Sunday, 19 January 2014

ছায়ামায়ায়

'আনন্দবাজার' ওয়ানস্টপে আজ 2.2.2014 বেরনো ‘ছায়ামায়ায়’- গল্পটির শেষভাগ নীচে ব্লু কালারে হাইলাইটে রাখলাম। গল্পটি তিনভাগে বেরিয়েছিল, 19.01.14, 26.01.14 ও আজ 02.02.14-য়।


ছায়ামায়ায়
মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী
                                                               (1ম ভাগ)
বিন্দি তখন গরুমারা জঙ্গলের মাচানে। ঘন্টা দেড়েক গায়েব ছুঁচো-বেজী কিছুরই পাত্তা নেই সঙ্গে ঋক আছে- গাইড... তবু ছমছমে ভাব, অন্ধকার নামলেই চিত্তির। তল্পিতল্পা গুটবে ভাবছে হঠাত্ হঁসর-ভঁসর শব্দে নীচে তাকিয়েই উল্লাস। স্কুইরাল-হরিণ নয় একেবারে গণ্ডারের দেখা পেয়ে বিন্দির উত্তেজনা তুঙ্গে। বিস্ফারিত নাসার তেজীয়াল রাগ যে তেঁনার কিসের ওপর কেজানে- খাড়াই খড়্গ আছড়ে পড়ছে গাছে মূহুর্মুহু। আর তখনই তন্ময়তাকে খানখান করে বনজঙ্গল কাঁপিয়ে বেজে উঠলো মোবাইল। কী লজ্জা, কি লজ্জা- রেঞ্জার পইপই করে বলে দিয়েছিল মোবাইল যেন বন্ধ থাকে- রঙিন পোশাক, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, সিগারেটের গন্ধ... ছিঃ, ছিঃ, গাইডের দিকে চোখ তুলে তাকাতে পারছে না বিন্দি। লাফিয়ে-ঝাঁপিয়ে ফোন তো থামাল কিন্তু অচেনা শব্দ বীরপুঙ্গবের দিমাগে এমন চমক পৌঁছল যে হাঁট্টাগাট্টা একছুট্টে ধাঁ। ঠাস-ঠাস করে নিজেকে চড়াতে ইচ্ছে করছে। উপায় কি- যা ঘটবার ঘটে গেছে। তাছাড়া গাইডের তিরছি নজর বিন্দিকে অপরাধী করে রাখছে- ফিরে যাওয়াই বেটার। জঙ্গল পেরতে পাক্কা আধঘন্টা গেল। বেরিয়েই ফোন চালু করতে হ- অফিসের হয় যদি... হসপিটাল টু হনিমুন ছাড়ান নেই কিনা- শ্যামের বাঁশী বেজেই চলে। মেল আসছে, কোটেশন দিতে হচ্ছে। কি যে সব ভাবে! সমাধানপত্র কি পকেটে নিয়ে ঘোরে যে হাত পাতলেই পাতে পড়বে! একশো অস্থিরতা চিবতে-চিবতে বিন্দি লাস্ট কল-নং-এ ফোন লাগাল। নাঃ- টাওয়ার না পাওয়ার ঢংবাজীতে তিনি কঁকাচ্ছে তাহলে বাজল কি করে। ঋক বলল ওটা বাইচান্সের মামলা- আমার থেকে করো। বিন্দির পোষাল না, মামলাটা বোঝা চাই। জঙ্গলে দুঘন্টা কাঠ পাকিয়ে অপেক্ষার থেকে যদি বা কিছু মিলেছিল তায় ফোন চিল্লিয়ে-মিল্লিয়ে দিল নাক কেটে। কে করেছিল, কি বলার ছিল... নানান ভাবনার সঙ্গে ফোন নিয়ে বিন্দির বিরক্তির খুটুরখাটুর চলেছে। টা প্রোমোশনাল ও অফিস মেসেজের পরেই দেখল ভায়ের মেসেজ- মাকে নিয়ে হসপিটালে যাচ্ছি। মানে? কি হল? দিন তিনেক আগে সব ঠিকঠাক, নিজের লং কোটটা দিয়ে দিল... একরকম জোর করেই।সব লং কোট-ফোট আউটডেটেড বলেও পাত্তা পাওয়া যায়নি। বাঁকা ঈঙ্গিতকে মা না বোঝার ভানে দিব্যি শুনেছে। নিজের বাঁচাকে যে স্থির করে রাখে অন্যের বেঁচে থাকার শর্তে তার ওসব গায় মাখলে চলে? উদ্দেশ্য সিদ্ধিটাই মোদ্দা। সবার জন্য বাঁচতে-বাঁচতে মা অভিমান করতেই ভুলে গেছে। অতি বুদ্ধিমতী তিনি জানেন কোথায় কি গিলতে হয়।

ইমিডিয়েটলি কলকাতা পৌঁছনো চাই- মাকে বলতেই হবে, তুমি না বাঁচলে আমিও বাঁচবো না।কথাটা কাঁচাকাঁচা গোদা টাইপড্ লেও এইবাঁচবো না- এক্সপ্লয়টেশনই উপায়। মার যা নেচার, হয়তো জাপ্টে নেবে জীবন। বেচারী বিলুটা একা, কোন হসপিটালে নিল... ভেতরে শব্দপুঞ্জেস্রোত। সময় বুঝে ঋকের ফোন নিশ্চুপ।

তুখোড় ড্রাইভার অবস্থার গুরুত্ব বুঝে প্রায় শ্যুমাখার স্টাইলে পৌঁছে দিল খুনিয়ামোড়। বিন্দির মোবাইল ধরা হাত আকাশে তাক করে থাকতে-থাকতে একসময় টাওয়ার মেলাল। কোনোমতের ঘষঘষে আওয়াজ থেকে বোঝা গেল- অবস্থা ক্রিটিকাল, কারুর রেফারেন্সে হস্পিটালে ভর্তি করা গেছে। এরপর ওরা দুদ্দাড়িয়ে হোটেল। ম্যানেজারটি চৌখস। বোর্ডার্স হ্যাপা সামলাতে-সামলাতে খ্যাঁচাপড়া চিড়চিড়াপন্ বা পাকটুস্ ব্রেনের পেটি পলিউশান গ্রাস করেনি এখনো। তাঁর চেষ্টায় ঘন্টাখানেকেই টিকিট হয়ে গেল। টাকাপয়সা মিটিয়ে শ্যুমাখারে জিপে চড়ে ওরা উড়ে চলল বাগডোগরার দিকে।

কলকাতা পৌঁছতে-পৌঁছতে রাত দশটা। বিপুল বিস্তারের সামনে যেমন সবকিছুই ক্ষুদ্র লাগে, তেমনি আকাশ চিরে যেতে-যেতে বিন্দির তুচ্ছ লাগছিল এই জীবন, কষ্টদায়ক অবস্থার ফের, নিজের একান্ত বাঁচা। অবশ্য কিছু পরেই মেঘের গায়ে চাঁদের আঁকিবুকি ওকে অন্যমনস্ক করল। পৃথিবীতে যন্ত্রণার পাশে রূপের মহোত্সব আছে বলেই না বাঁচাটা সহনীয়। ঐ সময়টুকু বিন্দির কাছে বড় আপন ছিল, একটা নির্ভার যাপন... একটা ফ্রেশনেস। ভাগ্যিস্! নাহলে মুস্কিল হত। সারাটা দিন আজ যুঝতে হয়েছে নানা অনুভূতির সঙ্গে- কষ্ট, অপরাধ বোধ, দুশ্চিন্তা...

এয়ারপোর্টে নেমে ট্যাক্সি নিল ঋক, বাড়িতে ব্যাগপত্র নামিয়েই সোজা হস্পিটাল। তিনতলার বারান্দায় একটা ট্রলি-স্ট্রেচারে বিলু বসে আছে দ-মার্কা হেরো চেহারায়। দিদিকে দেখে ধড়ড়িয়ে নামল- বিন্দির দম ধরে থাকা ভাবটা এবার উপছে যেতে চায়- কোনমতে সামলে বলল-
- মা কেমন? জ্ঞান আছে?
- আপাততঃ স্টেবল, যেভাবে বদলাচ্ছে...
- ভেতরে যাব?
- না, না...

ঋক পরের বাড়ির ছেলে, অত আবেগী চপচপানীতে নেই- অবস্থাটা বুঝতে একটু থমকালো বিন্দিকে বিয়ে করে থেকে দুই ভাইবোনকে দেখছে। একটুতেই হাত-পা ছেড়ে দেওয়া এদের প্রকৃতিঋক দুজনকে সঙ্গে নিয়ে নীচে নামল, ক্যান্টিন থেকে তিনটে চা এনে বসল গাছতলার বাঁধানো চত্বরে।
- বল এ'বার...

                                       (2 ভাগ)
                                      26.2.2014

যেন সবই স্বাভাবিক, খুব ইজি। ঋকের আত্মবিশ্বাসী এ্যাটিচ্যুডের স্পষ্টতায় বিলুর ঘাবড়ানো ভাব থৈ পেল চাতালে পা গুটিয়ে বসতে-বসতে বলল- ‘চেয়ার ছেড়ে উঠতে গিয়ে মা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সঙ্গে-সঙ্গে হাউস ফিজিশিয়ান, স্পেশালিস্ট, এ্যাম্বুলেন্সের পর্ব পেরিয়ে এখানে তখুনি পেস-মেকার বসাতে হত কিন্তু মেডিক্যাল টেস্ট না করে হবেনা তাই আজকের রাতটা সাপোর্টিভ ব্যবস্থায় রেখে কাল অপারেশন

বহুদিন থেকেই মার হৃদয় নাজেহাল বিন্দি জানে তা’বলে এত তাড়াতাড়ি ধড়কন বিষম-ছন্দ ভালবাসবে বোঝা যায়নি এ’সব ভাল লাগেনা বিন্দির, বড় বিরক্তিকর বাস্তবতা
- এত জায়গা থাকতে হস্পিট্যালে কেন রে ভাই?
- কিছু করার ছিল না আনন্দীর কাকা এখানের সার্জন, তাছাড়া তুই নেই...
আনন্দী বিলুর হোনেওয়ালী বৌ। এই মাঘেই বিয়ে- এখন কি হবে কেজানে।
- আর কারুকে জানিয়েছিস?
- হ্যাঁ, অনেককেই...
- তুই থাকবি এখানে?
- হ্যাঁ।
- কিন্তু কোথায়? সিঁড়ির কোণে-কোণে পানের পিক...
- ওসব দেখিস না দি, রুগী রোগের জ্বালায় যখন পোড়ে ওসব দেখে?
- কিন্তু সুস্থ মানুষগুলো তো দেখে। কেয়ার গিভারই অসুস্থ হয়ে পড়লে...
- ভাবিস্ না, সব ঠিক হয়ে যাবে
বিলু আস্থায় স্বস্তি পেল বিন্দি।

পরদিন সকালবেলায় এল যখন অপারেশন সারা। পরিবারে কম মানুষ থাকা যে কি ঝক্কির তা এই সময়গুলোয় টের পাওয়া যায়। বিলুর ওপর দিয়ে ঝড় একটা যাচ্ছে বটে। ইতিমধ্যে কাকামণিও এসেছেন। নার্স জানালেন- পেশেন্টকে বেডে দেওয়া হয়েছে, যেতে পারেন।’ অবস্থার সঙ্গে যুঝতে-যুঝতে বিলু পুরো কাহিল- বিন্দিই প্রথম গেল। ভেতরটা আলো-আঁধারী, বিন্দি দেখল মার আধো খোলা চোখে দৃষ্টিহারা নজর, গভীর কালোমুখে কষ্ট সওয়া ফ্যাকাশে সাদা ঠোঁট। দাপুটে মাকে অমন অসহায় দেখে কান্না উঠে এল বিন্দির, সামলে নিয়ে মাথায় হাত রাখল। স্পর্শের একটা ভাবময়তা যেমন আছে তেমনি স্ট্রং মেসেজও। তা শুনতে চেয়েই বোধহয় মার চোখের পাতায় তরঙ্গ। কানের কাছে মুখ নিয়ে খুব আস্তে বিন্দি বলল-কষ্ট হচ্ছে?লগি ঠেলা কোন্ দুস্তর পারাবার সাঁতরে মা লাল চোখে চাইল, ঠোঁট দুটো নাড়ল আর বিন্দি শুনল-মিঁয়াও।

মারাত্মক চমকে গিয়ে কেবিনের আলোটা জ্বেলে ফেলল ও। দেখল লেজ-খাড়া এক বেড়াল বেড়িয়ে আসছে বেডের তলা থেকে। বিন্দি অসুস্থ মার চেয়েও ঘোরতর অসুস্থ বোধে কি করবে ভাবছে। ঠিক তখনই ডক্টর এলেন রাউন্ডে। বিন্দি খোনা-ফাটা গলায় কোনোমতে বলল -স্যার বিড়াল। নিবির্কার তিনি অতি স্বাভাবিক স্বরে বললেন- অবাক হবার কী আছে, তাড়িয়ে দিন। বিন্দির অবাক হবার মাত্রা এতে বেড়ে গেল চতুর্গুণ- এই নির্লিপ্তি কে স্থির থাকতে দিলনা। ধড়ফড়িয়ে বেরল কেবিন ছেড়ে- এক্ষুণি মাকে নিয়ে চলে যাবে ও। বিরক্তির আঁচ বিলু অবধি পৌঁছে গেল-

- মাকে কোথায় এনেছিস, আই.সি.সি.ইউ-তে বেড়াল!!!!-
- কাল আমিও দেখেছি
- তারপরেও!!!!!
- কি করতে পারি?
- বেড়াল শুনে ডক্টর বললেন... কী আছে, তাড়িয়ে দিন।
- তবে?
- কি তবে, মিনিমাম একটা পরিষেবা থাকবে না?
- ওঁক্যাজুয়াল এ্যাটিচিউডে মধ্যেই তো উত্তরটা লুকোনো, বুঝলি না?
ঋক -
- কিছু পেলে তবেই কিছু না পাওয়ার অনুযোগ মানায় বিন্দি- ডাক্তারবাবু ঘুরিয়ে সেটাই বললে!
- আমি শুনবো না, এখান থেকে নিয়ে যাব মাকে।
বিলু অবাক-
- কোথায়?
- নার্সিংহোমে।
হ্যাঁ,গল্পটা এ্যাপারেন্টলি ভাল, কিন্তু...
- কিসের কিন্তু?
- নার্সিংহোমে রাখলেই কি রুগীর জ্বালাপোড়া কমবে না স্যাটাক্ করে ভাল হয়ে উঠবে?
- এটা আগেও বলেছিস্, আমি তর্কে যাব না।
- রালে সমাধান হবে? তারচেয়ে-
- কি তারচেয়ে? তারচেয়ে চোখ বুজে থাকব? বেড়ালের সঙ্গে মাকে এক বিছানায় থাকতে দেব?
ওদের তর্কবিতর্কের মধ্যেই কাকামণি দেখে এসেছে, বলল-
- বৌদিকে একটু সুস্থ মনে হল জানিস্। জল চাইছিল।
কিন্তু উত্তর দেবে কি, মাথা দপদপ করছে বিন্দির। কি মনে করেছে বিলু, একা সামলেছে বলে একারই খবরদারী! বন্ড দিয়ে হলেও মাকে ছাড়িয়ে নিয়ে যাবে...

হঠাত্ কুশকে মনে পড়ল বিন্দির। স্কুলের সেরা ছেলে ছিল ও- পড়াশোনা, স্পোর্টস্, স্যুইমিং... কদিন আগে দেখা হতে বলল সাউথ ক্যালকাটার এক নার্সিংহোমে জয়েন করেছে।‌ পরিবেশ ভাল, কাজের স্বীকৃতি, স্বাধীনতা... সবটাই বেশ লাগসই। ফোন লাগাল বিন্দি। সব শুনেটুনে কুশ বলল- ‘আরেকটা দিন ওখানে রাখ তারপর নিয়ে আয়। দুদিন বাদেই ওরা ছাড়িয়ে নিল মাকে।

হস্পিট্যালের কোনো কিছু সম্পর্কেই আর আগ্রহ নেই বিন্দির, বেরিয়ে বেঁচেছে। হয়তো ভাল- তবু নিজের কাছে নিজের ভাল থাকার প্রয়োজনকে উপেক্ষা করা যায়না। পয়সার মূল্যে কিনলেও স্বস্তি অনেক দামী। এখানে আনতে পেরে কি ভাল যে লাগছে... নার্সিংহোম তো নয় যেন পাঁচতারা হোটেল। সেন্ট্রালি এসি, লাউঞ্জে দামী সোফা, মৃদু সুরে সেতার বাজছে, দেওয়ালে মর্ডান পেন্টিং... এমন কি দায় বদল হতে বিলুও খুশদিল। মা ঘুমোচ্ছে... তবু তাঁকে নিয়েই চিন্তা, হাজার হোক্ ধকল তো। ভাগ্যিস্ কুশ ছিল।

                                              
                                        (শেষভাগ)
                                        2.2.2014
ভিজিটার্স আওয়ার্সের পর ওরা বেরলো, গাড়ি নিয়ে ঋক সোজা বাইপাশের ধাবায়। ভেতরে ঢুকতে-ঢুকতে বলল-
- আর টেনশন নেই... বিনদাস থাকো। দিন পাঁচেকের মধ্যেই যখন ছেড়ে দেবে বলেছে...
- কিন্তু এখানে কেন?
- খাবে বলে...
- এখন খাওয়া যায়? মা হস্পিটালে?
- বাড়িতে তো খেতে হত
- কিন্তু...
- নো কিন্তু। সিচ্যুয়েশন এখন বেটার। জোর করে কষ্টে থাকার মানে আছে?
- জোর করে আছি?
- হ্যাঁ আছো, কষ্টে আছি-র ভাবনা একটা ঠকানো অভ্যাস- বাদ দাও- এনার্জি স্টোর থাকলে তবে না যুঝবে।
- হোটেলে খেয়ে?
- কিছুটা তো বটেই। মন অন্য প্লেজারে ঢুকলে কষ্টপত্র মাথায় চড়তে দেনা। আখেরে তোমারই লাভ হবে বিন্দি। একসময় দেখবে মন খারাপ ভ্যানিস।
- না হতে পারে...
- হতেও পারে। মাঝখান থেকে মনমরুনী থেকে কেন ক্ষতি নিজের... পরিবেশের...

ঋক এমনই। গুরুতর ঘটনাকে হাল্কাছাঁদে নিয়েও সামলায় দায়িত্বের সঙ্গে। ওর প্লাস পয়েন্টগুলো বিন্দি জানে কিন্তু নিজে পারেনা, উতলা হওয়া ওর নিয়তি। কোনোমতে খাওয়া চুকিয়ে বাড়ি ফিরে নিশ্চিন্তি। ঋক যতই বলুক, ভেতরে-ভেতরে একটা অপরাধবোধ চলছে। জামাকাপড় ছেড়ে ঋক বসল কম্পিউটরে আর বিন্দি বসল প্ল্যানার নিয়ে। গোছাতে হবে, সবকিছু এত এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
                                                  
সকালে তাড়াতাড়ি ঘুম ভাঙল বিন্দির কিন্তু ঋক কোথায়? গ্যারাজে গাড়ি নেই, সেন্টার টেবিলে একটা চিরকুট, ব্যস্ত হয়ো না, আমি সঙ্গে আছি- টিভি খোলো।' খাপছাড়া চিঠি পেয়ে বিন্দি অথৈ জলে। চায়ের জল চাপিয়েছিল, গ্যাস বন্ধ করে টিভি খুলে বসল। প্রত্যেক চ্যানেলেই ঘুরে-ফিরে এক খবর।  প্রোগ্রামের নীচে স্ক্রল করে লেখা যাচ্ছে-

The city of joy faced calamitous fire that swept through the floor of South Kolkata’s… hospital… Few months back, the fire service dept. had inquired the hospital and...

মাথায় কোনো কথা পৌঁছচ্ছে না বিন্দির- কুশকে এখুনি ফোনে পেতে হবে।  কিন্তু কোথায় কি, ফোন বেজে যাচ্ছে, এমন কি ঋককে নয়, বিলুকেও পাচ্ছেনা। বারবার ওর সঙ্গেই কেন এমন হচ্ছে? গরুমারা থেকে যখন চেষ্টা চালাচ্ছিল তখন পায়নি- এখন তাই। কোনো রাস্তা খুঁজে পাচ্ছেনা বিন্দি

The incident was more heartbreaking as most of the victims were patients...

কি করতে পারে এবার ও উঠে যাওয়া ছাড়া? তাই করল, উঠে গেল বিন্দি টিভি ছেড়ে। কি জানার অপেক্ষা, কি দেখতে চায় ও... মার মুখ? ও যে পালাতে চেয়েছিল তা স্পষ্ট। পালাতে চেয়েছিল বেড়াল থেকে বৈভবে, বিভ্রম থেকে বিশ্বস্ততায়। পেল? স্বস্তির আকাঙ্খা কি শান্তির দোরে এনে দাঁড় করাল? জেদ দিয়েও নিয়তিকে পেরনো যাচ্ছে না। বিলু কতবার বলেছিল... ‘যে কষ্টে আছে তার কষ্ট সর্বত্র এক। বাইরের রূপে ভুলবি দি... শোনেনি বিন্দি, ঋককে পাশে নিয়ে যা চেয়েছিল তা ঘটিয়ে ছেড়েছে। কি পেয়েছে এতে? অস্থিরতা থেকে স্থিরতায় গেছে শুধু হতাশা, বাকি প্রশ্নচিহ্ণে। কে ভুল? হসপিটাল, বেড়াল, কেতাদুরস্তের তলায় লুকনো জঞ্জাল, বিলুর দর্শনতত্ত্ব না বিন্দির... ভাবতে পারছে না আর। ওর জেদ ঠিক না বেঠিক তার উত্তরপত্র নষ্ট। বিলুর ভাবনা ভুল, ঋকের স্মার্টনেস ভুল, নিজের তীব্র আবেগ ভুল, সত্য শুধু... 
                                                 
কোথাও বোধহয় বাড়ি ভাঙা হচ্ছে, শব্দের দামামা নিয়ে মাথার মধ্যে ক্যামেরার সাটার পড়ার স্যাক্, চোখের ওপর একশো তারার রেস। পিছনের বাগানে এসে দাঁড়ালো বিন্দি, প্রতিদিনের মত সেই ফিঙেও এসেছে, ‘টুইক’ ডাকে কান ঝালাপালা। ধূসরটি নেই- এসেছে কালোবরণী একাই। এসময় বিন্দি চা খেতে-খেতে বিস্কুট ছড়ায়, সেই টানে যে কত পাখী আসে। সবার নিজস্ব সময় আছে, সেই মাপে আসে বুলবুলি, ঘুঘু, শালিখের দল, তারপরেই আসে কালোলীনা আর ধূসরিনা দুই ফিঙে। কিন্তু আজ কি কিছু অন্যরকম? কালোলীনা হঠাত্ চুপ করে গেল কেন? বকুল গাছের গোড়ায় রোদ এসে পড়েছে- মানে সাতটা বাজল। কই, বুলবুলিও এলো না তো! সেই ছটা থেকে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে বিন্দি, কোথায় শালিখ, ঘুঘু দম্পতি? শুধু খোঁড়া কাকটা এলো অসময়ে।

ঘরে ফোন বাজছে অনেকক্ষণ- বারবার। মালসায় ঠোঁট ডুবিয়ে জল খাচ্ছে কাক, পালক ভিজছে, ভিজছে ঠোঁট-বুক-মুখ। আকাশের দিকে উঁচু করা মুখ বেয়ে জল নামছে টুকটুক করে- রূপোলী মায়া চোখে তৃপ্তির অন্তহীন সুখ। তাকিয়ে আছে বিন্দি, তাকিয়েই আছে- রোদ বেঁকে গেছে ফের। ঝিরিঝিরি পাতার ফাঁক গলে উঠোনে একশো আঁকিবুকি।

এখানে ছড়ানো ডুয়ার্স, এখানে ভোর-পাখী-রোদ্দুর জুড়ে দাঁড়িয়ে বিন্দি অপেক্ষায়... ‘ধূসরিনা’ আসবেই, ঘুঘু দম্পতি,শালিখ, বুলবুল, মা...



+23
********************************************************************************

2 comments:

Indira Mukhopadhyay said...

ভ্রমণের মধ্যে দিয়ে সুন্দর গল্প। পরেরসংখ্যায় কিছু ক্লাইম্যাক্স পাব আশা রাখি ।

Unknown said...

জানিনা ভাল লাগবে কিনা, তবে আমার লিখে ভাল লেগেছে... এই আর কি।