আজ থেকে বছর দশেক আগে জনক তার বাবার সাথে মাথেরান বেড়াতে এসেছিলো। কোলকাতায় ওদের নিজেদের ছোট একটা রেস্টোরেন্ট ছিলো।ওই আয়েই ওদের সংসার চলতো। বাবা কেবল বলতেন, কোলকাতার বাইরে, কোন হিল স্টেশনে যদি কোনদিন একটা ছোট হোটেল খুলতে পারি, তাহলে তোদের আর চিন্তা থাকবে না। রেস্টোরেন্ট থাকলে থাকলো, না থাকলেও হিল স্টেশনে হোটেল ভালোই চলবে। মাথেরান এসে একদম না জেনেই ওরা এই জায়াগাটায় উঠে এসেছিলো। তখন এটা হোটেল বা রিসর্ট হিসেবে ছিলো না, এক অ্যাংলো ইন্ডিয়ান মহিলা এই বাড়িটার মালিক ছিলেন, ওঁর হাজব্যান্ড স্বাধীনতা পরবর্তী কোন দাঙ্গায় অ্যাকসিডেন্টালি মারা যান। মহিলা ভারতবর্ষ ছাড়েন নি, এই বাংলোতেই থাকতেন আর কখনও কখনও কোন কোন ট্যুরিস্টকে রুম রেন্টে দিতেন, বিশেষতঃ যদি সেই ট্যুরিস্ট মহিলা আর এজেড হতেন। তাতে তার আয়ের থেকেও কটা দিন সঙ্গীর যোগাড় হয়ে যেতো। আপাত দৃষ্টিতে মহিলা খুব সক্ষমই ছিলেন, সাইকেলে ঘোরাঘুরি করতেন, বন্দুক চালাতে জানতেন, বাংলোর চারপাশে ভালো বাগানও বানিয়েছেন। জনকের মনে আছে মাথেরানে পৌঁছে, বাবা যখন হোটেলের ঠিকানা ইত্যাদির খোঁজ করছেন, তখন হঠাৎ একজন মেম মহিলা এসে ওর বাবার কাছে জানতে চায়, ওরা কি ফ্যামিলি পার্সন? কজন আছেন? উনিই ওদের প্রথম এই বাংলোয় নিয়ে আসেন। তারপরে সাতদিনে কেমন করে যেন বাবাকে মিসেস ফ্লিন্টের পছন্দ হয়ে যায়। বাবার বিজনেস আর মনের ইচ্ছার কথা জানতে পেরে, একদিন সকালে ব্রেক ফাস্ট টেবিলে উনি বাংলোটা বাবার কাছে বিক্রি করার প্রোপোজাল দিয়ে দেন। বলেন, ‘এবার আমি দেশে ফিরে যেতে যাই, উইলিয়াম অনেকদিন হলো চলে গেছে, তোমায় ভালো লোক বলে মনে হলো, তাই তোমার কাছে বাড়িটা দিয়ে যেতে চাই। যদি কখনও আবার ইন্ডিয়া ঘুরতেও আসি, এখানে আসবার একটা চান্স থাকবে’। বেড়াতে এসে, এমন ব্যাবসায়ী সুযোগ আসবে, এটা ওদের কল্পনারও বাইরে ছিলো। কিছুদিনের সময় চেয়ে নিয়ে, জনকরা তাড়াতাড়ি কোলকাতায় ফেরে। মাসখানেকের মাথায় বাবা মনস্থির করে বায়নার টাকা মিসেস ফ্লিন্টের নামে মানি অর্ডার করে দেন। অর্ডার ফর্মের নীচে লিখে দেন কাইন্ডলি মেক দি ডিল’স পেপারস ফর পারচেসিং দি ডিজায়ারড বাংলো ফর অনওয়ার্ড রেজিস্ট্রেশান উইথ দি আন্ডারসাইনড। রিগার্ডস।
২০০০ সালের শেষের দিকে ডিল ফাইনাল হয়, কোলকাতার রেস্টোরেন্ট বেচে দিয়ে জনকরা মাথেরান সিফট করে যায়। কোলকাতার বাড়িতে জনকের দিদি আর জামাই বাবু থেকে যায়। জনক আর বাবা মা মাথেরানে এসে নতুন করে সংসার আর ব্যাবসা দুটোই গুছতে বসলেন। একজন বাঙালি তার স্বপ্নের খাতিরে পরদেশে মোটামুটি হোষ্টাইল পরিবেশে এর আগে কোন দিন তার পরিবার সমেত বসত বাটি উঠিয়েছে কিনা, তা হয়তো বঙ্গদর্পণের কোন ঐতিহাসিকই বলতে পারবেন, কিন্তু জনক জানে বাবা কত বড় রিস্ক নিয়েছেন। মাথেরান ওয়েস্টার্ন ঘাটসের এক পাহাড়ি স্থান। প্রাকৃতিক পরিবেশ এতো মনোরম যে বছরে এখানে ট্যুরিস্টের কম বেশি ভীড় লেগেই থাকে, যদিও বৃষ্টির দিনে জুন জুলাই থেকে সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি একটু বেশি লোক জন আসে।সেখানে এমন হঠাৎ করে নিজের সবচেয়ে ঐকান্তিক স্বপ্নের ঠিকানা পেয়ে যাবেন, জনকের বাবা প্রথমে এটা বিশ্বাস করতে পারছিলেন না। তারপরে এটা তার গুরুর নির্দেশ মনে করে, আর কোন দ্বিধা না করে সোজাসুজি চলে আসেন। নিজের জীবনের এতোদিনের যোগাড় করা শেষ পুঁজিটুকুও লাগিয়ে দেন এই বাংলোর কমপ্লিট রেনোভেশানে। ২০০১ সালের ১৪-ই এপ্রিল পয়লা বৈশাখের দিন পার্থ রিসর্টের দরজা আনুষ্ঠানিক ভাবে পাবলিকের জন্যে খুলে দেওয়া হয়। কাগজে বিজ্ঞাপন দেওয়া ছাড়াও, লোকাল স্টেশানে পোষ্টার, হ্যান্ডবিল সবই বিলি করা হয়। সেই বছরে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বোর্ডারের সংখ্যা ছিলো চার। কিন্তু তাতে জনকের বাবাকে দমানো যায় নি। পরের বছরের জন্যে কোলকাতার কাগজে পুরোনো রেস্টোরেন্টের রেফারেন্স দিয়ে মাথেরানে মনোরম পরিবেশে বাঙ্গালির ঘরোয়া জায়গা বলে লাগাতার বিজ্ঞাপন দিলেন। ওনার আন্দাজ ঠিক ছিলো। পরের বছর থেকে রিসর্ট পুরো দমে চালু হয়ে যায়। তারপরে এই দশ বছরে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। বাবা এর মধ্যে দেহ রেখেছেন, জনকের বিয়ে হয়েছে, ওর স্ত্রীও ওর সাথে এই ব্যাবসায় পুরো দস্তুর জড়িয়ে পড়েছে। বাবার কাছ থেকে জনক হোটেল চালানোর সব ফিকির আর কায়দা রপ্ত করে নিয়েছে। বাবা থাকা কালীনই পরশুরাম ওদের দেশের বাড়ি থেকে এখানে চলে আসে। সেই থেকে ওদের সাথেই রয়ে গেছে। মিসেস ফ্লিন্ট অবশ্য আর ফেরত আসেন নি। তবে গত বছর ওনার দেহান্তের খবর এই হোটেলে সুদূর স্কটল্যান্ড থেকে ওনার কোন ভাইপো চিঠি দিয়ে জানিয়েছিলো। জনকরা সে খবরে সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলো, যেন কোন নিকট আত্মীয়ার চলে যাওয়া। রিসর্টের ডেস্কের পেছনে দেওয়ালে বাবার ছবির পাশে মিসে ফ্লিন্টেরও একটা বড় ছবি পরে লাগানো হয়। দুজনের মধ্যিখানে বাবার গুরুদেবের ফোটো।
* * * *
