Thursday, 27 October 2011

বাঁধানো দাঁত ও এক পাটি চপ্পল

হিমাদ্রী শেখর দত্ত, মুম্বাই


এই গল্পটি লেখার প্রেরণা আমার এক বন্ধু পত্নীর সত্তোরার্দ্ধা নিজের মায়ের বোন, তার মাসী। আমার বন্ধুপত্নী হাস্যচ্ছলে তাঁর সম্বন্ধে নানা ঘটনা বলার সময়, আমি এর মধ্যে হাসির গল্পের বেশ কিছু উপাদান পাই। তাই ভাবলাম যদি ঠিক মতো হাজির করতে পারি, মানে যেমন বন্ধু পত্নী শুনিয়েছিলো, তাহলে নির্মল হাসির একটা ফোয়ারা উঠতে পারে। আমার এ লেখা বেশিটাই কল্পনা,কেবল মূল টুকু সত্যি।


মাসীর বয়স হলেও বয়সের ভারে কাবু নন। ভারতের নানা প্রান্তে নিজের আত্মীয় স্বজনের কাছে ঘুরে ঘুরে বেড়ান, কিছুদিন থাকেন, সেখানকার লোকেদের মোটামুটি মাসখানেকের প্যারেড করিয়ে আবার অন্য জায়গায় নিজের ক্যাম্প সিফট করে নেন। নিজে থেকে এ ভাবে বাঁচার একটা উপকারী রাস্তা বের করেছেন, যাতে উনি নিজে ফিট থাকেন মনের দিক থেকে। আর এর ফল খানিকটা তারাও পান, যাদের কাছে উনি সাময়িক অথিতি হোন। রিসেন্টলি পরেশ রাওয়ালের একটি মুভি এসেছিলো, আশা করি অনেকেই দেখেছেন, ‘অতিথি তুম কব যাওগে’। অনেকটা সেই রকমই, ইনি প্রায় পরেশ রাওয়ালের লেডি এডিশন। এক ছেলে, তার বিয়ে দিয়ে দিয়েছেন, ছেলের বউ ডাক্তার, কোন সরকারী হাসপাতালে। সাধারণ শ্বাশুড়িদের মতো বউ আসার পরে, ছেলের সংসার সামলানোর অবান্তর দায়িত্বে উনি নিজের মাথা ঢোকান নি, বরঞ্চ, নিজের খেয়াল খুশি মতো বোনপো, বোনঝি এদের বাড়ি ঘুরে বেড়ান। তাই কখনও দিল্লী, কখনও বরোদা, কখনও কোলকাতা তার অস্থায়ী ঠিকানা।


মানুষটি একদম পরিপাটি থাকেন। স্নান খাওয়া, বিশ্রাম, কখন কি ওষুধ এসব একদম আঙ্গুলে গোণা। কিন্তু কাজের ব্যাপারে স্বভাবটি অলস। নিজের দিদি যার বয়স ৮০ ছুঁই ছুঁই, ঘুম থেকে উঠে তাকেই হাঁক পাড়েন, ‘দিদি চা হয়েছে’? দিদি একেবারে মাটির মানুষ, যেখানেই যান দুজনে একসাথে ঘোরাফেরা করেন। নিজের বোনের সব খেয়াল রাখেন। বোনও ছোট বেলার আদত ছাড়েনি, এখনও সব কিছু দিদির হাতেই হওয়া চাই।


এবারে বোনঝি’র বাসায় এসেছেন বরোদায়। কিছুদিন থাকবেন। বোনঝি জামাই নামী আপিসের বড় পজিসানে কাজ করে। সেই হিসেবে ঘর বাড়ি, সাংসারিক যাবতিয় সুখের সামগ্রী (যেমন গরম জলের কল, যেটা ওনার খুব কাজে লাগে, এ.সি ঠান্ডা রুম, কোম্পানির টেলিফোন, বড় টেলিভিশান, হট ওয়াটার ব্যাগ, আর ইচ্ছেমতো ঔষধপত্রাদি)। বোনঝির বাড়িতে বেশ সুখেই দিনাতিপাত হচ্ছিলো। গুজরাট শুকনো জায়গা, কোলকাতার তুলনায় জল একটু বেশি খেতে হয়। মনে হয় অজানতে সেখানে কোন ডিস ব্যালেন্স হয়ে যায়। একদিন সন্ধ্যা বেলায় বেজায় মুখভারি, কিছু খাবো না, কোথাও যাবো না এই গো নিয়ে বসে পড়লেন। কেউ কিছু বোঝে না, মাসীর হলো কি? নিজের দিদি কাছে গিয়ে জানতে গিয়ে, কিছুটা বকুনি খেয়ে মুখ চুণ করে ফেরত এলো। এবার বোনঝি গিয়ে পড়লে। তাতেও বিশেষ লাভ হলো না, কেবল মনে হলো পেট সংক্রান্ত কিছু গড়বড় হয়েছে। সারাদিন কিছু খেলেন না, বাড়ির আর সকলে অস্বস্তিতেই থাকলো। সন্ধ্যে সাতটা বাজতেই ছেলের বউকে টেলিফোন লাগান।


