যেহেতু ঘরবন্দী, তাই বেড়ানোর গল্প। নতুন নয়, কারণ বহুকাল কোনো বেড়ানো নেই। ২০০৮সালের অক্টোবরের লেখা, সচলায়তনে প্রকাশিত। আজ আবার মনফসলে ফসল ফলানো বন্ধুদের জন্যে--
মাস দুই আগে থেকেই টিকিট কাটা ছিল শিলিগুড়ির। শুভজিতের বোনের বৌভাতে কনেযাত্রী হিসেবে নিমন্ত্রিতের তালিকায় নাম ছিল আমাদের জোড়ে। সেইমত শুভ টিকিট কেটে রেখেছিল আর টাইম টু টাইম রিমাইন্ডারও দিচ্ছিল। যাব বলে কথা দিয়েছিলাম দুজনেই। না যাওয়ার কোন কারণ নেই। দুজনেই বেড়াতে ভালবাসি, ফাঁক পেলেই এদিক ওদিক বেড়িয়ে পড়ি আর এ তো বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া। উত্তরবঙ্গে আমার আগে যাওয়া হয়নি কাজেই ওটা একটা বাড়তি আকর্ষণ। দু'দিনের প্রোগ্রাম। কিন্তু আমি সুমেরুকে বলেই রেখেছিলাম, দু'দিন পরে আমি সকলের সাথে ফিরছি না! পাহাড়ে চলে যাবো, গ্যাংটক, ভুটান বা সিকিম। যে কয়টা জায়গা দেখা যায়, বেড়ানো যায়, বেড়িয়ে ফিরবো! দিন সাত/আটের আগে ফেরার প্রশ্ন নেই!
-২-
-৩-
-৪-
পাহাড়ে
চড়ার অভিজ্ঞতা যার নেই সে কল্পনাও করতে পারবে না সে যে কি জিনিস! চুলের
কাঁটার মত বাঁক ঘুরে সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি চড়ে যায় উপরে, আরও উপরে। কখনও
একপাশে তো কখনও দু পাশেই হাজার হাজার ফুট খাদ! গাড়ি যদি পড়ে তো মানুষ তো
কোন ছার গাড়ির টুকরো টাকরাও খুঁজে পাওয়া যাবে না! ড্রাইভারের মুখে শুনলাম,
এখানে যদি কোন গাড়ি খাদে পড়ে যায় তাহলে প্রথম যে গাড়ি বা মানুষের চোখে
সেটি পড়ে তারা এসে রাস্তার ধারে লাগিয়ে রাখা কালো বোর্ডে গাড়ির নাম,
নম্বর, ও গাড়ির আরোহীদের নাম লাল চক দিয়ে লিখে রেখে যায়! সমতল ছেড়ে গাড়ি
যখন পাহাড়ের দিকে এগুচ্ছে তখন দেখলাম ফলকে লেখা আছে, ইটস বেটার টু বি লেট
নট টু বি মিষ্টার লেট! বুকের ধুকপুকুনি তখনই বেড়ে গেসল!
শরীরের হাড়-মাংস-রক্ত ততক্ষণে অলরেডি জমে বরফ তায় এই সব গল্প! ড্রাইভারকে প্রায় চেঁচিয়েই বলি, মন দিয়ে গাড়ি চালাও, কথা বলতে হবে না! চোখ বন্ধ করে দুই হাতে শক্ত করে পাশে বসা মানুষটিকে ধরে শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধু প্রভুর নাম জপ করি, এবারে বেঁচে ফিরে যেতে পারলে আর কখনও পাহাড়ে আসার নাম করব না! শুক্লা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠছিল ভয়ে আর সে নিয়ে প্রবল হাসাহাসি করছিল গাড়িতে বসা অন্যরা। চোখ বন্ধ করে রাখতেও ভয় পাই, জোর করে চোখ খুলে রাখি, গাড়ি যদি পড়ে তবে অন্তত যেন কলমাটা পড়তে পাই। চোখ মুদে থাকলে তো জানতেই পারব না যে গাড়ি পড়ছে! সবাই রাস্তার উপর হাঁটাহাটি করছে, রাস্তার ধারে গিয়ে খাদ দেখছে, আমি গাড়ির পাশে গাড়িকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। পা দুটো থরথর কাঁপছে! শুভ, তথা এসে হাত ধরে টানাটানি করছে, খাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখার জন্য। সে নাকি অপূর্ব! অনন্য সাধারণ! কিন্তু আমার পা কিছুতেই রাস্তার ধারে যায় না। চেষ্টা করেও যেতে পারি না।
এমনিতেই আমার উচ্চতায় ভয়। চারতলা বাড়ির ছাদে থেকে আমি নিচের দিকে তাকাতে পারি না, মনে হয় পড়ে যাব! তথা বুঝতে পারে, বলে ছেড়ে দাও ওকে, ওর ভয় আছে হাইটে! শুভ তবুও মশকরা করে যায় সমানে। এমনকি শুক্লাকেও দেখা গেল ভয়-ফয় দূরে সরিয়ে রেখে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! রাস্তার একপাশে কিছু ষ্টোনচিপস জড় করা ছিল, আমি গিয়ে সেটার উপর বসি। ওরা ছবি তোলে। ছবি তোলার আমিও চেষ্টা করি কিন্তু সে রাস্তার এপাশ থেকে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে। তাতে করে রাস্তার ধারের রেলিংএর ছবিই ওঠে। নিচের পাহাড়, উপত্যকা, গাছপালা, পাহাড়ের গায়ে গায়ে চায়ের বাগান আর খাঁদের ছবি ওঠে না।
মোবাইল
ফোনের উপুর্যপরি ঘন্টায় ঘুম যখন ভাঙল, বেলা তখন সাড়ে ন'টা। শুভজিতের
নতুন বোন'জামাই অনির্বাণ এসে ডোরবেল বাজানোতে তার ঘুম ভেঙেছে আর সে সকলকে
ফোন করে ঘুম ভাঙিয়েছে! ঘটনা হল, সাড়ে ছ'টায় গাড়ি নিয়ে ড্রাইভার এসে
হোটেলের বাইরে দাঁড়িয়ে থেকে থেকে শেষমেষ অনির্বাণকে গিয়ে ডেকে এনেছে ঘটনা
কি দেখার জন্যে! সারা ঘরময় ছড়ানো বোতলেরা গড়াগড়ি করছে দেখে অনির্বাণ আর
ঘরে ঢোকেনি, বাইরে থেকেই জানিয়ে দিল গাড়ি অপেক্ষা করছে, আপনারা রেডি হয়ে
বেরিয়ে পড়ুন। সন্ধে সাতটায় ট্রেন, কাজেই পাঁচটার মধ্যে হোটেলে ফিরতে হবেই!
যে গাড়িটির সামনে এসে দাড়ালাম সেটিও একটি স্করপিও। তবে কালকের গাড়িটি নয়। ড্রাইভারও দেখলাম নতুন। এগিয়ে এসে সবাইকে নত হয়ে অভিবাদন জানিয়ে নিজের পরিচয় দিল মুহাম্মদ রফিক বলে। বলল, তাড়াতাড়ি চলুন, আপনারা এমনিতেই দেরি করে দিয়েছেন! হিন্দিতে কথা বলছিল, জিজ্ঞেস করে জানলাম, শিলিগুড়িতেই জন্ম, বড় হওয়া। তবে আদিপুরুষেরা ইউপি থেকে এসেছিলেন। সামনের সিটে তথা আর নীলু গিয়ে বসল, মাঝের সিটে প্রথমে শুভ, মাঝে আমি আর একপাশে শুক্লা। বলা বাহুল্য আমি ইচ্ছে করেই মাঝখানে গিয়ে বসলাম। শুভ বলল, গাড়ি যদি পড়ে তো তুমি কি মাঝখানে বসে বেঁচে যাবে নাকি? কান না দিয়ে চুপ করে বসি আর মনে মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করি। টুকটাক কথা বলছে সবাই। বেশিরভাগই পাহাড়ের কথা। তথা দার্জিলিং সেন্ট পলসের ছাত্র। শুভ শিলিগুড়ি ডন বস্কো'র। কাজেই ওদের কাছে অফুরন্ত গল্প।
আমাদের আজকের ড্রাইভারটি চুপচাপ বসে শুধু গাড়ি চালায় না কালকের ড্রাইভারের মত। সে বেশ কথা বলে সকলের সাথে। গাড়ি শিলিগুড়ি ছাড়ানোর আগে একটা ট্র্যাফিকে দাঁড়ানোতে আমি দেখলাম কয়েকজন হকার মাথার ঝাঁকায় করে লিচু বিক্রি করেছে। সবুজ লালে মেশানো লিচু। আমার তখনও এই মরশুমের লিচু খাওয়া হয়নি বিধায় বায়না ধরলাম লিচু খাব বলে! শুভ এক ধমক দিল, এই মেয়েটা খালি খাই খাই করে, কালও মোমো খাব মোমো খাব করে পাগলা বানিয়ে দিয়েছে! চুপ করে বস! খানিক বাদেই তো চুপ করে যাব আমি, বলে ব্যজার মুখে চুপই করে গেলাম! ভাল ছেলে নীলু লিচুওয়ালাকে ডেকে লিচু কিনল আর আমি মন দিয়ে বসে লিচু খেতে লাগলাম।
গাড়ি আবার পাহাড়ের দিকে। আর আজকের রাস্তা কালকের থেকেও ভয়ংকর! আমাদের ড্রাইভারটি অদ্ভুত। সে বাঁকের মুখেও গাড়ির হর্ন বাজায় না। পাহাড়ের গায়ের ছায়া দেখে নাকি বুঝতে পারে, ওপর থেকে কোন গাড়ি নেমে আসছে কিনা! হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছিল ওর এই হর্ণ না বাজানো দেখেই। গাড়িও প্রচন্ড স্পীডে চালায়, বলে আমি রোজ এই রাস্তায় পাহাড়ে উঠি আর নামি, প্রাণের ভয় আমারও আছে, একটা ছেলে আছে আমার, মরতে আমিও চাই না। কাজেই আপনারা ভয় পাবেন না। শুক্লা একটু বেশিই চেঁচামেচি করছিল ভয়েতে তাই ওই ভাষণ মুহাম্মদ রফিকের। খানিকটা ওঠার পরেই পুরুষেরা গাড়ি থামাতে বললেন, তারা ছোট প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যাবেন! রফিক গাড়ি দাঁড় করাল একটা সাইড ধরে, পুরুষেরা আড়ালে চলে গেলেন। আমি আর শুক্লা গাড়িতে বসে পাশের খাদ আর দূরের তরাই দেখছি, পাহাড়ের গায়ে দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়। থাকে থাকে চায়ের গাছেরা উঠে গেছে পাহাড় বেয়ে।
