Wednesday 3 June 2015

‘কুলডিহা’র কাঁকন-বাঁকে'


‘কুলডিহার কাঁকন-বাঁকে’ নামে এ’ মাসের (June 2015) ‘গৃহশোভা’তে আমার একটি লেখা বেরিয়েছে। কাঁকনের ব্যাপারটাই হচ্ছে বালার ওপরমহল্লায় কাঁটা শিরোনামটি কাব্যিক শুনতে লাগলেও আসলে সতর্কিকরণ। ‘কাঁকন’ দেখতে খানিকটা বালার মত হলেও বালা নয়। তার Circular Area জুড়ে কাঁটার মত Design থাকলে তবেই সে’টি কাঁকনএকদম অন্যরকম সুন্দর, বন্যসুন্দর। যে সামলাতে পারে তাকে এ’টি অনন্যতা দেয় আর যে পারেনা তার হাত কেটে-ছড়ে একাক্কার। এমন কি এ’টি সামলাতে পারা বাহুকে বাহার দিলেও তার আশেপাশে ঘোরাফেরা মানুষ এর আঘাত থেকে যে অব্যহতি পাবেই এমন কথা নেই কুলডিহা’ জায়গাটি হচ্ছে এমনই। তায় যদি তা’তে ঘন-ঘন বাঁক থাকে তবে তো কথাই নেই। লিখতে বসে তাই ‘কুলডিহার কাঁকন-বাঁকে’  শব্দটা  আপনি এসেছিল।  ‘গৃহশোভা’ কে ধন্যবাদ এ’ লেখা ছাপার জন্য।


‘কুলডিহা’র কাঁকন-বাঁকে'              

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী

যাব-যাব ভাবতে-ভাবতে একদিন সব ফেলে ছুট- পৌঁছে গেলাম কুলডিহা নীলগিরি পাহাড়ের কোলে ধানী জমি, গ্রাম, অরণ্য নিয়ে একদিকে সিমলিপাল অন্যদিকে কুলডিহা। সিমলিপাল যদি আলগা চটক হয়, তবে কুলডিহা এক হরিণ চোখের ফড়িং মেয়ের সরলতা ও সাজ নিয়ে সমগ্রটা। এ কন্যের কাঁকনের বাঁক এতই তীক্ষ্ণ ও প্রাকৃত যে তাতে ঘষটা লেগে ঘোল খেয়েছি জোর

দলে আট থেকে আঠাশ-আটচল্লিশ ছুঁয়ে ছিল ষাট পেরোন দুজন অসম বয়সী হলেও প্রকৃতির সুরে বাঁধা পড়েছিলাম বলেই ছিলাম একান্নতায়। নাহলে সম্ভব? ওবামার সাথে কখনো মেলে ওসামা? কিন্তু এখানে মিলেছিল, ওবামার পিঠে ওসামা যে কতবার হাত বুলিয়ে দিয়েছে- আসলে কিছুটা বোঝাবুঝি ছিল নিজেদের আর অনেকটা ভালবাসা দিয়েছে প্রকৃতি তাই বোধহয়...



 সিমলিপাল থেকে কুলডিহাকে আলাদা করেছে সুখুয়াপোতা আর গাগুয়া নামের দুই পাহাড় যে ভাগটায় ছোট বড় মিলিয়ে মেলা কাঠবিড়ালী- সেটিই ‘কুলডিহা’। ক’জন মিলে ক’দিন ধরে কষে মেখেছি কুলডিহার সাতশো রঙা সবুজ ও সবুজপাতার আনাচ-কানাচের ভয় পৌঁছনো এখানে সহজ ছিল না, বাধা ছিল প্রায় নীলগিরি পাহাড়ের মাপে। শেষে যার সূত্রে যেতে পেলাম- এই ভ্রমণের সেই মানুষটিই মূখ্য মুখ এমনিতেই কুলডিহার কাঁকনে ঘন ঘন বাঁক- বিপুল বনানী পেরনো জঙ্গলে রোদ ঢোকেনা তায় এই বিবরণ বাদ দিলে আঁধার পেরিয়ে প্রবেশ আরো শক্ত হবে বৈকি আসলে আপাত সহযোগী মানুষটির কোনো রাখঢাক নেই, দু-হাট খোলা মনোভাব। অনেক চেষ্টায় ফোনে তো পেলাম কিন্তু কিছু শোনার আগেই তাঁর প্রস্থুত রাখা প্রশ্নমালার সামনে পড়তে হল প্রায় ‘হ্যালো’ শব্দটির  গায়ে-গায়ে জুড়ে এক নিঃশ্বাসে তার প্রশ্ন- কোথায় যেতে চাই- চাঁদিপুর, ভিতরকণিকা, কপিলাস, পঞ্চলিঙ্গেশ্বর, সিমলিপাল...
বাপরে- উত্তর দেব কি, মাথার মধ্যে তখন ভীমরুলের ভোঁ ভোঁ। যেন বাসে উঠেছি, কন্ডাক্টর হাঁকছে- বেলেঘাটা, কাদাপাড়া, চিংড়িঘাটা, মেট্রোপলিটন... কোনমতে ঐ ছেদহীন নামমালার মাঝখানে নিজের চাওয়াটুকু সিঁধিয়ে দিয়ে বলতে পেরেছিলাম- ‘কুলডিহা, কুলডিহা‘ ফোনের ওপারের মানুষটি নিলাজ ধাতুতে গড়া- দিব্যি নির্ভার। দয়ার দান দিচ্ছেন ভঙ্গিমায় একটি নৈর্ব্যক্তিক আওয়াজ শুধু ছুঁড়ে দিলেন কি যে মানে আওয়াজটির... বুঝতে পারিনি বলেই খেজুরালাপে গেলাম, কেননা পেতে আমাকে হবেই ‘কত নাম শুনেছি আপনার,’ ‘কুলডিহার কোলে-কাঁখালে কত না কীর্তি,’ ‘লজের গায়ে শুনেছি বিদেশী সৌরভ...’ সবটা বেকার, আসলে কথার ফাঁকে বুঝতে চাওয়ার চেষ্টা উনিও অনড়। বলতে থাকলেন যে কুলডিহার যেহেতু চাহিদা প্রচুর সেহেতু হবে না-টা ধরেই নেওয়া যায়। আশ্চর্য্য, উনি কিন্তু এখনো ডেট জানেননি। তা’তেও ‘না’ বলছেন মানেই আগাম ভেবে রাখা। আশা নিয়ে বহুক্ষণ বাজে বকেছি- চূড়ান্ত হিউমিলিয়েটিং দশায় দাঁড়িয়ে এবার মেজাজ আমার তীক্ষ্ণ প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে ডেট দু’টো জানালাম- ডিসেম্বরের 25 আর 26 তিনি কম নন, অনায়াসে ও’সব ডেট বুকড্ বলে জানিয়ে দিলেন। সিগার চিবোতে-চিবোতে কথা বললে যেমন কটকট শব্দ ওঠে, মানুষটি কথা বলছিলেন সেই ঢঙে আমি বুঝে যাচ্ছিলাম, ওটা আত্মবিশ্বাসের ভঙ্গীমায় অন্যপ্রান্তের মানুষটিকে রেয়াত না করার স্টাইল যা বহু ব্যবহারে ক্লিন্ন। বেশ, সে থাক তার জায়গায়- আমি আমার।

মোষে-মোষে যুদ্ধ হলে যেমন শিঙে শিঙ বাধিয়ে দু’টোই দাঁড়িয়ে থাকে ও ফের ঝটকা মেরে খুলে নিয়ে ঢুঁসোয়- আমাদের অবস্থা খানিক তেমন। হারাতে চলেছি আন্দাজ পেতেই জেদ চড়ল অসম্ভবকে সম্ভাবনায় বদলানো আমার স্পেশাল এবিলিটি, হেরে যাচ্ছি খালি কুলডিহায় কতবার যে...


 বুকিং এখনো চালুই হলনা অথচ বুকড... পষ্টাপষ্টি ভদ্রলোকের কাছে অবিশ্বাসী মনোভাব পৌঁছে দিলাম। তিনি এ ধরণের বার্তালাপ শোনেন না বরং হাত কচলানী পেতেই অভ্যস্থ এত সহজে অচেনার কাছে ধরা পড়ে যাওয়া... ইগো তেঁনার টাল খাচ্ছে বুঝলাম ঠান্ডা পাথুরে গলায় জানিয়ে দিলেন- সরকারী অফিস থেকে যেহেতু বুকিং হয়, সেহেতু আমি যেন ওখানেই যোগাযোগ করি।
হাঃ বাণ ছুঁড়ল ওপক্ষ, একদম শব্দভেদী বাণ। চ্যালেঞ্জ-ঋদ্ধ এ্যাটিচ্যুডে বিঁধে এবার আমার মুখে কুলুপ। কুলডিহা-কুলডিহা করে কতবার টাল খেয়েছে আস্থা- তবু যে কেন... আমার গোঁয়ার্তুমির ফাঁক গলে এটাও বুঝি যায় একসময় বালেশ্বরের অফিসে ফোন করে শুনেছি যে ফোনে বুকিং হবেনা সরাসরি করতে হবে। তার মানে ভাবলাম হয় মানি অর্ডার নয় থ্রু অনলাইন পেমেন্ট। কিন্তু নাহ, অফিস জানালো হবে না। অগত্যা? বুঝে পাচ্ছিনা কি করি কলকাতা থেকে বালেশ্বরে গিয়ে বুকিং? সম্ভব, না এমন হয় কখনো? ব্যাপারটা এমন অদ্ভুত কেন প্রশ্ন করে জানতে পেলাম এটাই নাকি নিয়ম।

‘নিয়ম?????? কোনো বনেই এমন শুনিনি যারা হিল্লী-দিল্লী-হায়দ্রাবাদ থেকে আসবে?’ উত্তর তো দূর, ফোন কেটে গেল তত্ক্ষণাত্। ভুল আমারই- কথার ভিতরের কথাটা বুঝতে চাইনি বলে ওদিকে এজেন্টের চ্যালেঞ্জটি ভেতরে ধোঁয়াচ্ছে তাঁর ঠান্ডা-ঠান্ডা কুল-কুল চালে আমার ঘাড়ে ওদিকে ঘামদরিয়া কুলকুল। ভদ্রলোকের আত্মবিশ্বাস দেখি বাঁকা পথের খুঁটিতে মজবুতিতে গাড়া- এবার নুইতে হল আমাকে স্পষ্ট জানালেন যে আগে কন্ট্যাক্ট করা পাবলিকের প্রেফারেন্স আগে ও তারপরেও আছে উপরীর একটা হিসেব ওসব ঠিকঠাক পেয়ে গেলে তবেই বুকিং মেলা না মেলার প্রশ্ন আমি যে প্রাপ্তি বা অপ্রাপ্তিকে টাকায় না মেপে ইচ্ছেগুলোকেই প্রায়োরিটি দিই- এই খবর কি মানুষটির কানে পৌঁছে গিয়েছিল?

