রাত্রিবেলা দেখি ছোটোমামা আমাদের ঘরে শুতে এসেছে। আমি আর আর পুঁটে তো মহাখুশি। চমৎকার ব্যাপার। খুব গল্প শুনব। কাঁথা-টাঁথা মুড়ি দিয়ে বেশ জমিয়ে বসেছি, ছোটোমামা টেমির আলো একটু কমিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে খাটে এসে বসলো। আজ কীসের গল্প হবে কি জানি? ভূতের, চোরের, বাঘের নাকি ওর ওই উইল চুরির?
এদিকে কোথায় কোন ফাঁক ফোঁকর দিয়ে ঠান্ডা হাওয়া ঢুকে ঘর কেমন স্যাঁতস্যেঁতে। টিমটিমে আলোয় দেখলুম ছায়ারা আবার নাচন শুরু করেছে। আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে খালি নাক চোখ বাইরে বার করে ছোটোমামা গল্প শুরু করল।
—‘তোদের এইবেলা সব বলে রাখি। বেশ কয়েক বছর আগেকার কথা। লাটসাহেবের হুকুম এল কত্তামশায়কে ভাগলপুর থেকে কাশীতে বদলি হতে হবে। আমি তো খুব খুশি। কদ্দিন পর আবার দিদির সাথে দেখা হবে। চেনাজানা লোকজন পাব। ওই বদখত ইশকুলের মাস্টারদের থেকে পালিয়ে বাঁচা যাবে। কত্তামশায় অবিশ্যি খুব চেষ্টা চরিত্রির করলেন, বদলি আটকানোর। কিন্তু লাটসাহেবের দপ্তর থেকে একেবারে জেদ ধরে বসলে। কাজেই আমরা ওখান থেকে তল্পিতল্পা গুটিয়ে নিয়ে কাশী চলে এলুম।
কাশী এসে দেখলুম রাস্তাঘাট একেবারে জমজমাট। কতরকমের আখড়া। রাজ্যের বুড়োবুড়ি আর সাধুসন্তদের ভীড়। অলি গলি মহল্লা সব কৌপিন পরা, বাঘছাল গায়ে, কিংবা গেরুয়া বসন সাধুতে ছয়লাপ। কোথাও বহুরূপীরা ঘুরে বেড়াচ্ছে, কোথাও বাঁদর খেলা দেকাচ্ছে। আমার তো পিলে চমকাতে লাগল।
যা হোক, কিছুদিন পর কত্তামশায় মিশনারী ইশকুলে নাম লিখিয়ে দিলেন। দেখলুল মন্দ নয়। খালি একটু ন্যাকা ন্যাকা এই যা। খুব বেশী কড়াকড়িও নেই। তাই আমিও মনের সুখে ইশকুল পালিয়ে কোতোয়ালী, টেলিগ্রাফ আপিস, কি টাউন হল দেখে বেড়াতে লাগলুম। জমিয়ে থ্যাটারী দেখতুম, ম্যাজিকের আখড়ায় নাম লেখালুম, ঘাটে বসে সাধুদের সাথে ইয়ারকি দিতুম। মোটকথা দিনগুলো দিব্যি কাটছিল। এমন সময় কাশীর ঘাটে হঠাৎ এক নোতুন উটকো সাধু এসে উপস্থিত হল।’
—‘ভিঞ্চি মহারাজ!’
‘আঃ, গল্প বলার সময় হুড়ো দিতে হয় না।’ এই বলে পায়ের চেটো হাত দিয়ে ঘষে কোমর মটকিয়ে ছোটোমামা ফের বলতে শুরু করল, ‘তা সেই সাধুর কী তেজ! কতরকম ভাষা বলতে পারে। রামায়ণ মহাভারত সব মুখস্থ। নাম জানা গেল সাধু বজরংদাস। তা যেমন নাম, তেমনি চেহারা আর তেমনি গলার আওয়াজ। কিছুদিন পরেই এমন ভক্তের ভীড় লাগল যে অন্য বাবাজীদের সে কী হিংসে! কতরকম গল্প চালু হল। বাবাজীর নাকি কতরকমের অলৌকিক ক্ষমতা। রাতারাতি প্রচুর শিষ্য। শিষ্যদের হেড যে সে—’
—‘ভিঞ্চি মহারাজ!’
‘দ্যুৎ! থামবি! এখনই ভিঞ্চি মহারাজ কেমন করে আসবে শুনি’, ছোটোমামা খেঁকিয়ে উঠল, ‘আগে তো আমাদের ম্যানেজারমশাই বজরং বাবাজীকে বাড়ীতে নিয়ে আসবেন, কত্তামশায়ের সাথে দেখা হবে। বাবাজী আমাদের বাড়ীতে ঠাঁই গাড়বেন। তাপ্পর একদিন শ্রাবণ মাসের বিকেলে একটা উটকো লোক এসে হাজির হবে, তবে না ভিঞ্চি মহারাজের কথা আসবে। এতই যদি তাড়াহুড়ো তবে গল্প শোনা কেন বাপু! এই আমি চুপ করলাম!’
