Tuesday, 5 July 2011

ননসেন্স প্রেমের গল্প- পর্ব ১

বইপাড়া চত্ত্বরে সিদ্ধার্থ ঘুরতে ভালোবাসে। নতুন পুরোনো বইয়ের গন্ধ, বিকিকিনি, প্লাস্ট্যিকের প্যাকেটের ভেতর ঝকঝকে মলাটের উঁকিঝুঁকি, ইস্কুল কলেজের ছাত্রছাত্রী, কৌতুহলী লোকজন, সবকিছু মিলেমিশে কেমন সাড়ে বত্রিশভাজা। নেশার মতো। এলোমেলো ঘুরপথে এ গলি, ও গলি, সে গলি ছাপাখানাছাপাখানা শেষে বইবিপণির প্রত্যন্ত কোনার তাক। প্রতিটি পাতার ভাঁজে কত অজানা নতুন ঘুম। এবং ঘুম শেষে যত ফালতু বিকেলে ফিরতি ডাকের বাস।
     সিদ্ধার্থ এসবে ক্লান্ত হয় না। এ হল নেশাড়ু চরিত্রের অন্যতম দিক। কলেজের ছুটি ছাটা, ফাঁক ফোঁকর পেলেই সটান তীর্থভূমিতে এসে হাজির। ফুটিফাটা রোদ, তুমুল বৃষ্টি, ঝড়জল, বন্‌ধ, ঘেরাও উপেক্ষা করে এই অদ্ভূত আকর্ষণের কী মানে? নাকি এসব তার জিনে ইমপ্রিন্ট? আদিম মানুষের মতো যাযাবরবৃত্তি, বই থেকে বইয়ে ?
     শ্যামাচরণ দে স্ট্রীটে দুপুরের রঙ ধরতেই সিদ্ধার্থ স্থির করল, কোনো প্যারালাল ইউনিভার্সে তার কাউন্টার পার্টও নিশ্চয়ই একই রকম ভাবে নিঃশ্বাসে প্রশ্বাসে এই ভার্জিন মেরীর স্বাদ নেয়বাসের টিকিট হাতঘড়ির রিস্টব্যান্ডে গুঁজে জিভ দিয়ে ঠোঁট চাটে। ইউনিভার্সিটির পাশের ফুটপাথে জহুরী চোখে খোঁজে অমূল্য রতন। প্রশ্ন হচ্ছে সেই কাউন্টার পার্টটিও কি একই রকম বিপর্যস্ত? ন্যাকা ন্যাকা, একটু বোকা মতন? ক্লিশে নাটুকেপনা নিয়ে মাথা ঘামায়? আফশোস করে? নাকি তার চারপাশ ঘিরে রয়েছে সাফল্যের ওম। রয়েছে তুখোড় স্মার্টনেসে অর্জিত স্নবারি। হয়তো অন্য বিশ্বে সে খাতির পাচ্ছে প্রতিভাবান ছাত্র সিদ্ধার্থ বসু হিসেবে। এবং সবচেয়ে বড় কথা সাদা চুড়িদার নীল ওড়না মাখা কিছু পলকা মুহূর্ত তার কাছে হয়তো সহজলভ্যহয়তো একটু বেশীই
     এতসব ভাবার কারণ হল, সিদ্ধার্থ ভাবতে ভালোবাসে। আলগোছ অলস ভাবনা চিন্তা নয়। ঐ অন্যমনস্ক হয়ে পথচলতি মানুষের ভীড়ে সাতপাঁচ ভাবতে ভাবতে হেঁটে যাওয়া, এ তার বড় পছন্দের। বইপাড়া চত্ত্বরে এরকম ভাবুক লোকেদের জন্য বিশেষ খাতির আছে। আচমকা হুমড়ি খেয়ে গায়ে পড়লে কেউ কিছু মনে তো করবেই না, উলটে হাত থেকে পড়ে যাওয়া খাতাপত্র কুড়িয়ে নিয়ে হয়তো মৃদু হেসে উঠবে। পরক্ষণেই তীব্র ম্যাসকুলিন নাক সচকিত হয়ে উঠবে ফেমিনিন পারফিউমে। অপ্রস্তুত হাসি হেসে একপ্রস্থ ক্ষমা চাওয়ার মাঝে মনে হবে, ‘যাঃ শালা, এ এতদিন কোথায় ছিলো?’
     আজকে এসব কিছুই ঘটছিল না কারণ সিদ্ধার্থ বসু তার মধ্যবিত্ত জীবনের ফাঁকে কোন একসময় আবিস্কার করে ফেলেছে যে, তার জীবনে প্রেম এসে পড়েছে। একেবারে সিপাই সান্ত্রী ঢাল তলোয়ার সমেত। জীবনে দ্বিতীয়বার। হুড়মুড়িয়ে এবং প্রেমের পিছু পিছু এসে পড়েছে যত রাজ্যের অপরাধবোধ। সিদ্ধার্থ নিশ্চিত জানে এরপর ক্রমান্বয়ে অবধারিত ভাবে হাজির হবে কিছু উদ্দামতা, সিনেমাসূলভ বৃষ্টি ভেজা এবং সবশেষে সর্দি জ্বর, সাইনাস, একগাদা ওষুধপত্তর, ইত্যাদি, ইত্যাদি। সুতরাং কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে কাঙ্খিত বর্ষার জন্য অপেক্ষা করা আর নিস্তরঙ্গ অপরাধবোধে ভোগা ছাড়া তার আর কাজ কী? রুটিনমাফিক টহলদারি শিকেয় তোলা থাক।
     কিন্তু অপরাধবোধ কেন? আসলে খুঁটি বাঁধা অবস্থায় দিশী গরুদের বেশী দূর যেতে নেই। পাড়ায় প্রেম করবে, ভালোবাসা-টাসা ইত্যাদিকে একেবারে প্রাতঃস্মরণীয় করে তুলবে, আবার কলেজের পয়লা বোশেখের অনুষ্টানে কোনো এক চিত্রাঙ্গদা দেখে ঐসব ইয়ে টিয়ে ভেবে রাতকাবার করবে, এ কি ‘মেরিক্যান ড্রিম’ পেয়েছো! তারচেয়ে হাহুতাশ করো। প্লট খোঁজো। বেছে নাও সাপ কিংবা লাঠি। তারপর দংশিত হতে হতে কোনো একসময় চীৎকার করে বল স্বাভাবিক কিছু ‘ধুত্তোর’
     মোদ্দা ব্যাপারটা ঘটেছে হপ্তাদুয়েক আগে। নববর্ষ জাতীয় কিছু আদিখ্যেতা ছিল কলেজে। এইসব অনুষ্ঠান সে ফি বছর মন দিয়ে দেখে। রবীন্দ্রসঙ্গীতের রূপান্তর লগ বুকে নোট করে। তবে কবিতাপাঠের চক্করে পড়ে না। বড়জোর দরকারে নাটকের দলকে দাড়িগোঁফ সাপ্লাই দেয়। মোটামুটি একজন সহজ সরল ক্যাবলা টাইপ, যাকে কক্ষনো কেউ খেয়াল করে না। কিন্তু এরাই কখন চুপসময়ে প্রেমে পড়ে যায়। গাছ থেকে টুপ করে পাতা ঝরে, শিশির কখন জমে ঘাসের আগায়, দিগন্ত বিস্তৃত চিল নিঃশব্দে ঢেকে দেয় বিকেলের সূর্যপালক, আর ‘নেই মানুষ’রা অবয়ব খুঁজে পায় অন্যের ঘ্রাণে, এই তো ব্যাপার!
সুতরাং, গ্রীনরুমের পাশে, ঐ যে পাউডারের গন্ধ ছড়িয়ে, নাচের ড্রেস সামলাতে সামলাতে, ঘুঙুরের লঘু চপল আওয়াজ মেখে, কারো লক্ষীমন্ত পায়ে হেঁটে প্রেম আসবে, এ আর এমন কথা কী? ঠিক কি হয়েছিলো মনে নেই। মোটকথা অনুষ্ঠানের পুরো সময় সিদ্ধার্থ বসু চুপ করে নাটক দেখেছে, অন্ততঃ তিনবার সিগারেটের কাউন্টার ফিরিয়েছে, একবারও উঠে ইয়ে করতে যায়নি, এবং হাঁ করে দেখেছে কোনো এক শ্রবণা চ্যাটার্জী চিত্রিত হচ্ছে কত্থকীয় মুদ্রায়শরীরে বিভঙ্গ উঠছে, বোলের তালে তালে দুলছে কথার শরীর, রূপের নাচন লাগছে অবর্ণনীয় হুরি পরী জিন্‌ দেহে। পরিচিত ভালোলাগাগুলো ক্রমশঃ এসে ভীড় করেছে স্রোতের মতো।
     এতোটুকু যথেষ্ট ছিলো সিদ্ধার্থ বসুর কাছে। পরবর্তী কিছু হপ্তা ধরে সে মেতেছিল তথ্য সংগ্রহের খেলায়। নাহ্‌, ‘এই, মালটা কে রে?’ জাতীয় ব্যাপার নয়, বরং অনেক নিশ্চুপে। সন্তপর্ণে। বাক্সে লেখা ‘ফ্রাজাইল’ এর মতো, যত্ন করে। ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকা অপরাধবোধকে দাবিয়ে রেখে। এ এক ধরণের খেলা। নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখে নিজেকে ভাঙার খেলা। অবশ্যই সে সফল বলতে হবে কারণ বনামী তো একটুও টের পায়নি।
     এ খেলা কিন্তু বেশ। ভলডেমর্ট নিজেকে সাতভাগে ভেঙেছিল, সে ভেঙেছে মোটে দুভাগে। একভাগ আত্মার সাথে কিছুটা জড়বস্তু না হয় সে বনামীকে দিয়ে দেবে। কিন্তু অন্য ভাগ না হয় তার কাছেই থাকুক।
     কলেজ স্কোয়ারের বেঞ্চিতে বসে গা এলিয়ে সিদ্ধার্থ টেলিপোর্টেশনের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করলতার কাউন্টারপার্টিটির কী অবস্থা এখন, অন্য বিশ্বে? তার জীবনেও কী বনামী জাতীয় কিছু আছে?

3 comments:

Unknown said...

তুমি তিতাস, এত ভাল লেখ.... এ-ত ভাল? না থেমে যেমন গড়গড়িয়ে পড়ে এলাম, মনে হচ্ছে তুমিও যেন তেমন স্পন্টিন্যুয়াসলি লিখে এসেছ একদম না থেমে গড়গড়িয়ে। যদি এই হচ্ছো আসল তুমি, তবে কেন শুধুমুধু সময় ব্যায় করে অন্যের মত লেখ? সেই সময়টা নিজেকে দাও তিতাস.... তুমি সম্ভাবনায় ভরপুর, এ'কথা সময়ে জানবে। সেদিন মিলিয়ে নিও আমার কথা। তবে বড্ড গোঁয়ার। সেটুকুকে কব্জা করে ফেলতে পারলে....
এবারে আবার প্রশ্ন কোরনা লেখার সঙ্গে ব্যক্তির সম্পর্ক কি। আছে, আছে, ধীরে বুঝবে- না বুঝলেও তখন বুঝিযে দেব। আপাততঃ লিখে যাও... তুমি সত্যি ওজনদার, এ বিশ্বাস বুকে রেখ।

তিতাস বেরা said...

কেন শুধুমুধু সময় ব্যয় করে অন্যের মত লিখি? নাহ্‌ থাক এখন, এ তর্ক বরং অন্যদিন হবে।
তবে লেখাটা যত ভালো বলছ অতটা নয় বোধহয়। ইন ফ্যাক্ট আমার নিজের পড়ে কেমন কেমন লাগছে।

Unknown said...

ঐ কেমন-কেমন লাগাটাই তো লেখক তিতাসকে ক্ষীর-আম-মুগের নাড়ু দেবে। আর মঞ্জুদির বলা? ওপর-ওপর শোন....উঁহু, একদন ভেতরে বসতে দিও না। আশপাশ থাকুক আশপাশের মত ও তুমি তোমার।