সাধারণতঃ বেড়াতে বেড়িয়ে কোন আকস্মিক সিচ্যুয়েশনে পড়া ও তাকে কাটিয়ে ওঠাও একধরণের এনজয়মেন্ট। এ্যাডভেঞ্চার না থাকলে আর পরিপাটী চৌহদ্দী ছেড়ে পথে বেড়োনো কেন? এখানের প্রকৃতিতে যত আয়োজন- সমস্যাও তত। প্রত্যেক জায়গার মত কুলডিহারও একটা বিশেষত্ব আছে- তা হল প্রতি পদে ঘুষঘাষ, অন্যায্য ডিলিং যা প্রকৃতির প্রণোদনাকেও ছাপিয়ে গেছে

আমি জানতাম যে কুলডিহা ছাড়িয়ে দশ কিলোমিটার ভিতরে আরেকটি জায়গা আছে নাম- যোধাচুয়া। কপাল ঠুকে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম। আমার জানার বহরে এবার এজেন্ট মানুষটি চমকালেন। জানালেন যে, যে দলে আট থেকে আটষট্টি বছরের মানুষজন আছে তাদের জন্য যোধাচুয়া সুবিধেজনক নয় ফেসেলিটিস প্রায় নেই বললেই হয় তোলা জলে স্নান-পান তায় থাকার জন্য দু’টি মোটে ঘর এ’ছাড়া নির্জনতা ছাড়া এ্যাস সাচ কিছু নেই দোষ দিইনা তাঁকে- এমনটা তিনি ভাবতেই পারেন বেড়ানোর ধাঁচধরণ আজকাল এত শৌখিনতায় জড়িয়েছে যে অসমবয়সীরা একসঙ্গে থাকার আনন্দেই যে আনন্দ পেতে পারে তা তাঁর বোধে ঢুকছে না বন্যতার চেনা কন্সেপ্ট আজকাল মাতলামীর মধ্যে বসত করে, স্বাভাবিকতাই বিস্ময়। মনঃশ্চক্ষে দেখলাম- এপাশ থেকে ওপাশে নিয়ে চিবোতে থাকা হিরোর সিগার ফের মুখ থেকে নেমে এলো দু আঙুলের ফাঁকে।

অনেকগুলো জঙ্গলে ঘোরার অভিজ্ঞতায় জানি, অরণ্য গভীর থেকে গভীরতম হলে প্রাপ্তির কোটা ভরবেই তায় যদি উপরী হিসেবে জোটে নির্জনতা তবে তো সোনায় সোহাগা বিনা বাক্যব্যয়ে ওখানেই ব্যবস্থা চাইলাম ভদ্রলোক এবার খাতির নেওয়ার বদলে কিছুটা খাির দিলেন জানালেন প্রথমদিন আমাদের ‘যোধাচুয়া’-য় থাকতে হলেও পরদিন উনি ‘কুলডিহা’-য় ব্যবস্থা করে দেবেন হঠাত্ই দেখি দয়ার সাগর... আসলে কোথাও দিয়ে আমায় বোধহয় আসলি ভ্রামণিক বলে মনে হচ্ছে ওঁনার তাই ছেলে-ছোকরার যে দল পরপর দুদিন বুকিং নিয়ে রেখেছে, তাদের উনি একদিন ‘কুলডিহা’য় ও পরদিন ‘যোধাচুয়া’-য় পাঠিযে দেবেন বলে জানালেন আমি অবাক হলাম, বুকিং দিয়ে রাখা মানুষকে কিভাবে... জিজ্ঞাসা করাতে গলায় সেই পুরনো আস্থার আওয়াজ উঠে এলো ফের। ওঁনার ওপরেই ছাড়তে বললেন ব্যাপারটা।

কি বলব, আমি তো আপ্লুত। এবার খুব দূর থেকে হলেও তীর দেখা যাচ্ছে- তরী এই ভিড়ল বলে। উল্লসিত আমি ফের প্রশংসার খাতা খুললাম- ‘সো কাইন্ড অফ ইউ।‘ ভদ্রলোক ব্যারিটোন ভয়েসে দয়াটয়া ডিসকার্ড করে জানালেন যে এখনো সবটাই চলছে হাওয়ায়। এরপরের অগ্রগতি নির্ভর করছে ঠিকঠাক সময়ে ঠিকঠাক প্রাপ্তির ওপর সঙ্গে এটাও বলে দিলেন- ইমিডিয়েটলি শুধু বুকিং-এর টাকা পাঠালেই হবে, বাকী পেমেন্ট বালেশ্বরের অফিসে পৌঁছে দিতে হবে তারপর এন্ট্রি ফি, ক্যামেরা, ড্রাইভার, জ্বালানী, বাংলো সব মুখে-মুখে হিসেব করে জানালেন কোন এ্যামাউন্টটি সরকারী, কোনটি উনি নেবেন ও ফরেস্ট অফিসারের জন্য কত টাকা। একই সঙ্গে জানাতে ভুললেন না যে পনেরো দিনের মধ্যে টাকা পেয়ে গেলে আগামী দশ দিনের মধ্যে আসল কাগজ পেয়ে যাব বেঁকা পয়সার এই কনফিডেন্স দেখে আমি থ। মিনমিন করে ক্ষীণ স্বরে তবু জানতে চেয়েছিলাম যে বিট অফিসার সরকারী চেয়ারে বসে এমনটা করে কি করে? ভদ্রলোক থামিয়ে দিয়ে বলে ছিলেন ওঁর থেকেও অনেক রহিস পার্টি আছে, তবু ওপরঅলারা ওঁনাকেই গুরুত্ব দেন

বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা চালাবার একটা প্লাস পয়েন্ট আছে আমার আগ্রহী মনোভাব যেমন পৌঁছে যায় মানুষটির কাছে তেমনি বিশ্বাসটাও তাই কথা প্রসঙ্গে আমার বলতে অসুবিধে হলনা যে টাকা শুধু উনি দেন না, ‘রহিস পাবলিকে’ও দেয় তবে ওপরওয়ালা কেন ওঁনাকেই প্রেফার করেন? আসলে ওঁনার স্পেশালিটি ঠিক কোথায় একটু বুঝতে চাই, এই আর কি। ভদ্রলোক জানালেন- ওখানে পৌঁছে চোখের ওপর ঘটনা পরম্পরা দেখলে নিজেই সবটা বুঝতে পারবো তাছাড়া কুলডিহার জাংগল-ক্যাম্পটি নাকি উনিই চালান এ ব্যাপারে গভর্মেন্টের আদৌ উত্সাহ নেই অথচ পর্যটকের উত্সাহ অনন্ত এটা দেখে উনি ব্যাপারটাকে দু’ভাবে ভেবেছেন এক- পর্যটকের কাছে নিজেকে পরিচিত করে তোলা, দুই-অবস্থার সুযোগ নিয়ে উপার্জনের পন্থা খুঁজে বার করা এসব ক্ষেত্রে চোখের চামড়া পাতলা হলেই প্রাপ্তি সুতরাং...  যেমন জঙ্গলে আগে জলের অসুবিধে ছিল, উনি ইনিসিয়েটিভ নিয়ে দু’টো টিউবওয়েল বসিয়েছেন তাছাড়া গ্যাস, সোলার লাইট, পানীয় জল নিয়ে কুলডিহা এখন রাণী। স্বভাবতঃই প্রশ্ন উঠে এল- তাহলে যোধাচুয়ায়? নাঃ, পরিষ্কার জানালেন সেখানে কিছু করেননি কেননা বেশীর ভাগ মানুষ কুলডিহায় এলে যোধাচুয়ায় যাবেই- যেহেতু ভরপুর সবুজ, গভীর অরণ্য কিন্তু ফেসিলিটিস্ তেমন নেই বলে থাকার কথা খুব একটা কেউ ভাবেন না

আমার যা বোঝার ছিল বুঝেছি, অনর্থক কথা না বাড়িয়ে প্রয়োজনীয় প্রসঙ্গে গেলাম জানালাম দু-একদিনের মধ্যেই ওঁনার এ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছি, বুকিং আমার চাই-ই এবার যে এ্যামাউন্ট উনি বলেছেন, তার সঙ্গে যেন একস্ট্রা পঁচিশ টাকা জুড়ে পাঠাই তা উনি মনে করালেন ওটা নাকি ক্যাশ ট্রান্সফারের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যাঙ্ক কেটে নেবে ভদ্রলোকের একদিকে অনায্যতার ডিলিং, অন্যদিকে পেশাদারীত্ব। মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না দিন কয়েকের মধ্যেই টাকা মিটিয়ে অপেক্ষায় রইলাম- নাঃ, কোনো হেরফের নেই, কথা তো কথাই। দশ দিনের মধ্যে পাকা কাগজ হাতে এল

সব গুছিয়ে নিয়েছি এবার বেড়বো ভোরের ট্রেন, মোবাইলের এ্যালার্মে কেউ পাখীর ডাক, শিশুর কান্না রেখে নিশ্চিন্তির কাঁথামুড়িতে গেলাম। উঠবো, সাজানো জামা-জুতোয় ট্যাক্সি ধরবো ও ধাঁ। কিন্তু ভাবার সঙ্গে ঘটে ওঠার বড্ড বিরোধ। মাঝে যে কোন রসিকজন সূক্ষ্ম রসের ভিয়েনঘরে জিরেন কাঠে পাক দিচ্ছেন... বেড়োবার ঠিক মুখেই চাবী হারালো। সময় তখন সেকেন্ডে দু মিনিটের হারে এগোচ্ছে। কত আর, মিনিট পাঁচেক এলোথেলো- তারপর এক তরুণীর হাতব্যাগ হাতড়াতেই... ব্যস, এবার আমরা ছিলে ছেঁড়া ধনুক- ছুটছি। খুশীকন্যার মুখের রোদ লেগেছে ভোরবেলাকার গায়। প্ল্যাটফর্মের চালায়, গাছের পাতায়, রেলইয়ার্ডের ফাঁকে আলতো আদরের মত কুয়াশার আস্তরণ।
জঙ্গলে যাচ্ছি, সঙ্গে চাল-ডাল-জল... হাতি থেকে আলপিন বাদ নেই কিছুই। সবাই মিলে বোঁচকা টেনে কোনমতে কোচে পৌঁছলাম গাড়ি স্পিড নিতেই এবার ভাবনপথে হাজির পরের সিন। নেমে কাকে ফোন করব, নীলগিরিতে বিসলেরী ওয়াটার পাব কিনা, কাঠের জ্বালে খাবারে ধোঁয়া গন্ধ ছাড়বে কিনা... ভাবতে-ভাবতে পৌঁছে গেলাম ‘বালেশ্বর‘ কতটুকু আর- সাড়ে তিনঘন্টার জার্নী।
প্ল্যাটফর্ম থেকে বাইরে বেরতেই শুনতে পেলাম ডাক- স্বপ্নমগন? হ্যাঁ, হ্যাঁ স্বপ্নমগন, প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ে কথাটা ধরলাম। ঝাঁ চকচকে বোলেরোর গায়ে ঠেসানে দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেটিই প্রশ্নকর্তা। আগাম ব্যবস্থা করে রাখা এই গাড়িটির ড্রাইভার উনি, নাম দীপ্তিময়

