Thursday, 24 May 2012

আজ সকালের আমন্ত্রণে..

ভোরবেলায় হাঁটতে বেরিয়ে নিচে গেটের কাছে আটকে গেলাম, কোলাপ্‌সিবলে তালা আটকানো। রোজই থাকে, আমার ভদ্রলোকটি বাড়িতে থাকলে তার পকেট থেকে চাবি নিয়ে আমি বেরিয়ে যাই, কদিন ভদ্রলোকটি বাড়িতে নেই কাজেই ভরসা দোতলার সিদ্ধার্থবাবু। পাঁচটা কুড়ি নাগাদ তালা খুলে মৌকে সঙ্গে নিয়ে বাইকে করে বেরিয়ে যান, বোটানিক্যাল গার্ডেনে প্রাতঃভ্রমণের উদ্দ্যেশ্যে। আজ কোনো কারণে তিনি বেরোননি, হয়তো বাড়িতেই নেই। গোগোলের উচ্চ মাধ্যমিক শেষ হয়েছে তিরিশ তারিখে, ছেলেকে নিয়ে তাঁরা হয়ত কোথাও বেড়াতে গিয়ে থাকবেন। গত দুসপ্তাহ ধরে আমারও প্রাতঃভ্রমণের ঠিকানা ওই বি গার্ডেন। যেহেতু চাবি নেই ঘরে তাই একটু দেরি করেই বেরুচ্ছি এই কদিন, সাড়ে পাঁচটারও পরে। পাড়ার রিকশাওয়ালা শংকর গলির মুখটায় দাঁড়িয়ে থাকে, রিক্‌শায় চেপে আমি হাঁটতে যাই। ফেরার সময় অবশ্য বাস চালু হয়ে যায়, বাসেই ফিরি। বোটানিক্যাল গার্ডেন অব্দি হেঁটে গেলে বড়জোর মিনিট তিরিশ বা পয়ত্রিশ লাগবে কিন্তু অত ভোরে অক্টোপাশের বাহুদের মত ছড়ানো ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে একা হাঁটা যে মোটেই নিরাপদ নয় বিশেষ করে কোনো মহিলার জন্যে, সে এই এলাকার সকল বাসিন্দাই একবাক্যে বলে থাকেন। আমি নিজেও যে জানি না তা নয়। কাজেই শংকর জিন্দাবাদ।

আধঘন্টা গেটের সামনে সিঁড়িতে বসে থাকার পর কার একটা দরজা খোলার শব্দ পেলাম, দু-তিনজন মানুষের পায়ের শব্দও পাওয়া গেল, নিচে নামার। তিনতলার নতুন ভাড়াটে ভদ্রলোক ও তার মা এবং গিন্নি। ভদ্রলোক অফিস যাবেন বলে মা এবং গিন্নি নিচে গেট অব্দি ছাড়তে এসেছেন। গেটের তালা খুললে আমি উঠে বেরিয়ে গেলাম। শংকর অপেক্ষা করে করে চলে গেছে, হয়ত ভাড়া পেয়ে গেছে। বাসস্ট্যান্ড অব্দি গেলাম, যেদিককার বাস পাই- বি গার্ডেন বা ধর্মতলা, তাতেই চেপে বসব, ধর্মতলার বাস পেলে ভিক্টরিয়ায় চলে যাওয়া যাবে। একসময় যেখানে নিয়মিত হাঁটতে যেতাম ভোরবেলায়। গঙ্গার এপারে যবে থেকে ঠিকানা হয়েছে, ভিক্টোরিয়ায় প্রাতঃভ্রমণও শেষ হয়েছে। স্ট্যান্ডে বেলা ছটায়ও কোনো বাস নেই। বাসস্ট্যান্ড যেখানে, সেখান থেকেই শুরু হয়েছে ব্রীজ, দেখলাম বেশ কিছু মানুষ হাঁটছেন ব্রীজের উপর। কেউ এগিয়ে যাচ্ছেন ফ্লাইওভার ধরে, কেউ বা হাঁটা শেষ করে ফিরছেন।

বাসের অপেক্ষায় না থেকে এগোলাম ফ্লাইওভার ধরে। খানিক দাঁড়িয়ে দিক ঠিক করে নিলাম, কোনদিকে যাব। যেদিকে বেশি মানুষকে এগোতে দেখলাম, আমিও সেই পথই ধরলাম। দিক নির্দেশনা জানান দিল সে পথ গেছে কোনা এক্সপ্রেসের দিকে। খানিক এগোতে পুলের আরেকটি হাত বেরিয়ে এল, সে নিয়ে যাবে আন্দুল। আমি কোনা এক্সপ্রেসই পছন্দ করলাম।  উড়ালপুলে হাঁটতে গিয়ে দেখা গেল এই সামান্য চড়াইয়েও হাঁফ ধরছে, বুঝলাম, এই চার বছর ধরে ধোঁয়া গিলে গিলে দম বলে কিছু আর বেঁচে নেই!