এখানে চা বাগানে কোন শেড ট্রি নেই। রফিক বলল, রোদ তো লাগে না খুব একটা। ঠান্ডা জায়গা, শেড ট্রি'র দরকারই নেই। সমতলের বাগানগুলোতে শেড ট্রি আছে, আসার পথে নিজেই দেখে এসেছি। মন দিয়ে দেখছিলাম আর শুক্লার সাথে কথা বলছিলাম। আমাদের দু'জনকেই চমকে দিয়ে মুহাম্মদ রফিক আমার দিকে তাকিয়ে বল; ওঠে, আপ মুসলিম হ্যায় না? শুক্লা সাথে সাথেই জানতে চায়, তুমি কি করে বুঝলে? রফিকের ত্বরিত জবাব, মুসলমানকা চেহরে পে এক আলগই হি রওনক হোতি হ্যায়! ইনার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় যে উনি মুসলিম! আমি কথা বাড়াই না আর। শুক্লাও চুপ করে গেছে। আমার পাশে বসা অনিন্দ্যসুন্দরী শুক্লাকে দেখার পরও কেউ আমার চেহারায় রওনক দেখতে পায় আর মুসলিম বলে শনাক্ত করে! চুপ তো হয়ে যাওয়ারই কথা।
গাড়ি এগোয়। এক অদ্ভুত নিয়ম পাহাড়ে। এখানে কেউ অকারণ হর্ণ বাজায় না। কেউ কাউকে ওভারটেক করার চেষ্টাও করে না। নেমে আসা গাড়িটিকে পাশ দেয় নিজে খাঁদের ধারে চলে গিয়ে। যে গাড়িটি উঠছে সে খাঁদের ধারে চলে যায় আর যে নামছে সে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নামে। রফিক দুর্দান্ত গাড়ি চালায়। সে জানাল, গতকাল সে নাকি একটি হর্ণ নষ্ট গাড়ি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমেছে। বলল, হর্ণ থাকলেই অসুবিধে। না থাকলে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালানো যায়। আমি শক্ত হয়ে বসে থাকি সামনের সিটটিকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি উপরে ওঠে। শুভ মাঝে মাঝে আমাকে বলে, সিটটা ছিঁড়ে যাবে যে! শুক্লা একবার চেঁচিয়ে উঠে ধমক খেয়েছে রফিকের কাছে, রফিক বলেছে, আপনারা এরকম করলে কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট হবেই! হাজার পাঁচেক ফিট উপরে ওঠার পরে থেকেই পাহাড়ী গ্রাম দেখা যেতে লাগল। ছোট ছোট গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে ঢালে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পাহাড়ী ছাগলের মত রাস্তা ছেঁড়ে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। স্কুলযাত্রী স্মেয়েরা সালোয়ার কামিজ আর ওড়নার ইউনিফর্মে দল বেঁধে পথ হাঁটছে। মহিলারা মাথায় কুড়িয়ে আনা ডালের আঁটি নিয়ে খাঁদের ধার দিয়ে পথ চলছেন। নেপালী চেহারা, নেপালী পোষাক। বাচ্চাগুলো খেলছে রাস্তার ধারে ধারে। রেলিংএ বসে গল্প করছে জোড়ায় জোড়ায় পাহাড়ী যুবক-যুবতী। কোথাও বা বয়স্ক কয়েকজন মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছেন রাস্তার ধারের একটুখানি শেডের তলায় বসে। ওদের দেখে, এতসব দেখেও আমি সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম না, একটু রিল্যাক্সড হয়ে বসে দুপাশের দৃশ্য দেখার!
মিরিক যখন আর হাজার খানেক ফুট উপরে, তখন রফিক গাড়ি হঠাৎ করেই দাঁড় করালো একটা জায়গায়। দুম করে খাঁদের ধারে নিয়ে গিয়ে আচমকা ব্রেক। মাগোওও বলে শুক্লার কান ফাটানো চীৎকারে রফিক ক্ষেপেই গেল এবার। কি হল? কি হল? আপনি চেঁচালেন কেন ওরকম করে? নীলু বোঝানোর চেষ্টা করে রফিককে, প্রথমবার পাহাড়ে চড়া তো, ভয় পেয়ে গেছে! শুক্লা ভেবেছিল রফিক বোধ হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে গাড়ির। সকলেই একে একে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। রফিক জানাল, এটা একটা সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়। খানিক নেমে ঘুরে ফিরে দেখে নিন সবাই। যে বাঁকটি ঘুরে গাড়িটি এসে দাঁড়াল, সেখানে একটা জায়গা বানানো আছে। কয়েক থাক সিঁড়ি বেয়ে একটা খোলা হলমত জায়গা। মাথার উপর ছাদ, চারপাশ খোলা। সকলেই একে একে গিয়ে উঠে পড়লে সেখানে। আমি কিছুতেই খাদের ধারের ওই পয়েন্টে যাব না। দাঁড়িয়ে থাকি গাড়ির গা ঘেঁষেই রাস্তার উল্টোদিকে গিয়ে ছবি তুলি, যেটুকু আসে আর কি পাহাড়ের ধার থেকে। চারপাশের দৃশ্য দেখে বাক্যহারা আমি। বর্ণনা করে বোঝাবো সে সাধ্য আমার নেই। রফিক এগিয়ে এসে বলে, এখানে এসেও আপনি দেখবেন না? চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি, দেখুন, কিছু হবে না। হাত ধরে রফিক নিয়ে যায় সেই সানসেট পয়েন্টে। সিঁড়ি বেয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে যাই সেখানে। রফিক দেখায়, ওই দেখুন, লোকে এর ছাদে উঠে বসে আছে!
তথা আর শুভ'র কানে কানে শুক্লা ততক্ষণে সেই 'রওনক'এর কথা বলে দিয়েছে আর তারপর আমাকে হাত ধরে ওখানে নিয়ে যাওয়া দেখে সকলেই নতুন খোরাক পায়। আমি পাত্তা দিই না। যতদূর চোখ যায় কালচে সবুজে ঢাকা পাহাড়। দূরে দূরে পাহাড়ি গ্রাম সব পাহাড়ের ঢালে ঢালে। নাম না জানা সব লম্বা লম্বা গাছেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কালচে সবুজ তাদের রং। বিশাল বিশাল সব চারপেয়ে খাম্বা বিছিয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে, বিদ্যুতের তার বেয়ে আধুনিকতার আলো এসেছে পাহাড়ে। কবে কে নিয়ে এসেছে এসব? কে এভাবে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা বানিয়েছে?
মাস দুই আগে থেকেই টিকিট কাটা ছিল শিলিগুড়ির। শুভজিতের বোনের বৌভাতে কনেযাত্রী হিসেবে নিমন্ত্রিতের তালিকায় নাম ছিল আমাদের জোড়ে। সেইমত শুভ টিকিট কেটে রেখেছিল আর টাইম টু টাইম রিমাইন্ডারও দিচ্ছিল। যাব বলে কথা দিয়েছিলাম দুজনেই। না যাওয়ার কোন কারণ নেই। দুজনেই বেড়াতে ভালবাসি, ফাঁক পেলেই এদিক ওদিক বেড়িয়ে পড়ি আর এ তো বন্ধুদের সাথে দল বেঁধে বেড়াতে যাওয়া। উত্তরবঙ্গে আমার আগে যাওয়া হয়নি কাজেই ওটা একটা বাড়তি আকর্ষণ। দু'দিনের প্রোগ্রাম। কিন্তু আমি সুমেরুকে বলেই রেখেছিলাম, দু'দিন পরে আমি সকলের সাথে ফিরছি না! পাহাড়ে চলে যাবো, গ্যাংটক, ভুটান বা সিকিম। যে কয়টা জায়গা দেখা যায়, বেড়ানো যায়, বেড়িয়ে ফিরবো! দিন সাত/আটের আগে ফেরার প্রশ্ন নেই!
বিধি
বাম। পিচ্চিদের নাচের প্রোগ্রাম -নাচ, ধুম মাচা লে- নিয়ে সে এত ব্যস্ত
হয়ে পড়লো যে একদিনের ছুটিও ম্যানেজ করা সম্ভব হল না। বিয়েতে সে রাত দশটায়
গিয়ে শুধু মুখ দেখিয়ে চলে এসেছে আর বৌভাতে যেতেই পারছে না! আমিও যাব না
ধরেই নিয়েছি। আঠেরো তারিখ সকালবেলায় শুভর ফোন, ব্যাগ গুছিয়ে রেডি থাকো,
সন্ধে ছ'টায় ট্রেন! সে কী! আমি একলা যাবো কী করে? আমার একলা যাওয়ার কথা
শুনে পরমাশ্চর্য শুভ। আরে, একলা কেন যাবে? আমরা যাচ্ছি তো আর সঙ্গে এক
ট্রেন ভর্তি লোকও যাবে! দোনোমনা করে ফোন রেখে ওকে বলি, কী করবো বলো তো?
