ভোর হতেই ঝি-চাকরদের কত কাজ। বাসন তোল রে। দালান ঝাঁট দাও রে। উঠোন নিকোও রে। বাতি নেভাও রে। সারা বাড়ী একপ্রস্থ ধোয়া মোছা চলে। ভারীরা সদর রাস্তা থেকে জল বয়ে নিয়ে আসে। নাওয়ার ঘরে বড় বড় জালায় সেসব ভরে রাখা হয়। কোচোয়ানরা আস্তাবলে ঘোড়াদের ছোলা দেয়। হাত পা ডলে। বুনো গন্ধ শোঁকে। গোয়ালঘরে জাবনাতে গরুদের খড় বিচালি পড়ে। তুলসীতলায় গোবরগোলা জল ছড়ানো হয়। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল কতরকমের যে আওয়াজ হয়। বাসনপত্রের ঝনঝনানি। ভারীদের হুমহুম শব্দ। নাওয়ার ঘরে চাকরবাকরেদের হপাসঝপাস জল ঢালার শব্দ। বড়মার বকবকানি। তবে আমি শুধু জানালার পাশে বসে এসময় পাখিদের কিচিরকিচির শুনি। দেখি মাকড়সারা কেমন করে জাল বোনে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে চোখে আলো এসে পড়ে। হাঁ করে আলো খাই।
বেলা বাড়লে রান্নাঘরে ইতুপিসী দম ফেলার ফুরসত পায় না। বাবা আপিস যাবেন, জ্যাঠামশাইরা কাছারিঘরে শলা করবেন। উকিলবাবুর বাড়ী থেকে জাবদা খাতা নিয়ে লোক আসবে। নায়েব গোমস্তারা সব চরকি পাক খাবেন। এত সব লোকের জলখাবারের বন্দোবস্ত না করলে চলে! আমরা তখন রান্নাঘরে ইদিক উদিক ইতুপিসীর পায়ে পায়ে ঘুরি। ঝিয়েদের কুটনো কোটা বাটনা বাটা দেখি। নিমদাঁতন চিবুতে চিবুতে ঘটি বাটি উলটে সব মাখামাখি। সেসব দেখে ইতুপিসী দাঁতমুখ খিঁচিয়ে আমাদের তাড়া দেবে না বলো। তখন আমাদের দৌড় দেখে কে! একদৌড়ে বাগানকোঠা চালতেতলা হাঁসচরা পেরিয়ে পুকুরঘাটে এসে হাঁপ ছাড়ি।
পুকুরঘাটে সিঁড়ির পাশে পয়সাফুলের ঝোপ। কী সুন্দর নীল হলুদ পয়সাফুল। তক্ষুনি তুলে ফেলতে হয় নতুবা রোদ লাগলেই ঝরে যায়। ঝোপের পাশেই মস্ত শান বাঁধানো চাতাল। জেলেরা জাল গুটিয়ে, মাছ বেছে তুলে, পরিপাটি করে তেল মাখে। বড় বড় হাঁড়ির ভেতর রুপোলি সব মাছ আর খালি ছলাৎ ছলাৎ শব্দ।
পুকুরধারে বাতাবিনেবুর গাছ। গাছের ডাল নুয়ে পড়েছে জলের উপর। পুঁটে ডাল ধরে ঝুলে ঝুলে জলে ঝপাং দেয়। আমি অবশ্য ঝপাং দিতে ভয় পাই। সিঁড়ি বেয়ে কোমর জলে নেমে ডুব দিই মোটে। ততক্ষণে পুঁটে সাঁতরে হয়তো মাঝপুকুরে। আমাকে দেখে চেঁচিয়ে বলে, ‘দে ঝপাং দে। হাত পা নেড়ে এদিকে আয়। আয়, ডুবসাঁতার দিই। আয় না, দেখ না, জলের ভেতর কেমন সব সবুজ সবুজ।’
আমার সাহস হয় না। জলের ভেতর হাওয়া কই। পা ফেলার জায়গা কই। হাত বাড়িয়ে ধরার মতো খুঁটি কই।
তাছাড়া জলের নীচে ভুতভুতিয়া মাছ আছে। মাঝপুকুরে মস্ত বড় কুয়ো আছে। সেখান থেকে চোরাস্রোত ওঠে। পুঁটে যদিও সেসব পরোয়া করে না। ও চিতসাঁতার দেয়, ডুব সাঁতার কাটে, ওর অনেক দম।
নাওয়া সেরে আমরা ভিজে গায়ে ঘাসজমি পেরিয়ে সদরবাড়ীর দিকে রওনা দিই। আর তখন পুকুরঘাটে সারি দিয়ে হাঁসের দল চরতে নামে। ছোটোমামা কি ভালো হাঁস ধরতে পারে।
সদরবাড়ীতে রতনদা আমায় গা মুছিয়ে, মুখ টিপে চুল আঁচড়িয়ে দেয়। ইশকুল যাওয়ার জন্য চোগা চাপকান পরতে হয়। সেই সময় রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে সারি সারি পাত পড়ে। রাজ্যের আদুড়ে বাদুড়ে রোগা মোটা লম্বা বেঁটে লোকেরা সব হাপুস হুপুস করে চেটেপুটে পাত সাবাড় করে। বাবা জ্যাঠাদের জন্য অবশ্য আলাদা করে কাছারিবাড়ীতে ঠাঁই হয়। দেখাদেখি আমিও অত হট্টগোলের মাঝে যাই না। রতনদা আমায় পড়ার ঘরে এসে খাইয়ে দেয়। খালি রুপোর চামচে করে সুপটুকু আমি নিজে খাই।
এতসব শোনার পরে এর পর কী হয় সেটুকুও শুনে নাও। দেউড়ীতে আমাদের জন্য কালো ব্রুহ্যামগাড়ীখানা মজুত তো থাকেই। আমরা উপস্থিত হলেই সৈয়দ চাচা আমাদের সেলাম দিয়ে মুচকি হেসে দরজাখুলে দেয়। তারপর কোচোয়ানের সিটে বসে কষি ধরে একবার ঝাঁকাতেই শাহারজাদী নড়বড় করে চলতে শুরু করে। পাথরের রাস্তায় ঘোড়ার নালের খটমট খটমট বোল ওঠে। আমরা হাঁ করে রাস্তার রকমারি লোক দেখি, ব্যান্ডের আওয়াজ শুনি আর সেসব ছাপিয়ে সৈয়দ চাচার বিকট চীৎকার কান ঝালাপালা করে দেয়। ‘আলি এ সের, আলি এ হাক, আল তারানি’ আরো কী কী সব খকখকানি শব্দ।
আজকে যদিও এতসবের বালাই নেই। ইশকুল আজ যেতে হবে না। আজ তো রথযাত্রা। বিকেলবেলা বাগবাজার থেকে সং বেরুবে। রতনদা বলেছে দেখাতে নিয়ে যাবে। কিন্তু ছোটমামার কি হল?
মনে পড়তেই একছুটে ওর ঘরে। দেখি কী, পুঁটে আর বকুল আগেই এসে বসে রয়েছে। ছোটোমামার মাথায় এখনো কাপড়ের পটিটা বাঁধা। তক্তপোষের ওপর বসে মাথা ঝুঁকিয়ে মুখ বেঁকিয়ে পা দোলাচ্ছে। আমাকে দেখেই পা দুলুনি থামাল।
—‘হাঁ করে দেকচ কী? আমি কি করব? পইপই করে বলেচি, ওরে নবীনচাঁদ আমায় গোল আগলাতে দিস না। দিস না। এদিকে বাবুরা সব কাদা মাঠে আছাড় খাবেন আর আমায় খালি দোষ দেওয়া।’
—‘মারামারি করলে বুঝি!’
—‘দ্যুত! খানচারেক গোল খেতেই দেখি বাবুপাড়ার ছেলেগুলো কি বিশ্রী হাসাহাসি শুরু করল। তা দেখে আমাদের শ্যামদুলাল, নবীনচাঁদ অমনি ওদের দিকে তেড়ে গেছে। গন্ডগোলের মধ্যে ছুটে পালাতে গিয়ে— যাক গে, এসব থাক, শুনেছিস তো সব? এখন আমার কি হবে তাই তোরা বল?’
ভয় পেলেই ও কেমন ফোঁৎ ফোঁৎ করে নাক টানে। কী যে বিচ্ছিরি অব্যেস। আসোয়াস্তি ঝেড়ে একটা টুলের ওপর উঠে বসলুম। খানিক পরে পুঁটে বলল, ‘আমি একটা উপায় পেয়েছি।’
—‘কী?’
