Wednesday 15 June 2011

ফ্ল্যাশব্যাক


মাসের 11.06.11-তে ‘NEWS বাংলা পত্রিকার খোলাআকাশ পাতায় কভার পেজে প্রকাশিত লেখা।

চন্দন রায়চৌধুরী

আলো ঝলমলে কয়েকটা দিন

সকালবেলা একদল রোদ্দুর এসে গায়ে-মুখে ঝাঁপাঝাঁপি করে ঘুম ভাঙিয়ে দিল। চোখ খুলতেই মনে পড়ে গেল কিছুদিন আগেকার দৃশ্যগুলো। ঠিক এমনি করেই খোলা জানলা দিয়ে সাঁই-সাঁই করে এসে কানে-কানে কত কিছু বলে ঘুম ভাঙিয়ে দিত। এই পর্যন্ত লিখে cut লিখতে বাধ্য হলাম। এই flashback এর শুরু থেকে না লিখলে পাঠক হয়তো ভাববেন বড় পুরনো ধরনের লেখা। এখনকার কিছু চলতি শব্দ ব্যবহার না করলে বা সিনেমার কিছু term ব্যবহার না করলে লেখা জমবে না। মানে আজকালকার চলতি শব্দে ব্যাপক হবে না। এবার শুরু করি তা'হলে flashback-এর প্রথম দৃশ্য দিয়ে।

দৃশ্য 1

সেদিন দুপুরবেলা অফিসে এসেছিলাম আমারই মুক্তিপ্রতীক্ষিত একটি ফিল্মের মিটিং-এ। সবে বসেছি, হঠাত্ ফোন এল ইস্টার্ন জোনাল কালচারাল সেন্টারের অভিজিত চ্যাটার্জীর কাছ থেকে। বলল- আপনি কি এখনই একবার আসতে পারবেন আমাদের সল্টলেকের অফিসে? রাঁচীতে আমাদের একটা ফেস্টিভ্যাল আছে ফোক-ডান্সের ওপর। সেটার কিছু মিউজিক কম্পোজ করতে হবে। ডিরেক্টর শ্রী অনুপ মতিলাল আজই সব ফাইনাল করবেন। একটা কাজে এসে আরেকটা কাজের খবর নিয়ে ভাবতে গিয়ে ভাবনাগুলো সব ফুটবল খেলতে শুরু করে আর কি। আসলে চিরকালই মিউজিকের নানা ক্ষেত্রে নিজেকে খুঁজে বেড়িয়েছি তা সে ক্লাসিক্যাল, মর্ডান কিংবা ফিল্ম, ডান্সড্রামা, থিয়েটার, এ্যাডফিল্ম... যাই হোক্ না কেন। এবার মনে মনে নিজেকে খোঁজার নেশায় ফোক্ মিউজিক যেন হাতছানি দিয়ে ডেকে নেশা ধরালো। যাই হোক্, মিটিং সামলে ছুটলাম EZCC-র অফিসে। জানতে পারলাম 28-শে ফেব্রুয়ারী থেকে 9-ই মার্চ অবধি থাকতে হবে রাঁচীতে, আর অক্টেভ 2011 নামে যে অনুষ্ঠান হবে তার মিউজিক কম্পোজিশনের দায়িত্ব আমার। নর্থ-ইস্ট জোনের আটটি জায়গার বিভিন্ন ফোক-ডান্স নিয়ে হবে এই ফেস্টিভ্যাল। সঙ্গে নানান রকমের প্রদর্শনী ও আঞ্চলিক পোশাকে থাকবে ফ্যাশান প্যারেড। যেটা আমার কাছে চ্যালেঞ্জিং মনে হল, তা হচ্ছে এই সমস্ত জায়গার মিউজিশিয়ানরা আসবে তাদের নিজস্ব মিউজিক্যাল ইনস্ট্রুমেন্ট নিয়ে। এবার তাদের নিয়ে মিউজিক কম্পোজ করে পারফর্ম করতে হবে। এর আগে বহু জায়গার যেমন মুম্বাই, দিল্লী, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদির মিউজিশিয়ানদের নিয়ে প্রোগ্রাম বা রেকর্ডিং করেছি। কিন্তু এবার যেটা আমাকে প্রলুব্ধ করল তা হল ওখানকার ফোক্ মিউজিককে খুব কাছ থেকে দেখা, জানা এবং সেই সঙ্গে ভ্রমণের একটা বাড়তি পাওনা। বাড়ি ফিরতে-ফিরতে প্ল্যান করলাম যেহেতু ডান্সের প্রোগ্রাম, সেহেতু স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে যাব। কিন্তু বাড়ি ফিরে শুনলাম ঐসময় ওর নিজেরই প্রোগ্রাম, তাই একাই যেতে হবে। অতঃপর জয় মা বলে রওনা দিলাম রাঁচীর উদ্দেশ্যে।