—‘আহা ছোটোমামা, তুমি পুঁটের কথায় কান দিও না। বলো না ফের কী হল?’
ও কিছুক্ষণ গোঁজ হয়ে বসে রইল। আমরাও যেযার চাদরের তলায় বসে ঘামতে লাগলুম। টেমির আলো প্রায় নিবুনিবু। কিছুক্ষণ পরে, সেদিকে চেয়ে উদাস গলায় ছোটোমামা বলল, ‘সব ঠিকঠাকই চলছিল। বাবাজী আমায় খুব নেকনজরে দেকতেন। বলতেন, বেটা সংসার তোর জন্যে না আছে, পালিয়ে যা বেটা পালিয়ে যা। আমিও খুশি মনে ওঁর ভোগের পেসাদ পেতুম। হঠাত একদিন কেমন সব বিগড়ে গেল। জানিস্, আমার পষ্ট মনে আছে। সেদিন ছিল শনিবারের বিকেল। বাবাজী রোজকার মতন ভক্তদের বাণী দিচ্ছেন, আমি হাতজোড় করে ঘরের এককোণায় চুপটি করে আছি। এমন সময় শুঁটকে মতন, হালকা লম্বা, ফরসাপানা একটা লোক এসে জুটল। ওকে দেখে বাবাজীর কথা থেমে গেল, চোখ ছোট হল, কেমন যান আসোয়াস্তিতে পড়লেন। এদিকে লোকটা সক্কলকে ডিঙিয়ে একেবারে সামনের সারিতে এসে কাষ্ঠহাসি হেসে বসে পড়ল।’
—‘ভিঞ্চি মহারাজ!’
—‘হ্যাঁ হ্যাঁ, এই লোকটাই হল ভিঞ্চি মহারাজ। জ্বালিয়ে খেলি দেকচি! গল্পটা শুনবি কিনা তাই বল—’
—‘আচ্ছা বেশ বেশ, তুমি বলে যাও।’
—‘হুমম্, যা বলছিলুম। বাবাজীর সুপারিশে ভিঞ্চি মহারাজ আমাদের বাড়ীতে সূচ হয়ে ঢুকলেন। ম্যানেজারবাবু প্রথমটা একটু আপত্তি করেছিলেন। কিন্তু ততদিনে কত্তামশায়ের মন গলে একশা। বাবাজীর আদেশ যখন তখন তা না পালন করে থাকা যায়। অতএব বাবাজীর পাশের ঘরে ভিঞ্চি মহারাজ এসে উঠলেন। ওঁর নাম তখনো অবশ্য ভিঞ্চি মহারাজ হয়নি! নাম ছিল জনার্দন। প্রথম দিকে বাবাজীর চামচাগিরি করে কাটাতেন। ম্যানেজার বাবুর ফাইফরমাশ খাটতেন। উনি অবশ্য ওকে পছন্দ করতেন না। আমিও করতাম না। সারাক্ষণ কেবল আমার উপর নজর রাখত। কোথায় যাচ্ছি, কী করছি। আমিও কি কম ঘুঘু। দিব্যি চোখে ধুলো দিতাম। তা এই চোরপুলিশ খেলার মাঝেই একদিন দেখা গেল বজরংবাবাজী উধাও হলেন। খালি রেখে গেলেন কত্তামশায়ের জন্য একটা চিরকুট!’
—‘ও মা, সেকী কথা! উধাও হলেন মানে?’
—‘মানে, চলে গেলেন।’
—‘কেন কেন? চলে গেলেন কেন?’
—‘তা আমি কী করে জানব? চিরকুটে কিচ্ছু বলা ছিল না যে কোথায় যাচ্ছেন, কবে ফিরবেন।’
—‘কি ছিল সেই চিরকুটে?’
ছোটোমামা খুব হতাশ গলায় বলল, ‘ওই চিরকুটেই তো আসল ব্যাপার লুকিয়ে। বাবাজী লিখে গেলেন আমার সব ক্ষমতা আমি জনার্দনকে সমর্পন করিলাম। ব্যস ওকে আর পায় কে। রাতারাতি গেরুয়া ধরে তিলক কেটে বিরিঞ্চিমহারাজ নাম নিয়ে জাঁকিয়ে বসল।’
—‘কত্তামশাই সব দেখেও কিছু বললেন না!’