পুলের ধার ধরে হাঁটতে হাটতে হঠাৎ খেয়াল হল কাঁচের গুড়োর উপর দিয়ে হাঁটছি। কুচো কাঁচ, টুকরো কাঁচ, পাউডার কাঁচ। কদিন পরপরই ব্রীজে ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটে, ভাবলাম এখানেও হয়েছে হবে, জানতে পারিনি। কিন্তু ভাল করে খেয়াল করতে দেখা গেল, ভুল ভাবছিলাম, এগুলো গাড়ির কাঁচ নয়, বোতল ভাঙা কাঁচ সব। পুলের দুই ধারেই সরু ফুটপাথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা আধভাঙা সব বোতলও দেখা গেল, ম্যাক্‌ডাওয়েল,  হোয়াইট মিস্‌চিফ আর আরও নানারকম লেবেলের বোতলের সব ভাঙা টুকরো। গাড়ির চাকার চাপে যা কিনা গুড়ো গুড়ো হয়ে ছড়িয়ে আছে পুলময়। মিনারেল জলের তোবড়ানো খালি বোতল, আলুভাজার খালি প্যাকেট সবই আছে সেখানে। বুঝলাম, এলাকার ছেলেপুলেদের সান্ধ্য বা রাত্রিকালীন ঠেক এই উড়ালপুল। রেলিংএর ধার ধরে নিচে তাকাতে বসতি দেখতে পেলাম। উড়ালপুলের ঘোরানো প্যাঁচানো সব বাহুদের ফাঁকে ফাঁকে নিচে কোথাও ঝোপ-ঝাঁড়, কোথাও চায়ের দোকানে ছোটোখাটো জটলা, কোথাও দিনশুরুর ব্যস্ততা সমস্ত দিনের জন্যে দৌড়ুতে শুরু করা মানুষগুলোর মধ্যে।

নিচের দিকে তাকিয়ে মনে পড়ল, দিন পনেরো আগে এখানেই কোথাও বাড়ি বাড়ি কাজ করে নিজের ঠিকানায় ফেরার পথে একটি মেয়ে গণধর্ষিতা হয়েছিল। কতজন ছিল সেই ধর্ষকদের দলে জানা নেই। ভোরবেলায় মেয়েটি যখন উড়ালপুলের তলা থেকে লেংচে লেংচে রাস্তার ধারে এসে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিল, তখনও তার ছেঁড়া সায়া আর কোনোমতে গায়ে জড়ানো শাড়িটিতে  টাটকা  রক্তের দাগ। যে পরিমান রক্ত তার ছেঁড়া সায়া-শাড়িতে ছিল, সে নাকি ঋতুস্রাবের রক্তের চাইতেও বেশি। খুব স্বাভাবিক নিয়মেই সেখানে ভীড় হয়, কেউ একজন ছেঁড়া শাড়িটি দিয়ে ঢেকে দেয় মেয়েটির অনাবৃত উর্ধাঙ্গ। মুখে জল ছিটিয়ে তার জ্ঞান ফেরানোর চেষ্টাও করে লোকজন। বেহঁশ পড়ে থাকা মেয়েটির দিকে অজস্র প্রশ্ন ছূঁড়ে দিতে থাকে জমে ওঠা ভীড়- কতজন ছিল? কোথায় করলো? বাড়ি কোথায় তোমার? কেউ একজন পুলিশে খবর দিলে পুলিশ এসে ভ্যানে তুলে নিয়ে যায় মেয়েটিকে। কোথায় নিয়ে যায় কে জানে, হয়ত থানায়, হয়ত হাসপাতালে। সেই থেকে আমার বাড়িতে কাজ করতে আসা মেয়েটি বিকেল বিকেল কাজ সেরে বাড়ি ফিরে যায়, সন্ধ্যে হওয়ার আগেই। তাকেও তো ওই উড়ালপুলের নিচে দিয়ে অন্ধকার রাস্তায় প্রায় আধঘন্টা হেঁটে বাড়ি ফিরতে হয়।

মন্দিরতলা থেকে কোনা এক্সপ্রেসওয়ে হয়ে আবার মন্দিরতলা, আমার দুপাক হাঁটা হয়ে যায় ততক্ষণে। বাড়ছে চলমান গাড়ি-ট্রাক-লরির সংখ্যা। সাঁই সাঁই বেরোয় সব গাড়ি। কেউ ভেঁপু বাজায় কেউ বাজায় না। এই ভোরেও কোনো কোনো গাড়ি থেকে ছিটকে বেরিয়ে আসা উদ্দাম বাজনা্র শব্দ চিরে দেয় সকালের সমস্ত নৈঃশব্দকে।  ভয় লাগে বিশাল বিশাল লরি দেখে। যদি চাপা দেয় তো আমার এই পলকা প্রাণ ফুঁশ করে বেরিয়ে যাবে খাঁচা ছেড়ে। সরু ফুটপাথ ধরে ফেরার পথ। বাড়ি। খবরের কাগজ আর ধোঁয়া ওড়া চা। সঙ্গে তারা মিউজিকের আজ সকালের আমন্ত্রণে..

1 comment:

Unknown said...

বাঃরে খেরোখাতার ডায়রীপাতা। লেখা এত অনায়াস, মনে হচ্ছে আমিও যেন পাশে-পাশে হাঁটছি তোমার ভোরবেলাকার সঙ্গী হয়ে। তুমি তো করিতকর্মা মেয়ে সামরান, প্রতিদিন হাঁটতে বেরোও। নাঃ,এবার দেখছি আমাকেও...

আসলে কি জান, ভোরবেলাকার ঘুমটুকু মনে হয় স্বপ্নের জন্য যেন জরুরী। কিজানি, এ বাহানাই হয়তো... নিজেকে ঠকানো... তাই বোধহয় যাচ্ছি-যাব করেও আজ অবধি...

দেখা যাক্।