Tuesday, 21 June 2011

পয়সাফুলের দিন - পর্ব ৮

সেরাতে ভালো করে ঘুমই হোলো না। থেকে থেকে কেমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে লাগলুম। একবার দেখলুম আমি আর পুঁটে। রান্নাঘরে আরশোলা ভাজা তদারক করছি। বড় কড়াইতে চড়বড় করে আরশোলা ফুটছে। ইতুপিসী থেকে থেকে গাওয়া ঘি ঢালছে আর এই বড় খুন্তি নিয়ে পাক দিচ্ছে। একবার সেই ফিরিওয়ালাটাকে দেখলুম। হাঁউমাউ করে কেঁদেই চলেছে। তার ঠেলা ভর্তি পুতুল, কেউ কিনছে না। দেখলুম শৈলদিদির স্কার্ফ নিয়ে হাঁসেরা পালাচ্ছে। ওদের পেছনে লেজ উঁচু করে ম্যাও ম্যাও। আরেকবার দেখলুম ছোটোমামা আর মেজজ্যাঠামশায়। সামনে ইয়া বড় একটা বাস্‌কো। জ্যাঠামশায় ফিতে নিয়ে বাস্‌কো মেপে ছোটোমামাকে —আচ্ছা, সে কথা বরং থাক। মোটকথা, সারারাত ঘুমই হোলো না, তাই কার যেন খোঁচা খেতেই তড়াক করে উঠে বসলুম।
—‘ইস্‌, ওদিকে লোকজন সব এসে গেছে, আর এদিকে এরা উলটে পড়ে নাক ডাকাচ্ছে। এই সুনু, ওঠ বলছি। এত নিশ্চিন্তি কিসের তোদের! আর দেখ পুঁটে, ফের যদি আমার দিকে অমন করে চেয়ে থাকবি তো ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।’
অগত্যা উঠতেই হল। চেয়ে দেখি পুঁটেও উঠে পড়েছে। আমি জানি ঘুম থেকে উঠে ওর কিচ্ছু মনে থাকে না। চটিজুতো কোথাও কিচ্ছু খুঁজে পায় না। থমথমে হাঁড়ি মুখ করে পাথরপরীর দিকে চেয়ে বসে থাকে।
এদিকে ছোটোমামা ঘরময় পায়চারি সুরু করেছে। ঘনঘন মাথা নাড়ছে, আঙুল মটকাচ্ছে। চেয়ে দেখলুম ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি আর কী করি, চুপটি করে চাদর জড়িয়ে দরোজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম।
     দেখি নীচের রোয়াকে রীতিমতো হইচই কান্ড। বাবা-জ্যাঠামশায়রা সব সার দিয়ে সদর দেউড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। ওঁদের পেছনে নায়েব গোমস্তারা সব চশমা ঠুলি এঁটে জোহুজুর। কীসব গুজগুজ ফিসফাস চলছে। একতলা দোতলার বড় ঘর থেকে বড়মা সেজমারা সব ক্ষণে ক্ষণে সদরের দিকে উঁকি দিচ্ছেন। ঝি চাকরবাকরেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে এ ওকে হাঁক পাড়ছে, কোঁদল করছে। সদর থেকে কাছারিঘর অবধি লাল গালচে পাতা। দুপাশে সার দিয়ে খাস বেয়ারারা সব দাঁড়িয়ে। কোচোয়ান দারোয়ানেরা নতুন পাগড়ী পরে কোমরবন্ধ এঁটে গম্ভীর মুখে খালি খালি আকাশের দিকে চাইছে। ম্যাওম্যাওকেও দেখলাম হাঁড়িপানা মুখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।
     এমন সময় ব্রুহ্যাম গাড়ীখানা সদরের সামনে এসে থামল। অমনি ঝিচাকরদের হাঁকডাক সব চুপ। নীচের তলার ফিসফাস বেড়ে মৌমাছির ভনভনানি। জ্যেঠিমারা সব লালপেড়ে কাপড় পরে ঘোমটা টেনে নীচে নেমে এলেন। এদিকে গণাদাদুও কাঠের পাদানি নিয়ে গাড়ীর সামনে হাজির। দেখলুম বড়জ্যাঠামশায় ছুটে গিয়ে কৌচের দরজা খুলতেই, ভেতর থেকে একটা নীল মোজা পরা পামশু আঁটা ধবধবে সাদা পা বেরিয়ে এল। হাঁচোড়পাঁচোড় করে পায়ের মালিক ধুতি সামলে, মাটিতে নেমে একবার গলাখাঁকারি দিলেন। অমনি দেখি বড়জ্যাঠামশাই টপ করে প্রণাম ঠুকে দিয়েছেন। এই বুঝি খুড়োমশাই। তাই হবে বোধহয়। ধবধবে ফরসা চুল। ফরসাপানা গায়ের রঙ। সাদা ধুতিপাঞ্জাবি। পকেটে ট্যাঁকঘড়ি। মুখখানা কেমন রাশভারী। দেখলুম বাবা-জ্যাঠারাও হুড়োহুড়ি করে খুড়োমশায়ের একেবারে পায়ের কাছে। নায়েব, গোমস্তা, জো হুজুরেরাই বা পিছু থাকবে কেন। তারাও হুমড়ি খেয়ে, ঠেলা ঠেলি করে, এ ওকে ধাক্কা দিয়ে অনাছিষ্টি কান্ড। খালি বড়মা সেজমারা দূর থেকে কান্ড দেখে শাঁখে ফুঁ দিলেন।
     ঠিক সেই সময় গাড়ীর ভেতর থেকে আরেকজন বেরিয়ে এল। আপাদমস্তক গেরুয়া ঢাকা। মাথায় কান ঢাকা গেরুয়া রঙের পটি। পায়ে খড়ম। ছোটমামা যেমন বলেছিল, তেমন রোগা নয় মোটেই। বরং দস্তুরমতো মোটা। বোধহয় চাপা রঙ। একহাতে কমন্ডুলু মতন কিছু একটা ধরা। অন্য হাতে ইষ্টমালা। কোমরে ঘুনসি। কপালে তিলক। সরু চোখ। সরু হাসি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই তবে ভিঞ্চি মহারাজ!
     ফ্যোঁৎ করে একটা শব্দ হতেই দেখলুম কখন পাশে পুঁটে আর ছোটোমামা এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের চোখ বড়বড়, মুখ হাঁ। ছোটোমামার নিশ্চয়ই পিলে চমকাচ্ছে। পুঁটে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
     এদিকে খুড়োমশাই শশব্যস্ত হয়ে ভিঞ্চি মজারাজকে এগিয়ে দিয়েছেন। আশে পাশে যারা ছিল তারা সব উপুড় হয়ে বাবাজীর পায়ে। হুড়োহুড়ি আর কী আদিখ্যেতা! দেখতে দেখতে কত সব লোক জড় হয়ে গেল। আদ্দেককে চিনতেই পারছিলুম না। শাঁখ বাজছে, উলু দিচ্ছে, হা ঠাকুর যো ঠাকুর অবস্থা। গালচের দুধারে বড়মা জ্যেঠিমারা সব দেখলুম ঘোমটা টেনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রয়েছেন। কান্ড দেখে যা হাসি পাচ্ছিল। গড় সেরে উঠবে যখন তখন সব্বার নাকে নিশ্চয়ই রোয়াকের শ্যাওলা লেগে থাকবে।
      ভিঞ্চিমহারাজ একটু করে এগোচ্ছেন আর কমন্ডুলু থেকে শান্তিজল বিতরণ করছেন। দূর থেকে মনে হল বিড়বিড় করে কিছু বলছেনও বোধহয়। হইচইয়ের আওয়াজে কিছু শুনতে পাচ্ছিলুম না। আগে আগে বড় জ্যাঠামশায়। খাতিরদারী করে মহারাজকে বৈঠকখানার দিকে নিয়ে চলেছেন। মহারাজের পিছনেই খুড়োমশায়, হাতে ছড়িটি নিয়ে টুকটুক করে হাঁটছেন। ছড়িখানা মনে হলো রুপো বাঁধানো।
যাহোক, জ্যাঠামশায়, মহারাজ আর খুড়োমশায়কে নিয়ে তো বৈঠকখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সাথে সাথে বাকিরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। একতলা দোতলার দরজা জানালা থেকে যারা সব উঁকিঝুঁকি মারছিল তারাও সব যে যার কাজে লেগে পড়লো। জ্যেঠিমারা ধুলোটুকু মাথায় মুছে টপ করে সোজা রান্নাঘরে। চোদ্দ রকম রান্না হবে। ইতুপিসী কি আর একা সামাল দিতে পারবে সব!
—‘কি রকম বুঝলি!’  
দেখলুম ছোটোমামা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে চেয়ে আছে। আমি আর কী বুঝব! ওই ভীড়ের মাঝে কালকের ফিরিওয়ালাটা কেমন করে এল তাই তো এতক্ষণ বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
চুপ করে আছি দেখে পুঁটে আর ছোটোমামার সেকী উশখুশুনি! দুজনে মিলে আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে নীচু গলায় কি সব ফন্দি আঁটতে লাগল। আমিও কিচ্ছু না ভেবে পেয়ে ঘরে ঢুকে তক্তপোষের ওপর হাত পা এলিয়ে শুয়ে পড়লুম।
     অন্যদিন এসময় রতনদা আমাদের নাইবার জন্য হুড়ো দেয়। আজ নিশ্চয়ই সে খুব ব্যস্ত। আমাদের দিকে তাকানোর সময় কোথা। কতরকম কাজ বাকী তার। মা থাকলে এতক্ষণে আমাদের নাওয়া হয়ে যেত। গরম কাপড়চোপড় পরিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দেওয়া হতো। কাঁসার থালার উপর কলাপাতায় গরম ভাত পেতুম, গরম ঘি পেতুম, মৌরলা মাছের ঝোল পেতুম, নালতে শাকের ব্যজন পেতুম। শেষপাতে ছানার পাকের মিষ্টি পেতুম, তবেই না—
     এই এক মুশকিল! দিননেই রাত নেই চোখের কোনায় জল। গলা ভারী। মহা বিরক্ত হয়ে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছছি, এমন সময় রতনদা কাষ্ঠহাসি হেসে ঘরে ঢুকল।
—‘তাই বলি! দেকেচ আমারও যে কি ছাই ভুলো মন!’
অমনি খুশি হয়ে টুক করে ওর পিঠে চড়ে বসলাম। রতনদাও আমায় পিঠে নিয়ে দিব্যি সিঁড়িঘর দিয়ে নেমে ঘাটের পথ ধরল। পেছনে পুঁটে আর ছোটোমামা। দেখলুম মেঘলা আকাশ যেন একটুখানি ফরসাপানা হয়েছে। অবস্থা বুঝে পাখিরাও এতক্ষণে বোল ধরেচে। সকালের কতরকম শব্দ থাকে না! পাখিদের কিচিরমিচির, রাস্তায় লোকজনের খচমচ, জমা জল পাতায় পড়ার টুপটাপ। আঁতকে আঁতকে উঠতে হয়। পয়সাফুলের ঝোপের পাশে দেখলুম কাগের পালক পড়ে। তা দেখে রতনদা গুনগুনিয়ে সুর ধরল,
খুঁটি নড়ে, দেয়াল পড়ে, চাল ওড়ে গোওওও,
কেঁচোর খোঁজে ব্যাঙ ঢোকে আমার ঘরে গোওওওও।
রইল পড়ে ময়নামতী
গভীর পারা ভবনদী—

—‘ভবনদী কি রতনদা!’
—‘ভবনদী কি জানোনা খোকাবাবু! ভবনদী গো! মস্ত নদী। সোজা ঐ তোমার সগ্‌গে যায়।’
—‘রাস্তা চেনো তুমি, আমায় নিয়ে যেতে পারবে!’
—‘তা কি আর চিনিনে খোকাবাবু! তবে ওখানে ছোটদের যেতে দেয় না।’
পুঁটে পেছন পেছন দাঁতন চিবুতে চিবুতে আসছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সব মিছে কথা। আমায় মা বলেছে, কাম্‌লিরা বড় মিছে কথা বলে।’
রতনদা হোহো করে হেসে উঠল। তারপর ফের গান ধরল,
           বাহ গো ডোম্বী, বাহিয়া চল ইছামতীর তঅঅঅরে
           সোজা পথে, চিত্তির যেন থরহি নাই করে
           খুঁটি নড়ে, দেয়াল পড়ে, চাল ওড়ে গোওওও,

5 comments:

আল ইমরান said...

"বড় কড়াইতে চড়বড় করে আরশোলা ফুটছে"

এই লাইন টা পড়ে আমার গিন্নির সে কি সিটকানো...........

তবে ওকে সিটকাতে দেখে আমি আরও জোরে জোরে পড়ি। শেষ পর্যন্ত ঘর থেকেই দৌড়ে বের হয়ে গেলো। হা হা হা হা হা ................

অসাধারণ দাদা। সবগুলোই পড়ছি। কিন্তু মন্তব্য করিনি। তবে আজ অবধি পড়ে মনে হোল মন্তব্য না করলে এর দায় পুরন হবে না।

কতগুলো পর্ব দেবেন দাদা??

Unknown said...

তিতাস, এ্যাজ ইউজ্যুয়াল তুখোড়। 'গড় সেরে উঠবে যখন তখন সব্বার নাকে নিশ্চয়ই রোয়াকের শ্যাওলা লেগে থাকবে' পড়ে ও তোমার কল্পনায় যাবার ধরণ দেখে মুগ্ধ হলাম। এত কাজপত্র করেও কি করে এমন লিখে চলেছ গো টপাট্টপ?

দেরী হল লিখতে। কেন বলতো? কলকাতায় প্রচন্ড বৃষ্টি, ফোন লাইনে জল ঢুকে আমার নেট বেড়ানো বন্ধ। কি সুক্ষণে এইমাত্র ঢুকতে পেরেই লিখলাম... জানিনা থাকবো কতক্ষণ।

nilakash said...

এই লেখা 1900-র নয় মনে হচ্ছে 1800-র। আপনার পড়ার তারিফ করতেই হয়, প্রায় নিঁখুত বর্ণনা।

তিতাস বেরা said...

@ইমরান আল হাসান, পড়ার জন্য ধন্যবাদ। আশা করি আরো বেশ কিছু পর্ব লিখবো। সংখ্যাটা কত ঠিক করিনি। গল্পটা নিজে নিজেই শেষ হোক।

@মঞ্জুদি,কাজপত্র সেরে লিখতে পারছি কই। চাপ সামলে রোজকার লেখালেখি প্রায় হচ্ছেই না তো। আর কলকাতায় বৃষ্টি তো ভালোই। জল টল জমলে আরো ভালো। 'স্পোর্টিংলি' নাও।

@নীলাকাশ,আপনি ঠিকই ধরেছেন। এ গল্প ঊনবিংশ শতাব্দীর। ঠিকঠাক ভাবে বলতে গেলে ১৮৯০ এর কাছাকাছি সময়ের। আমার মনে হয় বর্ণনা আরো নিঁখুত হওয়া উচিত ছিল। আরো ভালো করে হোমওয়ার্ক করতে হত। পড়ার জন্য ধন্যবাদ।

Asim said...

এই পর্বতেও আগ্রহ বেড়ে গেল। কিভাবে শেষ করবেন কিছু ভেবেছেন?