আবার ফোন। এবার শুক্লা। আরেক বন্ধু নীলায়ণের স্ত্রী শুক্লা। নীলায়ণ-
শুক্লাও নিমন্ত্রিত। আমাকে কোন কথা বলতে না দিয়ে হড়বড় করে সে জানান দিল
ব্যাগ-ফ্যাগ গুছিয়ে রেডি থাকো, না যাওয়ার কোন সীন নেই। আর শোনো, তুমি যাবে
না বললে আমি শুভকে বলে দিচ্ছি যে সামরান না গেলে আমিও যাচ্ছি না, এরপর
শুভ সামলাবে! আমার কর্তামশাই এবার বললেন, চলেই যাও, অসুবিধেটা কোথায়?
অসুবিধে
কিছু নেই শুধু রাতের বেলা ভয়ে ঘুম হবে না এছাড়া আর কোন সমস্যা নেই!
সুমেরু সেটা ভাল করেই জানে বলেই জোর দিয়ে কিছু বলছিল না। যাই হোক, আমি
জামা কাপড় গুছিয়ে রেডি হলাম তুন্নু'র বৌভাত খেতে শিলিগুড়ি যাওয়ার জন্যে।
পরপর কয়েকবার ফোন করে শুভ নিশ্চিত হল আমি যাচ্ছি কিনা, আর জানিয়ে দিল
ট্রেনের সময়। ক'টায় কোথায় পৌঁছুতে হবে তাও বিস্তারিত বুঝিয়ে দিল। বিকেল
বিকেল রেডি হয়ে ষ্টেশনে পৌঁছে দেখা গেল শুভ তখনো পৌঁছোয়নি, রাস্তায় আছে,
খাবার তুলে নিয়ে পৌঁছুচ্ছে। ষ্টেশনের মেন গেটে দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই এল
তথাগত। তথাও কমন ফ্রেন্ড। জোড়ে নেমন্তন্ন ছিল তারও কিন্তু তথার পুঁচকেকে
নিয়ে কিছু একটা ঝামেলা বাধায় তথা একলাই যাত্রী। এখানে তথার একটু পরিচয়
দিয়ে নেয়া ভাল। তথাগত পেশায় সাংবাদিক। হারবার্ট-কাঙাল মালসাট- ফ্যাতাড়ু'র
স্রষ্টা নবারুণ ভট্টাচার্য-র সুপুত্র ও খ্যতনামা লেখিকা মহাশ্বেতা দেবীর
পৌত্র। তুমুল আড্ডাবাজ তথা থাকা মানেই যেকোনো আড্ডায় এক আলাদা মাত্রা যোগ
হওয়া। ছোট হাফপ্যান্ট ও ও লাল টিশার্ট পরা তথা পিঠে স্যাক, হাতে জলের বোতল
ঝুলিয়ে পৌঁছে গেল শুভজিতের আগেই। ছোটখাটো রোগাসোগা চেহারার দেখতে তথার
মুখভর্তি দাড়ি আর ঘাড়ের নিচ অব্দি চুল সযতনে বেখেয়ালে বাড়ানো। আর তথা
সারাক্ষণ দাড়িতে হাত বুলায়।
কুলি
সাথে নিয়ে হাজির শুভ। কুলির মাথায় শুভর ট্রলি ব্যাগ আর হাতের বিশাল
কাপড়ের ঝোলা ভর্তি খাবারের প্যাকেট দেখে রিতিমত ভয় পেলাম, অত খাবার, আমরা
মানুষ কতজন? শুনলাম, শুভর আত্মীয়-স্বজনেরাও যাচ্ছেন এই ট্রেনেই আর এখানে
সকলেরই রাতের খাবার। অচেনা সব মানুষের সাথে যাচ্ছি ভাবতেই একটু অস্বস্তি
হচ্ছিল। শুভ সেটা বুঝতে পারে, বলে, আরে, ওঁরা সব বয়স্ক মানুষ, পাশের
কম্পার্টমেন্টে করে যাবেন, আমরা আমাদের মত করে যাব, কোন অসুবিধে হবে না।
বয়স্ক আত্মীয়েরা সঙ্গে থাকলে অসুবিধেটা যে আমার থেকে বেশি ওরই হত সেটা
বলাই বাহুল্য! শুভর কাঁধে ঝোলানো স্যাকে দেখলাম দু খানা জলের বোতল। আমি
নিজে কোন জলের বোতল আনিনি ভেবে সংকোচ হচ্ছিল। কোচ নম্বর ধরে নির্দিষ্ট
জায়গায় পৌঁছুতে দেখা হল শুভর আত্মীয়দের সাথে। কেউ কাকা, কেউ মামা তো কেউ
শুভর বাবা'র বন্ধু। সকলেই ষাটের উপরে। ট্রেন আসার আগেই এল ঝড়। প্রচন্ড ঝড়।
কালবৈশাখী। প্ল্যাটফর্মে পড়ে থাকা যাবতীয় খালি বোতল, কাগজপত্র তো উড়লই
বাতাসের তোড়ে রোগা-পাতলা তথারও উড়ে যাওয়ার যোগাড়!
ইডেনে
তখন আপ্রাণ লড়ে যাচ্ছে শাহরুখ খানের নাইট রাইডার্স। মরন-বাঁচন লড়াই। হয়তো
জিতেও যেত নাইট রাইডার্স কিন্তু বাঁধ সাধল ওই ঝড়। ওভার কমে গিয়ে রান
রেটে হেরে গেল কলকাতা নাইট রাইডার্স। মুহুর্মুহু ফোনে খেলার খোঁজ নিতে
থাকা আমরা ক্রমশই মুষড়ে পড়ছিলাম। অবশেষে তুমুল খিস্তি শুরু হল নাইটদের
উদ্দেশ্য করে। সেই খিস্তির কাছে আরেকটু হলেই কালবৈশাখী হার মেনে যাচ্ছিল
আর কী ! ঝড়-বাতাস সামলে টলমল টলমল করতে করতে নীলায়ণ আর শুক্লা এসে পৌঁছুলো
সবার শেষে। শুভজিত আদর্শ মেজবানের মত সকলকে যার যার কম্পার্টমেন্টে-সীটে
তুলে দিয়ে এল। ইতিমধ্যে শুভ দুই কার্টন মিনারেল ওয়াটার কিনছে দেখে জানতে
চাইলাম, অত জল? তোমার ব্যাগেও তো দু বোতল দেখা যাচ্ছে! কোন জবাব না দিয়ে
শুভ পয়সা মেটাল মিনারেল ওয়াটারের। আস্তে করে তথা জানান দিল ব্যাগে কি
ওগুলো জল নাকি? ওগুলো তো রেডিমিক্স!
-২-
সে
রাতের ট্রেনযাত্রা সত্যিই খুব মজার ছিল। আমি আমার তেনাকে খুব মিস
করছিলাম, আর যাই হোক তাকে কলকাতাতেই রেখে দিয়ে আমি তারই বন্ধুদের সাথে
বেড়াতে যাচ্ছি আর বেচারা এখানে সকাল থেকে রাত কখনো বা এক সকাল থেকে
পরেরদিন রাত অব্দি কাজ করছে, অপরাধবোধ তো হবেই! আমারও হচ্ছিল, বারে বারেই
এসএমএস করছিলাম। ফোনও করছিলাম খানিক পরে পরেই। আমার খারাপ লাগছে বুঝতে
পেরেই বোধ হয় বলে, বেড়ানো এঞ্জয় কর!
শুক্লার
আবার সেই প্রথম রাত্রিকালীন ট্রেনযাত্রা বিধায় সে প্রবল উৎসাহে জানালার
বাইরে চোখ রেখে ঠায় বসে। রাতের অন্ধকারে ছোটো কোন খাল দেখা গেলেও ওই দ্যাখ
গঙ্গা দেখা যায় বলে মাঝে মাঝেই শুক্লাকে গঙ্গাদর্শন করাচ্ছিল শুভ!
শুক্লা বয়সে সকলের ছোট আর খুব হাসিখুশি এক মেয়ে। সবেতেই সে প্রবল মজা পায়
আর মন খুলে হাসে হা হা করে। একবার তো সে বাইরের অন্ধকারে খালকেই গঙ্গা
বিশ্বাসও করে ফেলল। শুভ, নীলু আর তথা তাদের রেডিমিক্স উপভোগ করছে, সাথে
সিগারেট। ভর সন্ধেতে আলো জ্বলা ট্রেনের কামরায় ন'জনের এক ডিব্বাতে পাঁচজন
মানুষের হুল্লোড় চলে ক্রমাগত। দ্রুত হাতবদল হয় সিগারেট এদিক ওদিক দেখে
নিয়ে, টিটি আসছে কিনা, অন্য কোন যাত্রী টয়লেটে যাবে বলে এদিকে আসছে কিনা।
কারও আসার সম্ভাবনা দেখা দেওয়ামাত্রই সিগারেট সহ হাত জানালার বাইরে। কেন কে
জানে সেদিনের অত হুল্লোড়েও অন্য কোন যাত্রী কোন আপত্তি করেনি বা কোন
অভিযোগ করেনি। যা করাই খুব স্বাভাবিক ছিল।
পাশের
কম্পার্টমেন্টে শুভর জ্যেঠুর ছেলে শুভ্র ছিল, সে মাঝে মাঝেই উঠে এসে এই
কামরার আড্ডায় বসছিল। এই আড্ডা ফেলে কতক্ষণ আর বাবা-কাকাদের সাথে বসে থাকা
যায়! রাতে শোওয়ার সময় শুক্লা আর আমাকে বলা হল আপার বার্থে গিয়ে শুতে, আমার
সেটাই নিরাপদ বলে বোধ হলেও শুক্লা কিছুতেই উপরে চড়তে রাজী নয়, তার ভয়, সে
ঘুমের মধ্যে ঠিক নিচে পড়ে যাবে উপরের বাঙ্ক থেকে! অগত্যা পুরুষেরা সব
মিডল আর আপার বার্থে, প্রমীলাবাহিনী লোয়ার বার্থে। কারো সাথেই বিছানা
বালিশের কোন বন্দোবস্ত নেই। টুকিটাকি জিনিসপত্র সহ পিঠে ঝোলানো স্যাক
রাতের বেলা হয়ে যায় বালিশ। নিজের নিজের বার্থে সকলেই শুয়ে পড়ে সাড়ে বারোটা
নাগাদ।
নীলু,
শুভ খুব বেশিক্ষণ জেগে থাকার মত অবস্থাতেও ছিল না। ওদের দুজনারই প্রবল
নাসিকা গর্জন আসতেও সময় লাগে না। জলতেষ্টা পায় আমার, কিন্তু খাব কী?
মিনারেল ওয়াটারের সব কটা বোতল খালি! রেডিমিক্সের পরে আরো মিক্স রেডি করতে
গিয়ে এক লিটারের একডজন মিনারেল ওয়াটার খাল্লাস! সীটের তলায় গড়াগড়ি খাচ্ছে
সবকটি খালি বোতল। সীটের এক কোনায় বসে ঢুলতে থাকা তথাকে বলি, জলের ব্যবস্থা
কর যেভাবেই হোক। কিন্তু তথা কোথা থেকে ব্যবস্থা করবে? জানলার পাশে এসে বসে
তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে, অপেক্ষা, ষ্টেশন এলে নেমে গিয়ে খাওয়ার পানি
কিনবে। শুক্লা সীটের উপরে উপুড় হয়ে শুয়ে কোলের কাছে জাপটে ধরে রাখে নীলুর
ব্যাগ, বলা বাহল্য যে ওটি নীলুর ক্যামেরার ব্যাগ আর মাথা জানলার দিকে তুলে
তাকিয়ে থাকে বাইরের দিকে। তথার বাক্যে; উটপাখির মত গলা বাড়িয়ে বাইরের
অন্ধকার দেখে শুক্লা । কি দেখে কে জানে। বাইরে প্রবল বৃষ্টি ঝরে পড়তে থাকে
অবিরত।
আমি ঘুমানোর চেষ্টা করি। ঘুম না আসায় এপাশ
ওপাশ করি, ওইটুকু সরু সিটে যেটুকু করা যার আরকি। চোখ লেগে আসে। চমকে
চমকে উঠি খানিক পরপরই। অজনা ভয়ে চোখের পাতা এক হয় না। জেগে আছে শুক্লাও,
জানালার বাইরে চোখ রেখে ঠায় মাথা উঁচিয়ে রেখে জেগে আছে শুক্লা। বলি, ঘাড়
ব্যথা করে না তোর? ঘুমো না এবার! ঘুমচোখে হাসে শুক্লা, জানোতো, জীবনে
প্রথমবার রাতের ট্রেনে কোথাও যাচ্ছি, দারুণ লাগছে, ঘুমুতে ইচ্ছে করছে না
একটুও! অথচ এই শুক্লাই যে কোন জায়গায় যে কোন সময় বসে বসেই দিব্যি ঘুমিয়ে
নেয় পাশে বসে থাকা মানুষটির কাঁধে মাথা রেখে। কখনো বা গুটিসুটি মেরে ঠিক
একটুখানি শোওয়ার জায়গা বানিয়ে নিয়ে আর পাশে যেই বসে থাকুক না কেন, তার
কাঁধে মাথা রেখে বে-খবর ঘুমোয়। পাশে বসে থাকা মানুষটি যে সব সময় নীলুই হয়
তা নয়, কোন বন্ধু বা সহযাত্রী যে কেউ হতে পারে সে। আজ জেগে থাকে শুক্লা।
জানালার কাঁচ বেয়ে গড়িয়ে নেমে যেতেই থাকে অঝোর বৃষ্টির ধারা...
-৩-
এক
ঘন্টা লেটে নিউ জলপাইগুড়ি ষ্টেশনে ট্রেন যখন পৌঁছুলো তখন বেলা আটটা।
ইতিমধ্যে আমাদের মেজবানদের তরফ থেকে বার তিনেক ফোন এসে গেছে ট্রেনের দেরি
দেখে। ওরা অপেক্ষা করছেন ষ্টেশনে, আমাদের জন্যে। ট্রেন থেকে নামতেই পরিচিত
মুখ দেখলাম, সাড়ে চার ফুট উচ্চতার দীপ। গাঢ় কমলা রঙের টিশার্ট পরা দীপকে
দেখে সকলেই একবার মুখ চাওয়াচাওয়ি করে নিল! দীপ তুন্নু'র দেওর। বিয়েতে দেখা
হয়েছিল। দীপের চেহারা মনে থাকার এবং ওই মুখ দেখে একে অন্যের মুখ দেখার
আরও কারণ আছে, সেটা পরে বলছি। ষ্টেশন থেকে সদলবলে বেরিয়ে এসে দেখা গেল,
বেশ কয়েকখানি গাড়ি পরপর দাঁড়িয়ে আছে, আকারে সেগুলো বিশাল। আটজন লোক সেসব
গাড়িতে এনিটাইম বসতে পারে আর সেও আরামসে! দীপের সাথে আরও কয়েকজন ছিলেন,
তারা ঝটপট আমাদের লাগেজপত্র প্রায় ছিনিয়েই নিলেন আমাদের হাত থেকে। এখানেও
ট্রেনের মতই ঘটনা ঘটল, বড়রা সব ওদিককার দুটি গাড়িতে গিয়ে উঠলেন আর আমরা
পাঁচজনে একটা গাড়িতে। ড্রাইভারের সাথে দীপও উঠল আমাদের গাড়িতে। পেছনে আরও
দুটি গাড়ি প্রায় খালি, তাতে দীপের সঙ্গীরা একজন দু'জন করে মালপত্র নিয়ে
পেছন পেছন এলো প্রায় একটা কনভয়ের মত করে।
নিউ
জলপাইগুড়ি ছাড়িয়ে গাড়ি খানিক এগুতেই দূরে দেখা গেল পাহাড়শ্রেণী। শুভ
দেখাল, ওই দ্যাখো, ওখানেই দার্জিলিং, ওই পাহাড়ের মাথায়! আমরা ট্রেনেই ঠিক
করেছিলাম, পৌঁছেই গাড়ির বন্দোবস্ত করে বেড়াতে বেরুবো। যদিও বৌভাতে এসেছি
কিন্তু সে তো রাতের বেলা। সন্ধের আগে আগে ফিরে এলেই হলো। শিলিগুড়ি এসে
শুধুমাত্র বৌভাত খাওয়া আর তুন্নুর শ্বশুরবাড়ির আতিথেয়তা নেওয়ার কোন মানে হয়
না। সকলেই একমত। গাড়ি এসে দাঁড়াল সেবক রোডের উপরে একটি হোটেলের সামনে।
ধারণা ছিল কোন বাড়িতে উঠব তাই হোটেলের সামনে দাঁড়াতে একটু অবাক হলেও চুপ
করেই থাকলাম। ব্যস্ত রাস্তা, দু'পাশে সারসার দোকান, হোটেল, শপিং কমপ্লেক্স।
আমাদেরকে যে হোটেলের ভেতরে দীপ নিয়ে ঢুকল তার নাম হোটেল রাজেশ। দীপ
বুদ্ধিমান ছেলে, আঙ্কেলদের সে এই হোটেলে রাখার ব্যবস্থাই করেনি, তাদের
জন্যে পাশের গেষ্ট হাউস! তিনখানি ডবল বেড এসি রুম, শুভ বলল, রুম পছন্দ করে
নাও, কে কোনটায় থাকবে। রুম নম্বর ৭০১, ৮০১ আর ৯০১। এক সারিতে তিনটি ঘর আর
তাদের নম্বর এরকম! মাঝের রুমটি অর্থাৎ ৮০১এ আমি ঢুকলাম, ৯০১এ ঢুকল শুভ আর
তথা আর ৭০১এ নীলু-শুক্লা। বেশ বড়সড় ঘর, ওয়াল টু ওয়াল পরিস্কার কার্পেট
পাতা। রুমে ঢুকেই মনে হলো, আগে ঘুমুবো! সারারাত জেগে থাকার ক্লান্তি মাথা
চেপে বসে আছে প্রবল যন্ত্রণার রূপ নিয়ে। ঘুম ছাড়া এখন আর কিচ্ছু চাই না।
রুমে
ঢোকার আগেই দীপ বলল, গাড়ি রইল তোমাদের কাছে দুটো, তোমরা বেড়াতে চাইলে
বেড়িয়ে আসতে পারো, সন্ধের আগে ফিরে এলেই হবে। এ যেন না গাছে না উঠেই এক
কাঁদি! আরে আমরাও তো তাই চাইছিলাম! তথা বলল, ঝটপট ফ্রেশ হয়ে রেডি হয়ে নাও
সব্বাই, বেরুবো। দীপ হোটেলের ম্যানেজারকে ডেকে এনে ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল,
যার যখন যা চাই, সব যেন চাহিবামাত্রই হাজির হয়! শুক্লা বলল সেও ঘুমোতে চায়
খানিক, ওকে সময় দেওয়া হল আধঘন্টা, বিশ্রাম নিয়ে রেডি হয়ে আসার জন্যে।
শুভদের রুম ঠিক হল কমন প্লেস হিসেবে। ব্রেকফাষ্টের জন্যে ওই ৯০১এই আসবে
সবাই। দুপুরে লাঞ্চের ব্যবস্থাও দীপ করে রেখেছে, কয়েকটি হোটেলের নাম করে
বলল, সব জায়গায় বলা আছে, লাঞ্চ থাকবে, শুধু গিয়ে খেয়ে আসবে আর যদি পাহাড়ে
যাও তো সেখানেও ব্যবস্থা আছে। আমরা সত্যিই চমৎকৃত।
বেশ
ঠান্ডা ঠান্ডা ওয়েদার। এসি চালানোর কোন প্রয়োজনই নেই। ঘুমোনোর চিন্তা বাদ
দিয়ে স্নানে যাই। গরম জলে স্নান করে রেডি হয়ে শুভদের রুমে
গিয়ে দেখা গেল শুক্লা একটা বিছানায় কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়েছে। স্নানের পর
তার মাঝপিঠ পর্যন্ত লম্বা চুল খুলে দিয়েছে শুভ। নীলু তখনও তার নিজের রুমে
আর তথা খবরের কাগজ টাগজ নিয়ে বাথরুমে ঢুকেছে। টিভির রিমোট শুক্লার হাতে,
সে মন দিয়ে টম এন্ড জেরি দেখছে। বাইরে ততক্ষণে আবার ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু
হয়েছে। কোনদিকে যাওয়া হবে সেটা তখনও ঠিক হয়নি যদিও তথা বলেছে মঙপঙ যাবে।
টেলিফোনে সুমেরু আমাকে মঙপঙ শুনেই বলল, গরম কাপড় সাথে আছে কি? যদি না থাকে
তবে যে বেডশিটটা আছে সেটা অবশ্যই সাথে নিয়ে নেবে, ওটাই চাদরের কাজ করবে!
আগ্রহভরে শুধাই, ঠান্ডা হবে ওখানে? বলল, দিনের বেলা তো ওই একটা চাদরেই
হয়ে যাবে! ভাবি, ভাগ্যিস একটা বেডশিট ছিল সাথে।
দু'প্রস্থ
র চা সহযোগে ভরপেট ব্রেকফাষ্ট খেয়ে আমরা যখন বাইরের দিকে এগোই বেলা তখন
দশটা পার। তথার হাতে দেখা গেল রঙীন ফুলছাপ ছাতা। গাড়িবারান্দায় গিয়ে দেখা
গেল যাকে আমরা ঝিরঝিরে বৃষ্টি ভাবছিলাম সে মোটেই ঝিরখিরে বৃষ্টি নয়, বেশ
তোড়েই পড়ছে সে। সকলেই জিনস আর টিশার্ট পরে আছে, তথা বলল, জিনসগুলোকে
ভেজানোর কোন মানে হয় না, শর্টস পরে নেওয়া বেটার! শুক্লা তার জিনসটাকে মুড়ে
নিয়ে থ্রী কোয়ার্টার করে নিল, আমি রুমে গিয়ে চেঞ্জ করে থ্রী কোয়ার্টার পরে
এলাম আর নীলু, তথা আর শুভ সকলেই দেখলাম বেশ ফুলছাপ শর্টস পরে এল। সক্কলকে
দেখে টেখে নিয়ে নীলু মন্তব্য করল, পাহাড়ে যাচ্ছি বলে তো মনে হচ্ছে না,
বরং বীচে যাচ্ছি মনে হচ্ছে! হাওয়াই চটি পরা আমরা সকলে বৃষ্টি মাথায় করে
দীপদের নিজস্ব গাড়ি স্করপিওতে গিয়ে উঠলাম।
-৪-
বৃষ্টি
মাথায় করে আমরা রওয়ানা দিয়েছিলাম হিলকার্ট রোড ধরে, দার্জিলিংএর পথে।
কোথায় যাওয়া হবে কোন ঠিক-ঠিকানা নেই যদিও, তবু ওই রাস্তা ধরে এগুনো
হচ্ছিল, কোথাও একটা তো যাওয়া হবেই! পাহাড়ের রাস্তায় খানিকটা উঠতেই দেখা গেল
রাস্তার পাশের পাশের জঙ্গলের গাছ ভেঙে পড়েছে, রাস্তা বন্ধ, আর যাওয়া যাবে
না। ঝিরঝিরে বৃষ্টি মাথায় করে নেমে পড়লাম সব রাস্তায়। খানিক হাঁটাই যাক!
অন্য রাস্তা ধরে কার্শিয়াং যাওয়া সাব্যস্ত করে আমরা আবার গাড়িতে।
গাড়ি
ঘুরিয়ে আমরা আবার অন্যপথে। সময় কম। বেলা প্রায় বারোটা বাজে, বিকেলের
মধ্যেই ফিরতে হবে, এর মধ্যে যেটুকু দেখে নেওয়া যায়। বেরুনোর আগেই বলে
নিয়েছিলাম মোমো খাব। অন্য কোন লাঞ্চ নয়। শুধু মোমো। নেপালীদের তৈরি, নেপালী
ধাবায় বসে মোমো খাব। ড্রাইভার জানাল, পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে প্রচুর ধাবা
পাওয়া যাবে, চিন্তার কিছু নেই। আমাদের গাড়ি চলল, কার্শিয়াংএর পথে। কিন্তু
বিধি বাম। কার্শিয়াংএ একটা গন্ডগোল চলছিল সেদিন। অনেকদিন ধরেই চলছিল,
কিন্তু সেদিন একটু বাড়াবাড়ি রকমেরই হয়েছিল বলে খবর। পাহাড়ে অবশ্য অনেক আগে
থেকেই রাজনৈতীক ডামাডোল চলছে পৃথক গোর্খাল্যান্ডের দাবীতে। কার্শিয়াং যখন
অর্ধেক দূরত্বে, একটা মোড়ে ড্রাইভার গাড়ি থামিয়ে বলল, আর যাওয়া যাবে না,
বাড়ি থেকে বারণ করে দিয়েছে কার্শিয়াং যেন না যায়! গেলে আটকে পড়ার সম্ভাবনা
প্রবল! আমরা তবুও ড্রাইভারকে অনুরোধ জানালাম, আমাদের প্রাণটি হাতে নিয়ে
তুমি বাবা এই আট হাজার ফিট তুলে এনেছ, আর খানিকটাও নাহয় চল! কিন্তু সে
মুখে কিছু না বলে গাড়ি থামিয়ে দিল এক ধাবার সামনে, বলল, আপনারা মোমো খেয়ে
নিন!
শরীরের হাড়-মাংস-রক্ত ততক্ষণে অলরেডি জমে বরফ তায় এই সব গল্প! ড্রাইভারকে প্রায় চেঁচিয়েই বলি, মন দিয়ে গাড়ি চালাও, কথা বলতে হবে না! চোখ বন্ধ করে দুই হাতে শক্ত করে পাশে বসা মানুষটিকে ধরে শক্ত হয়ে বসে থেকে শুধু প্রভুর নাম জপ করি, এবারে বেঁচে ফিরে যেতে পারলে আর কখনও পাহাড়ে আসার নাম করব না! শুক্লা মাঝে মাঝেই চেঁচিয়ে উঠছিল ভয়ে আর সে নিয়ে প্রবল হাসাহাসি করছিল গাড়িতে বসা অন্যরা। চোখ বন্ধ করে রাখতেও ভয় পাই, জোর করে চোখ খুলে রাখি, গাড়ি যদি পড়ে তবে অন্তত যেন কলমাটা পড়তে পাই। চোখ মুদে থাকলে তো জানতেই পারব না যে গাড়ি পড়ছে! সবাই রাস্তার উপর হাঁটাহাটি করছে, রাস্তার ধারে গিয়ে খাদ দেখছে, আমি গাড়ির পাশে গাড়িকে শক্ত করে ধরে দাঁড়িয়ে ধাতস্ত হওয়ার চেষ্টা করছি। পা দুটো থরথর কাঁপছে! শুভ, তথা এসে হাত ধরে টানাটানি করছে, খাদের পাশে দাঁড়িয়ে নিচের দৃশ্য দেখার জন্য। সে নাকি অপূর্ব! অনন্য সাধারণ! কিন্তু আমার পা কিছুতেই রাস্তার ধারে যায় না। চেষ্টা করেও যেতে পারি না।
এমনিতেই আমার উচ্চতায় ভয়। চারতলা বাড়ির ছাদে থেকে আমি নিচের দিকে তাকাতে পারি না, মনে হয় পড়ে যাব! তথা বুঝতে পারে, বলে ছেড়ে দাও ওকে, ওর ভয় আছে হাইটে! শুভ তবুও মশকরা করে যায় সমানে। এমনকি শুক্লাকেও দেখা গেল ভয়-ফয় দূরে সরিয়ে রেখে রাস্তার ধারে গিয়ে দাঁড়িয়েছে! রাস্তার একপাশে কিছু ষ্টোনচিপস জড় করা ছিল, আমি গিয়ে সেটার উপর বসি। ওরা ছবি তোলে। ছবি তোলার আমিও চেষ্টা করি কিন্তু সে রাস্তার এপাশ থেকে, পাহাড়ের গা ঘেঁষে দাড়িয়ে। তাতে করে রাস্তার ধারের রেলিংএর ছবিই ওঠে। নিচের পাহাড়, উপত্যকা, গাছপালা, পাহাড়ের গায়ে গায়ে চায়ের বাগান আর খাঁদের ছবি ওঠে না।
ধাবায়
ঢুকে নেপালী হাতে রান্না করা মোমো আর পাহাড়ী ছাগলের প্রায় আধসেদ্ধ ঝাল
ঝাল মাংস ভরপেট খেয়ে ফেরার পথ। মোমোর সাথে ওরা এক অসাধারণ সস দেয় খেতে। সস
বলতে, শুকনো লাল লংকা আধবাটা করে নিয়ে ভিনিগার দিয়ে হালকা করে শুধু
আগুনের উপর বসিয়ে নিয়ে নেড়ে-চেড়ে নেওয়া। গোটা গোটা লংকার দানা আর টকটকে
লাল রং দেখলেই জিভে জল এসে যায়। আর সে কী দুর্দান্ত ঝাল সেই সস! আমার
সঙ্গীরা সব শুয়োরের মাংসের মোমো খেতে চাইছিলেন কিন্তু সে ফুরিয়ে গেছে শুনে
আমি যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচলাম। অন্তত শুয়োরটা আমার পোষাবে না। খেলাম চিকেন
মোমো। আহা! সে কি স্বর্গীয় স্বাদ! নামার সময় আর অতটা ভয় লাগল না। কেন কে
জানে। সন্ধেবেলা বৌভাত আর তারপরে রাত ভোর হওয়া অবদি শুভ আর তথার অত্যাচার।
কাউকে ঘুমোতে যেতে দেবে না। সবাইকে জেগে থেকে আড্ডা দিতে হবে আর তরল
গিলতে হবে। গিলতেই হবে! শুক্লা কম্বল মুড়ি দিয়ে শুয়েই পড়ল। তিনটে অবদি
আমিও কোনমতে বসে থকলাম। শেষে অনেক অনুরোধ উপরোধ করে ঘুমোতে যাব বলে রাজী
করানো গেল। সকাল ছ'টায় গাড়ি আসবে, আমাদেরকে মিরিক নিয়ে যাওয়ার জন্যে।
যে গাড়িটির সামনে এসে দাড়ালাম সেটিও একটি স্করপিও। তবে কালকের গাড়িটি নয়। ড্রাইভারও দেখলাম নতুন। এগিয়ে এসে সবাইকে নত হয়ে অভিবাদন জানিয়ে নিজের পরিচয় দিল মুহাম্মদ রফিক বলে। বলল, তাড়াতাড়ি চলুন, আপনারা এমনিতেই দেরি করে দিয়েছেন! হিন্দিতে কথা বলছিল, জিজ্ঞেস করে জানলাম, শিলিগুড়িতেই জন্ম, বড় হওয়া। তবে আদিপুরুষেরা ইউপি থেকে এসেছিলেন। সামনের সিটে তথা আর নীলু গিয়ে বসল, মাঝের সিটে প্রথমে শুভ, মাঝে আমি আর একপাশে শুক্লা। বলা বাহুল্য আমি ইচ্ছে করেই মাঝখানে গিয়ে বসলাম। শুভ বলল, গাড়ি যদি পড়ে তো তুমি কি মাঝখানে বসে বেঁচে যাবে নাকি? কান না দিয়ে চুপ করে বসি আর মনে মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করি। টুকটাক কথা বলছে সবাই। বেশিরভাগই পাহাড়ের কথা। তথা দার্জিলিং সেন্ট পলসের ছাত্র। শুভ শিলিগুড়ি ডন বস্কো'র। কাজেই ওদের কাছে অফুরন্ত গল্প।
আমাদের আজকের ড্রাইভারটি চুপচাপ বসে শুধু গাড়ি চালায় না কালকের ড্রাইভারের মত। সে বেশ কথা বলে সকলের সাথে। গাড়ি শিলিগুড়ি ছাড়ানোর আগে একটা ট্র্যাফিকে দাঁড়ানোতে আমি দেখলাম কয়েকজন হকার মাথার ঝাঁকায় করে লিচু বিক্রি করেছে। সবুজ লালে মেশানো লিচু। আমার তখনও এই মরশুমের লিচু খাওয়া হয়নি বিধায় বায়না ধরলাম লিচু খাব বলে! শুভ এক ধমক দিল, এই মেয়েটা খালি খাই খাই করে, কালও মোমো খাব মোমো খাব করে পাগলা বানিয়ে দিয়েছে! চুপ করে বস! খানিক বাদেই তো চুপ করে যাব আমি, বলে ব্যজার মুখে চুপই করে গেলাম! ভাল ছেলে নীলু লিচুওয়ালাকে ডেকে লিচু কিনল আর আমি মন দিয়ে বসে লিচু খেতে লাগলাম।
গাড়ি আবার পাহাড়ের দিকে। আর আজকের রাস্তা কালকের থেকেও ভয়ংকর! আমাদের ড্রাইভারটি অদ্ভুত। সে বাঁকের মুখেও গাড়ির হর্ন বাজায় না। পাহাড়ের গায়ের ছায়া দেখে নাকি বুঝতে পারে, ওপর থেকে কোন গাড়ি নেমে আসছে কিনা! হাত পা ঠান্ডা হতে শুরু করেছিল ওর এই হর্ণ না বাজানো দেখেই। গাড়িও প্রচন্ড স্পীডে চালায়, বলে আমি রোজ এই রাস্তায় পাহাড়ে উঠি আর নামি, প্রাণের ভয় আমারও আছে, একটা ছেলে আছে আমার, মরতে আমিও চাই না। কাজেই আপনারা ভয় পাবেন না। শুক্লা একটু বেশিই চেঁচামেচি করছিল ভয়েতে তাই ওই ভাষণ মুহাম্মদ রফিকের। খানিকটা ওঠার পরেই পুরুষেরা গাড়ি থামাতে বললেন, তারা ছোট প্রাকৃতিক ডাকে সাড়া দিতে যাবেন! রফিক গাড়ি দাঁড় করাল একটা সাইড ধরে, পুরুষেরা আড়ালে চলে গেলেন। আমি আর শুক্লা গাড়িতে বসে পাশের খাদ আর দূরের তরাই দেখছি, পাহাড়ের গায়ে দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম দেখা যায়। থাকে থাকে চায়ের গাছেরা উঠে গেছে পাহাড় বেয়ে।
এখানে চা বাগানে কোন শেড ট্রি নেই। রফিক বলল, রোদ তো লাগে না খুব একটা। ঠান্ডা জায়গা, শেড ট্রি'র দরকারই নেই। সমতলের বাগানগুলোতে শেড ট্রি আছে, আসার পথে নিজেই দেখে এসেছি। মন দিয়ে দেখছিলাম আর শুক্লার সাথে কথা বলছিলাম। আমাদের দু'জনকেই চমকে দিয়ে মুহাম্মদ রফিক আমার দিকে তাকিয়ে বল; ওঠে, আপ মুসলিম হ্যায় না? শুক্লা সাথে সাথেই জানতে চায়, তুমি কি করে বুঝলে? রফিকের ত্বরিত জবাব, মুসলমানকা চেহরে পে এক আলগই হি রওনক হোতি হ্যায়! ইনার চেহারা দেখলেই বোঝা যায় যে উনি মুসলিম! আমি কথা বাড়াই না আর। শুক্লাও চুপ করে গেছে। আমার পাশে বসা অনিন্দ্যসুন্দরী শুক্লাকে দেখার পরও কেউ আমার চেহারায় রওনক দেখতে পায় আর মুসলিম বলে শনাক্ত করে! চুপ তো হয়ে যাওয়ারই কথা।
গাড়ি এগোয়। এক অদ্ভুত নিয়ম পাহাড়ে। এখানে কেউ অকারণ হর্ণ বাজায় না। কেউ কাউকে ওভারটেক করার চেষ্টাও করে না। নেমে আসা গাড়িটিকে পাশ দেয় নিজে খাঁদের ধারে চলে গিয়ে। যে গাড়িটি উঠছে সে খাঁদের ধারে চলে যায় আর যে নামছে সে পাহাড়ের গা ঘেঁষে নামে। রফিক দুর্দান্ত গাড়ি চালায়। সে জানাল, গতকাল সে নাকি একটি হর্ণ নষ্ট গাড়ি নিয়ে পাহাড় থেকে নেমেছে। বলল, হর্ণ থাকলেই অসুবিধে। না থাকলে নিশ্চিন্তে গাড়ি চালানো যায়। আমি শক্ত হয়ে বসে থাকি সামনের সিটটিকে দুহাতে শক্ত করে আঁকড়ে ধরে। বাঁকের পর বাঁক পেরিয়ে সরু রাস্তা দিয়ে গাড়ি উপরে ওঠে। শুভ মাঝে মাঝে আমাকে বলে, সিটটা ছিঁড়ে যাবে যে! শুক্লা একবার চেঁচিয়ে উঠে ধমক খেয়েছে রফিকের কাছে, রফিক বলেছে, আপনারা এরকম করলে কিন্তু অ্যাক্সিডেন্ট হবেই! হাজার পাঁচেক ফিট উপরে ওঠার পরে থেকেই পাহাড়ী গ্রাম দেখা যেতে লাগল। ছোট ছোট গ্রাম। পাহাড়ের ঢালে ঢালে। ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা পাহাড়ী ছাগলের মত রাস্তা ছেঁড়ে পাহাড় বেয়ে উপরে উঠছে। স্কুলযাত্রী স্মেয়েরা সালোয়ার কামিজ আর ওড়নার ইউনিফর্মে দল বেঁধে পথ হাঁটছে। মহিলারা মাথায় কুড়িয়ে আনা ডালের আঁটি নিয়ে খাঁদের ধার দিয়ে পথ চলছেন। নেপালী চেহারা, নেপালী পোষাক। বাচ্চাগুলো খেলছে রাস্তার ধারে ধারে। রেলিংএ বসে গল্প করছে জোড়ায় জোড়ায় পাহাড়ী যুবক-যুবতী। কোথাও বা বয়স্ক কয়েকজন মানুষ বসে আড্ডা দিচ্ছেন রাস্তার ধারের একটুখানি শেডের তলায় বসে। ওদের দেখে, এতসব দেখেও আমি সাহস সঞ্চয় করতে পারলাম না, একটু রিল্যাক্সড হয়ে বসে দুপাশের দৃশ্য দেখার!
মিরিক যখন আর হাজার খানেক ফুট উপরে, তখন রফিক গাড়ি হঠাৎ করেই দাঁড় করালো একটা জায়গায়। দুম করে খাঁদের ধারে নিয়ে গিয়ে আচমকা ব্রেক। মাগোওও বলে শুক্লার কান ফাটানো চীৎকারে রফিক ক্ষেপেই গেল এবার। কি হল? কি হল? আপনি চেঁচালেন কেন ওরকম করে? নীলু বোঝানোর চেষ্টা করে রফিককে, প্রথমবার পাহাড়ে চড়া তো, ভয় পেয়ে গেছে! শুক্লা ভেবেছিল রফিক বোধ হয় নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেছে গাড়ির। সকলেই একে একে নেমে পড়ল গাড়ি থেকে। রফিক জানাল, এটা একটা সানসেট পয়েন্ট। এখান থেকে সবচেয়ে ভাল দেখা যায় সূর্যাস্ত আর সূর্যোদয়। খানিক নেমে ঘুরে ফিরে দেখে নিন সবাই। যে বাঁকটি ঘুরে গাড়িটি এসে দাঁড়াল, সেখানে একটা জায়গা বানানো আছে। কয়েক থাক সিঁড়ি বেয়ে একটা খোলা হলমত জায়গা। মাথার উপর ছাদ, চারপাশ খোলা। সকলেই একে একে গিয়ে উঠে পড়লে সেখানে। আমি কিছুতেই খাদের ধারের ওই পয়েন্টে যাব না। দাঁড়িয়ে থাকি গাড়ির গা ঘেঁষেই রাস্তার উল্টোদিকে গিয়ে ছবি তুলি, যেটুকু আসে আর কি পাহাড়ের ধার থেকে। চারপাশের দৃশ্য দেখে বাক্যহারা আমি। বর্ণনা করে বোঝাবো সে সাধ্য আমার নেই। রফিক এগিয়ে এসে বলে, এখানে এসেও আপনি দেখবেন না? চলুন, আমি নিয়ে যাচ্ছি, দেখুন, কিছু হবে না। হাত ধরে রফিক নিয়ে যায় সেই সানসেট পয়েন্টে। সিঁড়ি বেয়ে কাঁপা কাঁপা পায়ে উঠে যাই সেখানে। রফিক দেখায়, ওই দেখুন, লোকে এর ছাদে উঠে বসে আছে!
তথা আর শুভ'র কানে কানে শুক্লা ততক্ষণে সেই 'রওনক'এর কথা বলে দিয়েছে আর তারপর আমাকে হাত ধরে ওখানে নিয়ে যাওয়া দেখে সকলেই নতুন খোরাক পায়। আমি পাত্তা দিই না। যতদূর চোখ যায় কালচে সবুজে ঢাকা পাহাড়। দূরে দূরে পাহাড়ি গ্রাম সব পাহাড়ের ঢালে ঢালে। নাম না জানা সব লম্বা লম্বা গাছেরা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কালচে সবুজ তাদের রং। বিশাল বিশাল সব চারপেয়ে খাম্বা বিছিয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে গায়ে, বিদ্যুতের তার বেয়ে আধুনিকতার আলো এসেছে পাহাড়ে। কবে কে নিয়ে এসেছে এসব? কে এভাবে পাহাড় কেটে কেটে রাস্তা বানিয়েছে?
কত
প্রাণ হয়তো গেছে এই রাস্তা বানাতে গিয়ে, পাহাড়ের গায়ে ওই অতিকায় সব
খাম্বা বসাতে গিয়ে। রাস্তার ধারে ধারে সব মিশনারী স্কুল। সাদা শার্ট আর
রংবাহারী স্কার্ট পরা পাহাড়ি মেয়েরা কলকাকলি করে স্কুলের সামনে। তাদের
মাখনের মত মসৃণ আর ফর্সা রঙে জেল্লা বাড়ায় রঙীন স্কার্ট। আমি অবাক বিস্ময়ে
শুধু দেখি। কে কী বলে যায় কানে আসে না। মাঝে মাঝে কানে আছড়ে পড়ে সমবেত
হাসির শব্দ।
রফিক
বলে, চলুন এবার, দেরী হয়ে যাচ্ছে। এবার শুক্লা সামনে গিয়ে বসে নীলুর
কাছে, তথা পেছনে আসে শুক্লার জায়গায় আর আমি আগের মতই মাঝখানে। ভয়টা যেন
একটু একটু করে কমছে আমার। এখান থেকে রাস্তা মাঝে মাঝেই পাহাড়ের মাঝখান
দিয়ে যাচ্ছে। আবার হঠাৎ করেই দেখা যায়, পাহাড়ের একেবারে গায়ে এক বাঁক,
বাঁক ঘুরে রাস্তা আর এপাশে গভীর খাদ! রোদ নেই একেবারেই। ছায়া ছায়া এক সবুজ
ঠান্ডা এখানে। এই দুপুরবেলাতে শীত না লাগলেও বোঝা যায়, খানিক বাদেই নামবে
হিম ঠান্ডা। গাছেদের রং দেখে মনে হল, এখানে কখনোই হয়তো রোদ আসে না!
দেবদারু আর পাইনের মাথা উঁচু বনের মাঝখান দিয়ে রাস্তা। বুঝতে পারি, পৌঁছে
গেছি মিরিক। গাড়ি যেন হঠাৎ করেই এক শহরে ঢুকে গেল, পাহাড়ী শহর। রঙীন সব
ঘর-বাড়ি। রঙীন ঝলমলে পোষাক পরা সব পাহাড়ী মানুষ। সকলের পরনেই সোয়েটার!
নানা রঙের, নানা ডিজাইনের। দোকান-পাটও দেখা গেল। শহুরে সব জিনিসের নাম
লেখা সব সাইনবোর্ড লাগানো দোকানে দোকানে।
মিরিকে নাকি লেক আছে একটা। পাহাড়ের উপর প্রাকৃতিক লেক। শুনেই কেমন যেন
উত্তজনা হয়। শুনলাম, সেখানেই যাব। রফিক বলল, ওখানে পার্ক হোটেল আছে, সেখানে
আমাদের পান-ভোজনের কথা আগে থেকেই বলে রেখেছে শুভ'র ভগ্নিপতি অনির্বাণ।
রফিকের উপর হুকুম, ওখানেই যেন আমাদের নিয়ে যায়। গাড়ি গিয়ে যেখানে থামল,
সেখানে যেন কোন মেলা বসেছে। প্রচুর মানুষ দেখলাম, যাদেরকে দেখলেই বোঝা যায়,
শহর থেকে এসেছে, বেড়াতে। সৌখিন সোয়েটার পরে সব ফুলবাবু-বিবিটি হয়ে ঘুরে
বেড়াচ্ছে লেকের পাশের বিশাল জায়গা জুড়ে। পার্কিং খুঁজে নিয়ে রফিক পরে আসছে,
আমাদেরকে বলল, এগোতে। আমি আর শুক্লা ছাড়া সকলেরই চেনা জায়গা কাজেই ওরা
এগুলো, আমরাও পেছন পেছন। সত্যিকারের মেলাই বসেছে। তবে থাকে নাকি বছরভর।
কারণ এখানে ট্যুরিষ্টের অভাব কখনোই হয় না। যাওয়ার পথে এক ঝলক দেখে আমার মনে
হল, এ যেন ডিসেম্বরের ওয়েলিংটনের ভুটানীদের শীতবস্ত্রের অস্থায়ী সেই
বাজার। আছে নানারকম গিফট আইটেমের দোকান, নানা রকম সফট টয় শোভা বাড়াচ্ছে এই
বাজারের। ধীর পায়ে আমরা লেকের ধারে পৌঁছুনোর আগেই রফিক এসে ধরে ফেলে
আমাদের। মেলা ছাড়িয়ে আমরা লেকের ধারে গিয়ে পৌঁছুই। গাঢ় সবুজ দেখায় জলকে
লেকের পাশের কালচে সবুজ পাইনবনের জন্যে। তবে বাঙালী যেখানেই যায় তার চিহ্ন
রেখে আসে -কথাটা সত্যি প্রমাণ করল লেকের জলে ভাসমান অজস্র মিনারেল
ওয়াটারের খালি বো্তল, চিপসের খালি প্যাকেট ও আরও নানা রকম বর্জ্যে। লেকের
একধারের জলে গাঢ় শ্যাওলা আর তাতে অজস্র নোংরা আবর্জনা ভেসে বেড়াচ্ছে।
হাজার হাজার ফুট উঁচু পাহাড়ের উপর প্রাকৃতিক লেক দেখার সমস্ত উত্তেজনা
শেষ! মিরিকের 'দ্য পার্ক'এর দিকে এগুলাম আমরা সকলে।
অসাধারণ
রূপসী এক নেপালী মেয়ে দরজা থেকে এগিয়ে এল আমাদের দেখে। পরনে তার ছাপা
সুতীর থ্রী কোয়ার্টার পা'জামা আর খাটো কুর্তার উপরে ফুলহাতা সোয়েটার। পায়ে
সাধারণ একজোড়া চটি। তার মাখনরঙা ত্বক, কোমর ছাড়ানো একঢাল চকচকে কালো চুল
আর মুখে ধরে রাখা হাসিটি দেখে সকলেরই যে নয়ণ তৃপ্ত হল সে'কথা বলার দরকার
পড়ে না। মাঝারি আকারের একটা ঘরের একপাশে কাউন্টার, যাতে নানা রকম চকোলেট
আর উপহার সামগ্রী সাজানো। গোটাকয়েক প্লাষ্টিকের চেয়ার টেবিল ঘর জুড়ে। আমরা
ঘরের ভেতরে না বসে বারান্দায় বসলাম।
একতলা সমান উঁচু এই বারান্দায় আছে
কয়েকটা বিশালাকারের ছাতা, যার তলায় পেতে রাখা রঙীন প্লাষ্টিকের চেয়ার
টেবল। মেয়েটি এসে মৃদু হেসে জানতে চাইল, কি খাবেন? এদের সকলের দূর্ভাগ্য,
এখানেও শুয়োর নেই! অগত্যা সকলের জন্যেই চিকেন মোমো। সাথে যার যেমন পছন্দ
তেমন পানীয়। রফিক শুধু নিল ভেজ মোমো আর চা। মেঘলা আকাশ হঠাৎ করেই ঝকমক করে
উঠল আর খলখলিয়ে হেসে সূর্যদেব দেখা দিলেন মিরিকের আকাশে। মুহুর্তেই
চারপাশের সমস্ত রং কেমন অদ্ভুতভাবে বদলে গেল! সোনা সোনা রোদে কেমন সোনালী
হয়ে গেল সবকিছু। টেম্পারেচার কত হবে তখন? খুব জোর আট ডিগ্রি সেলসিয়াস!
আগের দিনই আমরা কলকাতার চল্লিশ ডি্গ্রি থেকে প্রায় সেদ্ধ অবস্থায়
বেরিয়েছিলাম! রোদের ওম গায়ে মেখে আয়েস করে খেতে খেতেই দেখলাম বিশালাকারের
সব ঘোড়া ঘুরে বেড়াচ্ছে, হোটেলের আশে পাশে। ঘোড়ার লাগাম হাতে সব নেপালী
মুখ। বোঝা গেল, এরা ট্যুরিষ্টদেরকে ঘোড়সওয়ারী করায়। আমরাও বাঙালী আর আমরাও
ট্যুরিষ্ট প্রমাণ করতে সকলেই ঘোড়ায় চাপতে চাইল। এবং আমরা ঘোড়ায় চাপলাম।
সে
এক কেলেংকারী কান্ড। ছোটোখাটো চেহারার নেপালী লোকগুলো কম করেও সাড়ে
চার-পাঁচ ফিট উঁচু তাগড়া এক একখানা ঘোড়া নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। চাপব তো বলেছি
কিন্তু ঘোড়ার পিঠে চড়ব কি করে? রফিক প্রায় চ্যাংদোলা করে সকলকে ঘোড়ায়
তুলে দিল একে একে! ঘোড়ায় চড়ল না শুধু শুক্লা। সে রফিকের সাথে ঘোড়ার পেছন
পেছন হেঁটে এল। ঘোড়ার মালিক আমাদেরকে লেকটা এক চক্কর ঘুরিয়ে মেলার শেষ
মাথায় আমাদের গাড়ির কাছে নামিয়ে দিল। ফেরার সময় হয়ে এল! রাস্তার ধারের
একটা দোকান থেকে বীয়ার তোলার জন্যে শুভ আর নীলু গেল। পেছন পেছন আমরাও। এবং
গিয়ে সেই দোকানের একটা কাউন্টারে চকোলেটের যা কালেকশন দেখলাম সে যে কোন
বড়সড় চকোলেটের দোকানকেও হার মানায়। আমরা চকোলেট কিনলাম। রফিকের বাচ্চার
জন্যে কিনে দিলাম একটা খেলনা আর দু রকম চকোলেট। হুড়মুড় করে আমরা আবার
গাড়িতে। ঠান্ডায় রীতিমত কাঁপুনি ধরছে। হঠাৎ করে কোথা থেকে উড়ে এসেছে ঘন
কুয়াশা। আর দেখতেই দেখতে সব ঘোর অন্ধকার। বেলা চারটেতে রফিক হেডলাইট
জ্বালিয়ে গাড়ি চালাচ্ছে। শুভকে জিজ্ঞেস করে রফিক, এই পাহাড়ের পিকে যাবেন
স্যার? বৃটিশদের হেলিপ্যাড ছিল এক সময় ওখানে। মিরিক ছাড়িয়ে আমরা উঠে যাই
আরও উপরে, ঘনঘোর কুয়াশায়! কিছুই দেখতে পাচ্ছি না চোখে, নিজের হাতের তালুও
বোধ হয় মানুষের এতটা মুখস্ত থাকে না যতটা রফিক মুখস্ত করে রেখেছে সুবিশাল
এই পাহাড়ের শরীরের শিরা-উপশিরাকে। মিনিট কয়েকের মধ্যেই একটা ফাঁকা জায়গায়
গাড়ি এসে থামে। গাড়ির হেডলাইট জ্বালিয়ে রেখেছে রফিক। সেই আলোতে আমরা
প্রত্যেকে যেন নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করলাম। মিরিকের পিকে গাড়িতে চেপে
পৌঁছে আমরা যেভাবে উচ্ছসিত হয়ে উঠলাম সে জাষ্ট অকল্পনীয়! সেখানে কেউ কারোর
নয় আবার সকলেই সকলের ভীষণ আপন!
নীলু
ছবি তোলে। আমরা পাগলের মত কুয়শাকে গায়ে মাখি। হাতে গলায় মুখে একে অন্যকে।
মুঠো মুঠো কুয়াশা ছুঁড়ে দিই একে অন্যকে! হেডলাইটের আলোতে শুধু নিজেদের
কেই দেখতে পাচ্ছি। ঘন কুয়াশায় কিচ্ছু, কিচ্ছুটি দেখা যায় না!
আমরা বাস্তবে ফিরি। গাড়িতে উঠে বসি। হেঁড়ে গলায় সকলে গান গায়। গলা মেলায়
রফিকও। সারা রাস্তা রফিক তার প্রিয় কুমার শানু চালিয়ে আমাদেরকে মহা বোর
করেছিল, এবার রফিক খানিক বোর হোক!
খানিকটা
নিচে নামতেই কুয়াশা কেটে যেতে লাগল। নীলু বলে, আমরা জিরো ভিজিবিলিটি থেকে
এখন ভিজিবিলিটিতে ঢুকছি! যেন ক্ষণিকের মধ্যেই কুয়াশা কেটে গেল আর আমি
দেখলাম এক অবিস্মরণীয় দৃশ্য! পাহাড় থেকে দুরে বহুদূরে নিচে খানিকটা যেন
আলোর আভাস দেখা যায়। রফিক বলে, ওই হল শিলিগুড়ি শহর! আর ওই দেখুন ওই যে
তরাই দেখতে পাচ্ছেন ওটা হচ্ছে আমাদের ভারতের শেষ সীমানা, ওপাশে নেপাল! ওই
দেখা যায় হিমালয়! নিচেকার দৃশ্যকে আমার বাস্তব বলে মনে হয় না। যেন বিশাল,
বিশাল ব-অ-ড় এক ক্যালেন্ডারের পাতা, যে ক্যালেন্ডারের আকারের কোন
সীমা-পরিসীমা নেই!
রাস্তার
ধারের চা বাগানে নামবে বলে আমি ছাড়া সকলেই বায়না ধরে। নিরাপদ জায়গা দেখে
নিয়ে রফিক গাড়ি থামায়। একে একে সকলেই নেমে যায় চায়ের বাগানে। শতেক বছরের
পুরোনো কোমর সমান চা গাছের ফাঁক দিয়ে ঢাল বেয়ে তরতর করে নেমে যায় সকলেই,
এমনকি শুক্লাও! বেশ খানিকটা নেমে গিয়ে সকলেই আমাকে ডাকে নিচে নামতে। আমি
কোনমতেই নামতে রাজী নই দেখ রফিক বলে, 'আপকো দেখকর তো যমীন ডর যায়েগী, আপ
যমীন সে কিউ ডরতি হ্যায়?! হাত ধরে রফিক নমিয়ে নিয়ে যায় চায়ের বাগানে।
সকলেরই বয়েস যেন দশ-পনের বছর করে কমে গেছে। ছেলেমানুষি আনন্দে চায়ের পাতা
ছিঁড়ি। বুক ভরে টেনে নিই টাটকা-শুদ্ধ বাতাস। হিমালয়ের বাতাস!
গাড়ি
দ্রুত নেমে যেতে থাকে সমতলের দিকে। জানলার ধারে বসা আমি শরীরের প্রায়
অর্ধেকটা জানলা দিয়ে বের করে তাকিয়ে থাকি পেছনপানে। রাস্তার ধারের লোকজন
হাত নাড়ে, বিদায় জানায়। সম্পূর্ন অচেনা, জীবনেও কোনদিন দেখা না হওয়া
মানুষদের ওভাবে বিদায় জানানো দেখে বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে ওঠে। গলার
কাছে কিছু একটা দলা পাকাতে থাকে যেন। দ্রুত সরে যেতে থাকে, বদলে যেতে থাকা
দু'পাশের দৃশ্যাবলী। আমরা নেমে যেতে থাকি সমতলের দিকে। দ্রুত।
ট্রেনের সময় হয়ে এল বলে...
3 comments:
খুব ঈর্ষা করছি সামরান, কি দুর্দান্ত বন্ধুভাগ্য তোমার্। সবাই ডাকছে, তুমি এড়াচ্ছ, শেষে বাধ্য হচ্ছ প্র্যাকটিক্যালি তাদেরই চাপের কাছে হার মেনে। এমন ঘটনা ক’জনের সঙ্গে ঘটে জানিনা, আমার কখনো ঘটেনি বলেই ঈর্ষা হল, ভালও লাগল্। আর লেখা নিয়ে কি বলব সামরান- তুমি দেড়দিনের বেড়ানোকে যদি এই মনোগ্রাহীতায় নিতে পারো, তবে অদূর ভবিষ্যতেই একজন শ্রেষ্ট গল্পকারকে পেতে চলেছি এ’ নিঃসন্দেহ। কারণ জীবন সীমার মধ্যেও কত ঘটনা, কত ওঠাপড়া তোমার... একবার যদি তার মৌতাত নিতে লিখতে বসো...
আরেকটা কথা, ‘সারা রাস্তা রফিক তার প্রিয় কুমার শানু চালিয়ে আমাদেরকে মহা বোর করেছিল, এবার রফিক খানিক বোর হোক’ পড়ে এতই জোরে হেসে উঠেছি- আমার পতিদেবও চমকে-টমকে একশা।
বড় লেখা দেখে যতটা ঘাবড়েছিলাম, পড়া শেষে ততটাই আক্ষেপ- এত তাড়াতাড়ি ফুরলো?
তুমি তাড়াতাড়ি বিছানা ছেড়ে এসো আর লেখ... অনন্তকাল লেখ।
খুব চমৎকার উপস্থাপনা আপনার। বেশ ভাল লাগলো। আমি ভ্রমন কাহিনী পেলে মিস করি না।
আপনি সচলায়তনে কি এই নিকেই লিখেন?
মঞ্জু,
অনেককাল পরে আবার ব্লগের পাতায়, এই দেখলাম তোমার মন্তব্য।
অনেক, অসংখ্য ধন্যবাদ। লিখব আবার- এই আশাতেই বাঁচি:-)
----------
ধন্যবাদ ইমরান।
ওখানে শ্যাজা নামে পরিচিতি। সেই নামেই 'ছিল' লেখালেখি বা ব্লগ-ব্লগানি। এখন সবই অতীত। কিছুই আর লেখা হয় না। ফিরতে হবে, ফিরতেই হবে অক্ষরে অক্ষরে, শব্দমালায়। ফিরবই- এই প্রতিশ্রুতি নিজের কাছে।
আবারও ধন্যবাদ।
Post a Comment