আমি ? কেন আসিতে পারি নাই? এতো অল্পের ব্যাবধানে (১৫০ বছর মহাকালের সময়ের স্কেলে কিছুই নয়) আমি কেন মিস করলাম? আমার মতো এই সহস্র জনসাধারণও মিস করেছে। বুঝতে কি পারছে ওরা ? এ কথা কে জানাবে আর কে বোঝাবে ? তোমার ভক্ত তুমিই তাদের দেখবে, তুমিই তাদের সময়ে জাগাবে, এই ভরষা রাখি।
1 comment:
তোমর ঝটিকা সফরের সঙ্গে দিব্যি একাত্ম হলাম হিমাদ্রী। লাইনে দাঁড়িয়ে-দাঁড়িয়ে এই আশপাশ দেখা, এই অবজার্ভেশন... এও বেশ।
Post a Comment