Tuesday, 28 June 2011

অনিন্দ্য রাত্রিপ্রাঙ্গণে

একটা ঘুড়ি উড়ছিল একটু আগেও। নাটাই হাতে হাফপ্যান্ট পরা ছেলেটি ঘুড়িটাকে পাকা নাচিয়ে হাতে ওড়াচ্ছিল। তারপরই ভোঁকাট্টা, এখন একলা হয়ে ঝুলে আছে গাছের ডালে। বৃষ্টিহাওয়া ঘুড়িটাকে ওর কাছ থেকে আলাদা করে উড়িয়ে এনে বসিয়ে দিয়েছে অন্য জায়গায়, সে এখন বৃষ্টিতে ভিজছে আর বোকা বোকা চোখে ওর ভিজতে থাকা নেতিয়ে পড়া গোলাপী-সাদা ঘুড়িটার দিকে তাকিয়ে আছে। গলির মুখে আটকে যাওয়া অনেকের সাথে নীল সালওয়ার-কামিজ বৃষ্টি থেকে নিজেকে বাঁচাতে মাথায় তুলে দিচ্ছে আকাশনীল ওড়নার আড়াল। সেঁটে যাচ্ছে আরও বেশী করে দেয়ালের সাথে। মুঠোফোনে তাড়া দেওয়া প্রেমিককে এইমাত্র রাগীমুখে যেন ধমকে উঠল সে, তারপর ফোন ব্যাগে পুরে অখন্ড মনোযোগ ঢেলে দিল মুখ আর হাতের বিন্দু বিন্দু জলকণার প্রতি।


বারান্দায় দাঁড়িয়ে এইসব দৃশ্য দেখি আর ভেতরে ভেতরে কাঙাল হয়ে উঠি। খন্ড খন্ড আবেগ বিক্ষিপ্ত হয়ে মিশে যেতে চায় অঝোর বৃষ্টির সাথে। আমার একলা লাগতে আরম্ভ করলে সিঁড়ি ভেঙে ভেঙে চিলেকোঠায় উঠি। নিষ্পলক চোখে তাকিয়ে থাকি পলেস্তাবা খসে যাওয়া দেয়ালের ইতিউতি থেকে যাওয়া স্মৃতিমাখা দাগগুলোর দিকে। বৃষ্টির ছাঁট আসছে খোলা দরজা দিয়ে। ছাদে গিয়ে দাঁড়াই, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে আমার কষ্টগুলোকে স্নান করাতে থাকি। ছাদে নেমে আসে বৃষ্টিগন্ধা প্রবল আকাঙ্খার এক সন্ধ্যা। দাঁতে দাঁত কামড়ে কষ্টগুলোকে আড়াল করি, সযত্নে বুকের মধ্যে ঢুকিয়ে নিয়ে ছাদ থেকে নেমে আসি চুপচাপ।




বৃষ্টির তোড় কমে না, তার মধ্যে বার দুয়েক আমাকে বর্ষাতি পরে বেরোতে হয় আলু,লঙ্কা, ডিম আনতে। এনে দিই, সিগারেট ফুরিয়েছিল সেটাও মনে করে কিনি। ঘরে ঢুকে দেখি রিনি সুখী সুখী মুখে খিচুড়ি রাঁধছে। ইলিশ নেই বলে ডিম কষা, আর আলুভাজা করবে বলে রান্নাঘর থেকেই জানান দেয়। বৃষ্টিশব্দ ছাপিয়ে ওর চুড়ির টুং টাং আওয়াজ আর মশলার ঝাঁঝালো গন্ধ দুইই আমার ইন্দ্রিয়ে অস্বস্তি এনে দিলে আমি বসার ঘরে বসে কিছুক্ষণ দৈনিক পত্রিকার হেডলাইন পুনরায় মন দিয়ে পড়ার চেষ্টা করি, হঠাৎ মনের মধ্যে ফিসফিস করে কথা বলে ওঠে কেউ, একটা বৃষ্টিভেজা আবছা মুখ জলের ভেতর থেকে মুখ তুলে ফের ডুবে যায় হুস করে। আমি তার ফিসফিস করে বলা কথা শুনতে কান পাতি বুকের গভীরে। তার ভেতরে ডুব দেবার প্রবল তৃষ্ণার অনুভব আমাকে ভেতর থেকে নিয়ে যায় দূরালোকে। ক্রমশ তার স্পর্শ অনুভব করতে শুরু করি ঘাড়ে, কপালে,চুলে।রিনি এসে রাতের খাবার খেতে ডাকে। ওর ডাকে ঘোরের সুতো ছিঁড়ে যায়। দুম করে সুতো কেটে যাওয়া ঘুড়ির মত আচমকা ঝুলতে থাকি শূন্যে।




খাবার পরে সারা ঘরে ঝাঁ ঝাঁ আলো জ্বেলে রিনি রাতের প্রসাধন সারে আর আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। সিগারেটে লম্বা ছাই জমে, হৃদস্পন্দনের মধ্যে ফের অনুভব করি তাকে। রাস্তায় জল জমে গেছে, আলোর প্রতিবিম্ব জলে দোল খায় আর ঝিকমিক করে সেসবের মধ্যে দেখতে পাই ছেঁড়া ছেঁড়া স্থিরমুহূর্তকে। খুঁটে তুলে নিই এক এক করে স্মৃতিদৃশ্য, জমিয়ে রাখি পাঁজরের প্রতি খাঁজে। ঘরে গিয়ে ল্যাপটপ খুলে পুরোনো ঠিকানায় ফিরে যাই। এক বছর আগের বৈদ্যুতিন চিঠিগুলো ঘুরেফিরে পড়ি। দুজনের কথপোকথনগুলো উল্টেপাল্টে দেখি। হু হু করে ওঠে বুকের ভেতর, বৃষ্টিস্নানের পর পুনরায় জমিয়ে রাখা কষ্টগুলো, পুরুষত্ববোধের তলায় চাপা পড়া কষ্টগুলো এবার গলতে শুরু করে। বেরিয়ে আসে ওরা নোনাজল হয়ে। প্রবল তোড়ে আমাকে ভাসিয়ে দিয়ে বৃষ্টির সাথে মিশে যেতে যেতে আমাকে ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়।


ছায়াশরীরী দক্ষ সে তীরন্দাজ ফেলে গেছে বৃষ্টির বধ্যভূমিতে
তার অনিশ্চিত ফেরার প্রতীক্ষায় বৃষ্টিজলে মুখ রেখে অস্ফুটে বলি
ভস্ম হয়ে মিশে যাবো বাতাসে তবু ছড়িয়ে দেবো স্ফুলিঙ্গ চারদিকে
অস্থিটুকু পুঁতে দিও বাগানে; পুনশ্চঃ জন্ম নেবে এক শ্বেতকরবী।

Monday, 27 June 2011

আমার গানের খাতার স্মৃতি থেকে............

আইয়ুব বাচ্চু
প্রয়াত আযম খান


আমি....... ছোটবেলা থেকেই প্রচণ্ড গান শুনতে পছন্দ করি। তো তখন মাঝে মাঝেই গুনগুন করে গান গাইতাম। প্রথম ভালো লাগা গান গুলোর মধ্যে ছিল “হাওয়া হাওয়া” এবং “মুকাবেলা” টাইপের হিন্দি গান। একটু বুঝার পর শুনতাম পপগুরু আযমখান এর “ওরে সালেকা ওরে মালেকা”, “রেল লাইন এর বস্তিতে”, “ আলাল আর দুলাল” ইত্যাদি। আরও একটু বড় হয়ে শুনতাম আশ্রাফ বাবু এবং চারুর র‍্যাপ গান। আমি যখন যে ধরনের গান শুনতাম তখন আমার বন্ধু মহলে ওই গান গাওয়ার জন্য আমি বিখ্যাত ছিলাম। আর একটু বড় হয়ে শুনতাম আর্ক, জেমস, আয়ুব বাচ্চু। আয়ুব বাচ্চুর চেয়ে আর্ক এর হাসান এবং জেমস খুব প্রিয় ছিল। যখন ৭ম/৮ম শ্রেণীতে পড়ি তখন পরিচয় হয় ভারতীয় জীবনমুখী বাংলা গানের অন্যতম শিল্পী নচিকেতা, অঞ্জন দত্ত এবং সুমন চট্টপাধ্যায় এর সঙ্গে। তখন ওনাদের গান ছাড়া কিছু বুঝতাম না। এখনও নচিকেতার গান গুনগুন করে গাই। 

একতারা হাতে বাউল
S.S.C এর সময় পরিচয় হয় বাউল গান বা দেশি গান এর সাথে। তখন বারী সিদ্দিকির “আমার গায়ে যত দুঃখ সয়” এবং “সোয়া চান পাখী” গান গুলো চমৎকার ভাবে গাইতে পারতাম। তখন একটা সময় চলছিলো যখন এধরনের গান খুব চলত। এরপর যে গান গুলো চলত সেগুলো হোল “কৃষ্ণপক্ষ কালপক্ষ”, “আমার একটা নদী ছিল”, “মাক্ষি গিরা গরম তেল মে”, “ঘাটে লাগাইয়া ডিঙ্গা”, “বাজারে মন এই দেহ মাদল”, এবং জেমস এর “পাগলা হাওয়ার তোড়ে” ইত্যাদি।

B-)B-)B-) কলেজে পড়ার সময় আমার সাথে পরিচয় হয় “হীরা” নামক একটি ছেলের সাথে। খুব মিশুক ও চটপটে স্বভাবের কারনে অর সাথে আমার বন্ধুত্ব হতে দেরি হয় না। আমাদের বন্ধুত্ব হবার আরও একটা বড় কারন ছিলো, ও ভালো গান গাইতে পারত। বন্ধু মহলে মাইক্রো কনসার্ট করার ক্ষেত্রে একজন কো-পারফরমার পেলাম। এরপর থেকেই আমরা দুজন। খুব দ্রুতই পুরো কলেজে আমাদের কথা জেনে গেলো। কলেজের ২য় বর্ষে থাকাকালীন একটা নবিন বরন অনুষ্ঠানেও আমরা গান গেয়েছিলাম।


:):):) এমনিভাবে চলতে চলতে একদিন আমরা দুজনেই খেয়াল করলাম দুষ্টামির ছলে আমরা অনেক কথা সুরে সুরে বলছি। সেখান থেকে গান লেখার আইডিয়া এলো। আমি অল্পবিস্তর কবিতা লিখতাম। সিদ্ধান্ত হোল আমার একটা কবিতা দিয়েই গান এর শুরু করতে হবে। এক ছুটির দিনে আমি, হীরা আর ববি (..;)...... ও বলতে ভুলে গেছি, ববি আমার প্রাক্তন গার্লফ্রেন্ড এবং বর্তমান স্ত্রী, আমরা তিনজনই বন্ধু ছিলাম।) আমার বাসায় বসে একটা টেপ রেকর্ডার, কাঠের টেবিল (বিট এবং রিদম দেয়ার জন্য), অর্ধ ভর্তি ষ্টীলের মগ এবং চামচ (পানির ঢেউ এর মতো আওয়াজ করার জন্য আমার আইডিয়া), একটা বাশের বাকা কঞ্চি (পায়ে বেজ দেয়ার জন্য), ইত্যাদি যন্ত্রপাতি বা মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট নিয়ে রেকর্ড করতে বসলাম আমাদের প্রথম গান এর ডেমো। গানটি ছিল “যতদিন রইবে ওই আকাশ, যতদিন রইবে ওই বাতাস, যতদিন রইবে সুর আমার, ততদিন রইব আমি তোমার” আমাদের প্রথম গান তাই এর প্রতি ভালবাসাটা ও অনেক বেশী ছিল। যদিও এখনও এই গানটা অন-এয়ারে যায়নি কিন্তু আমার বন্ধু মহলে বেশ জনপ্রিয়। এর পর আমি আর হীরা আমার বাবার বকা উপেক্ষা করে কত রাত জেগে জেগে গানের সুর করেছি তার কোন হিসেব নেই। বেশির ভাগ রাতেই প্রথম ভাগে আমি জাগতাম এবং ওকে উৎসাহ দিয়ে গান ধরিয়ে দিতাম এবং এরপরই আমি ঘুমিয়ে পরতাম। এই নিয়ে ওর বিরক্তির অন্ত ছিল না। পরবর্তীতে আমাদের এই কার্যকলাপে মাত্র দু দিনের জন্য যুক্ত হয়েছিল একটা খেলনা কীবোর্ড। আমরা তখন তার পরিপূর্ণ ব্যবহার করেছিলাম। সেই ঘটনা গুলো মনে পড়লে খুব ভালো লাগে এবং খুব হাসি পায়।

হীরা, BAFA(bulbul academy of fine arts) থেকে নজরুল সঙ্গীত এর উপর ৪ বছরের কোর্স সম্পন্ন করে বর্তমানে মিউজিক ডিরেক্টর চঞ্চল মাহমুদ ভাই এর কাছে মিউজিক ডিরেকটিং এর উপর তালিম নিচ্ছে।

আমাদের দুজনের লেখা ও সুর করা প্রায় ৪০টির ও বেশী গান আছে। হয়তো কখনও কোন একসময় অন-এয়ারে শুনতে পাবেন। এখন যদিও সেই কলেজ জীবনের মতো গানের চর্চাটা নেই। তারপরও বন্ধুরা একসাথে হলে গান আর আড্ডা খারাপ চলে না।
:):);):P;):P;):)

যাও পাখি বলো

Open Windows by srijankundu
Open Windows, a photo by srijankundu on Flickr.

এই উইন্ডচাইমটা আমার বৌএর কিনে আনা . খুব মজার ব্যাপার হলো , যখন বউ বাড়ি থাকে, এটার খুব একটা শব্দ পাওয়া যায়না , কিন্তু তিনি যখন তার বাবার বাড়ি যান , এটা টুং- টাং শব্দ করে তার উপস্থিতি জানান দিতে থাকে .


cross posted from : ছবি ঘর

Saturday, 25 June 2011

স্বপ্ন


স্বপ্ন 5

মঞ্জুশ্রী রায়চৌধুরী, 25.06.11,  দুপুর 2.30

কি হয়েছে কি জানি কদিন কিচ্ছু লিখতে পারছি না। ভাগ্যিস স্বপ্নটা এলো, কিছু তো লেখার জন্য তবু পেলাম। অদ্ভুত।

আমি, আমার মা, নবু আর ভুচু বাড়ি যেতে চাই নদী পেরিয়ে অথচ হাঁটাপথে বাড়ি কাছেই। কি করব, ওটা স্বপ্নময় ইচ্ছে.... ওটা খেয়ালদাম তো তার দিতেই হবে। তো যেখানে স্টিমার এসে ভেড়ে, সেই জেটিঘাট থেকে নদীর উত্তাল ঠেউএর সঙ্গে গা ভিজিয়ে মন ভিজিয়ে চারজনেই জলে ঝুপ্পুস। পাশ দিয়ে স্টিমার যাচ্ছে ঘুচঘুচ শব্দে দিব্যি ধোঁয়া উড়িয়ে.... কিন্তু কিজানি কেন আমরা যাচ্ছিনা, আমরা যাচ্ছি সাঁতরে। বাস্তবে অথচ আমি ছাড়া বাকীরা সাঁতার জানেনা। কিন্তু স্বপ্ন বোধহয় এজন্যই মধুর... যা নয়, যা নই তার সঙ্গে মুলাকাত্ ঘটায় মনে রোদ্দুর জ্বেলে!!!!! তা যা হোক্, এবার তো সাঁতারাচ্ছি। আমার মা, আর ভুচুর মা মানে নবু দেখি ফ্রিস্টাইল স্ট্রোকে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক পথে আর ভুচুবুড়ো নদীর লম্বাই ধরে কেজানে কোন পথে চলল। আমি একদম শেষে সাঁতারাচ্ছি, তাই সবটা দেখে ভুচুকে ডাকতে-ডাকতে ওরই দিকে চললাম। কিন্তু সে ছেলে শুনতেই পায়না, বরং স্পীড বাড়িয়ে জোরসে চলেছে। একটু এগিয়েই দেখি বালিয়ারী... ডাঙা। বাধ্য হয়ে দুজনকেই উঠতে হল। কাছে গিয়ে দেখি ওমা, ভুচু কই! এতো অন্য কাদের মেয়ে.... হলুদ ছিটের ফ্রক পড়া। এবার শুরু হল আমার দৌড়। দৌড়চ্ছি, দৌড়চ্ছি.... আমাকে জেটিঘাটে পৌঁছতেই হবে। আমি ডাঙায় উঠেই যেন বাড়িতে পৌঁছে গিয়েছিলাম, তবু মনের মধ্যে চলছে আমি ভুল করেছি, ভুল করেছি। ভুচু নিশ্চই মা-দের সঙ্গেই.... আমি ভুল করেছি।

দৌড়চ্ছি, দৌড়চ্ছি.... দৌড়তে-দৌড়তে যে ঘাটে এসে পৌঁছলাম, সেটা একদম অপরিচিত, আগে দেখিনি। পাড় থেকে অনেক নীচে জলের সীমানা। দেখি ওপর থেকে সেখান অবধি দড়ির সিঁড়ি নেমে গেছে। আমি এরপর সিঁড়িকে পাকড়ে ধরে ল্যাগব্যাগ করে ঝুলতে-ঝুলতে ঠিক মাঝ বরাবর এসে যেই ডাইভ দেব ভাবছি, তাকিয়ে দেখি জলের মধ্যে এলোমেলো নুড়ি-পাথরের মিশেলে জেগে আছে ছোট-বড় পাহাড়-পাহাড় এলাকা। আমি তবু নীচে নামতে চাইলাম। ভাবলাম ডাইভ না দিয়ে নাহয় সাঁতরে... পাশ কাটিয়ে.... এবার দেখি ঐ সিঁড়ি বেয়েই আরেকটি মেয়ে নেমে আসছে.... সে চেঁচিয়ে-মেচিয়ে বলল

যেও না যেও না... এই ঘাটটা পরিত্যক্ত
তা তুমি আসছ যে...
আমার অন্য কাজ
এখন কি করি?
যেমন এসেছ, তেমন ফেরত্ যাও।
কেন গো? আমি কি পাশ কাটিয়ে, সাবধানে.... পারিনা? সাঁতরে....
পাগল? দেখতে পাচ্ছ না পাশের ঘাটটা? ওখানে যাও।

তাকিয়ে দেখি পাশের জেটিটাই সেই আগের জায়গা। এবার ফের হাঁচড়-পাঁচড করে দুলতে থাকা দড়ির সিঁড়ি বেয়ে-বেয়ে ওপরে প্রায় মুখ অবধি পৌঁছে গেলাম। কিন্তু কি যে হল, শেষের দুটো সিঁড়ি পেরনো গেল না। মন খারাপ, শরীরও খারাপ, ওপরে উঠতে পারছি না... কিছুতেই। এইসময় কিন্তু মনে মা-নবু-ভুচু আর কেউই নেই। সারাটা মন এখন একাগ্র সিঁড়ির শেষধাপে শরীরকে টেনে ওঠানোর নেশায়। চেষ্টা এবং চেষ্টা এবং তারপরেও না পেরে জুলজুল করে নীচে বয়ে চলা জল আর কুলকুল স্রোতের দিকে চেয়েচেয়েই হাল্কা হয়ে গেল ঘুম।