‘হ্যালো, কে, হ্যাঁ, শর্মিলা শোন, গত চার দিন ধরে আমার পায়খানা হচ্ছেনা,মনের মতো। খুব কষ্টে আছি। আমি কি ফিলিপস মিল্ক অব ম্যাগ্নেসিয়াটা খাবো’? শর্মিলা হয়তো সবে তখন হাসপাতাল থেকে জাস্ট ফিরেছে।
বউমা তার শ্বাশুড়িটিকে ভালোই চেনেন। ও প্রান্ত থেকে একটু জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে চাইলেন, কি খেয়েছিলেন, কেমন বাউলস হচ্ছে ইত্যাদি। ব্যাস আর পায় কে ! এমন ঝর ঝরে বাংলায় উনি নিজের বাহ্যের বিবরণ বলা শুরু করলেন যে সকলে সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে। রং, ঘনত্ব, কনটিনিউটি ইত্যাদি সবিস্তারে বলার পরে একটু দম নিলেন। এবং সেই প্রশ্ন আবার ‘আমি কি ফিলিপস মিল্ক অব ম্যাগ্নেসিয়াটা খাবো’? রাতে ঘুমোবার সময় এক চামচ নিদান পাবার সাথে এটাও জানলেন বেশি ওষুধের ওপর ডিপেন্ডেন্ট না হয়ে প্রকৃতির সাহায্য নিলে এই বয়সে বেশি ভাল থাকা যাবে। সেই হিসেবে কলা খাওয়াটা উপকারী হবে। রাতে অল্প গরম দুধের সাথে যদি আধখানা বা একখানা কলা মেখে খান, তবে সেটা মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়ার থেকে বেশী লাভ দায়ক হবে। একটা মাত্র কলা তার চার দিনের মন খারাপকে অক্লেশে ভালো করে দিতে পারবে, সেটা জানতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেন, মুখে সামান্য একটু হাসির দেখা মেলে। বাড়ির সকলেও খানিক নিস্তার পায়। বোনঝি জামাই এর ওপর তখনই নির্দেশ গেলো, সকালে বাজার থেকে পাকা কলা আনার জন্যে। আর একটা ছোট্ট শিশি মিল্ক অব ম্যাগনেশিয়াও। মানে যা সব পেটে বাঁধা পড়ে আছে, তাদের উনি এই দুই রামবাণে বের করেই ছাড়বেন। পরদিন সকালে যখন চায়ের জল চড়েছে, উনি ব্যালকনিতে বসেছিলেন। নীচে দেখেন ঠেলারিক্সা করে কলাও’লা কলা নিয়ে যাচ্ছে। বাজারে যাবার আগেই এমন ঘরে বসে পবনপুত্রের খাদ্য সামগ্রী নজরে এসে যাবে, মাসী স্বপ্নেও ভাবেনও নি। নিজেকে সংবরন করতে পারেন না।‘এই কলাওয়ালা’ বলে হাঁক মারেন।

কলাওয়ালা তখন যাচ্ছিলো বাজারে জায়গা মতো নিজের ঠেলাটি লাগাবার জন্যে, এমন অচানক ভিনদেশিয় ভাষায় তার নাম শুনে দাঁড়িয়ে, ঠাউর করতে চেষ্টা করে, আওয়াজটা এলো কোন দিক থেকে। ‘আরে, ইধার উধার ক্যায়া দেখতা হ্যায়, উপর মে দেখো। ম্যায়, ম্যায়, তুমকো বোলা রহি হুঁ’।
কলাওয়ালা এতোক্ষণে নিজেকে ওরিয়েন্ট করতে পারে তার গ্রাহকের সাথে।
‘হাঁ, মা’জী বোলিয়ে’
‘ক্যাতনা করকে বেচতা হ্যায় তুমারা কেলা’?
‘আরে লিজিয়ে না, ২৪ রুপিয়া দরজন, কিতনা দু? এক দরজন’?
‘আরে নেহি, নেহি, খালি ৬টো দিজিয়ে। ঝুকে দেখাতে থাকেন, উধার সে নেহি, ইধার সে...... আরে আরে, আমার দাঁত, দাঁত খোল গিয়া, পাকড়ো, পাকড়ো, নীচে আ রহা হ্যায়’। ব্যালকনির গ্রীলে ঠোকা লেগে নীচের পাটির দাঁত কি ভাবে খুলে যায়।

কলাওলা তখন চাকু দিয়ে ছ-খানা কলা কাটছিলো, সে বেচারা কিছু দেখেনি, ঠিক করে শোনেও নি। মাসী তখন চিল চিৎকার করে সকলকে ডাকা ডাকি শুরু করে দিয়েছেন। বোনঝি, নিজের দিদি এসে যতক্ষণে ঘটনা স্থলে এসে পৌঁছান, ততক্ষণে কলাও কাটা হয়ে গেছে, আর দাঁতের পাটিও পটিট (পতিত) হয়ে গেছে।

‘তোকে এ ভাবে কলা কিনতে কে বলেছে? হে ভগবান, তোর দাঁতের পাটি কোই’? দিদির গঞ্জনা।
‘ওই নীচে পড়ে গেলো। মনে হয় লুজ ফিট ছিলো’।
বোনঝির হাত ধরে টান, ‘এই এখুনি নীচে চল। আমার দাঁতের পাটি চাই’।
‘মাসী, ছাড়ো, ও তুমি ওটা রাস্তায় এখন কোথায় খুঁজবে’?
‘তুই চল আমার সাথে, আমি খুঁজে বের করবো।ওটা আমার পয়া দাঁতের পাটি’।

নীচে পৌঁছে কলাওলার কাছ থেকে কলা নিয়ে, ব্যালকনির ঠিক নীচে জায়গা দেখে খোঁজাখুঁজি শুরু করেন। ইতিমধ্যে মিউনিসিপালিটির ঝাড়ুদার ঝাড়ু মেরে আগে এগিয়ে গেছে। খানিক খুঁজে, হঠাৎ মাসীর চিৎকার, ‘ওই যে ঝাড়ুর আগে আগে গড়াচ্ছে রে। আমার সাধের দাঁত। এই রোকো, রোকো, ঝাড়ু রোকো, মেরি দাঁত যা রহা হ্যায়’।

দাঁতের পাটিটি ওপর থেকে পড়ে তিন টুকরো হয়ে গেছেলো, দু টুকরো উদ্ধার হল কোন ভাবে, তৃতীয় টুকরোটা পাওয়া গেলো না। আধা ডজন কলা খাবার জন্যে সন্ধ্যা বেলায় নতুন দাঁতের পাটি এলো চার হাজার টাকা নগদ দিয়ে। মিল্ক অব ম্যাগনেসিয়া বোনঝি জামাই অফিস ফেরতা নিয়ে আসবে। কিন্তু এসব কিছু ছাড়াই, বিকেলের চায়ের পরে, পেট একদম বর্ষার নদীর মতো বয়ে গেলো। কি কপাল !

এই মাসী একবার ইউরোপ ট্যুরে গেছিলেন। কোন এক ট্রিপের সাথে কোলকাতা থেকে দলবেঁধে। লন্ডন প্যারিস, সুইজারল্যান্ড এই সব ঘুরে ফেরার পথে জাপান নিয়ে যায়। ঠিক কি কারণে ইউরোপ ট্যুরের সাথে জাপান জুড়ে গেছিলো, সেটা আমার জানা নেই, তবে মনে হয় ঐ সময় জার্মানি না যেতে পারায় ওদের এই সুযোগটা হয়েছিলো। যাই হোক সেটা প্রধান কথা নয়। কথা হলো মাসীর জাপানে ট্রেন ভ্রমণ।

টোকিও স্টেশানে দলের সকলের সাথে পায়ে পা মিলিয়ে উনিও বুলেট ট্রেনে চাপতে যান। পেছনের কারো অনিচ্ছাকৃত ঠেলা খেয়ে এক পায়ের চটি খুলে প্ল্যাটফর্ম আর ট্রেনের মাঝখানে নীচে পড়ে যায়। উনি দরজার কাছে দাঁড়িয়ে পড়েন। সব লোক ঢুকে যাবার পরে রুমাল দিয়ে পা’দানিটা একটু পরিষ্কার করে নিজেই দেখার চেষ্টা করেন চটিটা কোথায় কি অবস্থায় আছে! কিন্তু নিজে হাত ঢোকাতে সাহস পান না। ট্রেনের দরজা বন্ধ করা যাচ্ছে না, কেননা স্লাইডিং দরজা সিগনালই নিচ্ছেনা। নেবে কি করে, মাঝখানে তো মাসী বিরাজ মানা। ট্রেনের কন্ডাক্টর আর স্টেশানের কর্তা ব্যাক্তিরা ছোট ছোট চোখ রাগে আরোও ছোট করে, কপালে বিরক্তির সেকেন্ড ব্র্যাকেট ঝুলিয়ে দৌড়ে আসে, তখন মাসী আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছেন ওদের ব্যাপারটা বোঝাতে। ইশারা আর মাসীর বার বার নীচের দিকে আঙ্গুল দেখানোয় কাজ হয়। কিন্তু যন্ত্র যুগের এই বিশ্বকর্মার দেশেও তক্ষুণি কোন ব্যাবস্থার কথা ওরাও ভেবে পায় না। চারিদিকে ঘোষণা হতে থাকে, প্ল্যাটফর্ম নাম্বার তিনে বুলেট ট্রেন এক ইমারজেন্সি সিচুয়েশানে পড়েছে। হেল্প চাই।

এক জাপানি মঙ্ক প্লাটফর্ম ধরে আসছিলেন, উনি কাছে এসে ব্যাপারটা বুঝে, নিজের হাতের স্টিকটি আলগোছে নামিয়ে চটির স্ট্র্যাপে ফাঁসিয়ে নিয়ে, আজকের ধোনির মতো হেলিকপ্টার সট মারেন, চটি জাপানের রেল পাতাল থেকে স্টেশান আকাশে উড্ডিয়মান হয়। মাসী চটি হাতে নিয়ে মঙ্ককে মহাশয়কে যত থ্যাঙ্কস দিতে থাকেন, সে তত ঝুকতে থাকে। শোনা যায়, সে দিনের এই অনিচ্ছাকৃত দেরীর জন্যে জাপানি রেলওয়েজ যাত্রী সকলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলো। খবরের কাগজেও বেরিয়েছিলো, ইন্ডিয়ান স্যান্ডাল ডিলেজ বুলেটস।

দেশে ফেরার পরে মাসী অনেকের কাছে নিজের এই কাহিনী শোনান। সকলেই হেসে কুটিপাটি। একজন জিজ্ঞাসা করেছিলো, মাসী তুমি নিজেও তো চটিটা তুলে নিতে পারতে!
‘হ্যা, তা হয়তো পারতাম, ওখানে রেল লাইনে তো আর গু পড়ে নেই, একদম ঝকঝকে। কিন্তু ভয় লাগলো, আমি নীচু হোই আর যদি দরজা বন্ধ হয়ে যায়, আর ট্রেন চলতে শুরু করে, তা হলে?তখন আমায় কে তুলবে রে’?
বোঝ !
------------------------------------------------------------------- ঋণ স্বীকার ঃ স্কেচটি দেশী পেইন্টারস.কম নামক সাইট থেকে নেওয়া। ব্যাক্তিত্বের সাথে মিল খাওয়ায় এখানে দিলাম।
আমার বন্ধুপত্নী যার কাছে এই চরিত্রের মশলাপাতি পাওয়া

2 comments:

Unknown said...

আরে দারুণ, দারুণ। এসেই জমিয়ে দিলে হিমাদ্রীভাই।

তবে এ'ধরণের চরিত্র কিন্তু খুব বিরল নয়। নিজের সুখে থাকা, ভাল থাকা, ধামাকা মাচিয়ে থাকার মধ্যেই জীবনের সারসত্য খুঁজে পান। বাকী দুনিয়ার রং বদলাল কিনা, কে কি ভাবছে বা কোথাও তাকে নিয়ে অসুবিধে হচ্ছে কিনা এ'সব বাজে ভাবনায় সময়ক্ষেপে এদের বড্ড অনীহা। ফলতঃ- সুখের জীবন।

তা সে যাই হোক্, তুমি কিন্তু গুছিয়ে লিখেছ। তোমার লেখার গুণে হেসে-হেসে ম'লাম। তবে স্কেচ কই, যে তার ঋণ স্বীকার? পোস্ট দিয়ে একবার পিছু ফিরে দেখে নিও ভাই।

Anonymous said...

Thanks Himadri ! থ্যাঙ্কস মুম্বাই ! মজার গল্প , উপভোগ করলাম। M K Pal