দৃশ্য 2   

1st March সকাল 10 টায় রাঁচীতে পৌঁছতেই একটি গাড়ি (যা আমার জন্য রাখা ছিল) নিয়ে গেল ন্যাশানাল ক্যাম্পের ভিলেজে। যেখানে গেস্টহাউস, সেখানে আমার জন্য একটি সুইট বরাদ্দ ছিল। ঘরগুলোতে ঢুকে আমার প্রথমেই মনে হল যে ওখানে ফুটবল বা ক্রিকেট যে কোনটাই খেলা যায় অথচ আমি থাকব একা। যাহোক্, কোন রকমে ব্যাগটা রেখেই গাড়িতে চলে এলাম ঠিক উল্টোদিকে, যেখানে হোস্টেলে আছে সমস্ত ডান্সারর্স এবং মিউজিসিয়াশস্। পৌঁছন মাত্র প্রোগ্রামের অন্যতম ভারপ্রাপ্ত গৌতম মুখার্জীর ফোন- ঠিকঠাক পৌঁছেছেন তো? আমি এখুনি আসছি।গাড়ি থেকে নেমে দেখলাম সামনের বিরাট খোলা জায়গাটায় যেখানে বড-বড় গাছগুলো শনশন হাওয়ার সঙ্গে ফিসফাস কথা বলছে, সেখানে চলছে নাচের মহড়া। কোরিওগ্রাফার তরুণ প্রধান আমাকে বসতে বলে ডান্সারদের নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। পরিস্থিতি বুঝতে একটু সময় লাগল বটে, কিন্তু সম্পূর্ণ নতুন পরিবেশ, নতুন পাত্রপাত্রী, বিরাট খোলা আকাশের নীচে রোদ্দুর আর বসন্তের আগমনের খবর বয়ে আনা বাতাসে মাটির গন্ধ, ঘাসের ছোঁয়া নিতে-নিতে আমি হারিয়ে যেতে থাকলাম নতুন নাটকের মাঝে। দুপুরে লাঞ্চ সারলাম সকলের সঙ্গে তারপর গেস্ট হাউসে ফিরে ফের ভাবতে বসলাম কম্পোজিশান নিয়ে। বিকেলে স্টেজ রিহার্সাল। সকালে এসে ইতিমধ্যে দেখে নিয়েছি বিভিন্ন জায়গা থেকে কি কি ইন্সট্রুমেন্ট এবং মিউজিসিয়ানস্ এসেছেন। প্রথমেই চোখে পড়ল অসম থেকে আসা চারজন ঢোলক প্লেয়ার এবং ফ্লুটিস্টের দিকে। এছাড়া শিঙা, করতাল, দোতারা, সারেঙ্গী এবং বিভিন্ন পারকাশনিস্টও এসেছেন মিজোরাম, অরুণাচল, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, মণিপুর ইত্যাদি থেকে। প্রত্যেকের নিজেদের বাজনার স্টাইলটা একান্তই তাদের নিজস্ব। দুপুর গড়িয়ে যখন বিকেলের দোরগোড়ায় তখন ফের গাড়ি করে স্টেজ রিহার্সালের গ্রাউন্ডে। গেস্ট হাউস থেকে এই মোরাবাদী গ্রাউন্ড বেশ দূরে। পথে যেতে-যেতে ছোট মত টিলা দেখতে পেলাম, যার চূড়ায় জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাড়ি। সাড়ে চারটেয় পৌঁছে গেলাম মাঠে। মনে হল এই অনুষ্ঠানে শুধু মিউজিক নয়, সাউন্ড ব্যালান্সটাও আমাকে করতে হবে। নাহলে এই বিশাল এরিয়া জুড়ে মিউজিক প্রোডাকসন ঠিকঠাক ভাবে শ্রোতার কাছে নাও পৌঁছতে পারে। স্টেজটি 100 বাই 80 ফিট, ব্যাকড্রপে সুন্দর ক্রাফটের ডিজাইনে লাল সূর্য্য, বাইসনের শিং, বর্শা ইত্যাদি দিয়ে লোকসংস্কৃতির ছাপ রেখে সাজানো। দেখেই ভাল লাগায় মন আচ্ছন্ন হল। সেদিন শুধুই ডান্স রিহার্সাল দেখলাম ও বুঝে নিলাম কি করতে হবে। পরদিন সকালে হোটেলের পিছনে খোলা আকাশের নীচে বড়-বড় গাছের ছায়ায় ঘেরা একটা জায়গায় শুরু হল আমার কম্পোজিশন ও রিহার্সাল। বলতে দ্বিধা নেই, এমন অনুভূতি আগে কখনো হয়নি। এমনভাবে নেচারের মধ্যে মিউজিককে শুনতে-শুনতে আক্ষরিক অর্থেই গায়ে কাঁটা দিচ্ছিল। মিউজিক যখন শেষ হল, তখন অনেকের হাততালীর শব্দে সম্বিত ফিরল। দেখলাম অভিজিত্, তরুণ, লাইট ডিজাইনার কনিষ্কদা একসঙ্গে উচ্ছ্বসিত তালিতে। মনে একটা প্রত্যয় এলো, মনে হল স্কুলের ফার্ট টার্মটা ভালই দিলাম।     

