বিকেলে সঙ দেখতে গিয়ে যা মজা হলো। একটা গাড়ীতে আমি, পুঁটে, ছোটোমামা আর ম্যাও ম্যাও। অন্য গাড়ীতে শৈলদিদি বকুল আর রতনদা। বড়রা কেউ আসতেই চাইল না। কাল সকালবেলাতেই খুড়োমশাই এসে পড়বেন কিনা। সাথে ভিঞ্চি মহারাজ। সাড়া বাড়ীতে তাই কী এক যেন সাজসাজ রব পড়ে গেচে। ঘরদোর আনাচ কানাচ সব ঝাড়পোঁচ মোছামুছি ধোয়াধুয়ি চলছে। বাতিদান, পিকদান, ঝাড়বাতি, গড়গড়া তামাক কলকে সব তেল চুকচুকে একশা। কাছারিঘর থেকে ইয়া মোটা মোটা কবেকার পুরোনো হিসেবি হাওলাত খাতাপত্র সব মুটেদের মাথায় করে চালান যাচ্ছে। নায়েবমশাই জাবদা খাতায় রুল টেনে একবার জমার ঘরে লিখচেন, ‘আদায় বাবদ মাসিক দুপয়সা সুদ’, পরক্ষণেই খরচের খাতায় ঢেঁড়া টানছেন, ‘ষেটের বাছার জন্যি আধসের দুধ’। গোরা পল্টনের উকিলবাবুরা সব এয়েচেন। জ্যাঠামশাইদের মুখ দেখলুম খুব গম্ভীর। যত তোষামুদে গোমস্তারা কাছারিঘর সরগরম করে বসে রয়েচে। চাকরবাকরেরা সব তটস্থ। মুখ থেকে কথা খসার আগেই চা, পান, তামাক, গড়গড়া কলকে সব পৌঁছে যাচ্ছে।
ভেতরবাড়ীতেও দেখি একই রকম গোলমাল। দরজাতে সব নতুন ঝালর টাঙানো হয়েচে। খুড়োমশাইএর শোওয়ার ঘর পরিপাটী করে গুছোনো হল। ভিঞ্চিমহারাজ থাকবেন দোতলার পুবদিকের ঘরে। সেঘরে সকাল হতে ধূপধুনো চড়িয়ে, পালঙ্কে সাদা চাদর বিছিয়ে ইয়া মোটা মোটা সব বালিশ তোষকের ব্যবস্থা হয়েচে। ঘরে নাকি মেজমার নিজের হাতে তৈরী নকশী করা উড়নি ঢাকা রেকাবিও রয়েচে। আমি অবশ্য দেখিনি কেননা ছোটদের ও ঘরে যাওয়া নিষেধ। ওদিকে রান্নাঘরে বড় কড়াইতে তেল ছেড়েচে। ঝি বামনিরা সব ময়দা ঠেসে ভিয়েন মেখে ঘেমে নেয়ে কূল পাচ্চে না। বড়মা সব নিজে হাতে তদারকি করছেন। সেজমার উপর ভার পড়েচে ঠাকুর ঘরের কোষাকুষি, তামার বাসনপত্র সব তকতকে করে হাতের কাছে গুছিয়ে রাখা। ঠাকুরের পাঁচ রকম নৈবেদ্য তৈরী হবে। ধামা ভরা খই, চিঁড়ে, নাড়ু, আটকড়াই, সব মেপে শুনে দেখে বুঝে রাখতে হবে না! এরমধ্যেই ঠাকুরদালানের সামনে আবার গোবরজলের ছিটে পড়ল। মহারাজ ওখানেই নাকি বসে সাধনভজন করবেন।
ঘাটের দিকেও হইচই কম নয়। বাগানকোঠার সামনে মিস্ত্রিরা সব বাঁশ বাঁধছে। ওখানে রাতভর কীর্তন হবে। সূতানুটি থেকে বাজিয়েরা এসে গেচে। বাগানকোঠার ভেতরে একতলার বৈঠকখানায় তাদের থাকার ব্যবস্থা হয়েচে। সদর দেউড়ীতে লাল শালু দেওয়া ম্যারাপ। ঘোড়াদের নালে যত ধুলো কাদা সব ঝেড়ে ঝুড়ে সাফসুতরো। এমনকি সৈয়দ চাচাকে অবধি দেখলুম দাড়ীতে নতুন লাল রঙ করেচে।
মোটকথা সক্কলে এমন ব্যস্তসমস্ত হয়ে উদ্বিগ্ন মুখে ঘুরে বেড়াচ্চে যে আমরা কোনফাঁকে বেরিয়ে এলুম সেসব কেউ টেরই পেল না। খালি ইতুপিসী বেরোনোর সময় রতনদার হাতে দুটি পয়সা দিয়ে বলল, ‘ও রতন আমার ক্ষান্তর জন্য দুটি পুতুল আনিস’।
যাইহোক, বড়রা কেউ না আসাতে ভালোই হল। নইলে যা হুকুমদারি চলত। গাড়ীর জানালা দিয়ে মুখ বের কোরো না, গোরা পল্টনের দিকে তাকিয়ো না, গাড়ী থেকে নেমে কোথাও যেও না, আরো নানান এটা ওটা। ভালোই হল, আমি আর পুঁটে দিব্যি জানলা দিয়ে চারিপাশের তামাশা দেখতে দেখতে এলাম। খালি ছোটোমামা অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে গোঁজ হয়ে বসে রইল। শেষে দেখি মাথা হেলিয়ে দিব্যি নাক ডাকিয়ে ঘুম দিচ্ছে। পারেও বটে।
সারাটা দিন আকাশ মেঘলা। কখন থেকে টাপুর টুপুর করে বৃষ্টি হয়েই চলেছে। পুঁটে বলল রথযাত্রা কিনা তাই এমনি। পুঁটে ছাই জানে। আমাদের ইশকুলে শেখায় কেমন করে বৃষ্টি হয়। সাগর পেরিয়ে মেঘেরা জল বয়ে নিয়ে আসে। তারপর সেই জল উব্বুড় হয়। নদী নালা খাল বিল পুকুর দিঘী টইটম্বুর। আমরা সে জল গায়ে মাখি, খাই দাই। রোদ পড়লে আবার সে জল আকাশে উড়ে পড়ে।
টিপটিপানি বৃষ্টিতে পাথরের রাস্তা সব পিছল। সৈয়দ চাচা আজ আর অত হাঁকডাঁক করছে না। শাহারজাদীও ফুরসত পেয়ে দিব্যি খোশমেজাজে টুকুস টুকুস করতে করতে চলল। আমরা বাইরে দেখলুম আমাদেরই মতো জুড়িগাড়ীতে চেপে ফরসাপানা মেম চলছে। তার হাতে দস্তানা, মুখে চুমকি বসানো জাল, মস্ত বড় টুপিতে রঙবাহারি পালক। তারপাশে আরো লম্বা টুপি ওলা এক বুড়োসায়েব। স্যাঁতস্যেঁতে হাওয়ায় তার ঘুমে দুচোখ জড়িয়ে আসছে। তাদেখে আমাদেরও লম্বা লম্বা হাই উঠতে লাগল। দেখলুম রাস্তায় কত লাল নীল সাদা পতাকা লাগানো এইটুকুনি রথ বের হয়েছে। ছোটছেলেমেয়েরা সুন্দর কাপড় পড়ে কাদা বাঁচিয়ে রথ টানছে। পিছনে কত চাকরবাকর। জগন্নাথ ঠাকুর গড়গড়িয়ে কুটুমবাড়ী চললেন।
একটু পরেই দেখি চারপাশে কত ভীড়, বাজনার আওয়াজ। বুঝলুম পৌঁছে গেছি। ছোটোমামাকে ঠেলা মারতেই ও ঘুমঘুম চোখে আমার দিকে চেয়ে রইল।
পিছনের গাড়ীও থেমেছে। গাড়ী থেকে রতনদা নেমে এসে মুখ বাড়িয়ে বলল, ‘খোকাবাবুরা এইখেন থেকেই সঙ দেখো। ঐ মোড়ের রাস্তার দিকে চোখ রেখো। কিন্তু খবরদার, গাড়ী থেকে কেউ নেমোনি যেন।’
দেখলুম বিশাল উঁচু ছচাকাওয়ালা বৈঠকখানার রথ। কত উঁচু। তার পিছনে পোস্তার রথ। রথের ভেতর ফুলমালায় ঢাকাঢুকি জগন্নাথদেব। আর কত লোক। রথের পিছনে পিছনে পুরোহিতরা হাঁটছেন। সামনে কাছি ধরে কত লোক রথ টেনে নিয়ে যাচ্ছে। পিছনে রঙবেরঙের পতাকা। কারো মাথায় কারুকার্য করা ঝালর ঝুলোনো ছাতা। কারো হাতে নক্সা করা তালপাতার পাখা। আরো পেছনে সড়কি হাতে লেঠেলদের দল। কারো হাতে ঝুনো নারকোলের শাঁস আর কাপড়ের মশাল। মুখে হুমহাম করে সব আওয়াজ তুলছে। আর তার পিছনেই সঙেদের দল। সঙমাস্টার হাত পা নেড়ে বকাবকি ঝকাঝকি করছে। আর সঙেরা সব কতরকমই না সেজেছে। একজন দেখলুম হলুদ, আলতা, সিঁদুর, পাউডার, চকখড়ি, মেখে বউ সেজেছে। একজন রাম হয়েছে। একজন নিমাই হয়েছে। একজন সিংহ সেজেছে। আর চারপাশে সব শিঙে, ঘন্টা, পাতিল, হারমোনিয়ম, ঢাক, ঢোল, খোল, খমক বাজিয়েই চলেছে। সঙেরা হাতপা নেড়ে কে কী বলছে কিচ্ছু শোনা যাচ্ছে না।
আমরা হাঁ করে এসব দেখছি, হঠাৎ দেখি বড় বড় চোখ, উস্কোখুস্কো চুল, ঝোলা পাতলুন পরা ঠেলা নিয়ে এক ফিরিওয়ালা আমাদের গাড়ীর পাশে দাঁড়িয়ে আমাদের দিকে তাকিয়ে হাসতে লাগল। দেখলুম ওঁর দাঁতে মিশি। ঠেলাটা দাঁড় করিয়ে আমাদের সামনে ওর ঝাঁপির ঢাকনা খুলল। অমনি ঝাঁপিতে কি আছে দেখার জন্য মুখ বার করলুম।
দেখি কী যত মেয়েদের জিনিসপত্রে বোঝাই। বিরক্ত হয়ে চোখ সরাতেই ফিরিওয়ালা ঝাঁপি বন্ধ করে বলল, ‘শুধু এই নয়, আরো দেখাতে পারি। দেখতে চাও বুঝি।’
পুঁটে বলল, ‘আমাদের বারণ আছে। আমরা অচেনা লোক দেখলে কথা বলি না। অচেনা লোকের কাছ থেকে কিছু নিই না।’
তা শুনে ফেরিওয়ালা ভয়ানক রকম হাসতে লাগল। ব্যাপার দেখে ছোটোমামা গলা বার করে বলল, ‘এইও! কী চাই কী শুনি।’
—‘তা, খুব বেশী আর কি চাই। দুটি ভাত চাই, পরণের কাপড় চাই, মেয়েদের জন্য পুতুল চাই।’
—‘পুতুল! তা সে তো তোমার ঝাঁপি থেকেই তো দিতে পার।’
ফিরিওয়ালা জিব কেটে বলল, ‘না না তা কি হয়! সব যদি নিয়েই নিলুম তবে বেচব কী।’ তারপর কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল, ‘বেচতেই বা পারি কই। বাবুরা কী আর সস্তা জিনিস কেনে?’
—‘তা গরীবদের বেচলেই পারো!’
ফিরিওয়ালা ভীষণ অবাক হয়ে বলল, ‘ও মা সে কী কথা। গরীব দুখিরা চুলই বাঁধে না তো চুল বাঁধার কাঁটা চিরুনি। হাওয়া মাখে না তো নক্সাদার হাতপাখা। রঙ গুলে আলতা বানায়, লালমাটি গুঁড়ো করে সিঁদুর দেয়। ওদের কী আর শখ আহ্লাদ আছে গো বাবু।’ এই বলে ফোঁৎ করে নাক মুছল।
আমার ভীষণ মায়া হলো। শুধোলুম, ‘এই, তোমার নাম কী?’
তাই শুনে ফিরিওয়ালা ফিক করে হেসে বলল, ‘গরীব গুর্বোদের নাম থাকতে নেই। আমায় ফিরিওয়ালা বলে ডেক।’
এমন সময় সৈয়দচাচা কোচোয়ানের খোপ থেকে হাঁকারি দিল। তা শুনে ফিরিওয়ালা ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে বলল, ‘বাবুরা যদি একটু মায়া দয়া করেন তো এই অধম প্রাণে বাঁচে।’
পুঁটে অমনি শৈলদিদির গাড়ীর দিকে দেখিয়ে দিল। ফিরিওয়ালা তো মহাখুশি। গলা বাড়ীয়ে মুখ তুলে ফিসফিস করে বলল, ‘গরীবদুখীরা কত রকম কাজ করে দেয়। উপগার কখনো ভোলে না। দরকারে কাজে লাগে। বুদ্ধিবাতলায়।’
শেষ কথাটা শুনে আমার কেমন বিচ্ছিরি লাগল। কথার কি ছিরি। ছোটোমামা তাড়াতাড়ী বলে উঠল, ‘চৌরঙ্গীর দিকে আসনা কেন? ওখানে কত বাবুদের বাড়ী আছে। কাজও পেতে পারো।’
তা শুনে ফিরিওয়ালা একগাল হেসে বলল, ‘তা কি আর জানি না। ভাবছি ওখানেই ঘঁটি গাড়ব।’ এই বলে শৈলদিদিদের গাড়ীর দিকে ঠেলা নিয়ে এগিয়ে গেল।
আমরাও বাকি সময় সঙেদের মজার কান্ড দেখে খুব খানিক আমোদ করে ম্যাও ম্যাও কে জিলিপি খাইয়ে বাড়ীর দিকে রওনা দিলুম।
সন্ধ্যে প্রায় হব হব। রাস্তায় গ্যাসবাতিগুলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তাঘাটে লোক নেই। আধো আলোয় অন্ধকারে কিছু দেখাও যায় না। সকালের ব্যাপার স্যাপার নিয়ে ছোটোমামার সাথে শলা করবো ভাবছি, তা দেখলুম এবারও ও অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসে রইল। তাই সারা রাস্তা আর কিচ্ছুটি কথা হল না। খালি আমি আর পুঁটে মিলে বন্ধ জানালার কাঁচের ধোঁয়াশায় নিজেদের নাম লিখলুম।
তবে বলার মতো ব্যাপারটা ঘটল দেউড়ী দিয়ে ঢোকার সময়। গাড়ীর জানালার কাঁচে ধোয়াঁশা জমেচে বেশ। হাত দিয়ে তাই মুচছি, এমন সময় বুকের ভিতরটা ছাঁৎ করে উঠল। রাস্তার ওধারে ঠেলা নিয়ে ফিরিওয়ালাটা দাঁড়িয়ে না!
No comments:
Post a Comment