জানুয়ারি মাসে কোন দিন দেশে ফিরিনি। দেশ বলতে কোলকাতা বলছি। সেই কবে থেকে চাকরি সূত্রে বাইরে বাইরেই ঘুরছি। যখন মেয়েরা ছোট ছিল, তখন ওদের স্কুল কারিকুলামের সাথে তাল রেখে আমরা মে-মাসে কোলকাতা আসতাম। অত্যন্ত গরমের মধ্যে, লোডশেডিং এর সাথে লুকোচুরি খেলে আমাদের দিন ১৫-২০-র স্বদেশ প্রত্যাবর্তন হঠাৎ করেই শেষ হয়ে যেতো। কিন্তু এবার কেবল মাত্র আট দিনের ঝটিকা সফরে কোলকাতা চলে এলাম সস্ত্রীক মুম্বাই থেকে কেবল মাত্র প্রাণের টানে।
আমরা যখন চাকরি জয়েন করি, তখন ফোর্সড ব্যাচেলর ছিলাম বছর চারেক। তারপরে একে একে সকলেই মায়ের জন্য বলিপ্রদত্ত হয়ে যায়। আমার আবার শাস্তিটা সকলের চেয়ে আগে হয়। আমরা ব্যাচেলর হিসেবে চার বংগ সন্তান একসংগে থাকতাম একটা তিন কামরার বাংলোতে। এবারে সেই সন্তানদের এক সন্তানের মেয়ের বিবাহ উপলক্ষ্যে আমাদের কোলকাতা সফর। ২০-তারিখ বিবাহ ছিলো, আমরা ১৬-তারিখে হাওড়া স্টেশনের নতুন বিভাগে ২১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে এসে নাবলাম সন্ধ্যে সাড়ে সাতটায়, দুরন্ত এক্সপ্রেসে চড়ে। বহুদিন পরে ট্রেনে ভ্রমণ বেশ ভালো লাগলো। যদিও ট্রেনটির গতি ছাড়া বিশেষ কিছু উল্লেখনীয় বলে মনে হয় নি আমার, কিন্তু সব মিলিয়ে খারাপ নয়। বিশেষতঃ ২৬-ঘন্টায় মুম্বাই থেকে কোলকাতা। এই ট্রেনটি কোথাও স্টপেজ দেয় না, মুম্বাই থেকে ছাড়লো, আর সোজা কোলকাতা। যদিও টেকনিকাল স্টপেজ আছে চারখানা, সেটা কেবল রেলের নিজস্ব কাজের জন্যে, যেমন জল নেওয়া, খাবার নেয়া, ইঞ্জিন বদলানো, ড্রাইভার বদল এবং কোন জরুরী কারণে। যাত্রীরা একবার ওঠে আর একবারই নামে। হাওড়ায় নেমে মালপত্র সমেত ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে আসতে প্রায় আধা ঘন্টা লেগে গেলো। বাইরে এসে দেখি মানুষের লাইন। এই লাইনে দাঁড়াতে হবে নাকি! কুলি’কে বলি ভাই সংগে বুড়ো মানুষ রয়েছেন, একটু বেশি চাইলেও আমায় একটা ট্যাক্সি ধরিয়ে দাও। বাবু কিছু চিন্তা করবেন না, বলে সে যে ট্যাক্সি খুঁজতে গেলো, এলো মিনিট কুড়ি পরে। আমরা যেতেও পারছি না, কেননা ওর মজুরি দেওয়া হয় নি। এলো খালি হাতে। বললে, না বাবু কেউকে যেতে দিচ্ছে না পুলিশে। আপনারা মিটারের লাইনে দাঁড়ায়ে যান। হাওড়ার বাইরে দুটি লাইন, একটি প্রি-পেড, আরেকটি নর্মাল ট্যাক্সি’র লাইন, লাইন ধরে আসছে, যেমন যেমন যাত্রী পাচ্ছে, নিয়ে চলে যাচ্ছে। মিটারে যাবে, মানে মিটারে যা উঠবে, তার দুগুণ প্লাস দু’টাকা আমায় দিতে হবে গন্তব্য স্থলে পৌঁছে। এটাই নিয়ম। প্রায় এক ঘন্টা লাইন দিয়ে, আমরা আমাদের নির্দ্ধারিত ট্যাক্সিতে মাল পত্র তুলে যখন বাড়ির দিকে রওয়ানা দিলাম, তখন ঘড়ি বলছে নটা দশ। স্বল্পদিনের কোলকাতা বাসের দুঘন্টা অলরেডি তখন খরচ হয়ে গেছে।