আমাদের দলের নাম স্বপ্নমগন মাঝেমাঝেই তার মগ্ন স্বপ্নে হলুদ-সবুজ রং ভরতে লাগে। যেমন এখন। পৌঁছে গেছি সদরে... অপেক্ষা শুধু প্রবেশের- অন্দরে।  ড্রাইভার দীপ্তিময়ের ব্যবহারে ছিল এমন এক দীপ্তি যা না থাকলেই মুস্কিল যতই হোক্ কদিন এর সঙ্গেই কাটবে। এন্ট্রি পারমিটের জন্য আমাদের বিট-অফিসে নিয়ে গেল দীপ্তিময়। অফিসার ওড়িয়া মহিলা তিনি হ্যালাফ্যালার একটা কাগজে হিসেব লিখে হাতে ধরিয়ে বললেন- কিছু বলার আছে? আমার বিস্ময় চরমে বলার থাকলেই বা কে শুনবে, নিয়ম তো নিয়মই! হঠাত্ এজেন্ট ভদ্রলোকের কথাটা মনে পড়ল- এখানে এলে নিজেই দুচোখে দেখবেন ম্যাম...‘  না, অফিসারের ঈঙ্গিতটা নজর এড়ায়নি বরং নিজেই উনি হেল্প করলেন। জানালেন, সঙ্গে ক্যামেরা থাকলেও উনি পেপারে লিখবেন না, ছোট ছেলেমেয়ে থাকলে তাকে পাঁচবছরের কম দেখানোয় আপত্তি নেই। বদলে যে টাকাটা উনি নেবেন, রসিদে তার উল্লেখ থাকবে না। আমি ভাবলাম, অসুবিধে কি- যেমনি ঠাকুর, তেমনি তার নৈবেদ্য জেনেবুঝেই এসেছি যখন। আধঘন্টায় কাজ মিটিয়ে নীলগিরি' থেকে মাছ-বাজার-বিসলেরী কিনে ছুট আমরা পৌঁছলে রান্না হবে, তারপর খাওয়া, তারপর... কি জানি কি তারপর, আগে তো পৌঁছই।

কুয়াশা অভেদ্য রোদের চাপা তাপ গায়ে মেখে- তাল, সুপারী, জংলী লতাপাতার সখ্যতা দেখতে-দেখতে পেরিয়ে গেলাম শেষ জনপদ নীলগিরি। বনের সরু পথ, পথের দুধারে সারিবদ্ধ গাছ, ফাঁক দিয়ে তার রোদ্দুর পড়ে আলো-ছায়ার আল্পনা আর অদূরে নদীর পটচিত্র। কাকে ছেড়ে কাকে দেখি ভাবতে-ভাবতেই ঝুপ্পুস আওয়াজ ও দুপাশে ফোয়ারার মত স্রোত। দেখি গাড়িটি কেন্দুনদীতে নেমে পড়েছে আর এ্যাক্সিলেটর দাবিয়ে জেদী নদী পেরিয়ে যাচ্ছে দীপ্তি- চাকার চারপাশে সেই আক্ষেপেরই জোয়ার হঠাত্ই গাড়ির নীচে বোল্ডার পড়ে ভেতরে বিপুল উথাল-পাতাল। আনাজ-পাতি, বিশ-লিটারি বিসলেরী, মানুষ-জন সব একধারসে ড্যাং-গড়াগ্গড় সামলাবো কি- হেসেই কুটিপাটি। কোথাও সীম-বেগুনের রাজ্যে আমি তো কেউ কাঁচা ডিমে ফ্যাচাস্। তবে ঐ একবারই। ঝোরা দেখলেই এরপর একে অন্যকে আঁকড়ে-পাকড়ে ধরেছি এতই বদল ছবি এই জঙ্গল দেখিয়েছে যে আগের রূপ মুছতে না মুছতেই চোখে অন্য অপরূপ এসে দাঁড়াচ্ছিল কুলডিহার প্রতিটি বাঁক যেন আছোঁয়া কিশোরীর উল্লাস-সহ জীবন্ত, বন্য, আদিম

বেলা দেড়টা নাগাদ পৌঁছোলাম যোধাচুয়ায়। বাজার-দোকান কেয়ার-টেকারের জিম্মায় দিয়ে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে পড়লাম। যদিও ঠান্ডা তবু আস্তানা জুটতেই শরীরে ক্লান্তি নেমেছে ঝাঁপিয়ে ছেলেরা বিছানা জুটতেই কেউ কম্বল-বালিশের সঙ্গে মিতালীতে, কেউ প্রকৃতিতে আটের বাচ্চাটি আলাপালায় ঘুরঘুর করে কাটাল আমাদের মেয়েদের চেতনাতেই যত দেখি ধূলোবালির ঝঞ্ঝাট... আগে স্নান অবশ্য কাঠের জ্বালে ফোটানো গরম জল হাজির হল তক্ষুনি
মূলোশাকের আবার ক্যাশমেমো-র মতই দেখি বুনো বাথরুমে আবার টালির বাহার ওদিকে দরজার দক্ষিণ কোণে মৌমাছি বাসা বেঁধেছে, সিলিং-এ উইয়ের আঁকিবুকি তবু মনের মধ্যে কি যে ছন্দোময় গান। আসলে বুনো জায়গার বন্যতাটাই আসল- যেন এটাই চাইছিলাম, ঠিক এমনই অগোছালো উদভ্রান্তি। নিজের ঘরে অথচ একটা মথ উড়ে গেলেও অশান্তি। অভ্যাস-মুক্তির এই আনন্দকে ছুঁয়ে যে আরাম উড়ছে আকাশে তা শিকড়ের টান বলে চিনতে পারলাম

ইতিমধ্যে কাঠের জ্বালে রাঁন্নাবাড়ি সারা, খিচুড়ি-ডিম-পাঁপড়-ভাজায় লাঞ্চ সেরে বেরোলাম। ঘন্টাখানেক জঙ্গল চষে যখন সন্ধ্যা নামছে, তখন দীপ্তি বলল ও পুকুরিয়ার দিকে গাড়ি  ঘোরাচ্ছে কিছুটা আন্দাজ করলেও বুঝে পেলাম না এমন কি আছে সেটা দেখবার ধন্ধ কাটাতে দীপ্তি জানাল ওটা একটা বড় পুকুর যেখানে জন্তু-জানোয়ার জল খেতে আসে। বাব্বা- চিন্তা হয়ে গেল। বলেই ফেললাম- একে অন্ধকার তায় কৃষ্ণপক্ষ

দীপ্তি ভারি দৃপ্ত বলল- আমি তো আছি ভয়ের ভার আমাদেরও কম না- প্রায় সাথেসাথেই বলে ফেললাম- ওরা তোমায় চেনে বুঝি? শ্লেষের শব্দকে ঠাট্টায় নেবার মতন শিক্ষা আছে দীপ্তির। তাই মৃদু হেসে গাড়ীতে উঠলো, পিছুপিছু আমরাও- পৌঁছে গেলাম পুকুরিয়া। বেশ বড়সড় পুকুর যার মাঝ-দরিয়ায় আর্টিস্টিক কেতায় দাঁড়িয়ে আছে এক ইকড়ি-বিকড়ি গাছ। ওপাড়ে দৃষ্টি-অগম্য আঁধারে কুচি-কুচি জোনাকী আর চুড়ান্ত নিস্তব্ধতার থম বাড়িয়ে চতুর্দিকে ঝিঁঝিঁর ঝুমঝুম এমনই সময় খুব কাছ থেকে জল পড়ার শব্দ শুনে দুদ্দাড়িয়ে এক পাবলিক দৌড়ে গিয়ে উঠল গাড়িতে। আকস্মিক এই ঘটনায় একেই ঘাবড়েছি, তায় মারাত্মক চমকে দিয়ে কোথা থেকে যেন তীব্র আলো পড়ল ঝোপে। দেখি দীপ্তি স্পটলাইট ফোকাস করেছে... এবং যেদিকে- সেদিকে আলোয় ভাসতে-ভাসতে এক লজ্জাখাকি পুরুষ কড়ে আঙুল তুলে জানান দিচ্ছে জল বিয়োগের কথা। তিনি যে কখন টুকটুক করে ঝোপের আড়ালে তা যেমন জানা ছিলনা, তেমনি জানা ছিলনা দীপ্তির সঙ্গে স্পটলাইট আছে জোড়া আকস্মিকতার ধাক্কায় তখন ‘স্বপ্নমগন’-এর স্বপ্ন ভেঙে খানখান, বুকে উত্তেজনার হামানকুট। খুব হয়েছে, গাড়িতে ফিরলাম- কাচ তুলে দিয়ে চুপচাপ বসলাম দীপ্তি আশাবাদী- বলল ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে পারলে হাতী একসময় পাবই মশা কামড়াচ্ছে তবু চড়-চাপ্টা মুলতুবী রেখেছি- পাছে হাতি পালায়। এভাবে মিনিট পাঁচেক কেটেছে কি কাটেনি- হঠাত্ই স্তব্ধ চরাচরে ফোঁসর-ফোঁসর শব্দ দীপ্তি সঙ্গেসঙ্গে স্পটলাইট তাক করল কিন্তু কোথায় কি- আওয়াজ তো গাড়ীর ব্যাকসীট থেকে আসছে। যিনি চেম্বার খালি করেছেন তিনি এখন নিশ্চিন্তির নিদ্রায় তাঁরই নাসিকা নিসৃত...