দৃশ্য 3

এরপর চলল কয়েকদিন ধরে রিহার্সাল। কখনও স্টেজে নাচের সঙ্গে, কখনও বা গেস্ট হাউসের ঘরে। কারোর মধ্যে কোনও ক্লান্তির চিহ্নমাত্র নেই। সুরসাগরে ডুব দিয়ে সবাই খুশী। এমনি করে সব ডান্সার, মিউজিশিয়ান, ই.জেড.সি.সি-র সমস্ত অফিসিয়াল, ডান্স কোরিওগ্রাফার, এই কর্মযজ্ঞের হাজার কাজের অন্যান্য সব কর্মীরা কখন যে মিলেমিশে এক হয়ে গিয়েছি তা নিজেরাও টের পাইনি। এমনি ভাবেই একসময় অনুষ্ঠানের মাহেন্দ্রক্ষণ এগিয়ে এল। টেনশনে যেদিন শুতেই পারছিলাম না। এ তো স্টুডিও রেকর্ডিং নয়, যে ভুল হলে যত ইচ্ছে শুধরে নেওয়া যাবে। যাই হোক্, অনুষ্ঠানের দিন সাড়ে চারটেয় পৌঁছে গেলাম। সমস্ত সাউন্ড চেক করে সকলকে সব বুঝিয়ে দিয়ে সব ইন্সট্রুমেন্টের সুর মিলিয়েও টেনশন আর কাটে না। আমার ছাত্র তন্ময় গিয়েছিল আমার এ্যাসিস্টান্ট হয়ে। ওকে বারবার বুঝিয়ে দিচ্ছিলাম কি করতে হবে, কিভাবে সামলাতে হবে, তবু শান্তি নেই। সব মিউজিসিয়ানরা কিন্তু খুব সহজ ভাবেই সিচ্যুয়েশনকে উপভোগ করছিল। আকাশে মেঘ করেছিল, হিমেল হাওয়ায় ধুলো উড়ছিল। ভবছিলাম যদি বৃষ্টি নামে তো কি হবে... সব পন্ড? কিন্তু ধূসর মেঘ মুচকি হেসে দু-চার ফোঁটা ঝরিয়ে দিয়ে কোথায় যেন উধাও হল আর ঝুপ করে নামল অন্ধকার। একটি গং (এর ধরণের বড় ঘন্টা) এর আওয়াজে শুরু হল অনুষ্ঠান। এই আওয়াজের রেশ রেখে, তার মধ্যে থেকে ভেসে এল একসঙ্গে অনেকগুলো শিঙার আওয়াজ এবং তারই সঙ্গে পাহাড়ি বাঁশীর সুরে সূর্যোদয়ের খবর যেন ছড়িয়ে পড়ল এক পাহাড় থেকে অন্য পাহাড়ের গা বেয়ে দূরে। পাহাড়ি যে বিগ ড্রাম, এবার তাদের পালা। গুরুগম্ভীর তার আওয়াজে ধীরে যেন দৈনন্দিন জীবনের ঘুম ভাঙতে শুরু করল। শোনা গেল পুরুষ ও মহিলা কন্ঠে লোকগীতির সুর যা খোলা আকাশের নীচে ছড়িয়ে পড়ে এক অদ্ভুত মায়াজাল সৃষ্টি করল। এরপর তালে-তালে সমস্ত নর্থ-ইস্ট কখন যে মিলেমিশে একই স্রোতে বইতে-বইতে প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের গান হয়ে দাঁড়াল আমি বুঝতেই পারিনি। সম্বিত ফিরে পেলাম অনুষ্ঠান শেষে যখন তরুণ এসে জোর করে আমাকে স্টেজে নিয়ে গেল সকলের সঙ্গে পরিচিত হতে। যা নিয়ে এত বিব্রত ছিলাম, তা অনুষ্ঠানের সাফল্যের পরেও মনের কোণে দিব্যি ঘাপটি মেরে বসেছিল। তারপর হঠাত্ই করতালির শব্দে আর অভিনন্দনের বন্যায় ভাসতে-ভাসতে অলক্ষ্যে একটা ব্যাথার সুরও চিনচিন করে অনুভব করলাম। বিদায়ের বাঁশী বাজতে শুরু করেছে। ই.জেড.সি.সি-র ডিরেক্টর শ্রী অনুপ মতিলাল, অফিসার এ্যাডমিনিস্ট্রেটর শ্রী প্রদীপ ঘোষ, ডিরেক্টর ফিনান্স শ্রী টি.কে বাসু এসে যখন মিউজিকের প্রশংসা করে গেলেন, তখন অনুভব করলাম সমস্ত স্তরের মানুষকে ছুঁতে পেরেছে আমার মিউজিক। আসলে ব্যাকরণগত যে সঙ্গীত তার সঙ্গে হৃদয়ের রঙ মেশাতে না পারলে তা কখনই সম্পূর্ণ হয়ে ওঠে না। অনুষ্ঠানের এ্যাঙ্কার শ্রীমতি গৌরী বসু আমাকে দর্শকের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেবার পর স্টেজ ছেড়ে যেতে সত্যিই খুব খারাপ লাগছিল।