—‘হুঃ, ততদিনে কত্তামশাইকে নানান জাদু দেখিয়ে দিব্যি বশ করেছে। সেসব অলৌকিক কান্ডকারখানার কিছু অবশ্য নিছক হাতসাফাই। কিন্তু কিছু আবার আমি চেষ্টা করেও ধরতে পারিনি। বজরং বাবাজীও খেল দেখাতেন জানতুম, কিন্তু এ একেবারে উঁচুদরের শিল্পী। শোনা গেল কঠিন সাধনার পর এসব নাকি সে আয়ত্ত করেছে। রাতারাতি দেখলুম ম্যানেজারবাবুও হাতজোড় করে কথা বলতে লাগলেন। কত্তামশায়ও সারাক্ষণ মহারাজের পায়ে। এদিকে বাড়ীতে তো টেকা দায়। সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে চোরাগোপ্তা খোঁচা মারা চলছে। শেষে আর থাকতে না পেরে দিদিকে সব খুলে বললুম।’
—‘তারপর!’
ছোটোমামা মুচকি হেসে বলল, ‘দিদি ওদের কঠিন প্যাঁচটি ঠিক ধরেছিল। তোরা সব এইটুকুনি তখন। সবে হাঁটতে শিখেছিস। কলকাতায় তোদের জ্যাঠামশাইদের সপরিবারে চলে আসার কথা হচ্ছে। খালি খুড়োমশাই বেনারসে থাকবেন। এসব দেখে শুনে, দিদি ভয়ংকর মতলব বার করল।’
শুনে একটু খুশি না হয়ে পারলুম না। ঠিক জানতুম মায়ের ভীষণ বুদ্ধি ছিল।
—‘তারপর শোন, দিদি বলল, এসব নাকি ওদের কত্তামশায়ের সম্পত্তি দখল করার চাল। আমাকে ফাঁকি দিয়ে নিজেরা সব বাগিয়ে নেবে। ওই ম্যানেজার মশাইও নাকি দলে রয়েছেন। এতদিনে উইল হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়। শুনে আমার তো অজ্ঞান হওয়ার যোগাড়। দিদি তখন ফন্দিফিকির বাতলাল। সেই মতো আমিও রাত্রিবেলা কত্তামশায়ের সিন্দুকের চাবি চুরি করে—’
—‘ইস্, বিশ্বাসই করি না। তুমি পা টিপেটিপে চলতে পারো না, ক্যাঁচক্যোঁচ সামলে দরজা খুলতে পারো না, রাতের বেলা খালি খালি হোঁচট খাও, তুমি করবে চুরি! তাহলেই হয়েছে।’
একথা শুনে ছোটোমামার চোয়াল ঝুলে পড়ল। মিনমিন করে বলল, ‘ইয়ে চুরিটা ঠিক আমি করি নি। আমাদের ম্যাজিকের দলের শিবুর সাথে ষড়্ হয়েছিলো। ওই তো বাগানের পেছনে খিড়কি দিয়ে ঢুকে, দারোয়ানদের এড়িয়ে, কত্তামশায়ের ঘরে বালিশের নীচ থেকে চাবি খুঁজে— কিন্তু সে যাই হোক, খিড়কির দরজাখানা খুলে দিয়েছিলো কে। দারোয়ানদের আফিঙের গুলি কে সাপ্লাই দিয়েছিলো, কত্তামশায়ের ঘর চিনিয়েছে কে? শিবুকে বললোই বা কে যে কত্তামশায় বালিশের নীচে চাবি নিয়ে ঘুমোন। এতো বলতে গেলে একরকমের আমারই চুরি করা হোলো।’
—‘আচ্ছা আচ্ছা, সে যাই হোক, তারপর!’
—‘হ্যাঁ শোন্, উইল দেখে তো আমার চক্ষুস্থির। ঠিক দিদি যা ভেবেছিলো। ভিঞ্চিমহারাজের তরে বন্দোবস্ত একেবারে পাকা। তবে উইল চুরি গেছে সেকথা কাকপক্ষীও টের পায় নি। তাই শেষে কলকাতায় গিয়ে পড়বার নাম করে উইল নিয়ে দিদির সাথে পালিয়ে এলুম। ওরা ভাবল ভালোই হলো আপদ দূর হোলো। তাই কেউ কোনো আপত্তি করল না। এদিকে আমি আর দিদি মিলে কী ভীষন ষড়যন্ত্র কষেছি তা তো আর ওরা জানে না!’
এবার আমি আর পুঁটে একসাথে উশখুশ করে উঠলাম, ‘কী ষড়যন্ত্র ছোটোমামা। আহা বলো না, আমরা এক্ষুনি শুনব।’
‘হুঁ হুঁ বাবা’, চোখ সরু করে ছোটোমামা বলতে লাগল, ‘ওই উইল থেকে সইসাবুদ জাল করে নকল উইল তৈরী হত। তারপর কত্তামশায় স্বর্গে গেলে ওই জাল উইল দেখিয়ে সাক্ষীসাবুদ হাসিল করে মকদ্দমা করতে কতক্ষণ!’ শুনে কেমন রোমাঞ্চ হল। ভিজে বেড়ালটির মতো থাকে, এদিকে পেটে পেটে এত! কিন্তু এখন কি উপায়!
—‘বুঝলি, এতদিনে বোধহয় সব টের পেয়েছে। বিপদটা আঁচ করে এখন আমাকে পাকড়াবার তালে আছে। সেকারণে ভিঞ্চি মহারাজ নিজেই আসছেন।’
একথা শুনে আমরা সব চুপটি করে বসে রইলাম। টেমির আলো কখন নিভে গেছে। কোথা থেকে ঝিঁঝিঁর ডাক ভেসে আসছে। কত রাত হবে এখন। ঘন্টা বাজল কি কোথাও? হবে হয়তো। এত সব গা ছমছমে ব্যাপার শুনে আমার কান কেমন ভোঁ ভোঁ করতে লাগল। চোখের সামনে দেখতে লাগলুম, ওই শিবু না কে, কত্তামশায়ের বালিশের নীচ থেকে চাবি সরাচ্চে, সিন্দুক খুলচে, আর দরজার ফোঁকর থেকে সেসব দেখে দাঁতে দাঁত চিপে ছোটোমামা মুচ্ছো যায় আর কী। কত্তামশাই নাক ডাকাচ্ছেন, টেরও পাচ্ছেন না ঘরের ভেতর কী ভয়ানক কান্ড চলছে। বাব্বাঃ।
হঠাৎ কোথা থেকে যেন একপাল শেয়াল ডেকে উঠল আর অমনি কাঁচুমাচু গলায় ছোটোমামা বলে উঠল, ‘সবচেয়ে বিচ্ছিরি ব্যাপার হলো, দিদি মারা যাওয়ার পর উইলখানা যে কোথায় লুকিয়েছি, নিজেই ভুলে গেছি।’
3 comments:
দারুণ লিখছেন দাদা দারুণ.... একসাটে 4-টে পর্ব পড়েছিলাম, এখন পরপর বাকী 3টে। সত্যি কথা বলতে কি আমি পড়ব বলে অপেক্ষা করছিলাম।
তুমি এত ভাল লিখছ..... পডতে-পড়তে আমারই মুচ্ছো যাবার জোগাড়। কথা শোনো তিতাস.... আমার ধারণায এ গল্প তোমার টোটালটাই লেখা আছে..... খালি পর্ব হিসেবে ভেঙে-ভেঙে দিচ্ছ। সুতরাং বেশ খানিকটা কাজ সারাই আছে বলা যায়। ইমিডিয়েটলি কোনো কিশোর পত্রিকায় একে পাঠিয়ে দাও, খালি বাক্যগঠনের প্রাচীনতাকে আধুনিকতায় এনে। তারপর বেশীদিন অপেক্ষা নয়.... ম্যাজিকটা দেখ। আমি মুগ্ধ হচ্ছি ক্রমশঃ.....
এরপরে নীচে আমার ব্যক্তিগত কিছু বলা।
শোন হে ছেলে, মোটেই ভুল ভাবছি না। তাসের ঐ 29 খেলাটা জান? খানিকটা তেমন.... 'আছি-আছি'-র বলায় আছ, আদতে নেই। এত যে মনুষ্য চরিত্র বোঝ, তা ভুলে যায় মানুষ কখন বল তো? যাক্ গে... আর ঘাঁটাব না। আমিও ঘটি, তুমিও ঘটি। শেষে কথা বাড়িয়ে নেট মোলাকাত্ও ফুস্ হোক্ আর কি..... ভাগ্যিস্ দূরে আছ, সামনে পেলে মজা দেখাতাম।
অসীমবাবু, লেখা পড়ার ও ভালো লাগার জন্য ধন্যবাদ।
মঞ্জুদি, বাক্যগঠনের প্রাচীনতাকে আধুনিকতায় আনতে চাইছি না। মনে হচ্ছে আমেজ মাঠে মারা যাবে। আর আমার কিন্তু পুরোটা লেখা নেই। প্লটটা খালি মাথায় আছে। টুকটাক সময় পেলে লিখছি। তবে আমার এই গল্পটা পুরোনো কোলকাতা নিয়ে বিস্তর পড়াশোনা করে তারপর লেখা উচিত ছিল। সেটা যেহেতু হয় নি তাই কোনো পত্রিকায় পাঠানোর তাগিদ দেখছি না।
আর হ্যাঁ, আমি কিন্তু ২৯ খেলতে জানি না।:P
Post a Comment