Sunday, 19 June 2011

পয়সাফুলের দিন - পর্ব ৫

মেজ জ্যাঠামশাই ঘরে ঢুকে একটা আরামকাদারায় আরাম করে বসলেন। তারপর গলা খাঁকারি দিয়ে ছোটোমামার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে বললেন, ‘শুনেছ তো সব।’
ছোটোমামা ঘাড় নীচু করে রইল।
—‘ওদিকে তোমার জন্য চাকরীর ব্যবস্থা হয়েছে। শিবরতনবাবুর নিজের খবরের কাগজ। প্রথম প্রথম না হয় খালি ডিকটেশন দেবে। বানান ভুল না করলে পরে না হয় উচুঁপদে বহাল হবেএছাড়া আরো একটি বিষয় বলতে আসা। সেটি হল ওঁর মেয়ের কথা। খাসা মেয়েএ ব্যাপারে দুতরফের মতও পাওয়া গেছে, এখন যত তাড়াতাড়ি ব্যবস্থা করা যায় ততই মঙ্গল। ব্যবস্থাপত্র অবশ্য তোমার পিতৃদেবই সব করবেন।’
ছোটোমামার ঘাড়টা কেমন ঝুলে পড়ল। ইনিয়ে বিনিয়ে বলতে লাগল, ‘আজ্ঞে আমি ভেবেছিলাম এবার পাশ দিয়ে অর্চিবল্ড সাহেবের অফিসে—’
—‘আর হাসিও না তো। বছরের পর বছর ঘাঁটি গেড়ে একই ক্লাশে পড়ে রয়েছ, তুমি দেবে পাশ! একথা আমায় বিশ্বেস করতে বলোলোকে শুনলে হাসবে। এমনকি ওই যারা খাটের তলায় লুকিয়েছে তারাও একথা বিশ্বেস করে না।’
কী ভয়ংকর, দেখে ফেলেছে নাকি!
—‘শোনো, তুমি বেনারসে ফিরে যাওয়ার পরই শুনছি কথাবার্তা সব পাকাপাকি হবে। ভিঞ্চি মহারাজ নিজে সব তদারক করবেন বলেছেন। এ একেবারে আমাদের পরম সৌভাগ্য।’
—‘আজ্ঞে ভি-ভিঞ্চি মহারাজ!’
‘কী হল?’ মেজ জ্যাঠামশাই বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে ছোটোমামার দিকে তাকালেন, ‘নাম শুনে ওরকম ঘাবড়াচ্ছ কেন? অবশ্য ওঁর মতো মহাপুরুষের নাম তোমার মতো অপোগণ্ডের মুখে আসাটাই যথেষ্ট বিস্ময়ের! উনি যে রাজি হয়েচেন এ তোমার চৌদ্দপুরুষের ভাগ্য ভালো বলতে হবে। শিবরতনবাবু নিজেও গৃহপালিত জামাই পেতে খুব উৎসাহী। তোমার পিতৃদেব তো সম্মতি জানিয়েই দিয়েছেন।’
—‘আজ্ঞে শি-শিবরতনবাবুর মেয়ে—’
—‘তোমার হলটা কি? কালেজের বকাটে গুলো বুঝি মাথা খাচ্চে? নাকি বেম্মদের সাথে মিশচো? বিবাহের কথা শুনে অমন করছ কেন? সিংহের সে তেজ কই?’
ছোটোমামা মরমে মরে গিয়ে চুপটি করে দাঁড়িয়ে রইল। জ্যাঠামশাই ফের একবার গলা কেশে সাফ করে নিলেন।
—‘তল্পিতল্পা সব গুছিয়ে রেখোকালই ওঁরা সবাই আসছেন। আমরা তার পেয়েচি। ভিঞ্চি মহারাজ নিজেও আসচেনআহা, বেনারসের ঐ ঘুপচি গলিতে যতসব ছোটলোকদের সাথে থাকা কী আর পোষায়গুরুদেব এখানে কিছুদিন থেকে হাওয়া বদল করবেন এই যা
—‘এঅ্যাঁ! সে কী!’
—‘কেন হে! তোমার আপত্তি আছে বুঝি! বলদের শিং গজাচ্ছে দেকচি। শুনে রাখো, যা বললুম তার বিশেষ নড়চড় হবে না। বড়কর্তাও মত দিয়েছেন। ভালো চাও তো এই বেলা সব বাক্সপ্যাঁটরা ঝাড়পোঁচ করে রাখো।’
আড়াল থেকে দেখলুম একথা শুনে ছোটোমামার মুখ কেমন কাঁদো কাঁদো হয়ে গেল। আমারই তো কেমন যেন গলা বুজে আসছে। ওদিকে তক্তপোষের তলায় যারা রয়েচে তাদের কী অবস্থা কে জানে? আমার কেমন উসখুশুনি হতে লাগল।
একটু পরেই মেজজ্যাঠামশাই আরো সব নানান উপদেশ-টুপদেশ দিয়ে উঠে চলে গেলেন। আমরাও যে যার লুকোবার জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে এসে ছোটোমামাকে গোল করে ঘিরে ধরলুম। দেখি ওর কান কেমন লাল হয়ে রয়েছে। নাক দিয়ে ফোঁস ফোঁস করে গরম নিঃশ্বাস ফেলছে। তা দেখে, বকুল আমার জামার ছিট টেনে ধরে বলল,‘অপোগণ্ড মানে কী দাদাভাই?’
—‘আঃ জ্বালাস না তো। ও ছোটোমামা, শোনো, কিচ্ছুটি ভয় পেয়ো না। আমরা তো আছিই।’
ছোটোমামা ধপাস্‌ করে টুলের ওপর বসে পড়ল।
—‘তোমরা আর কতটুকু কী করতে পার। শুনলে তো সব। ঐ ভিঞ্চি মহারাজও আসচেন।’
—‘তাতে ভয় কী ছোটোমামা। এল তো ভারী বয়েই গেল। আমরা বাগানকোঠায় লুকোনোর জায়গা জানি। বড়দালানের পাশে একচিলতে খুপরি মতন আছে। ওখানে শুকনো খড় বিছিয়ে রাখব। তার উপর না হয় শুয়ো।’
—‘তোমরা তো কিছুই জান না। ঐ ভিঞ্চি মহারাজ একটি আস্ত বদের হাঁড়ি। ব্যাটা এতদিনে টের পেয়েছে। তাই শুঁকে শুঁকে একেবারে এইখেনে হাজির।’
এই বলে ছোটোমামা চট করে দরজাটা বন্ধ করে আমাদের দিকে ঘুরে বড় বড় চোখ করে বলতে লাগল, ‘ভীষণ প্যাঁচের ব্যাপার এ সব। কাউকে চট করে এ কথা বলেছ কী গেছ। আড়ালে আবডালে কী যে সব চলছে তার টেরটি পাওয়ার উপায় নেই। অথচ সব কেমন ভালোমানুষের মতো মুখ করে বসে আছে।’
আমরা অমনি রহস্যের গন্ধ পেয়ে ক্যাঁওম্যাঁও লাগিয়ে দিলুম, ‘কী রহস্য, না না বলতেই হবে। ও ছোটোমামা, বলো না আমাদের সেই বড়বড় ভাঁটার মতো চোখওয়ালাদের কথা। সেই যে পা গুটোনো পাতলুন পরে চোরেরা কেমন দারোগাদের বউদের হার চুরি করে, আর বনের ভেতর কেমন সব হানাবাড়ীর হদিস পাওয়া যায়—’
—‘শ স্‌ স্‌ স্‌। ওসব নয়। আসল লোক হল ঐ ভিঞ্চি মহারাজ। সব টের পেয়ে গেছে। তাইতো আমায় একেবারে হাতে নাতে ধরতে আসছে।’
—‘ও মা, সে কী কথা। তোমায় ধরবে কেন?’
—‘তোদের বলতে পারি, কিন্তু খবরদার এসব কথা যেন পাঁচকান না হয়।’
ভীষণ রেগে গিয়ে বললাম, ‘আজ ওবধি কোন কথা পাঁচকান করা হয়েচে শুনি। গতবার দোলের সময় কতই না সব কান্ডকীর্তি হল, সেসব কাকে—’
—‘আহা হা, চুপচুপ। এতো কথার কথা বলছি রে ভাই। আজকাল কতই না সাবধানে চলতে হয় জানিস। গুপ্ত খবর চেপেচুপে রেখে এমন অবস্থা হয়েছে যে—’
এই বলে আমাদের মুখগুলো একবার দেখে নিয়ে ছোটোমামা চোখ সরু করে বলল, ‘কেন ধরবে না তাই তোরা বল। কী বলে, আমিই তো কত্তামশায়ের উইল হাতসাফাই করেছি। ওই উইল মোতাবেক ভিঞ্চি মহারাজেরই তো সব সম্পত্তি পাওয়ার কথা।’
আমরা সব হাঁ করে দাঁড়িয়ে রইলুম। এতই অবাক হয়ে গেলুম যে ম্যাও ম্যাও কোনফাঁকে ঘরে ঢুকে ছোটোমামার জলখাবারের থালা বাসন পেয়ালা পিরিচ সব উলটে ফেলল তা দেখেও দেখলাম না। কাদের সম্পত্তি? কিসেরই বা উইল?
এদিকে ছোটোমামা গলা নীচু করে ঘুমঘুম স্বরে বলতেই থাকল, ‘ভাগ্যিস দিদি সব বুঝে গিয়েছিল। আরে, ওই তো আমায় বুদ্ধি দিল উইল চুরি করে ওদের সাথে কলকাতায় পালিয়ে যেতে। এদিকে কত্তামশাই কুটোটুকুও টের পাননি। রোজকার যেমন সিন্দুকের চাবি বালিশের তলায় নিয়ে শুতে যান তেমনই হয়েচে। কিন্তু হুঁ হুঁ বাবা আমিও কি কম দিন হলো দাশুবাবুর ম্যাজিকের আখড়ায় অ্যাপেন্টিসগিরি করেচি।’
শুনে আমার হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে এল। কানে ভোঁ ধরল। মনে হতে লাগল, চারিদিকে কী ভয়ংকর রকমের একটা ষড়যন্ত্রের জাল বোনা হচ্ছে। পুঁটেও দেখি আমার দিকে কেমন ফ্যাকাশে চোখে চেয়ে আছে। খালি বকুল এসব সাংঘাতিক ব্যাপার কিচ্ছুটি টের পেল না খালি আমার হাতটুকু টেনে ধরে বলতে লাগল, ‘উইল কী দাদাভাই, ও দাদাভাই, উইল কী বলো না, দাদাভাই—’

No comments: