Wednesday, 16 November 2011

অথঃ পেন্সিল এবং রাবার উবাচঃ

পেন্সিল আর রাবারের সাথে সম্পর্ক মোটামুটি চুকে বুকে গেছে যখন স্কুল পাশ করে বেরিয়েছি। ছোটবেলায় লেখালেখি, স্কুলের হোম ওয়ার্ক অথবা নিছকই ড্রয়িং-এর ক্লাসে আঁকিবুকি কাটা, এসব কাজে পেন্সিল আর রাবারের যতটা মহত্ব ছিলো, কলেজ জীবনে তেমন করে এদের কথা মনে আসে নি। স্কুলে যারা খুব বেশী ছটফটে আর দুরন্ত ছিলো, তাদের স্যারেরা এই পেন্সিলের মাধ্যমেই শাস্তি দিতেন, মনে আছে নিশ্চয়ই। কলেজে আমাদের প্যালিওন্টোলজি বলে একটা সাবজেক্ট ছিলো, যাতে বেশ ভালো রকম পেন্সিল রাবার লাগতো। গোল শরীরের পেন্সিল থেকে চারকোণা শরীরের পেন্সিল আমরা ব্যাবহার করেছি। পরের দিকে তিন কোণা পেন্সিলও বাজারে পাওয়া যেতো। আমার মেয়েরা যখন পড়াশুনো ওই ছোট বয়সে করতো, তখনো প্রায় আমাদের সময়কার কারিগরী বা স্টাইলই মজুত ছিলো পেন্সিলের অবয়বে।
এখন পেন-পেন্সিল, নানা আকারের, নানা ‘এইচ’ এর পেন্সিল এসেছে বাজারে। আগের দিনে পেন্সিলের পেছনে টুপির মতো রাবার পরানো থাকতো, এখনও আছে, কিন্তু সে রাবার যতটা না পেন্সিলের মাথার মুকুট, ততটাই কম উপযুক্ত রাবার হিসেবে। ও দিয়ে বেশী ভুল বা কালো মোটা দাগ মোছা যেতো না, এখনও যায় না, কিন্তু এখনও তা পেন্সিলের মাথায় শোভা বর্দ্ধন করে থাকে। এ ছাড়া পেন্সিলের পেছনে নয়, সাথে একরকমের গোলাকৃতি রাবার পাওয়া যেতো, যেটা চ্যাপটা আর মাঝখানে ফুটো থাকতো, যার চার পাশটা টিন বা লোহা দিয়ে মোড়া থাকতো। দোকানদার বলতো ওই রকমের রাবার দিয়ে ফাউন্টেন পেনের লেখাও নাকি মোছা যায়। আমি অবশ্য কোনদিন মুছে উঠতে পারি নি। যদিও সে রাবারের বেশ কদর ছিলো, কেননা, ওর সাথে মুরগীর ঝুঁটির মতো লাল নীল প্লাস্টিকের তারের ঝুঁটি লাগানো থাকতো, যেটা রাবারটি ব্যাবহার করার পরে, ক্ষয়ে যাওয়া রাবারের ময়লা পরিষ্কার করতে লাগানো হতো। অবশ্য সাদামাটা রাবারের তুলনায় শোভাবর্দ্ধক ছিলো এই গোল রাবারগুলি। সাত কাহন করে পেন্সিলের আর রাবারের বৃত্তান্ত কেন বলতে বসেছি, তাতে যাবার আগে একটা ছোট্ট প্রচলিত গল্প শোনাই। পেন্সিল আর রাবারকে নিয়ে এমন গল্প বা কথোপকথন কে বানিয়েছে জানা নেই, কিন্তু গল্পটি খুবই প্রচলিত।
একবার পেন্সিল আর রাবার দুজনে সারাদিন কাজের পরে একটু অবসর পেয়েছে। দুজনে পাশাপাশি বসে ভাবলে একটু গল্প করে। পেন্সিল বলে, ‘ভাই রাবার, আমি এতো লিখি সারাদিনে, আর যা যা সব ভুল করি, তুমি সে সব পরিষ্কার করে আবার ঠিক করে লেখার জন্যে সুযোগ করে দাও। তোমার কাছে আমি কৃতজ্ঞ’। শুনে রাবার বলে, ‘আরে ভাই, তুমি ভুল করবে বলেই তো আমায় আনা হয়েছে, আর আমার কাজই তো তাই। ভুলকে মেটাই, ঠিককে রাখি’।
‘কিন্তু এই কাজ করতে করতে তোমার শরীর রোজ কতটা করে ক্ষয়ে যায়, সেটা ভেবে দেখেছো কি? প্রতিদিনই তুমি আগের দিনের থেকে ওজনে একটু কম আর সাইজে ছোট হয়ে যাচ্ছো’।
‘ কি আর করা যাবে, আমার এই বিধিলিপি’, রাবার বলে ।
‘তাই আমি ঠিক করেছি, এখন থেকে চেষ্টা করবো কোন ভুল না করতে, বা একদম কমসে কম করতে। তাহলে আর তোমার শরীর কমবে না, ওজন একই থাকবে’। পেন্সিলের ইচ্ছে।
‘দেখো পারো যদি। তবে একেবারেই ভুল করবে না বল যদি, তাহলে তো আমি এমনিই বাতিল হয়ে যাবো। তখন তোমার সাথে আমার দেখাটাও হবে না। আর আমি একা তো কমছি না, তুমিও তো রোজ নতুন করে নিজেকে শান দিয়ে তৈরী হও লেখার জন্যে। তাতে তোমার কলেবরও তো ছোট হচ্ছে’। রাবার বলে।
‘আসলে কি জানো, আমাদের দুজনেরই একই নিয়তি, কাজ কর আর শেষ হয়ে যাও, কেউ দুদিন আগে, বা কেউ দুদিন পরে। ছ ইঞ্চি লম্বা থেকে আমি মাদুলির সাইজে চলে আসছি, আর তুমি চৌকো বা আয়তাকার থেকে ছোট্ট গোল গুলির মতো মতো হয়ে যাচ্ছো। শেষের দিকে আমরা দুজনেই এগোচ্ছি’। পেন্সিলের অভিমত।
‘তুমি একদম ঠিক বলেছো, কিন্তু আমরা যেটা বানিয়ে রেখে যাচ্ছি, সেটা তো সকলের কাজে লাগছে, তাই না বল। তাহলে আর দুঃখ কেন’। রাবারের সহজ জবাব।
গল্পের শেষে দুজনে দুজনকে ধরে সেদিনের মতো ঘুমিয়ে পড়ে।
এই গল্পটা পড়ার পরে, আমার মাথায় একটা অদ্ভুত যোগাযোগ বা তুলনা মূলক বিশ্লেষণ নজরে এলো। আমি ভেবে দেখলাম আমরা মানুষেরাও এই রাবার আর পেন্সিলের মতোই হবহু। আমরা একই সাথে রাবার আর পেন্সিল দুটোই, কেবল এইটুকুই তফাত। বুঝিয়ে বলছি।
শিশু যখন ছোট থাকে, আর জীবনের নানা পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে আস্তে আস্তে পুরো মানুষ হয়ে ওঠে, তখন সে পেন্সিলের ভুমিকায় থাকে। যা করে তার মধ্যে নানা ভুল ত্রুটি থাকে। যাকে বার বার শুধরে দিতে হয়। সে শিশুর বাবা/ মা তখন রাবারের ভুমিকায় কাজ করে। সত্যি করে নিজের জীবনে একবার ভেবে দেখুন সকলে, ছোট হতে বড় হওয়া, বা বলা ভালো নিজের শিশু পুত্র বা কন্যার বাবা/মা হওয়ার আগে পর্যন্ত, আমাদের কত ছোট বড় ভুল ভ্রান্তি, কাজের বা আচরণের, অভ্যাসের বা বিশ্বাসের, সব কিছু আমাদের মা-বাবাই শুধরে এসেছেন। মুছে এসেছেন, যাতে আমরা ঠিক করে, মুছে দেওয়া স্লেটে আবার নতুন করে জীবনকে এগিয়ে নিতে পারি। আমরা পেন্সিল আর মা বাবা রাবার, ঠিক কিনা। আবার নিজেরা যখন পুত্র কন্যার মা বাবা হলাম, তখন আমরা বদলে গেলাম রাবারে। ওরা হয়ে গেলো নতুন পেন্সিল। আমাদের কাজ হলো তখন ভুল করার
হাত থেকে ওদে র বাঁচানো, ভুল হলে তা শুধরে দেওয়া।
আসলে সব পেন্সিলেরাই একদিন রাবারে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এই রুপান্তর যুগে যুগে চলে এসেছে, যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন এই রুপান্তর এমনই চলবে। সকলের অগোচরে, কিন্তু নিশ্চিত রুপে। আমরা সকলেই ভালো রাবার হবার চেষ্টা করবো। কেননা রাবারের তাৎপর্য পেন্সিলের থেকে সব সময়ই বেশি। পেন্সিল যদি সুকুমার রায়ের ছড়ায় কেবল হাতে থাকে, রাবারকে থাকতে হবে বোধশক্তির চূড়ান্ত সীমায়, যেখান থেকে পথ কেবল সার্থকতার দিকেই যায়।
এমন রাবার বাবা মায়ের খোঁজে আছি। কারোর জানা থাকলে বলবেন, ইন্টারভিউএর জন্যে হাজির হয়ে যাবো। পেন্সিল আর রাবার সৃষ্টি আর স্রষ্টার অমোঘ মিলন। ভাবা যায় !!!