আমার শ্যালিকার বাড়ি কুদঘাটে, সেখানেই এবার আমাদের কোলকাতার ডেরা পড়বে। ট্যাক্সি করে কুদঘাটে এসে নাবলাম সাড়ে দশটা নাগাদ। ঘরে ঢুকে সকলের সাথে ‘কিরে এতো দেরী, আমরা সেই কখন থেকে’ ...... ‘আরে আর বলিস না, তোদের কোলকাতা একটা যা’তা, শালা ট্যাক্সি পেতেই হয়রান, এতো রাতেও কি জ্যাম.... তোরা কি করে যে আছিস’ !! রাতে রেওয়াজী মাংস আর লাচ্ছা পরোটা দিয়ে ডিনার শেষ করে, যে যার নির্দ্ধারিত স্থানে শয্যাবাসী হলাম।
পরের দিন সকালে গাড়ি বলা ছিলো আটটায়। আমরা দক্ষিণেশ্বর যাবো সকলে। যখন বরানগরে ছিলাম, তখন বাবার সাথে ছোটবেলায় প্রতি সেকেন্ড শণিবার দক্ষিণেশ্বরে যেতাম। পরে বড় হয়ে বাবার অবর্তমানেও গেছি কয়েক বার, কিন্তু এবারের যাওয়ার একটা বিশেষ উদ্দেশ্য ছিলো। প্রথম, সামনের নভেম্বরে আমার মেয়ের বিবাহের স্থির করেছি, যার একটা পার্ট জানুয়ারির ২৮-তারিখে সম্পন্ন করতে হবে। মায়ের কাছে, ঠাকুরের কাছে সে জন্যে অনুমতি আর আশীর্বাদ এই দুই এর জন্যে যাওয়ার খুব দরকার ছিলো। এটা পুরোপুরি আমার মনের ব্যাপার, তাই কেউ হাসাহাসি করলেও আমি কিছু মনে করবো না।আর দ্বিতীয় ছিলো পূজো দেবার পরে ওখানকার সাবেকি ময়রার দোকানের হিং-এর কচুরী আর ডাল খাওয়া। এটা যারা খায় নি, তারা জানে না, পৃথিবীতে এতো সামান্য জিনিষের কি মহান টেষ্ট হতে পারে। যে না খেয়েছে সে মিস করেছে, এ কথা আমি আবার হলফ করে বলতে পারি। জার্নির ধকলে আমার ঘুম ভাঙ্গে প্রায় সাড়ে দশটায়। তাও গিন্নীর মুখের সুমধুর বানী শোনার পরে। তাড়াতাড়ি প্রাতঃকৃত্যাদি শেষ করে জামা কাপড় পড়ে, নীচে এসে দেখি সকলে মুখ চোখ কুঁচকে আমার জন্যে ওয়েট করছে। ভাবখানা এই, নিজে এতো কিছু বড় বড় কথা বলে, পড়ে পড়ে কুম্ভকর্ণের ঘুম দিচ্ছে, আর আমরা (মানে আমার গিন্নী আর শ্যালিকা, শ্বাশুড়ি, শ্যালিকার ছোট মেয়ে) কখন থেকে কাপড় জামা পড়ে কেবল অপেক্ষাই করছি। যাই হোক হাত জোড় করে কোন ক্রমে গাড়িতে বসা গেলো। আসলে সকলের পেটেই তো তখন ছোট ছোট ইঁদুরে ডনবৈঠক মারছে। কুঁদঘাট থেকে দক্ষিণেশ্বর, কাছাকাছি তো নয়ই, আর এখন অফিস টাইমও শুরু হয়ে গেছে। ভক্তিযোগ কেবল আমার, বাকিদের রাজযোগের দশা চলছিলো। লাল চোখের সিগনাল বাঁচিয়ে যতটা দ্রুত চলা যায় আমরা চললাম মায়ের মন্দিরের উদ্দেশ্যে। ক্রমশ......
8 comments:
বেশ, তোমার তো তাহলে ভালই সময় চলছে... 'ক্রমশঃ'-টা তাড়াতাড়ি শেষ করো। তুমি কিন্তু বড় দীর্ঘসুত্রি ফাঁদে আটকেছ নিজেকে। 'মাথেরন...' তো প্রায় ভুলতে বসলাম।
ঠিক বলেছ। আমি আসলে তোমার মনফসলের টাইটেল পেজে রবি কবির যে কথা লিখেছ তাই। কেবল বিলাসিতাটা নেই। আর কবির মতো নিজেকে জাগানোর প্রবণতাও নেই। তাই আমি দীর্ঘসূত্রী কিংবা একটা যা-তা বলতে পারো। তবে এবার তোমায় নিরাশ করবো না।
আর মাথেরাণ লেখা তো আছে, কিন্তু কেউ পড়ছে না, তাই দিচ্ছি না।
এখনো তোমার বোঝা হল না- পাঠকের এই আকাল কেন? কেননা সবাই আজকাল লেখে, লেখা পড়াতে চায় কিন্তু পড়তে নয়। এই অবস্থা সবখানে। আজকাল পার্ফমার যত- দর্শক, শ্রোতা, পড়ুয়া তত নয়। আমি শুধু এ'কারণেই বীতশ্রদ্ধ হয়ে প্রিন্ট মিডিয়ার পিছে পড়েছি। হয়তো দশটা পাঠিয়ে একটার কপালে শিকে ছিঁড়বে, তবু যে মানুষটি পত্রিকাটি কিনছে, তার কাছে অন্ততঃ পৌঁছব বলেই বিশ্বাস। এমনকি তুমি জাননা, অবাক হয়েছি আমার 'দেশ'-এর লেখা গল্প ও 'আনন্দবাজার'র লেখাটা এই নেট মহল্লাতেই একজন অপরিচিত ব্যক্তি আরেক ব্যক্তিকে পড়ে দেখার সুপারিশ করছেন দেখে। চিতওয়ানের লেখাটা তো আবার স্ক্যান করে দেওয়া। এটা প্রাপ্তি বই কী? এই সুখ এখানে কই? একান্ত না লিখে পারিনা, তাই হাবজিগুবজি লিখে চলেছি একা-একাই... একটি-দু'টি আন্তরিকজনকে নিয়ে। অভিমান করোনা ভাই, কেউ না পড়ুক আমি তো পড়ছি, আমি তো বলছি। সেটুকু ভেবেই নাহয় 'মাথেরন...' দাও। তবে মন্তব্য পাও না দেখে এটা ভেবনা মানুষ পড়েনা। এই সাইটের এ্যাডমিন হওয়ার সূত্রে আমি জানতে পাই- তোমার লেখা কত মানুষ পড়ল। সুতরাং দেরী নয়... লিখে যাও ও বিভিন্ন পত্র-পত্রিকাতেও পাঠাও। সাড়া না পেলেও পাঠিয়ে যাও। একদিন হয়তো...
এই তো- এইবার ধরেছি। আচ্ছা, তুমি কি আমার দেশ-এর লেখাটা পড়েছ? আজ অবধি?
আসলে হিমাদ্রি দিদি, এখানে অনেকেই আসে, পড়ে, আবার চলে যায়। মন্তব্য করে না। কেন করে না, আমিও জানিনা। প্রথম প্রথম আমার কাছেও এমন লাগত। যেখানে প্রথম আলো ব্লগে আমি ১০০ মন্তব্য পাই। সেখানে এই ব্লগে শুধু মঞ্জু দিদি ছাড়া কারো মন্তব্য নেই। কিন্তু আমাদের ব্লগের কন্ট্রিবিউটর লক্ষ্য করুন। এটা এখন গা সওয়া হয়ে গেছে। যাক!! লিখতে থাকুন। কেউ মন্তব্য করুক আর না করুক।
আপনার লেখার হাত কিন্তু বেশ ভালো।
ওরে ভাই আল ইমরান, হিমাদ্রী 'দিদি' নয় 'দাদা'। ঠিক করো এখুনি... ঠিক হ্যায়?
কি করে ঠিক করব দিদি। এডিট করার অপশন দেখাচ্ছে না তো।
যাকগে, এটা সামান্য ভুল, এখন তো জেনে গেলে, এরপর থেকে নাহয়...
এডিট বাটন আমিও খুঁজে পেলাম না আল ইমরান।
Post a Comment