দুজনের কারোরই মনে এলো না, না রজত বাবুকে না নীহার বাবু আর তার স্ত্রীকে। ও কিছু না, আসবে যখন দেখা যাবে, এই বলে জনক উঠে পড়ে। বৃষ্টি একদম ধরে গেছে, একটু একটু করে রোদের চমক বাড়ছে। পরশুকে চেঁচিয়ে ডাকে জনক। গাড়ি ঠেলে স্টার্ট দিতে হবে। মোটামুটি লিস্ট একটা হয়েছে। ঘরের থেকে এখন টাকা নিয়ে যাচ্ছে কেনাকাটার জন্যে, আসার সময় ব্যাঙ্ক হয়ে আসতে হবে। এখানে ঘরে সব সময় কিছু মোটা টাকা রাখতেই হয়। বোর্ডারদের কখন যে কি চাইবেন আগে থেকে তো জানা থাকে না। বাবা বলতেন যতটা পারবে করবার চেষ্টা করবে, বোর্ডাররা আমাদের লক্ষ্মী। তাদের কখনও হেলে ফেলা কোরো না। জনক নিজেও খুব অনেস্টলি সব কিছু সামলাতেই ভালোবাসে, আর বাবার কথাটাও ও ফেলে দিতে চায় না। সীতা উঠে পড়ে, তার হাতে এখন বিস্তর কাজ। রান্নাঘর ঠিক ঠাক করা ছাড়াও সব ঘরে পর্দা, চাদর, বালিশের ওয়াড় বদালানো, ফার্নিচার সাফ সুফ, সবই করতে হবে। পরশুকে তাই যেতে দেয় নি ও জনকের সাথে। অবশ্য এমনিতে সব সাফই আছে, কিন্তু বিজনেস সিজনে একটু বিশেষ খেয়াল রাখতে হয়। ফুলওয়ালাকেও ফোন করতে হবে, সোমবার থেকে যেন ফুল দেওয়া আবার শুরু করে বোর্ডারের ঘরে ঘরে। দুজনের কেউই রিসর্টের ব্যাপারে কিপ্টে নয়, কিন্তু সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে হিসেব করে চলে। আর তাতেই ওদের বোর্ডার সংখ্যা বেশী না হলেও রিসর্ট এখনো লাভের খাতাতেই আছে। আর সুনামও পেয়েছে যথেষ্ঠ। ব্যাবসার নিয়ম অনুসারে ওদের সফল এন্টারপ্রেণার বলা যেতে পারে।
জনক এখন ঘন্টাখানেকের মধ্যে ফিরবে না। সীতা পরশুকে নিয়ে ঘরের পর্দা গুলো নিয়ে পড়ে। কাজ করতে করতে পরশু জানতে চায়, বোর্ডার কবে থেকে আসছে দিদিমণি। হঠাৎ সীতার মনে হলো পরশুকে একবার রজত বাবু বা নীহার বাবুর কথা জিজ্ঞাসা করে দেখলে কেমন হয়। পরশুতো সব সময়ই কিছু না কিছু দিতে বা নিতে ওদের ঘরে গিয়ে থাকবে। ওর মনে থাকাটা স্বাভাবিক।
‘হারে, পরশু, তোর রজত বাবুকে মনে আছে ? কিম্বা নীহার চৌধুরী আর ওনার স্ত্রী’কে’?
‘এনারা কারা গো দিদিমণি ? আমি কি নাম মনে রাখতে পারি ? তবে দেখতে কেমন যদি বলতে পারো, তবে খানিক ভেবে দেখতে পারি’।
‘ দেখতে কেমন সেটাই তো মনে নেই, তোকে কি করে বলবো? ওরা গতবচ্ছরও এসেছিলেন। একজন ওই এক নম্বর ঘরে, আরেকজন ও পাশের ডাবল রুমে। ভেবে দেখ, মনে পড়লে আমায় বলিস’।
‘সিংগল রুমে ছিলেন বলছো। দাঁড়াও, দাঁড়াও, মনে পড়েছে গো দিদি। সে বাবু তো সব সময় কালো চশমা পড়ে থাকতো, আর খুব সিগ্রেট খেতো। খুব নোংরা করে রাখতো ঘর দোর। চা দিতে গেলে দেখতাম, কিছু না কিছু নোট বইয়ে লিখছেন। ওনার খাবারও ঘরে দিতে হতো’।
ঝট করে সীতার মনে পড়ে গেলো, সেবার একদিন চিকেনে নুন দিতে ভুলে গেছিলো, আর এই ভদ্রলোক প্লেট নিয়ে সোজা কিচেনে ঢুকে এসেছিলেন, ‘আপনাদের এখানে কি সকলে হাই প্রেশারের রুগী’?
প্রশ্নটা ফলো না করতে পারায়, উনি চিকেনের প্লেটের দিকে ইশারা করে বলেন ‘এটিতে নুন না দিলে মুখে তোলা যাচ্ছে না। দয়া করে আর একবার নুন দিয়ে গরম করে নিন’।
বিব্রত সীতা কোনরকমে সামলায় সেদিন, জনকের কানে গেলে রাগ করবে, বিশেষতঃ এই রিসর্টের খাওয়া দাওয়ার সুনাম আছে, আর সেটা সীতার নিজস্ব রান্নার জন্যেই। ঠাকুর আছে, কিন্তু তদারকি এবং দিনের বিশেষ মেনুটা ও নিজেই রাঁধে। কোন ভাবে আজ মিস হয়ে গেছে, মনে হয় ফোন অ্যাটেণ্ড করতে চলে গেছিলো, তারপরে এসে ভুলে গেছে যে নুন দেওয়া বাকি রয়ে গেছে।
সীতা মনে মনে প্রমাদ গোণে, আচ্ছা উনি তাহলে রজত বোস। আবার আসছেন। কিন্তু ওনার আবার বৃষ্টিতে কি কাজ এখানে ? চিকেনের ঘটনাটা জনক জানে না, ওকে অন্য ভাবে বলতে হবে রজত বোসের কথা। রজত বোস এমনিতে শান্ত হলেও কি যেন একটা আছে তার হাব ভাবে, যা মনকে সন্ধিগ্ধ করে। সীতা মনে মনে একটু অস্বস্তি বোধ করে। কি আর করা, বোর্ডার বলে কথা।
ডেস্কের ফোনটা এই সময় আওয়াজ তোলে। রিসিভার তুলতেই, ও পাশ থেকে জনক ‘ব্যাটারিটা একদম বসে গেছে বুঝলে, আমি চার্জে দিয়েছি গ্যারাজে, নতুন ব্যাটারি এদের কাছে নেই, অন্য একটায় চার্জ চলছে। বাজার করে যেতে আমার দেরি হবে তাই। তুমি খেয়ে নিও যা হোক। আমি এখানে বাইরে খেয়ে নেব’।
‘আচ্ছা ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা কোরো’। সীতার জবাব।
‘দেখছি। নতুন ব্যাটারী নিতেই হবে মনে হচ্ছে; বোর্ডার আসার আগেই খরচের ফোয়ারা চালু হয়ে গেলো, কি বল’?
‘তা কেন, ওটা তোমার পাল্টানোরই ছিলো, ওয়েদারের জন্যে দু দিন আগে আর পরে। জানো, পরশুর রজত বাবুকে মনে পড়েছে। খুব খুঁতখুঁতে লোক। তুমি ফিরে এসো, সব বলবো তখন’।
‘বাবা পরশুরামের তা হলে স্মৃতিশক্তি বেশ ভালো বলতে হবে, অন্তত আমার তোমার চেয়ে তো ভালোই কি বল? ঠিক আছে, আচ্ছা এখন রাখছি’।
জনক লাইনটা কেটে দেয়। সীতা হিসেব করে আরো তিনটে ঘর বাকি আছে। আলমারি খুলে ন্যাপথলিনের গন্ধে ভরা সেলফ থেকে গুণে গুণে পর্দা নামাতে থাকে। শেষ পর্দাটা টান মারতেই কি যেন একটা মাটিতে ছিটকে পড়ে আলমারী থেকে। নীচু হয়ে তুলতে গিয়ে সীতা একদম স্থির হয়ে যায়। মেঝের ওপরে পড়ে আছে ছোট্ট একটা পয়েন্ট টু বোরের ঠান্ডা কালো রং এর রিভলভার। এটা কোথা থেকে এলো, কার এটা, আলমারীতেই বা কে রাখলো, কবে থেকে আলমারীতে, এসব একগাদা প্রশ্ন মাথার মধ্যে ভিড় করে এলো। কোনটারই জবাব সীতা জানে না। মাটিতে হাত–পা ছড়িয়ে বসে পড়ে ও। জিনিসটা তেমনই মাটিতে পড়ে আছে। এক্ষুণি কিছু একটা করতে হবে, পরশু এসে এখনই পর্দা চাইবে। মাথা কাজ করছে না, হাত পা চলছে না।
‘দিদি মণি, বাকি ঘরের পর্দা গুলোন কোথায় রাখলে’? পরশু এদিকেই আসছে। এক ঝটকায় হাত দিয়ে রিভলভারটাকে সীতা আলমারীর তলায় খালি পাঠিয়েছে, দরজা ঠেলে পরশুর প্রবেশ।
‘ও-মা, মাটিতে বসে কি করছো, শরীল খারাপ বোধ হচ্ছে ? তোমার মুখটা অমন সাদা কেন গো দিদি? কিছু কি হয়েছে? আমায় বল’।
‘কিছু না, হঠাৎই মাথাটা ঘুরে যায়। তুই এই চাদর আর পর্দা নিয়ে বাকি ঘরগুলোয় যা, আমি আসছি’।
ক্রমশ...
2 comments:
দা-রু-ণ... শেষকালটায় এসে এমন একটা প্যাঁচ কষছো যে 'তাপ্পার-তাপ্পর' করে মন হাঁকুপাঁকু করছে। নাঃ, তুমি দেখছি রহস্যগল্পের রহস্যটা খুঁজে পেয়েছ ঠিকঠাক।
মঞ্জুদি
উৎসাহ বাড়ানোর জন্যে ধন্যবাদ
Post a Comment