তখনো ভোরের আলো ফোটেনি, সকাল নয়। তাই ঘুম ভাঙতেই স্বপ্নকে জোড়া লাগাবার ইচ্ছে মনে নিয়ে ফের ঘুমোলাম ও স্বপ্নবেটা কিচ্ছু না দেখিয়ে ঘুম ভাঙাল যথা সময়েই।

Thursday, 23 June 2011

আমার মোবাইল ফটোগ্রাফি ৩

ঘুম মানুষের জীবনে খুব প্রয়োজনীয় একটি অংশ। তবুও ঘুমকে এইভাবেও বলা হয় যে, 
আটআনার জীবন,
চারআনা ঘুমে,
২ আনা প্রেমের ফাঁকি
জীবন তোর আর ২ আনা বাকি।।

তারপরও মানুষ ঘুমায়। জায়গায় ঘুমায়, বেজায়গায় ঘুমায়। মোট কথা আমাদের গ্রামের ভাষায় বলা হয়,
"খিদায় বুঝে না পাতা, শীতে বুঝে না খেতা (কাঁথা), আর ঘুমে মানেনা ক্যাদা (কাদা মাটি)।"

এই ছবি গুলো দেখলেই এই কথা গুলো প্রতিয়মান হয়।
নিশ্চিন্ত ঘুম

মহাখালি ফ্লাইওভার এর নিচে

ভিক্টোরিয়া পার্কের দেয়ালে

ট্রেনে 

Wednesday, 22 June 2011

মন-কবুতর


 লেখাটা কিছুতেই মনঃপূত হচ্ছেনা দীপঙ্করের দীপঙ্কর অর্থা  দীপুসমাজ সেবার জেরে এ পাড়ার দীপুদা টেনিদাকে ক্ষাণিকটা কাটছাঁট করে কপি-পেষ্টকরলে দীপুর চরিত্রে বেশ মানানসই সবে বি.এ ফার্স্ট ইয়ারপড়াশোনাটা অনেকটা তার কাছে মাছি তাড়ানোর মতএ হেন দীপু আজকাল এক মারণ রোগের শিকার
পেনটাকে সিগারেট ফোঁকার স্টাইলে দুঠোঁটের মাঝে চেপে ওয়ার্ম-আপ করাতে করাতে ভাবতে বসে দীপুনাহ্‌ মেয়েটার এলেম আছে!শালা! কত নোটঙ্কী এল গেল এ পাড়ায়! কিন্তু দীপঙ্কর স্যান্যালের পাথরের মত বুকে ফাটল ধরানোর সাধ্যি কারো হয় নি! আর এই হরিদাসী কিনা দু-চারবার মুচকি হেসে স্রেফ পাত্তা না দিয়ে ব্রম্ভচর্যের ঘেঁটি ধরে একবারে নেড়ে দিয়ে গেল  মাইরি! আজকাল শুতে,বসতে,হাঁটতে এবং বলাই বাহুল্য পড়তে গেলে সংসারময় শুধুপোলকা-ডটেডসালোয়ার কামিজ শুধুই কি তাই!নবাব কেনার সাথে আরাম ফ্রি তাই বাড়তি হিসেবে চোরা চোখের তাচ্ছিল্যের হাসি
নাহ্‌ চিঠিটা লিখতেই হবে কি দিয়ে শুরু করা যায়? ‘প্রিয়তমাসু’? এহেঃ বড্ড সেকেলে শোনাচ্ছে চড়চড় করে একটা আওয়াজ এ পৃষ্ঠাটাও বেকার গেল! প্রিয়দিয়ে শুরু করাই ভাল কিন্তু প্রিয়টা আজকাল যেন সার্বজনীন দূর্গোসবপাড়ার বল্টুদা থেকে হরির ঠাকুমা অবধি সবাই প্রায় মাই ডিয়ারকাজেই এই শব্দও বাতিল কিন্তু শুরুটা হবে কি দিয়ে পাড়ার টিঙ্কু,বুল্টি এরা তো মন্টিবলে ডাকছিলকিন্তু   পাড়াতুতো নামে  চিঠি দেওয়াটা কি ঠিক হবে! হিসেব করে   ‘পা’  না ফেললে কেস কিচাইনহয়ে যেতে পারে
পাশে রাখা গোলাপী খামটা খিদে পেটে অপেক্ষা করতে করতে নেতিয়ে পড়েছে ঘরের কোনে একের পর এক চিঠির বোল্ডার জমা হচ্ছে নাহ্‌ ব্যাপারটা ক্রমশ ঘোরালো হয়ে পড়ছে একটা প্রবহমান স্রোত  স্রেফ শব্দের চক্রব্যুহে ফেঁসে যাবে! কোনোমতেই মেনে নেওয়া যায়না ! ঢক্‌ ঢক্‌ করে এক নিঃশ্বাসে ক্ষাণিকটা জল খেয়ে একটা ব্রেক নিয়ে নেয় দীপুসন্তর্পণে চারিদিক মেপে ফস্‌ করে দেশলাইটা ধরায়  বারান্দায় একটু পায়চারি করা যাক্‌ চাঁদের আলোর সাথে বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁওয়া ! আজ চিঠি লেখা  কে থামায়! আচ্ছা কে যেন বলেছিল না  “পুর্নিমা-চাঁদ যেন ঝলসানো রুটি”......ধুসস্‌ একদম ফালতু কথা! আসলে ওটা পুর্নিমা-চাঁদ  যেন ধারালো মন্টিহবে তাকালে মনে হয় ভেতর অবধি দেখে ফেলল উফ্‌ ! কি চাহনি মাইরি! কোথায় লাগে বিপাশা বসু! কি লেখা যায় তাহলে, ‘ ওগো সুনয়না’ ...ধুর্‌  মনে হচ্ছে ন্যাকা স্বামী বাড়ী এসে পাপস্খালন করছে
রাস্তায় দুটো দেশী কুকুর কাঁ করু সজনীর সুর তুলেছে নারকেল গাছের  পাতার সর্‌সর্‌  শব্দে উড়ে গেল একটা রাতচরা পাখিআহা!যেন মন্টিডানা মেলে উড়ে গেল!  মিনিট দুয়েক পায়চারি করতেই  দীপুর চোখমুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠলআধপোড়া সিগারেটটা ছুঁড়ে দিল একেবারে নীচে    ব্যস্ত পায়ে ঘরে ঢুকে পেন হাতে তুলে নেয়

মন্টেশ্বরী ওরফে মন্টি,
এই চিঠিকে প্রেমপত্র বলে ভয়ঙ্কর ভুল করে বোসো না যেনকয়েকটা কথা না বললেই  নয়...তাই এই চিঠিগত কয়েকদিন ধরে তুমি যেভাবে আমাকে বিদ্যুপিষ্ট  করেছ তা ক্ষমার অযোগ্য কি ভাবো তুমি নিজেকে? বিপাশা বসু নাকি পুর্নিমার চাঁদ ? ঠোঁটের ঐ তাচ্ছিল্যমাখা হাসির অপসারণ না হওয়া অবধি তোমার ভবিষ্যত সংকটময় কিছুক্ষণ আগেই একটা আধপোড়া সিগারেটের সাথে আমি সবটাই ফেলে এসেছি
দীপঙ্কর

চিঠিটা গোলাপী খামে ঢুকিয়ে  ভালো করে সেঁটে হাতে তুলে নেয় বারান্দায় এসে দাঁড়ায়চিঠিটা এক্ষুণি পোস্ট করা দরকার......ভীষন দরকার  ভাবতে ভাবতে আলতো করে বন্ধ খামটা হাওয়ায় ভাসিয়ে দেয় উড়তে উড়তে খামটা কাঠগোলাপ গাছের ফাঁকে আটকে  পড়ে  দীপু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ঘরে  যায়   গত কয়েকদিনের জমানো ঘুম মিনিট খানেকের মধ্যেই নেমে আসে

আমিও পারি

 রবিবার 19.06.11-র ‘NEWS বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত লেখা
   
  মঞ্জুশ্রী রাযচৌধুরী

তার বিদায়বেলার মালাখানি আমার গলে রে       
দোলে দোলে বুকের কাছে পলে-পলে রে.....  

তোমার এগান ভালবেসেছিএতই 
এতই টেনেছি কাছে
বাস্তব বিপদ বুকে
আঁজলা ভরে রক্তস্নানে                                 
অবিরাম, তাই উন্মুখ।             
    
চুঁইয়ে পড়া ক্ষয়, অপ্রেম
আস্টেপৃষ্ঠে জাপ্টে আছে গা-
ঘেন্না ঘেন্না কেন্নো কুন্ডলিনী।   
দম দিতে সাধ্যিহারা জন
দম ভরে বাঁচছে নিলজ্জ।

নষ্ট সময়পথে ছিল নষ্টচাঁদের আলো 
নষ্টমনে নষ্টসুখের আমন্ত্রণ ভারে
আত্মদম কাদায় ভেজা বালি।
তাতেও হল তার,
অপর হওয়া স্বজন কু-জনার। 

আমার ফুঁ-এর হল্কা এখন তাতাপোডা
আমার ক্ষুধা আদিম, অশালীন।
মন্দ, ভাল, মাঝের-
লাজের কিংবা কাজের
হিসেব বোঝে সেজন
পেলে পথ্য ভাল ভাল।
    
দমহারানো নিত্যনতুন
সকালবিহীন অন্তর্লোক
কি দিচ্ছে বাঁচায়?
দিচ্ছে অসুখ গাঢ়।
লগি ঠেলে এরপরও কি
পার হওয়া যায় নদী?
যে নদীতে হাঙর-কুমীর-কামট?
    
আলোক কাড়া আঁধার ছিল দানে
নিত্যভোরে অবিশ্বাসী ধুন-
সরিয়ে এল অন্যদিনের ভোর।
আসুক্ বাধা হাজার সারিসারি
তবু পার হবো ঠিক নদী
যদি হাঙর-কুমীর-কামটদেরও
খাদ্য করতে পারি।
**********
                                    

Tuesday, 21 June 2011

পয়সাফুলের দিন - পর্ব ৮

সেরাতে ভালো করে ঘুমই হোলো না। থেকে থেকে কেমন উদ্ভট স্বপ্ন দেখতে লাগলুম। একবার দেখলুম আমি আর পুঁটে। রান্নাঘরে আরশোলা ভাজা তদারক করছি। বড় কড়াইতে চড়বড় করে আরশোলা ফুটছে। ইতুপিসী থেকে থেকে গাওয়া ঘি ঢালছে আর এই বড় খুন্তি নিয়ে পাক দিচ্ছে। একবার সেই ফিরিওয়ালাটাকে দেখলুম। হাঁউমাউ করে কেঁদেই চলেছে। তার ঠেলা ভর্তি পুতুল, কেউ কিনছে না। দেখলুম শৈলদিদির স্কার্ফ নিয়ে হাঁসেরা পালাচ্ছে। ওদের পেছনে লেজ উঁচু করে ম্যাও ম্যাও। আরেকবার দেখলুম ছোটোমামা আর মেজজ্যাঠামশায়। সামনে ইয়া বড় একটা বাস্‌কো। জ্যাঠামশায় ফিতে নিয়ে বাস্‌কো মেপে ছোটোমামাকে —আচ্ছা, সে কথা বরং থাক। মোটকথা, সারারাত ঘুমই হোলো না, তাই কার যেন খোঁচা খেতেই তড়াক করে উঠে বসলুম।
—‘ইস্‌, ওদিকে লোকজন সব এসে গেছে, আর এদিকে এরা উলটে পড়ে নাক ডাকাচ্ছে। এই সুনু, ওঠ বলছি। এত নিশ্চিন্তি কিসের তোদের! আর দেখ পুঁটে, ফের যদি আমার দিকে অমন করে চেয়ে থাকবি তো ভাল হবে না বলে দিচ্ছি।’
অগত্যা উঠতেই হল। চেয়ে দেখি পুঁটেও উঠে পড়েছে। আমি জানি ঘুম থেকে উঠে ওর কিচ্ছু মনে থাকে না। চটিজুতো কোথাও কিচ্ছু খুঁজে পায় না। থমথমে হাঁড়ি মুখ করে পাথরপরীর দিকে চেয়ে বসে থাকে।
এদিকে ছোটোমামা ঘরময় পায়চারি সুরু করেছে। ঘনঘন মাথা নাড়ছে, আঙুল মটকাচ্ছে। চেয়ে দেখলুম ওর কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম। আমি আর কী করি, চুপটি করে চাদর জড়িয়ে দরোজা খুলে বারান্দায় এসে দাঁড়ালুম।
     দেখি নীচের রোয়াকে রীতিমতো হইচই কান্ড। বাবা-জ্যাঠামশায়রা সব সার দিয়ে সদর দেউড়ীর সামনে দাঁড়িয়ে। ওঁদের পেছনে নায়েব গোমস্তারা সব চশমা ঠুলি এঁটে জোহুজুর। কীসব গুজগুজ ফিসফাস চলছে। একতলা দোতলার বড় ঘর থেকে বড়মা সেজমারা সব ক্ষণে ক্ষণে সদরের দিকে উঁকি দিচ্ছেন। ঝি চাকরবাকরেরা ব্যস্তসমস্ত হয়ে এ ওকে হাঁক পাড়ছে, কোঁদল করছে। সদর থেকে কাছারিঘর অবধি লাল গালচে পাতা। দুপাশে সার দিয়ে খাস বেয়ারারা সব দাঁড়িয়ে। কোচোয়ান দারোয়ানেরা নতুন পাগড়ী পরে কোমরবন্ধ এঁটে গম্ভীর মুখে খালি খালি আকাশের দিকে চাইছে। ম্যাওম্যাওকেও দেখলাম হাঁড়িপানা মুখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে।
     এমন সময় ব্রুহ্যাম গাড়ীখানা সদরের সামনে এসে থামল। অমনি ঝিচাকরদের হাঁকডাক সব চুপ। নীচের তলার ফিসফাস বেড়ে মৌমাছির ভনভনানি। জ্যেঠিমারা সব লালপেড়ে কাপড় পরে ঘোমটা টেনে নীচে নেমে এলেন। এদিকে গণাদাদুও কাঠের পাদানি নিয়ে গাড়ীর সামনে হাজির। দেখলুম বড়জ্যাঠামশায় ছুটে গিয়ে কৌচের দরজা খুলতেই, ভেতর থেকে একটা নীল মোজা পরা পামশু আঁটা ধবধবে সাদা পা বেরিয়ে এল। হাঁচোড়পাঁচোড় করে পায়ের মালিক ধুতি সামলে, মাটিতে নেমে একবার গলাখাঁকারি দিলেন। অমনি দেখি বড়জ্যাঠামশাই টপ করে প্রণাম ঠুকে দিয়েছেন। এই বুঝি খুড়োমশাই। তাই হবে বোধহয়। ধবধবে ফরসা চুল। ফরসাপানা গায়ের রঙ। সাদা ধুতিপাঞ্জাবি। পকেটে ট্যাঁকঘড়ি। মুখখানা কেমন রাশভারী। দেখলুম বাবা-জ্যাঠারাও হুড়োহুড়ি করে খুড়োমশায়ের একেবারে পায়ের কাছে। নায়েব, গোমস্তা, জো হুজুরেরাই বা পিছু থাকবে কেন। তারাও হুমড়ি খেয়ে, ঠেলা ঠেলি করে, এ ওকে ধাক্কা দিয়ে অনাছিষ্টি কান্ড। খালি বড়মা সেজমারা দূর থেকে কান্ড দেখে শাঁখে ফুঁ দিলেন।
     ঠিক সেই সময় গাড়ীর ভেতর থেকে আরেকজন বেরিয়ে এল। আপাদমস্তক গেরুয়া ঢাকা। মাথায় কান ঢাকা গেরুয়া রঙের পটি। পায়ে খড়ম। ছোটমামা যেমন বলেছিল, তেমন রোগা নয় মোটেই। বরং দস্তুরমতো মোটা। বোধহয় চাপা রঙ। একহাতে কমন্ডুলু মতন কিছু একটা ধরা। অন্য হাতে ইষ্টমালা। কোমরে ঘুনসি। কপালে তিলক। সরু চোখ। সরু হাসি। গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। এই তবে ভিঞ্চি মহারাজ!
     ফ্যোঁৎ করে একটা শব্দ হতেই দেখলুম কখন পাশে পুঁটে আর ছোটোমামা এসে দাঁড়িয়েছে। ওদের চোখ বড়বড়, মুখ হাঁ। ছোটোমামার নিশ্চয়ই পিলে চমকাচ্ছে। পুঁটে আমার গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
     এদিকে খুড়োমশাই শশব্যস্ত হয়ে ভিঞ্চি মজারাজকে এগিয়ে দিয়েছেন। আশে পাশে যারা ছিল তারা সব উপুড় হয়ে বাবাজীর পায়ে। হুড়োহুড়ি আর কী আদিখ্যেতা! দেখতে দেখতে কত সব লোক জড় হয়ে গেল। আদ্দেককে চিনতেই পারছিলুম না। শাঁখ বাজছে, উলু দিচ্ছে, হা ঠাকুর যো ঠাকুর অবস্থা। গালচের দুধারে বড়মা জ্যেঠিমারা সব দেখলুম ঘোমটা টেনে মাটিতে মাথা ঠেকিয়ে রয়েছেন। কান্ড দেখে যা হাসি পাচ্ছিল। গড় সেরে উঠবে যখন তখন সব্বার নাকে নিশ্চয়ই রোয়াকের শ্যাওলা লেগে থাকবে।
      ভিঞ্চিমহারাজ একটু করে এগোচ্ছেন আর কমন্ডুলু থেকে শান্তিজল বিতরণ করছেন। দূর থেকে মনে হল বিড়বিড় করে কিছু বলছেনও বোধহয়। হইচইয়ের আওয়াজে কিছু শুনতে পাচ্ছিলুম না। আগে আগে বড় জ্যাঠামশায়। খাতিরদারী করে মহারাজকে বৈঠকখানার দিকে নিয়ে চলেছেন। মহারাজের পিছনেই খুড়োমশায়, হাতে ছড়িটি নিয়ে টুকটুক করে হাঁটছেন। ছড়িখানা মনে হলো রুপো বাঁধানো।
যাহোক, জ্যাঠামশায়, মহারাজ আর খুড়োমশায়কে নিয়ে তো বৈঠকখানায় ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিলেন। সাথে সাথে বাকিরা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। একতলা দোতলার দরজা জানালা থেকে যারা সব উঁকিঝুঁকি মারছিল তারাও সব যে যার কাজে লেগে পড়লো। জ্যেঠিমারা ধুলোটুকু মাথায় মুছে টপ করে সোজা রান্নাঘরে। চোদ্দ রকম রান্না হবে। ইতুপিসী কি আর একা সামাল দিতে পারবে সব!
—‘কি রকম বুঝলি!’  
দেখলুম ছোটোমামা আমার দিকে ঝুঁকে পড়ে চেয়ে আছে। আমি আর কী বুঝব! ওই ভীড়ের মাঝে কালকের ফিরিওয়ালাটা কেমন করে এল তাই তো এতক্ষণ বুঝে উঠতে পারছিলাম না।
চুপ করে আছি দেখে পুঁটে আর ছোটোমামার সেকী উশখুশুনি! দুজনে মিলে আমার দিকে আড়চোখে চেয়ে নীচু গলায় কি সব ফন্দি আঁটতে লাগল। আমিও কিচ্ছু না ভেবে পেয়ে ঘরে ঢুকে তক্তপোষের ওপর হাত পা এলিয়ে শুয়ে পড়লুম।
     অন্যদিন এসময় রতনদা আমাদের নাইবার জন্য হুড়ো দেয়। আজ নিশ্চয়ই সে খুব ব্যস্ত। আমাদের দিকে তাকানোর সময় কোথা। কতরকম কাজ বাকী তার। মা থাকলে এতক্ষণে আমাদের নাওয়া হয়ে যেত। গরম কাপড়চোপড় পরিয়ে চুল আঁচড়িয়ে দেওয়া হতো। কাঁসার থালার উপর কলাপাতায় গরম ভাত পেতুম, গরম ঘি পেতুম, মৌরলা মাছের ঝোল পেতুম, নালতে শাকের ব্যজন পেতুম। শেষপাতে ছানার পাকের মিষ্টি পেতুম, তবেই না—
     এই এক মুশকিল! দিননেই রাত নেই চোখের কোনায় জল। গলা ভারী। মহা বিরক্ত হয়ে কাপড়ের খুঁটে চোখ মুছছি, এমন সময় রতনদা কাষ্ঠহাসি হেসে ঘরে ঢুকল।
—‘তাই বলি! দেকেচ আমারও যে কি ছাই ভুলো মন!’
অমনি খুশি হয়ে টুক করে ওর পিঠে চড়ে বসলাম। রতনদাও আমায় পিঠে নিয়ে দিব্যি সিঁড়িঘর দিয়ে নেমে ঘাটের পথ ধরল। পেছনে পুঁটে আর ছোটোমামা। দেখলুম মেঘলা আকাশ যেন একটুখানি ফরসাপানা হয়েছে। অবস্থা বুঝে পাখিরাও এতক্ষণে বোল ধরেচে। সকালের কতরকম শব্দ থাকে না! পাখিদের কিচিরমিচির, রাস্তায় লোকজনের খচমচ, জমা জল পাতায় পড়ার টুপটাপ। আঁতকে আঁতকে উঠতে হয়। পয়সাফুলের ঝোপের পাশে দেখলুম কাগের পালক পড়ে। তা দেখে রতনদা গুনগুনিয়ে সুর ধরল,
খুঁটি নড়ে, দেয়াল পড়ে, চাল ওড়ে গোওওও,
কেঁচোর খোঁজে ব্যাঙ ঢোকে আমার ঘরে গোওওওও।
রইল পড়ে ময়নামতী
গভীর পারা ভবনদী—

—‘ভবনদী কি রতনদা!’
—‘ভবনদী কি জানোনা খোকাবাবু! ভবনদী গো! মস্ত নদী। সোজা ঐ তোমার সগ্‌গে যায়।’
—‘রাস্তা চেনো তুমি, আমায় নিয়ে যেতে পারবে!’
—‘তা কি আর চিনিনে খোকাবাবু! তবে ওখানে ছোটদের যেতে দেয় না।’
পুঁটে পেছন পেছন দাঁতন চিবুতে চিবুতে আসছিল। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, ‘সব মিছে কথা। আমায় মা বলেছে, কাম্‌লিরা বড় মিছে কথা বলে।’
রতনদা হোহো করে হেসে উঠল। তারপর ফের গান ধরল,
           বাহ গো ডোম্বী, বাহিয়া চল ইছামতীর তঅঅঅরে
           সোজা পথে, চিত্তির যেন থরহি নাই করে
           খুঁটি নড়ে, দেয়াল পড়ে, চাল ওড়ে গোওওও,

Monday, 20 June 2011

"ঘুরে এলাম ভুটান (The Land of Peaceful Dragon)"

( বা থেকে ) লাকি,জুয়েল,জয়া,লিমন,ববি,আফসারা,সঞ্চরা,সুমি
কিছুদিন আগে ভুটান ঘুরে এলাম। আমরা টিমে প্রায় ১৫ জন ছিলাম। ভুটানে একটি সাংস্কৃতিক প্রোগ্রাম করা ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। আমাদের রুট ছিল "বুড়িমারি - জয়গা - ফুন্টসিলং - থিম্পু - পুনাখা - পারো - জয়গা - বুড়িমারি - ঢাকা"। ওদের সংস্কৃতি দেখে এলাম, আমাদের সংস্কৃতি দেখিয়ে এলাম। ওরা অনেক বেশী বন্ধুবৎসল। যদিও আমাদের ট্যুর ব্যাক্তিগত ছিল, তারপরও ভুটান মিনিস্ট্রি যথেষ্ট সহযোগিতা করেছেন। আপ্যায়নে ও কমতি ছিল না। আমাদের হোটেল থেকে শুরু করে সকল দিকেই ছিল তাদের সুনজর। মিনিস্ট্রি থেকে টুরিস্ট বাস দিয়েও সহযোগিতা করেছেন। বাংলাদেশ থেকে আমাদের টিমের ভিসা পেতে তেমন কোন সমস্যা হয়নি। দু-একজনকে ভারতীয় এম্বাসি একটু জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল তবে ডবল ট্রানজিট ভিসা হয়ে গেছিল সবার। আমি, ববি ( আমার স্ত্রী ), আফসারা (আমার মেয়ে), সুমি আপা, সুমন ভাই (সুমি আপার হাসবেন্ড ), সঞ্চরা ( সুমি আপার মেয়ে ), লিমন ভাই, জুয়েল ভাই, লাকি, জয়া, বাবু ভাই ( গানের শিল্পী ), অভিনেতা সানবিম, লুৎফর স্যার ( আমাদের এই ট্যুর এর আহবায়ক এবং নিয়ন্ত্রক ) এবং ওনার পুরো পরিবার মিলে আমরা গিয়েছিলাম বাই রোডে।

রাত ১০ টার মধ্যে শ্যামলীর বি.আর.টি.সি কাউন্টার গিয়ে উপস্থিত হলাম। ১০ই সেপ্টেম্বর রাত পৌনে ১২টায় যখন গাড়ি ছাড়ল, তখন অন্যরকম একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিলো। সেদিন ছিল চাঁদ রাত, মোবাইল এর এফ.এম. এ বেজে উঠছিল "রমজানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ।"

বুড়িমারি বি.ডি.আর. ক্যাম্পে আমি ও আমার পরিবার
বুড়িমারিতে পৌঁছলাম পরদিন অর্থাৎ ১১ সেপ্টেম্বর ভোরে, সেদিন ছিল ঈদুল ফিতর এর দিন। সেইদিন ই প্রথম ঈদ এর নামাজ পরতে পারলাম না। বাংলাদেশ বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করার সময় একটা আশ্চর্য অনুভূতি কাজ করছিলো, একই রকম মাটি, ঘাস, বাতাস, কিন্তু পার্থক্য ছিল একটি সীমানা। নো-ম্যান্স ল্যান্ড এ গিয়ে অবাক হচ্ছিলাম, এখন আমি কারো না। না ভারতের না বাংলাদেশ এর। এটাই দেশের বাইরে প্রথম যাওয়া তাই হয়তো একটু বেশিই অবাক হচ্ছিলাম।
সীমান্ত থেকে জলপাই গুড়ি হয়ে চলে এলাম জয়গা চেক পোস্ট এ। এখান থেকে ক্লিয়ারএন্স নিয়ে সোজা চলে এলাম ভারত ভুটান সীমান্তে। আসতে আসতে রাত হয়ে গেলো, তাই ফুন্তসলিং এ হোটেল পেলজরলিং এ খাওয়া দাওয়া করে রওনা হলাম থিম্পুর দিকে। একটা কথা বলে রাখা ভালো যে, ভুটানে ঢুঁকে বাংলা বা ভারতীয় খাবার আশা করা বোকামি। তাই ওখানে যা পাওয়া যায় তাই দিয়ে খাবার সেরে নিতে হয়েছে। এগুলো এক কথায় অখাদ্য। ভারতীয় যে খাবার গুলো ওরা রান্না করে তা ভালো কিন্তু ...........................

Bolero গাড়ি
যাই হোক, একটা বোলেরও গাড়ি ভাড়া করে রাতেই রওনা দিলাম। আমাদের ড্রাইভার এর নাম ছিল আমিন। চমৎকার একটি ছেলে। ওর কাছে পথে যেতে যেতে ভুটান এর কিছু বর্ণনা শুনলাম। পথে বেশ কয়েক স্থানে চেক পোস্ট ছিল, আমরা সেইখানে গাড়ি থামিয়ে পাসপোর্ট চেক করিয়ে নিলাম। রাতে পাহাড় বেয়ে গাড়ি উঠছিল, সে এক রোমাঞ্চকর অনুভূতি। সারাদিনের জার্নিতে সবাই ক্লান্ত কিন্তু ঘুম আসছিল না কারো, তার বদলে সবাই ঝিমুচ্ছিলাম।

গেদু, পাহাড়ের কোলে বার
এমন সময় ড্রাইভার আমিন কে জিজ্ঞেস করলাম, আশেপাশে ভালো কোন চা খাওয়ার মতো জায়গা আছে কি না? জিজ্ঞেস করে আবার নিজেই চিন্তা করলাম এই পাহাড়ে চায়ের দোকান আসবে কোত্থকে, কিন্তু আমিন বলল, চিন্তা করবেন না একটু সামনেই গেদু নামক একটা জায়গা আছে যেখানে চা পাওয়া যায়। গেদু পৌঁছালাম প্রায় রাত ১২টায়। এখানে পেলাম পাহাড়ের কোল ঘেঁষে ছোট্ট একটা এলাকা। ভুটানে প্রায় প্রতিটি দোকানই বার, যেখানে বিয়ার থেকে শুরু করে কিছু লোকাল এবং কিছু বিদেশি ব্র্যান্ডের মদ পাওয়া যায়। আসলে পাহাড়ের উপরে বলে ওখানে ঠাণ্ডা বেশী পরে তাই ওরা খুব স্বাভাবিক ভাবেই বিয়ার এবং অন্যান্য আল্কহলিক পানীয় গ্রহন করে। হয়ত এ জন্যই আমাদের গাড়ির সামনে লেখা ছিলো "Life is risky after whiskey"। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় এই যে ভুটানে অ্যালকোহল খুবই সহজলভ্য কিন্তু কোথাও সিগারেট পাওয়া যায় না। 

যাই হোক চা পাওয়া গেল, কিন্তু মুখের কাছে এনে দেখি শুঁটকির গন্ধ। আমার খাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। দেখলাম অন্য সবাই খেয়ে ভালই বলছে। আমিও তখন একটু চেখে দেখলাম, আমার কিছুটা পেট ব্যাথা করছিলো, চায়ে চুমুক দেয়ার ১০ সেকেন্ড এর মধ্যে ভালো হয়ে গেল। পরে জেনেছিলাম ওটা ছিল হারবাল সবুজ চা।
থিম্পুতে হোটেল টেনডিন

থিম্পু পৌঁছালাম রাত ২টায়। হোটেল টেনডিন এ বুকিং দেয়া ছিল আগেই, তবে হোটেলে গিয়ে কোন খাবার পেলাম না। কি আর করা না খেয়েই রুম এ ঢুকলাম। কাপড় ছেড়ে ফ্রেশ হয়ে শুয়ে পরলাম। এমনিতেই দুই দিনের জার্নিতে ক্লান্ত, ঘুম আসতে সময় লাগলো না। খুব সকালে ঘুম থেকে উঠে গোছল করে জামাকাপড় পরে চলে এলাম হোটেল এর ডাইনিং এ।
হোটেল রুমে আমি ও আমার স্ত্রী ববি
হোটেল টেনডিন এর ডাইনিং
আমি ও ববি