দৃশ্য-4

ওদিনও রাতে আর ঘুম আসে না। মনে-মনে চলেছে এই কদিনের নানান কথা, টেনশন, উচ্ছ্বাস। একসময় কান্ত শরীর ঘুমের কোলে আশ্রয নিল ও ভোর হতে যখন ঠান্ডা বাতাস গান শোনাতে এল, শেষ শীতের মিঠে রোদ্দুর এসে ঘুমের সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে চাইল. তখন উঠতেই হল বিছানা ছেড়ে। অনেক কিছু পেলাম আবার ফেলেও চললাম সময়টাকে। অন্যান্য দিনের মত ডায়রী নিয়ে বসলাম, তারপর শেষবারের মত ঐ কদিনের পরিচিত ব্যালকনীতে দাঁড়ালাম, ফেলে যাচ্ছি এখানের যে আকাশ, তার দিকে তাকালাম। তাকালাম সেই বিশাল স্টেডিয়ামের দিকে, সবুজ ঘাসে মোড়া ধুধু মাঠের দিকে, সামনে শুয়ে থাকা পরিষ্কার পিচ বাঁধানো রাস্তার দিকে আর দূরে সেই হোস্টেল যেখানে রয়ে গেল অজস্র ভাল লাগায় মুখর, গত দশদিনের সুন্দর মূহুর্তগুলো।

5 comments:

আল ইমরান said...

প্রথমেই যে কথাটা বলবো দাদা, তোমার শিরোনামটা খুব ভালো হয়েছে। তবে প্রথম ছবিটা কেমন খাপছারা মনে হোল।

বাকি প্রতিটি দৃশ্যেই ফিল্মি ছাপ ছিল। তবে আরও কিছু ভালো ছবি দিলে চমৎকার হতো।

chandan roy choudhury said...

তুমি কি আমার লেখাটা মন দিয়ে পড়েছ ইমরান? রাঁচীর যে স্টেজে প্রোগ্রামটা হয়েছিল, এটা সেই স্টেজের ছবি, যা আমার খুব ভাল লেগেছিল ও লেখায় যার বিবরণ রেখেছি।

আল ইমরান said...

আবারও পড়লাম পুরোটা। হুম, দাদা, চোখ এড়িয়ে যায় নি, মন এড়িয়ে গিয়েছিল। ধন্যবাদ ধরিয়ে দেয়ার জন্য।

nilakash said...

আচ্ছা আপনিই কি বৌকথা কও, সুবর্ণলতা এইসব সিরিয়ালগুলোর মিউজিক ডিরেক্টর চন্দন রায়চৌধুরী?

Asim said...

এ্যসিসটেন্ট করে আমাকে নিয়ে যাবার কথা ছিল তো- কবে থেকে লাইনে ইঁট পেতে বসে আছি বল।