—‘তাপ্পর সুনুবাবু! পালিয়ে যাবে কোথা বাছা।’
অঙ্কস্যার প্রথমে আমায় কান ধরে তুলে চেয়ারে বসিয়ে দিলেন। ছাতাটা খোঁটায় ঝুলিয়ে একে একে সবকটা জানালা বন্ধ করে টেবিলের বাতিটা একটু উসকে দিলেন। তারপর, রুমালে মুখটুখ মুছে পুঁটের কানের দিকে হাত বাড়ালেন। ল্যাম্পের আলোয় দেখলুম পুঁটে দিব্যি মাথা বাড়িয়ে দিল।
—‘তোরা সব কিষ্কিন্ধ্যার একএকটি রত্নবিশেষ! খালি ভেবে পাই না ল্যাজগুলো তোরা ঢেকে রাখিস কি করে। বলা যায় না কোনদিন দেখব, গাছে ঝুলে হুপহাপ করছিস!’
কিছুক্ষণ কান প্যাঁচানো চলল। তারপর উনি কোমর বেঁকিয়ে টেরিয়ে কিসব দেখে টেখে আঙুল মটকাতে লাগলেন। তারপর খুঁজে পেতে বেতটা বার করে টেবিলের উপর শপাং শপাং করে দুবার চালানো হল। শেষে আমার দিকে আড়চোখে কাষ্ঠহাসি হেসে বললেন, ‘প্রথমে ঠেঙিয়ে হাতে পায়ের খিল ছাড়াতে হয়, তখন হাত পা লড়ঝড়ে হয়, অঙ্করা সব দিব্যি গা হাত পা বেয়ে মাথায় ঢোকে।’
হবেও বা। কী দরকার বাবা! ঘন্টাকয়েক সামলে সুমলে নিলেই তো হয়। পুঁটেটা কি করছে? ওর আঁক কষার খাতা যে আমার কাছে, তা কি ও ভুলে গেছে?
খুট্ করে দরজায় আওয়াজ হল। বইপত্র নিয়ে গম্ভীরমুখে বকুলরানী আর শৈলদিদি ঘরে ঢুকলেন। পেছন পেছন দুহাতে রাজ্যের থালাবাসন নিয়ে গণাদাদু। শৈলদিদি ঘরে ঢুকেই সেজমার বানানো পশম আঁটা তুলোর ছোট গদির খোঁজ করতে লাগল। বকুল চেয়ারে বসে টেবিলের নাগাল পায় না কি না।
এদিকে চেয়ে দেখি টেবিলের উপর লুচি আর বেগুনভাজার মোচ্ছব বসেছে। অঙ্ক স্যারের চোখ ঢুলুঢুলু, চোয়াল নড়ছে শুধু। গণাদাদু একপাশে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। পুঁটে ইশারা করতেই আমরা চারভাইবোনেরা টেবিলের চারিপাশে পসরা সাজিয়ে বসে পড়লুম। অমনি সব কেমন নিঝুম হয়ে এল। ছাতের উপর কারিগররা হাতুড়ী পেটা থামিয়ে দিলেন। ঘরের ভেতর পোস্টাপিসের টরেটক্কাও বন্ধ। ছায়ারা সব নাচ থামিয়ে উঁকিঝুঁকি দিতে লাগল। শুনতে পেলুম বাড়ীর ঝি রা সব ঝাঁট দিয়ে দালান থেকে জল ছেঁচছে। জল থেমেচে বুঝি। নীচের তলায় কাদের সব গলা পাচ্চি। এতক্ষণ সব নাক মুখ সিঁটিয়ে বসে ছিল বোধহয়। ঝড় থামতেই কোমর বেঁধে নেমে পড়েছে। আমার পায়ের তলায় কেমন সুড়সুড়ি দিতে লাগল। চাদ্দিকে মনে হল কে যেন লক্ষ্মণের গণ্ডি কেটে দিয়েছে। গণ্ডি ভেঙে বেরিয়েছ কি অমনি খচমচ করে এসে তোমায় ধরবে।
এতক্ষণ মাস্টারমশাই পা নাচ্চাচ্ছিলেন, কচরমচর শব্দ হচ্ছিল, পুঁটে আর আমি টেবিলের তলা দিয়ে চিরকুট দেওয়া নেওয়া করছিলাম। এখন মাস্টারমশাই ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাং তুলে বসলেন, সুপসাপ শব্দ হতে লাগল, আর শৈলদিদি আমাকে একটা চিমটি কাটল। তা দেখে বেজায় বিরক্ত হয়ে আমি লজ সাহেবের বই খুলে বসলুম। দেখাদেখি ওরাও যে যার খাতাপত্র খুলে ঝিমোতে লাগল।
এমনি করে কতক্ষণ যে কেটে গেল। অঙ্কস্যারের ভোজ শেষ হল। হাত মুখ আঁচিয়ে, গামছায় মুখ মুছে টাগরায় শব্দ করলেন। গণাদাদু থালাবাসন তুলে এঁটো পরিষ্কার করে সরে পড়লে। তারপর ঘরের ভেতর পুরো দুটি ঘন্টা অঙ্কস্যার আমাদের নিয়ে হেস্তনেস্ত করে ছাড়লেন। পুঁটের পিঠে বেতের লাল দাগ পড়ল, শৈলদিদির খাতায় লাল ঢেঁড়া পড়ল, বকুলরাণীর ঠোঁট ফুলে লাল হল। আমার দিকে চেয়ে গজরাতে লাগলেন। খাতাপত্র ছিঁড়ে খুঁড়ে একশা কান্ড। শেষমেশ বড়ঘড়িতে যেই ঢং ঢং করে আটবার ঘন্টা বাজল অমনি ম্যাজিকের মতো কাজ হল। হুশ করে ছাতাটি নিয়ে দরজার ওপাশে মিলিয়ে গেলেন। আমরাও হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম।
রাতে ছোটমামার সাথে একবারও কথা হল না। রান্নাঘরে পাত পেড়ে খাওয়ার সময় দেখলুম কেউ ওকে মাছের মুড়ো দিল না। ওও কেমন ভালোমানুষের মতো মুখ করে দিব্বি সোনামুগের ডাল দিয়ে চাট্টি ভাত খেয়ে ফেলল। অথচ আমি জানি ও মাছের মুড়ো ছাড়া খেতেই পারে না। মাথায় দেখলুম সাদা কাপড়ের ব্যান্ডেজ বাঁধা। পুঁটে আর আমি কত মুখ চাওয়াচায়ি করলাম, ওকে কত ইশারা করলাম, কিন্তু কিচ্ছুটি হওয়ার নয়। মাথা নীচু করে সাপটে সুপটে খেয়ে দেয়ে সটান কলঘরে আঁচাতে চলে গেল। আমরাই বা আর কি করব, নিতাইদা থেকে থেকে শুতে যাওয়ার জন্য যা হুড়ো দিচ্ছিল! মাঝখান থেকে ম্যাও ম্যাও কেও খোঁজা হল না।
শোওয়ার ঘরে সারি সারি তক্তপোশ পাতা। সারি সারি বিছানা বালিশ, লেপ কাঁথা। আমি আর পুঁটে এখানে শুই। মাঝে মাঝে গণাদাদুও শোয়। বেনারস থেকে কাছারিবাড়ীতে লোক এলে তারাও মাঝে মধ্যে এসে শোয়। অবশ্য বেশির ভাগ দিনেই কেউ থাকে না। শৈলদিদির আলাদা ঘর রয়েছে। বকুল বড়মার কাছে শোয়। আমি আর পুঁটে তাই রাত বিরেতে দিব্যি গল্পগুজব করি। তক্তপোশের তলা থেকে ঘুড়ি লাটাই বার করে তদারকি করি। মাঞ্জা সুতো নাকের নীচে ঘষে ধার রয়েছে কিনা বুঝি। লন্ঠনের টিমটিমে আলোয় দেওয়ালের টিকটিকি গুনি।
নিতাইদা টেমির আলো নিভিয়ে চলে যাওয়ার পর পুঁটে এপাশ ফিরে ফিসফিসিয়ে উঠল,
—‘কিছু ভেবে পেলে?’
—‘না তো।’
—‘আচ্ছা আমরাও যদি ওর সাথে চলে যাই।’
তা কেমন করে হবে। সেজমা পুঁটেকে ছাড়বে কেন? রাতদিন জাপটেজুপ্টে ধরে আ পুঁটে হা পুঁটে বলে যা আদিখ্যেতা চলছে। তাছাড়া ইশকুলের কি হবে। অতসব যে মাঞ্জা দেওয়া হল, তারই বা কী হবে। চলে যাই বললেই তো হল না, লাট্টু লেত্তি ঘুড়ি সুতো খেলনা বইপত্র নিয়ে এই এলাহি ব্যাপার কে সামলাবে। আর ট্রেনে চড়তে আমি যে কী ভীষণ ভয় পাই। আর ম্যাও ম্যাও? সে আমাকে ছেড়ে থাকবে কী করে।
—‘তা হলে এখন উপায়?’
—‘ছোটোমামা নিশ্চয়ই কোনো উপায় ঠাউরাবে, ওর পেটে পেটে যা বুদ্ধি খেলে!’
পুঁটে চুপ করে রইল। কানখাড়া করে শুনলুম বাইরে আবার ঝাপুর ঝুপুর শুরু হয়েছে। তবে এবার যেন একটু ইনিয়ে বিনিয়ে। পাওনা গন্ডা কিছু বাকী ছিল বোধহয়, কিস্তিতে তার ধার শোধ চলছে। শীত শীত করতে লাগল। অন্ধকারে কাঁথার ভিতর গা হাত পা টিপে টুপে টেনে টুনে দেখতে লাগলুম। আমি পায়ের দশটা আঙুলও মটকাতে পারি। পুঁটে অবশ্য বুড়ো আঙুল গুলো পারে না। তবে ও কান নাচাতে পারে। ইশকুলে ও একদিন কান নাচিয়ে ছিল বলে রবিনসন সাহেব ওকে মিলিটারী চকোলেট খাইয়েছিল। আমি ভাগ পেয়েছিলুম। সাদা প্যাকেটে মোড়া, কেমন একটু তেতো খেতে। ওর থেকে মোরব্বা খেতে ভালো। মা কি ভালো বানাত মোরব্বা! তারপর সেই ক্রিসমাসের দিনে কেক! আমি তলা থেকে খুঁটে খুঁটে খেতুম। মা থাকলে কিছুতেই ছোটোমামাকে নিয়ে যেতে দিত না। কিছু না কিছু উপায় ঠিক বার করত।
মায়ের কথা ভেবে কেঁদে ফেললে আমি কক্ষনো হাত দিয়ে চোখ মুছি না। কাপড়ের খুঁট দিয়ে চোখ মুছি। আজও তাই করতে যাচ্ছিলুম। হঠাৎ খেয়াল করলুম পায়ের কাছে নরম গরম রোঁয়া রোঁয়া কি যেন একটা কাঁথার তলায় চুপিসাড়ে সেঁধোল। সঙ্গে সঙ্গে মন খুশি হয়ে গেল। যাক, ম্যাও ম্যাও তাহলে এখানেই ছিল।
4 comments:
পড়তে যে খুবই ভাল লাগছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এগোও, এগোও... আগামীর অপেক্ষায় রইলাম।
খুব সুন্দর তিতাস।
তিনটে পর্ব একসাথে পড়লাম। দারুণ লাগছে, অপেক্ষায় রইলাম।
ধন্যবাদ সবাইকে।
Post a Comment