5 comments:

Unknown said...

বাহ রে বাহ, তোমার ভাবনা তো বিচিত্র পথে এগিয়েছে...

যা বলেছ। ...'সব পেন্সিলেরাই একদিন রাবারে রুপান্তরিত হয়ে যায়। এই রুপান্তর যুগে যুগে চলে এসেছে, যতদিন মানুষ থাকবে, ততদিন এই রুপান্তর এমনই চলবে।'

থুব চিন্তাশীল হয়ে পড়েছ, আর তারই পরিণতি এই 'কথার কথা' তাই না?

চৈতী আহমেদ said...

মঞ্জুশ্রীর খোঁচা খেয়ে চলে এলাম আপনার লেখা পড়তে, সত্যি না এলে খুব ক্ষতি হয়ে যেত আমার, এত চমৎকার একটা লেখা কি সহজ করে লিখেছেন! পড়ে ভালোলাগায় ছেয়ে গেল মনটা, আমার ছেলেবেলায় এক ধরণের রাবার আমরা পেয়েছিলাম যা ঘষলে খুব সুন্দর সুগন্ধ বের হতো চইংগাম চিবোলে যেমন হয়। শেষটায় যে মেসেজ রেখেছেন এক কথায় অসাধারণ। মেয়ের ভুল গুলো নিয়ে খুব বকাঝকা করি ওকে, আপনার লেখা পড়ে ভাবছি আর বকবো না, আমিতো রাবার!

TRISHITA BANERJEE said...

কোন কথা হবে না । একঘর পুরো

Himadrisekhar said...

সকলকে ধন্যবাদ পড়বার জন্যে। আর অবশ্যই মন্তব্য জানানোর জন্যে। তৃষীতা দেবীর কমেন্টস ঠিক ঠাক বুঝতে পারলেম না। একঘর পুরো কি ?

আল ইমরান said...

‘আসলে কি জানো, আমাদের দুজনেরই একই নিয়তি, কাজ কর আর শেষ হয়ে যাও,

খুব খুব খুব গুরুত্বপূর্ণ কথা। আমার খুব মনে ধরেছে।