তার অন্য দু'টো গদ্যের মত এই গদ্যের শুরুটা চমকপ্রদ হলেও এই গদ্যে তা উল্লেখযোগ্যও বটে। একজন নিপুণ গল্প লেখকের মত শুরুতে ঘুড়ির গাছে ঝুলে থাকাটা, পরবর্তীতে মেটাফরের মত হয়ে এসেছে। শুরুতে লেখক লিখেন, "একটা ঘুড়ি উড়ছিল একটু আগেও। নাটাই হাতে হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটি ঘুড়িটাকে পাকা নাচিয়ে হাতে ওড়াচ্ছিল। তারপরই ভোঁকাট্টা, এখন একলা হয়ে ঝুলে আছে গাছের ডালে।" পরবর্তীতে তিনি বর্ণনা করেন, "... তার ভেতরে ডুব দেবার প্রবল তৃষ্ণার অনুভব আমাকে ভেতর থেকে নিয়ে যায় দূরালোকে। ক্রমশ তার স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করি ঘাড়ে, কপালে, চুলে। রিনি এসে রাতের খাবার খেতে ডাকে। ওর ডাকে ঘোরের সুতো ছিঁড়ে যায়। দুম করে সুতো কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত আচমকা ঝুলতে থাকি শূন্যে।"
শুরুতে ঘুড়ির এই গাছে ঝুলে থাকার দৃশ্য তৈরি করে তিনি পাঠককে প্রস্তুত করেন। পরবর্তীতে যখন মুখ্য পুরুষ চরিত্রের মানসিক অবস্থার বর্ণনা করেন, তখন পাঠক কাটা ঘুড়ির শূন্যে ঝুলে থাকাটা সহজে কমিউনিকেট করেন।
একইভাবে শুরুতে 'নীল সালওয়ার-কামিজ' পরা মেয়েটা মুঠোফোনে প্রেমিকের সাথে কথা বলার ধারণা দিয়ে লেখক গল্পের বিকাশে প্রেম বা প্রণয়ের ব্যাপারটা যে রয়েছে, তারও কিছুটা ইঙ্গিত ডিটেলসের বর্ণনায় এনেছেন। শুরুতে এই ধরণের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যাপারের অবতারণা, বাস্তবিকই পাঠকের অবচেতন মানসকে গল্পের বিকাশের যথোপযুক্ত পথে ধাবিত করে। গল্পের সাথে সূক্ষ্ম অন্বয়বোধ তৈরি করায়। আর করায় বলেই পরের প্যারার শুরুতে 'বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য দেখি আর ভেতরে ভেতরে কাঙাল হয়ে উঠি'-র বর্ণনাটাকে হঠাৎ কোন আলাদা ভাবনা মনে হয় না। সে সাথে আসে বৃষ্টি, যা আমাদের ঐতিহ্যে রোমান্টিকতার পরিপূরক, এবং আসে কষ্টের কথা। এতে করে দ্বিতীয় প্যারায় গল্পের থিমটা আরেকটু স্পষ্ট হয়ে উঠে।
তৃতীয় প্যারায় 'বৃষ্টিশব্দ ছাপিয়ে ওর চুড়ির টুং টাং আওয়াজ আর মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ দুইই আমার ইন্দ্রিয়ে অস্বস্তি এনে' দেয়াটা একটা গতানুগতিক নিরস দাম্পত্য জীবনেরই ইঙ্গিত দিচ্ছে। কেননা চুড়ির টুং টাং আওয়াজ-ই আবার রোমান্টিকতা সৃষ্টি বা প্রেমের বন্য আকর্ষণ তৈরি করে দিতে পারে। বৈচিত্র্যহীন দাম্পত্যেই আসলে 'বৃষ্টিভেজা আবছা মুখ জলের ভেতর থেকে মুখ তুলে .........।' এই প্যারায় লেখক যেভাবে পরিবেশের সাথে মনস্তত্ত্বকে সুগভীরভাবে এঁকেছেন, তা এক দক্ষ শিল্পীর তুলির সুকৌশলী আঁচড় বললে অত্যুক্তি হবে না।
কাব্যিকতা যে কিভাবে আষ্টে-পৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে এই গল্পে, তার একটা প্রকৃষ্ঠ উদাহরণ হলো চতুর্থ প্যারার এই বাক্যে, "রাস্তায় জল জমে গেছে, আলোর প্রতিবিম্ব জলে দোল খায় আর ঝিকমিক করে সেসবের মধ্যে দেখতে পাই ছেঁড়া ছেঁড়া স্থিরমূহুর্তকে।" এই প্যারায় একটা শব্দে আমার কিছুটা আপত্তি আছে, তাহলো 'বৈদ্যুতিন' চিঠিগুলো। 'বৈদ্যুতিন' শব্দটা 'বৈদ্যুতিক' শব্দের মতই 'বিদ্যুৎ' থেকে জাত বলে আপাতঃদৃষ্টিতে মনে হয়। কিন্তু 'ই-মেইল'-এর ক্ষেত্রে এই পরিভাষা (technical term)-টা কতটুকু যৌক্তিক, সে সম্পর্কে জানতে আমার বড়ই আগ্রহ। কেননা, এইসব শব্দের পরিভাষা অবশ্যই মূল শব্দের ধারণার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ হওয়া উচিত বলে আমার বিশ্বাস।
লেখকের "অজেয় ডানার ছন্দবিদ্যুত" এবং "কালো কুকুর, অন্ধকার এবং শিকার বিষয়ক" এই গদ্য দু'টো পাঠে আমার একটা অপরিপূর্ণতার অতৃপ্তি ছিল। কিন্তু "অনিন্দ্য রাত্রিপ্রাঙ্গণে" পাঠ আমাকে একটি পরিপূর্ণ অণুগল্পের স্বাদ দিয়েছে। গল্প পাঠে আমরা অনুমান করে উঠতে পারি, গল্পের মুখ্য পুরুষ চরিত্রের প্রেয়সীর তরে বিরহ বেদনা, কিন্তু তার নেপথ্যের ঘটনা সম্পর্কে আমরা ওয়াকিবহাল নই। গল্পের শেষের চার লাইনের কাব্যে লেখক আমাদের যেভাবে নিয়ন্ত্রণ করেন,আমরা সেভাবেই ভাবি। আর সে চারলাইনের ব্যাখ্যায় খুব সম্ভবতঃ এতটুকু উঠে আসে যে, মুখ্য পুরুষ চরিত্র এখনো তার প্রেয়সীর জন্য অনিশ্চিত প্রতীক্ষায় আছে। কিন্তু তার বিরহে পুরুষটি হার মানতে রাজি নয়। মরে গিয়েও সে আবার বেঁচে উঠতে চায়। লেখকের এই ভাবনার সাথে ঐক্যমত পোষণ করেও বা পক্ষপাতিত্ব দেখিয়েও, আমাদের মনে এই বিরহের নেপথ্যে কে দায়ী এই প্রশ্ন ক্ষণিকের জন্য হলেও উদয় হতে পারে। আর তা উহ্য থাকাটাই বোধ হয় অণুগল্পের সৌন্দর্য।
4 comments:
শামান ভাই, এত সুন্দর, এমন চুলচেরা বিশ্লেষণ পড়ে মনে হচ্ছে তোমার এটা একটা প্রিয় ব্যাসন। যা পড়বে তা এমনই আত্মস্থ করবে, যে তা থেকে উবজে কিছু আসতে চাইলে এ'ভাবেই আসবে। তোমার বলবার বা বোঝাবার ভঙ্গী অসাধারণ। তোমার বুঝি সমালোচনা সাহিত্যের ওপর প্রবল ঝোঁক? সবাই যখন নিজেকে নিয়ে, নিজের লেখা নিয়ে ব্যস্ত, সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে তোমার এই মনোভঙ্গী লেখকের কাছে সম্পদের মত। কেননা তুমি মন্দ-ভাল-ঠিক-বেঠিক সবটা নিয়ে স্বচ্ছ্বতায় দেখ, স্পষ্টভাবে বল। খুব ভাল। তা বাকী লেখাপত্র পড়বে না বা বলবে না? আমি কিন্তু অপেক্ষায় রইলাম।
মঞ্জুদি-র মন্তব্য পেয়ে ভাল লাগলো।
আসলে সময় করে উঠাটা একটু কঠিন হয়ে পড়ে। তবুও চেষ্টা থাকবে।
তোমার 'স্বপ্নপথ বেয়ে'গল্পটা খুঁজছি। লিংকটা দিলে ভাল হবে।
ভাল থেকো। আনন্দে থেকো।
শামান ভাই, তুমি এই ব্লগের প্রথম দিকে এটা পাবে। ‘কষ্টছোঁয়া স্বপ্নপথ বেয়ে’ গল্পের এই নাম আমি দিয়েছিলাম, কিন্তু পত্রিকা দপ্তর গল্পে কোথাও হাত না ফেললেও ঐ ‘কষ্টছোঁয়া’-কে বাদ দিয়েছিল কেন তা জানিনা.... যা আমার কাছে ঠিক লাগেনি। যাই হোক্, ওটা যে বাণিজ্যিক পত্রিকায় ছাপার যোগ্য বিবেচিত হয়েছে আমি তা’তেই ধন্য। যতটুকু তোমায় বুঝেছি, তাতে করে তুমি খুব কাব্যিক কাজ পছন্দ করো বলেই মনে হয়, এই গল্পে তা অনুপস্থিত। তবু পড়ো বা বলো যদি আমার ভাল লাগবে। তুমি এই ব্লগের হোম পেজের নীচে যে ওল্ডার পোস্ট অপশন আছে, সেখানে ক্লিক করলে পেয়ে যাবে। এটা আসলে এপ্রিলের পোস্ট। কিংবা এই মনফসলে পপুলার পোস্ট জায়গায় ‘স্বপ্নপথ বেয়ে’ আছে। ওখানে ক্লিক করেও পেতে পারো।
আমি যদিও অনুগল্প অত ভালো বুঝিনা, তবে শামান দাদা, আপনার লেখা আর দু একটা পড়লে ধারনা হয়ে যাবে আশা করি।
Post a Comment