আঃ, আমরা আবার ঠকলাম, আবার হাসলাম গা কাঁপিয়ে অথচ টুঁ-শব্দটুকু না করে- পাছে হাতি পালায়। হায় বেচারী দীপ্তি ও তার স্পটলাইটএকগাছি হরিণ পেলেও হত। পুরো এ্যান্টি-ক্লাইম্যাক্স অগত্যা গাড়ি ছুটল বাংলোর দিকে। আমাদের সারপ্রাইজ দিতে গিয়ে দীপ্তির স্পটলাইট এমন অজায়গা-বেজায়গায় জ্বলে উঠল যে ও নিজেই চমকে-টমকে একশা।
জলে-জঙ্গলে অন্ধকার নামলে খুব বেশী কিছু করার থাকেনা। তাই ফিরেই সবাই ধোঁয়া ওঠা চা নিয়ে ছাদে উঠলাম। একতলা বাংলোর দোতলায় ছাদ, ঘন আঁধারে হাত-পাও ঠাওর হচ্ছে না। মোবাইলের আলোয় ধাপি খুঁজে নিয়ে বসলাম আড্ডার কোনো নির্দিষ্ট টপিক থাকল না কেননা দলের কেউ ফিল্মমেকার, কেউ ডান্সার, একজন কম্পোজার, মিউজিক ডিরেক্টর, ব্যাঙ্ক ম্যানেজার, হোমমেকার ও সঙ্গে ছুটকো এক কচি। সে লিসনার, সে অবজার্ভার। একমাত্র কম্প্যুটার সম্পর্কিত আলোচনা উঠলেই তার জ্ঞানগম্যির জ্বালায় অস্থির আমরা যে যার ফিল্ডের প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি-দিগদারী নিয়ে মেতে থাকলাম কিছুক্ষণ ও হিম পড়া শুরু হতেই নামলাম। ভোরে ঘুম ভাঙল ছুটকো ছেলের ডাকে। সে নাকি শিশিরের শব্দ শুনেছে অবাক হলাম- শিশির? সে তো মিহি, গুঁড়ো- তার আবার শব্দ কিন্তু সে শুনেছে ও সেটা শুনিয়েই ছাড়বে সবাইকে হাত ধরে টেনে বাইরে আনলো চিন্তায় পড়লাম- সারা রাত্তির ছেলে ঘুমোয়নি নাকি? আসলে রাত্তিরে যেটা হিম বোলে ও শুনেছিল সেটাই সকালে শিশির কিনা দেখতে চেয়ে ভোর-ভোর উঠেছিল তারপর ভেতর থেকে নাকি শুনেছে টুপটাপ শব্দ যা এখন আমিও শুনছি বললাম- ধুর, শিশির না বৃষ্টি  চল দেখি...
বাইরে বেরিয়ে দেখি গাছের পাতা-মাটি-উঠোন সব ভিজে, টুপটাপ শব্দও হচ্ছে অথচ আমাদের গা ভিজছে না। তবে? ছুটকো ছেলে দেখালো- বড় বড় গাছের এক পাতা থেকে অন্য পাতায় শিশির জমা জল পড়ে চলেছে অবিরাম আর তারই শব্দ টুপটাপ। আমরা তো আর গাছের তলায় নয়, দাঁড়িয়েছি এসে আকাশের নীচে। তাই স্পর্শে সে নেই আছে শুধুই শব্দে। ভাগ্যিস সে কৌতুহলী ছিল, নতুন এক  অভিজ্ঞতার সাক্ষী হয়ে গেলাম

আর নয়, এবার ব্রেকফাস্ট সেরেই দুদ্দাড়িয়ে উঠলাম গাড়িতে- গন্তব্য কুলডিহা। পথে পড়ল ঋষিয়া ড্যাম। বিশাল বড় নদী, নদীতে ফুরফুরে নৌকো, গ্রাম্য দিশপাশ, ন্যাংটা ছেলেপিলে, ধান আছড়ানো পাছাড়ে মগ্ন কৃষক, খড়-ছাউনীর চালের মাথায় সারে-বাহারে টুনটুনিদের কিচিমিচি। এমনই উন্মনা হলাম যে শেষে দীপ্তিকেই ডাকতে হল জানালো বেলা হয়েছে ঢের কুলডিহা পৌঁছে রান্না হলে তবে খাওয়া-দাওয়া তারপরে জঙ্গলে ঘোরা ব্যস, আর বলতে হল না- ইঙ্গিতেই কাম ফতে দৌড়ে সেঁধিয়ে গেলাম গাড়িতে। আবার বনতলের ছায়া মেখে জার্নী। গাড়ির ঠিক আগেই পাইলট কারের মত একটি হলুদ বুলবুলি চলেছে তার উড়াল সঙ্গে চলতে-চলতে পৌঁছে গেলাম কুলডিহা। এখানে টেন্টে উঠলাম- নতুনের স্বাদ নিতে চাই। ‘স্বপ্নমগন’-এর মনজমিতে তাঁবু-র ছায়া পড়তেই সব বাক্যিহারা। ঘুলঘুলি জানালা, দড়ির ফাঁসকল-আঁটা দরজা, কাঠি-পর্দা ভেদ করে ভেতরে রোদের আঁকিবুকি। ত্রিপলের তাঁবুটি যেন আপ্যায়ন নিয়ে সেজেগুজেই বসে… এবার নজর গেল দূরে। গাছের গায়ে ঠেসানে রাখা ইয়াব্বড় হাতির মাথার খুলি। কুল, বাঁদরলাঠি, গোলঞ্চর গাছ দিয়ে ঘেরা বাগানে পাখি আর অঢেল প্রজাপতি বাংলোটি পরিখা দিয়ে ঘেরাকিজানি কেন, হয়তো জন্তুর ভয়। সামনে সরু পথ, মাটি-মাটি উইঢিবি, অদূরে সল্টলিক... একটা তীব্র আবেশে জাপ্টে গেল মন। কাটতেও সময় লাগল না- কেননা এজেন্ট মানুষটি দেখা করতে এসেছেন। তিনি এসেছেন পঞ্চলিঙ্গেশ্বর থেকে জনা কুড়ির দল নিয়ে। দলটি একেবারে বেয়ারা টাইপের- বনের প্রাপ্য মর্যাদাই দেয় না। হট্টগোল, চিল্লামেল্লি, ব্যাটমিন্টন... যেন পার্কের মাঠে চড়ুইভাতিতে এসেছে এ এক অদ্ভুত বিড়ম্বনার জায়গা- বারণের কেউ নেই, করলেও বোঝার মন নেই। এলো, খেলো, খেললো, জন্তু কেন দেখলো না-র অনুযোগে ধুন্ধুমার চেঁচালো ও পাতা মাড়িয়ে খচরমচর শব্দ তুলে চলেও গেল। এজেন্টটির পঞ্চলিঙ্গেশ্বরে হোটেল আছে- ওখানকার ট্যুরিস্টদেরই এই ট্রিপে আনে। প্রায় রোজই নাকি সারাদিনের জন্য ঢোকে আর সন্ধ্যার মুখে বেড়িয়ে যায়। কি পায় এভাবে মানুষজঙ্গল কি কারুর ঘুঙুর বাঁধা পা যে নাচতে বললেই নাচবে? আসলে এক পাবলিকের পয়সার প্রয়োজন আর অন্যজনের কম সময়ে প্রাপ্তির। ব্যস, মিলে গেল হিসেব তবু যে টাকার সঙ্গে আছে সে গেনার প্রাপ্তির হিসেব কষা যে ট্যুরিস্ট সময় কঞ্জুষি করে প্রকৃতিকে পেতে চায়, তার আশা ভাঙবেই।   