—‘ছোটোমামা, তুমি বরং দিনকতক শ্যামদুলালদাদের বাড়ীতে গা ঢাকা দাও। কেউ কিচ্ছুটি টের পাবে না। আমরা সব খবর পাচার করব তোমায়। কেউ খুঁজে না পেলে কেউ কি আর তোমায় টেনে নিয়ে যেতে পারবে?’
বুদ্ধির বহর দেখ! ছোটোমামাকে খুঁজে না পেলে তখন ওর নামে পুলিশে হুলিয়া জারি হবে না! একবার পুলিশে খবর গেলে লালপাগড়িরা ঠিক শুঁকে শুঁকে হাজির হবে। তখন!
এসব শুনে ছোটোমামা হাঁড়ির মত মুখ করে ঘরময় পায়চারি করতে লাগল। তারপর একসময় পায়চারি থামিয়ে আমার দিকে করুণ নয়নে তাকিয়ে বলল, ‘ইস্ দিদি যদি বেঁচে থাকত, কিছুতেই আমার এ দূর্দশা হত না।’
তা শুনে পুঁটে হড়বড় করে বলতে লাগল, ‘যা হোক, পুলিশেই ধরুক আর হুলিয়াতেই কামড়াক, তোমার এ বাড়িতে থাকলে আরো বেশী বিপদ।’
—‘তা কি আর আমি জানি না। ইস্, আমি কিনা ভেবেছিলাম এবার পাশ দিয়ে সাহেবদের অফিসে চাকরী নেব।’
শুনে হাসি পেল। ওর ওই প্যাংলা চেহারা দেখে সাহেবরা নির্ঘাত হো হো করে হেসেই উড়িয়ে দেবে। কেন যে ওর গায়ে মাংস গজায় না। তবে সেসব ভেবে আর কী হবে। কিছু একটা উপায় তো ঠাওরাতে হবে। বাড়ীতে কেউ ওর জন্য সুপারিশ করবে না। মেজজ্যাঠামশাই তো ওকে দেখলেই রেগে যান। দাঁত কিড়মিড় করেন। খালি ইতুপিসীর ওর জন্য মায়া আছে। কিন্তু ওঁকেই বা কে পোঁছে।
বসে বসে সাত পাঁচ ভাবছি এমন সময় ঘরের বাইরে চটির ফটাস ফটাস আওয়াজ শোনা গেল। ঢিমে তালে, ঠিক যেন শিকার ধরবে বলে এগোচ্ছে। এ আওয়াজ আমি চিনি। বেশ গম্ভীর আওয়াজ। বেশ একটা ‘ধরতে আসছি কিন্তু’ রকম ভাব। ঝপ করে মাথায় বুদ্ধি খেলে গেল। পুঁটে আর বকুলকে তক্তপোষের তলায় ঢুকিয়ে নিজে আলমারির পেছনে গিয়ে লুকোলুম। চটির আওয়াজ এখন আরো কাছে। বোধহয় বাইরের দালানে। আড়াল থেকে দেখি ছোটোমামা ক্যাবলার মতো ঘরের ঠিক মধ্যিখানে দাঁড়িয়ে আছে। ভয়ের চোটে ওর হাত পা গুলো কেমন ঝুলে পড়েছে।
আড়াল থেকে আরো দেখতে পেলুম চটি সমেত চটির মালিক এবার ঘরে ভেতর এসে দাঁড়াল।
4 comments:
বাহ্, এই পর্বটা সবথেকে বেশী এনজয় করলাম। আচ্ছা তুমি কি উত্তর কলকাতার ছেলে এবং পশ্চিমবঙ্গীয়? মানে পড়তে-পড়তে মনে হল আর কি। যদিও জানি তুমি এখন হাওড়ায় থাকো.... কিন্তু কখনো কি ছিলে? বেশ ভাল লাগল।
অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গবাসী এবং কন্মিনকালেও উত্তর কলকাতায় থাকিনি। একসময় কিছুদিনের জন্য দমদম ক্যান্টনমেন্টে ছিলাম। তারপর থেকে হাওড়াতেই।
তুমি তো বেশ ছেলে ভাই। লেখা রাখছ আর কাটছ, পরের লেখা পড়ছ না। নাঃ, বোঝা যাচ্ছে ধীরে তুমি সাফল্যপথে পা বাড়াবার নক্সা মক্সো করছ- তাই এই আত্মআবেশ.... তা বেশ, তা বেশ।
দারুণ, দারুণ, বাকি পর্ব তাড়াতাড়ি আসুক। চারটে পর্বই আজ একসঙ্গে পড়লাম।
Post a Comment