Wednesday, 25 January 2012

আজ যে রাজা কাল......

যদি আমি রাজার ঘরে জন্মাতাম, তাহলে আমার হাতে থাকতো রাজপুত্রের অধিকার। উঠতে বসতে হুকুম তামিল করার নকোর/ চাকর, খানা পিনা, মৌজ মস্তি। কিছুটা বড় হবার পরে রাজপাট। কিন্তু এটা সবসময় সত্যি হয় না। রাজপুত্রের অধিকার স্বেচ্ছায় ত্যাগ করে গৌতম, মহামতি বুদ্ধ হয়েছিলেন। রামচন্দ্র বনবাসে গেছিলেন, যুধিষ্ঠির স্ত্রী-ভাই-মা সহযোগে অজ্ঞাতবাসে পরিচয়হীন ভাবে জীবন কাটিয়েছেন। কিন্তু এদের সকলেরই অধিকারের পরিধির মধ্যে এসব হবার কথা ছিলো না। কিন্তু হয়েছে।
আবার রাজমাতার কোক থেকে জন্ম নেবার পরেও, রাজপুত্র না হয়ে মহাদানী কর্ণ সুতপুত্র হিসেবে পরিচিতি পেলেন। জ্যেষ্ঠ পান্ডবের মর্যাদা কখনও পেলেন না। কিন্তু এসব তার জন্মসূত্রে পাওয়া অধিকারের মধ্যেই ছিলো। পান নি। স্বয়ং শ্রীকৃষ্ণও সব জানা সত্ত্বেও তাঁকে এই লাঞ্ছনা থেকে মুক্তি দিতে পারেন নি। তিনি নিজেও ভগবান হয়েও মাতৃস্নেহ থেকে বঞ্চিত থেকে গেলেন তার ছোট্টবেলাতে। তিনি পালিত হলেন অন্য মায়ের কাছে, অন্য ঘরে, অন্য পরিবেশে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে অধিকার তা সে জন্মসূত্রেই হোক বা অর্জিতই হোক সবসময় কাঙ্খিত ফল দেয় না। তার নির্দ্ধারিত রাস্তায় চলে না। তাহলে কে বা কারা এই সব কন্ট্রোল করে? এর কোন সহজ জবাব আমার জানা নেই। এটা মহাকালের সময়ের চক্রে এক জটিল গণণা। বিধাতা পুরুষের হাতের খেলা, যা পরিচালনা করে হয়তো ভাগ্য আর নিয়তি। ‘ভাগ্যং ফলতিঃ সর্বোত্রঃ’ বা ‘নিয়তি কেনঃ বাধ্যতে’ এ সব তো আমরা চিরকাল শুনে আসছি। নিয়তির চালনায় আর ভাগ্যের সাহায্যে ফলাফল স্থির হয়ে আছে আমাদের কর্মের অনেক আগে থেকে। আগেকার দিনে মুনীঋষি’রা ত্রিকালজ্ঞ ছিলেন বলে কথিত। তাঁরা রামচন্দ্র আসার আগেই রামায়ণ বর্ণনা করেছেন, মহাভারতের কথা ব্যাসদেব আর গণেশ এক সিটিং-এ বসে লিখে ফেলেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ জানতেন তাঁকে কখন কি কি রুপে প্রকট হতে হবে, মহাভারতে তাঁর কি রোল হবে, কুরুক্ষেত্রের মাঠে তাঁরই অংশ হিসেবে জন্মিত অর্জুনকে গীতার পাঠ দেবেন সমস্ত পৃথিবীর জন্যে।
অধিকার হাতছাড়া হয়ে যেতে পারে, আর প্রায়শঃই হয়ে থাকে। আমি তার জন্যে ভাগ্য আর নিয়তিকে মূল মানি। ভাগ্য আর নিয়তির মধ্যে কি তফাত সেটা বোঝানো খুব কঠিন। এটা একটা মানসিক কনসেপ্টের ব্যাপার। আমার মতে ভাগ্য কথাটা আমরা ভালো বা খারাপ সবক্ষেত্রেই ব্যবহার করি, কিন্তু নিয়তিকে আমরা ব্যাপক অর্থে এবং কিছুটা নেগেটিভ অর্থেই ব্যাবহার করে থাকি। ভাগ্য ইন্ডিভিজুয়ালিস্টিক, আবার নিয়তি দেশব্যাপিও হতে পারে। সামগ্রিক দুর্ভাগ্যকে নিয়তির করায়ত্ব আমরা বলতে পারি, যেমন প্রাকৃতিক বিপর্যয়, কোন মেজর অ্যাকসিডেন্ট(ট্রেন, বাস, অগ্নি, ভুমিকম্প)। যে কোন সাধারণ মানুষ তার ভাগ্য, যেটা জন্মসূত্রে নিয়ে আসে, নিজের কর্মের জোরে তার কিছুটা হয়তো বদলাতে পারে, কিন্তু নিয়তির চক্রকে ভাঙতে পারে না। তাই আজ যে রাজা, কাল সে ফকির। আবার রাস্তা থেকে মহলে উঠে যাবার গল্পও আছে। এই বদলের সময় মানুষের অধিকারেরও বদল ঘটে। প্রোফেসর কালাম যখন ইসরো-তে রকেট ইঞ্জিনীয়ার হিসেবে কাজ করতেন, তখন তার অধিকারে ছিলো রকেটের বা উপগ্রহের নকশা বানানো। যখন রাষ্ট্রপতি হলেন, তখন অধিকারে এলো কোন উপগ্রহ কি উদ্দেশ্যে পৃথিবীর কোন কক্ষে স্থাপিত হবে তা ডিসাইড করার। এ হলো কর্মের অধিকার, অর্জিত অধিকার। আর্নল্ড সোয়ারজেনেগার যখন টারমিনেটর হয়ে জন কনার্স আর ক্যাথারিন ব্রিউস্টার-কে বাঁচাচ্ছে তখন তার কাছে রয়েছে অভিনেতার অধিকার। আবার সেই ভদ্রলোকই যখন গভরনার হয়ে বসলেন, তখন এলো ক্ষমতার আর আইনের অধিকার। এটাও অর্জিত অধিকার। এ’টা ভাগ্যও বটে।
বড় বড় মানুষের কথা থেকে আসুন এবারে আমাদের পরিবারে চলে আসি। বাবা, মা ভাই, বোন, স্বামী, স্ত্রী, ছেলে, মেয়ে, পাড়া পড়শী সকলেরই সকলের ওপরে একটা অধিকার আছে। কারোর ক্ষেত্রে এই অধিকারের সীমা একটু বিস্তারিত, কারোও ক্ষেত্রে কেবল তার্কিক। পিতা হিসেব সন্তানের ওপরে যে অধিকার আমার আছে, প্রতিবেশীর তা নেই। কিন্তু সন্তান যদি সেই অধিকার থেকে আমায় চ্যুত করে, অস্বীকার করে, তাহলে! তখন সেটা আমার ভাগ্য আর নিয়তি। এই হবার ছিলো। জোর করে অধিকারের পতাকা ওড়ানো যায় না। আমার নিজের বাবা ও মা দুজনেরই তাদের শেষ সময়ে আমায় তাদের সন্তান এবং জ্যেষ্ঠ হিসেবে যে অধিকার ছিলো, তার থেকে দূরে রেখেছেন। দুজনের একজনও আমায় তাদের সাথে মেলার শেষ সুযোগ দেন নি। এটা কি? আমার ভাগ্য না’কি আমার নিয়তি? আমি পাশে থাকা সত্ত্বেও আমার সে সুযোগ হয় নি, শেষ যাত্রায় তাঁদের হাত খানি ধরতে। হয়তো তাঁরা তাই চেয়েছিলেন। হয়তো তাদেরও নিয়তি এটাই ছিলো। আমার সহোদর সে হিসেবে ভাগ্যশালী ছিলো। হয়তো আমার কর্মফল, যা ছিলো আমার অমোঘ নিয়তি। আমার অধিকারের মধ্যে পড়ে জ্যেষ্ঠ হিসেবে মুখাগ্নি করার, কিন্তু করতে পারলাম কোই? শেষ বিদায়ের সময় আমি আরোও খানিকটা অপরাধী থেকে গেলাম। আরোও খানিক পাপের বোঝা বাড়লো। অধিকার হেরে গেলো নিয়তির ক্রুর হাসির কাছে। ভাগ্য বললো, এই বিধিলিপি, মেনে নেওয়া ছাড়া উপায় কি?
ব্যাক্তিগত আলোচনার বাইরে এসে এটুকু আমি বলতে পারি, এ জীবনে যা কিছু আছে, তার সবটুকু হয়তো সময়ের সাথে সাথে নেই, আবার যা কোথাও নেই, তাই এসে ধরে নেয় জীবনকে, সারা জীবন বয়ে বেড়ানোর জন্যে। এটা নেহাৎ যোগাযোগ, সুখ আসে না দুঃখ আসে। অধিকারের গর্বে মাথা খারাপ না করে কেবল নিজের কর্মে মন দাও, ওটাই একমাত্র তোমার হাতে। বাকিরা ছকের হিসেবে আসবে যাবে। আমার অধিকার শুধু কাজে, দাবার চাল দেবার মালিক কেবল সেই সর্ব শক্তিমান। ভেবে গেলাম, দেখা পেলাম না। তুমি আছো শুধু মনের গভীরে, অনুভবের আবেশে।

3 comments:

Unknown said...

তোমার এই অনুভবের সঙ্গে আমি সহমত ও সহযোগী ভাবনাবন্ধু হিমাদ্রী। তুমি যেভাবে ভাব, সেভাবে আমিও ভেবেছি... কিন্তু উত্তর পাইনা একজায়গায়। এ যদি পূর্বজন্মের কৃতকর্মের দায় বহন হয়, তবে তো এ'জন্মেও আমি যা করে চলেছি তা তাঁরই ইচ্ছার অনুসরণ। আমি কারুর প্রতি অবিচার করব কিনা বা আমি অনেক পেয়েও কারুর প্রতি অমনোযোগী হব কিনা সব তো পূর্বনির্দিষ্ট। তবে? এ'জন্যই দেখো অনেকে খুব গুরুতর অপরাধ করে ফেলে বলে 'ও'জন আমি ছিলাম না, ঐ গর্হিত কাজ আমাকে দিয়ে হতে পারেনা'... ইত্যাদি-প্রভুতি। আমি বুঝিনা, সেই যদি জীবনচক্র 'কলুর বলদ' কেন তবে আক্ষেপ 'পেলাম না' বলে, কেন তবে জোর করে ইচ্ছার বিরুদ্ধ আচরণের প্রচেষ্টা! আদতে তো তাই হবে হিমাদ্রী যা আমার নিয়তির নির্দেশ। বুঝিনা, বুঝিনা...বুঝিনা অনেককিছুই। মাঝেমাঝে মনে হয় নিজেকে আশ্বাস দিতেই এমনিতর ভাবকল্পনায় থাকি, নাহলে যে বেঁচে থাকাটা দুরূহ হয়। তাই কি?

আল ইমরান said...

মন্তব্য নেই...........

Himadrisekhar said...

মঞ্জুদি
আমার কথার কথা-র জবাব দেবার জন্যে ধন্যবাদ। আমি আমার মতো করে যা বুঝি, তাই লেখবার চেষ্টা করেছি। সব কথার উত্তর জানা নেই, তবে কেউ তো জানে। আমিও জানবো কোনদিন। ততদিন এমন ভাবেই ভেতোরে খুঁজতে হবে। এ ছাড়া অন্য রাস্তা নেই।