ওরা চলে গেল, ঠান্ডা হল কুলডিহা... এবার কিছুক্ষণ চুপচাপ ঘন্টাখানেক সময়ের শুশ্রুষা পেতেই অস্তিত্ব মাড়ানো গানহারা কুলডিহা ফের ছন্দে হেসে উঠল, তার গালের পড়া টোলে মুখ দেখতে দেখলাম ভিজে আকাশকে। হঠাত্ই এক ধাড়ি স্ক্যুইরাল তার ফাঁপানো পুচ্ছ নাচিয়ে দৌড়ে গেল এক গাছ থেকে অন্যয়। খাওয়া-দাওয়া-রান্না ভুলে ‘স্বপ্নমগন’ মেদুর হয়ে গেল। তবে চাবী খোয়ানো সেই ভুলো কন্যা কিন্তু অনন্যা- কল্পনায় ঢুকলেও বাস্তব খোয়ায়নিএরই মধ্যে তার রান্নাবান্না সারা, টেবিল সাজিয়ে ডাকতে এসেছে। কুলডিহায় গ্যাস আছে- চাইলে কেয়ারটেকারও রেঁধে দেয়। খেয়েদেয়ে কাছের ওয়াচ টাওয়ারে উঠলাম, নজর সল্টলিকে- যদি পথভুলে... কিন্তু ঝাড়া দু-ঘন্টা কাটিয়েও কোথায়? মশায় অতিষ্ট হয়ে ঘরে ফিরলাম ও খেলায় মাতলাম- ডামসরাড্। মিনিট পনেরো বাদেই দরজায় ধাক্কাধাক্কি- দেখি কেয়ারটেকার ও ড্রাইভার দীপ্তি স্পটলাইট নিয়ে রেডী। একটা হাতী নাকি পরিখার আশপাশে ঘুরছে। নিজের মত যাবার উপায় নেই, একটা পার্টিক্যুলার পয়েন্ট অবধি ওদের সঙ্গে গেলামকৃষ্ণপক্ষের রাত জানান দিচ্ছে আঁধারের নিশ্ছিদ্রতা। কিছুটা পরেই ফস্ করে আলো জ্বলল... সেই স্পটলাইট কাঠকুটো মড়মড়িয়ে ভাঙার আওয়াজ পেলাম, গাছপালার দোলাচল দেখলাম, কিন্তু তিনি কোথায়? হয়তো অন্ধকার গায়ে মেখে ধূসর তিনি কাছেই...

পরদিন ভোরে ভাগ্যিস কটা নাচুনে হরিণকে নুন চাটতে দেখেছিলাম। বনের সার্থকতা বনের আপন মধ্যেই স্থিত। প্রাণীকুল তার সম্পদ ঠিকই কিন্তু তাদের জন্য যাওয়া মুখ্য হলেই মুশকিলএক এক জঙ্গল এক একভাবে তার সৌন্দর্যকে তুলে ধরেতীব্র লিপ্সা নিয়ে, বাধাহীন বহুদূর দৃষ্টি চালিয়ে ছুঁতে চেয়েছিলাম যে কুলডিহাকে, সে জঙ্গল অন্যরকম দু-হাট খোলা দু-দুয়ারী বিস্তার দেবেনা এজংলী ঘেরাটোপ এত ঘন- এত মজবুত্ যে আমি চাইলেও চোখ দিয়ে সবুজের নিশ্ছিদ্রতা ডিঙোনো যাবেনা

শেষমেষ সেই সবুজ ছোপানো মনে- নীলচে আকাশের রঙ, কুয়াশার শব্দ, তাঁবুর শিরশিরানী মাখামাখি হয়ে সবটা ভীষণ নম্র, মখমলি ও আর্দ্র হয়ে রইল। এবার সময় ফেরার। স্বপ্নমগনকি কখনো ডানা মুড়ে বসে থাকতে পারে... স্বপ্নহীন? পারেনা। তাই আগামীর সুর সাধতে-সাধতে সওয়ার হলাম ট্রেনে- নজর ঘরপানে। ফিরছি। ছেড়ে আসা পরিজন, ফেলে আসা কাজপত্র একে একে লাফিয়ে নামছে মনে। হাওয়ায় শুনছি নগরের গান, রোদ্দুরে কার্মিক কারুকাজ।

...................................................................................................................................................................

কিভাবে যাবেন- হাওড়া থেকে ভোরের ‘রূপসী বাংলা’ ধরে বালেশ্বর স্টেশনএখান থেকে ভাড়া গাড়িতে কুলডিহা।
কখন যাবেন- বর্ষাকালটা বাদ দিয়ে যেকোন সময়ই যাওযা যায়শীতকালটা আরামপ্রদ হলেও পশুপাখি দেখার জন্য গ্রীষ্মকালই ভাল।
যোগাযোগ- দীপ্তি রাউত- ফোন নং- 0986944354
Agent: মনোরঞ্জন দাস- ফোন নং- 09937332552
কোথায় থাকবেন- কুলডিহা ও যোধাচুয়া ফরেস্ট রেস্ট হাউস। উপরের ফোন নং-এ যোগাযোগ করলে ওরাই ব্যবস্থা করে রাখবে।
...................................................................................................................................................................

No comments: