Tuesday 28 June 2011

অনিন্দ্য রাত্রিপ্রাঙ্গণে

একটা ঘুড়ি উড়ছিল একটু আগেও। নাটাই হাতে হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটি ঘুড়িটাকে পাকা নাচিয়ে হাতে ওড়াচ্ছিল। তারপরই ভোঁকাট্টা, এখন একলা হয়ে ঝুলে আছে গাছের ডালে। বৃষ্টিহাওয়া ঘুড়িটাকে ওর কাছ থেকে আলাদা করে উড়িয়ে এনে বসিয়ে দিয়েছে অন্য জায়গায়, সে এখন বৃষ্টিতে ভিজছে আর বোকা বোকা চোখে ওর ভিজতে থাকা নেতিয়ে পড়া গোলাপী-সাদা ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। গলির মুখে আটকে যাওয়া অনেকের সাথে নীল সালওয়ার-কামিজ বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে মাথায় তুলে দিচ্ছে আকাশনীল ওড়নার আড়াল। সেঁটে যাচ্ছে আরও বেশী করে দেয়ালের সাথে। মুঠোফোনে তাড়া দেওয়া প্রেমিককে এইমাত্র রাগীমুখে যেন ধমকে উঠল সে, তারপর ফোন ব্যাগে পুরে অখন্ড মনোযোগ ঢেলে দিল মুখ আর হাতের বিন্দু বিন্দু জলকণার প্রতি।


বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য দেখি আর ভেতরে ভেতরে কাঙাল হয়ে উঠি। খন্ড খন্ড আবেগ বিক্ষিপ্ত হয়ে মিশে যেতে চায় অঝোর বৃষ্টির সাথে। আমার একলা লাগতে আরম্ভ করলে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে চিলেকোঠায় উঠি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকি পলেস্তাবা খসে যাওয়া দেয়ালের ইতিউতি থেকে যাওয়া স্মৃতিমাখা দাগগুলোর দিকে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে খোলা দরজা দিয়ে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াই, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কষ্টগুলোকে স্নান করাতে থাকি। ছাদে নেমে আসে বৃষ্টিগন্ধা প্রবল আকাঙ্খার এক সন্ধ্যা। দাঁতে দাঁত কামড়ে কষ্টগুলোকে আড়াল করি, সযত্নে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসি চুপচাপ।




বৃষ্টির তোড় কমে না, তার মধ্যে বার দুয়েক আমাকে বর্ষাতি পরে বেরোতে হয় আলু,লঙ্কা, ডিম আনতে। এনে দিই, সিগারেট ফুরিয়েছিল সেটাও মনে করে কিনি। ঘরে ঢুকে দেখি রিনি সুখী সুখী মুখে খিচুড়ি রাঁধছে। ইলিশ নেই বলে ডিম কষা, আর আলুভাজা করবে বলে রান্নাঘর থেকেই জানান দেয়। বৃষ্টিশব্দ ছাপিয়ে ওর চুড়ির টুং টাং আওয়াজ আর মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ দুইই আমার ইন্দ্রিয়ে অস্বস্তি এনে দিলে আমি বসার ঘরে বসে কিছুক্ষণ দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন পুনরায় মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, হঠাৎ মনের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে কেউ, একটা বৃষ্টিভেজা আবছা মুখ জলের ভেতর থেকে মুখ তুলে ফের ডুবে যায় হুস করে। আমি তার ফিসফিস করে বলা কথা শুনতে কান পাতি বুকের গভীরে। তার ভেতরে ডুব দেবার প্রবল তৃষ্ণার অনুভব আমাকে ভেতর থেকে নিয়ে যায় দূরালোকে। ক্রমশ তার স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করি ঘাড়ে, কপালে,চুলে।রিনি এসে রাতের খাবার খেতে ডাকে। ওর ডাকে ঘোরের সুতো ছিঁড়ে যায়। দুম করে সুতো কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত আচমকা ঝুলতে থাকি শূন্যে।




খাবার পরে সারা ঘরে ঝাঁ ঝাঁ আলো জ্বেলে রিনি রাতের প্রসাধন সারে আর আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সিগারেটে লম্বা ছাই জমে, হৃদস্পন্দনের মধ্যে ফের অনুভব করি তাকে। রাস্তায় জল জমে গেছে, আলোর প্রতিবিম্ব জলে দোল খায় আর ঝিকমিক করে সেসবের মধ্যে দেখতে পাই ছেঁড়া ছেঁড়া স্থিরমুহূর্তকে। খুঁটে তুলে নিই এক এক করে স্মৃতিদৃশ্য, জমিয়ে রাখি পাঁজরের প্রতি খাঁজে। ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে পুরোনো ঠিকানায় ফিরে যাই। এক বছর আগের বৈদ্যুতিন চিঠিগুলো ঘুরেফিরে পড়ি। দুজনের কথপোকথনগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর, বৃষ্টিস্নানের পর পুনরায় জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো, পুরুষত্ববোধের তলায় চাপা পড়া কষ্টগুলো এবার গলতে শুরু করে। বেরিয়ে আসে ওরা নোনাজল হয়ে। প্রবল তোড়ে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে যেতে যেতে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।


ছায়াশরীরী দক্ষ সে তীরন্দাজ ফেলে গেছে বৃষ্টির বধ্যভূমিতে
তার অনিশ্চিত ফেরার প্রতীক্ষায় বৃষ্টিজলে মুখ রেখে অস্ফুটে বলি
ভস্ম হয়ে মিশে যাবো বাতাসে তবু ছড়িয়ে দেবো স্ফুলিঙ্গ চারদিকে
অস্থিটুকু পুঁতে দিও বাগানে; পুনশ্চঃ জন্ম নেবে এক শ্বেতকরবী।

6 comments:

Unknown said...

তুমি তোমার লেখক জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছ মেঘ। আমি এটা পড়ে বাক্যরহিত। এত ভাল লিখছ তুমি, এত ভাল!!!!! ইস্..... নিজের দুর্দশায় বড় মন খারাপ হয়ে আছে মেঘ। তুমি জাননা, গত 7/10 দিন নিজের থেকে নিজেই পালিয়ে বেড়াচ্ছি.... কিচ্ছু হাত দিয়ে বেরচ্ছে না... মস্তিষ্ক ফাঁকা। তোমারই এ’ লেখার থেকে ধার করে বলতে ইচ্ছে করছে- এ’সব দেখছি, আর ভেতরে ভেতরে কাঙাল হয়ে উঠছি।

তিতাস বেরা said...

এটা কী ঠিক হোলো মেঘদি, কান ধরে বুকের ভিতর হাঁচোড় পাঁচোড় গুলো মনে করিয়ে দিলে। ভালো করলে না একদম।

মেঘ said...

@ মঞ্জু,
যখন লেখাটেখা আসতে চায় না তখন সক্কলেরই এক অবস্থাই হয়। এই লেখাটা একটা ব্লগের বর্ষাবন্দনা উপলক্ষে ইবুকের জন্য চেয়েছিল। এই ঘোরবর্ষায় ভাবলাম মঞ্জুর এখানেও দিই।

মেঘ said...

তিতাস, হা হা..এই বর্ষায় এমনি তো বুকে পুরোনো কথার ঢেউ ওঠে। আমি না হয় ওতে একটা ঢিল ছুঁড়লাম। :)

nilakash said...

অসাঘারণ লেখা মেঘদি, আমি আবার এমন গদ্যের অপেক্ষায় রইলাম।

chandan roy choudhury said...

আপনার নামে পোস্ট থাকলে না পড়েও ভাল বলা যায়। কারণ আপনার লেখার একটা নিজস্ব ধরণ আছে, যা খুব অন্যরকম... ঠিক এটা যেমন।