মাঝে মাঝে একটা
ঘর দেখি –দেখতে পাই। ঘর না,
আসলে বাড়ি। পুরনো বাড়ি। পুরনো সেই বাড়ি। সেখানে হয়ত বা জন্মান্তরে বসত ছিল
আমার। বাড়িটা কেমন যেন পালটে পালটে যায়, ঘরগুলোও, এভাবে কখনও বাড়ি-ঘর পালটে পালটে যায়? কী জানি.. পালটে যায় দেওয়াল এমনকি পালটে যায় মানুষগুলোও। আমি মাঝে মাঝে
যাই সেই বাড়িতে, যেমন আজ এসেছি। কেন যে যাই নিজেও জানি না কিন্তু যাই, না গিয়ে পারি না বলেই যেন যাই সেখানে, যেখানে হয়ত বা কোনো এক জনমে বসত ছিল আমার। সেখানে এখন বাস করে অন্য মানবী, বাতাসে
অন্য শিশুর কলতান। সেই মানবী বসে আনাজ কোটে, কেরোসিনের
স্টোভে রান্না করে। এই স্টোভটা আমার চেনা। এর প্রতিটা সলতে আমার পরিচিত। চেনা এই
আঙিনা, অচেনা শুধু ওই মানবী আর ওই শিশুটি।
একটি পুরুষ আসে, একে আমি চিনি না। হঠাৎ করে সব কেমন অচেনা
হয়ে যায়। ভয় লাগতে শুরু করে। বাড়ির দেওয়ালটাও হঠাৎই বদলে যায়। একটা বাঁশের বেড়া
দিয়ে ঘেরা আঙিনা হয়ে যায় দেওয়াল ঘেরা ছোট্ট সেই উঠোন, যেখানে
এক অপরিচিত নারী বসে আনাজ কোটে, রান্না করে আমার চেনা
স্টোভে। আমার ভীষণ ভয় লাগে, আমি পালাতে চাই। জোরে হাঁটতে যাই,
পারি না। প্রচণ্ড ভারী লাগে পা দুটো। দৌড়ুতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ি।
অচেনা সেই পুরুষটি এসে আমার হাত ধরে, ফলাকাটা এক ছুরি দিয়ে
চিরে চিরে দেয় আমার দুই হাত, কনুই অব্দি, কনুইয়ের
উপরেও চিরে দিতে থাকে একের পর এক। খুব গভীর নয় সেই সব ক্ষত, যেন ছুরি দিয়ে
সে নকশা কাটে আমার হাতে, রক্তের রেখায় ফুটে ওঠে রঙ। আমি কাঁদতে থাকি, যেতে দাও, আমাকে যেতে
দাও -বলে অনুনয় করি, সে আমার হাত ছাড়ে
না। রক্তের রেখা আমার দুই হাতে, অদ্ভুতভাবে রক্ত জমাট বেঁধে
যেতে থাকে সেই চেরা জায়গাগুলোর উপরেই, গড়িয়ে নামে না।
নির্বিকার চিত্তে সেই অপরিচিত নারী আনাজ কোটে, শিশুটিকে
ডাকে। আমি তাকে বলি, আমাকে ছেড়ে দিতে বলো, আমার ভয় করছে, আমি বাড়ি যাব। সে হাসে, বলে, বাড়ি? তোমাকে তো ও বাড়ি
যেতে দেবে না, একবার পালিয়ে গেছ, আর
তোমাকে পালাতে দেবে না ও।
বাঁশের বেড়ার ওধারে কার যেন সাড়া পাই, তাকিয়ে দেখি ভীষণ চেনা দুটো মানুষ। ভারী, প্রায় অচল হয়ে যাওয়া পায়ে দৌড়ুনোর চেষ্টা করি, পারি না, তাও একসময় পৌঁছেই যাই বাঁশের গেটের কাছে, যেখানটায় গেটের বাইরে আমার ভীষণ চেনা মানুষ দুটো দাঁড়িয়ে আছে। আবার হুট করে সব পালটে যায়। সামনে সেই দেওয়াল! পুরনো বাড়ির পুরনো সেই দেওয়াল, মাঝখানে সদর দরজা। পুরনো কাঠের নড়বড়ে সেই সদর দরজায় শেকল তোলা, পেছন ফিরে তাকাই, ওই অচেনা মানুষটাকে হঠাৎ করেই চিনতে পারি, এ যে ভীষণ চেনা এক মুখ! শেকল নামিয়ে আধভাঙা নড়বড়ে দরজা পেরিয়ে আবার তাকাই পেছন ফিরে, পেছনে যারা আছে, তারা নিজেদের নিয়ে ব্যস্ত। শিশুটি একই ভাবে খেলে বেড়ায় আঙিনা জুড়ে, বটিতে আনাজ কোটে এক অপরচিত নারী, পাশে রাখা স্টোভে রান্না হয়, ঘরের দরজা পেরিয়ে যে সিঁড়ি তাতে বসে এক অচেনা মানুষ, যাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, যাকে আমি চিনি না..
5 comments:
তোমার তো যথেষ্ট ক্ষমতা সামরান, সজাগ থেকে এমন লেখা লিখেছ। দুর্দান্ত লাগল। লেবেল দিয়েছ 'মনখেয়াল'। বুঝলাম,তোমার খেয়ালী মন তোমায় খুব ভালবাসে। ভাবনা নিয়ে যে পথে চলতে চাও, সে পথে দিব্যি নিয়ে চলে।
ভাল লেগেছে জেনে ভাল লাগছে:-)
মঞ্জুশ্রী,
দুই আর তিন নম্বর প্যারার মাঝের যে গ্যাপ সেটা গায়েব হয়ে গিয়ে দু'খানা প্যারাগ্রাফ এক হয়ে গেছে পোস্ট করার পর। একবার এডিট করারও চেষ্টা করলাম, হলো না। একবার দেখবে প্লিজ?
'ঘরের দরজা পেরিয়ে যে সিঁড়ি তাতে বসে এক অচেনা মানুষ, যাকে আমি কোনোদিন দেখিনি, যাকে আমি চিনি না..'
আমি চিনি। সে আপনারই অন্য কোনো সেল্ফ, আপনারই অপেক্ষায়...
অসীম,
পাঠ এবং প্রতিক্রিয়া দুয়ের জন্যেই ধন্যবাদ।
Post a Comment